‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন —
উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,
‘ ভয় নাই, ওরে ভয় নাই —
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
ক্ষয় নেই যে সত্তার সেটাই ‘অক্ষয়’। যার কোনো বিনাশ নেই। ‘অক্ষয় তৃতীয়া’-র দিন আমরা ‘অবিনাশী’ হতে চাই, আমাদের যাবতীয় সম্পদকে অনন্ত অক্ষয় করে তুলতে চাই। কিন্তু ‘চাই’ বললেই তো হয় না! অক্ষত রাখার ‘আবহ’ তৈরি করতে হয়। যাতে আমার পারিবারিক সম্পত্তি হস্তচ্যুত না হয়, যাতে আমার আবাস-গৃহে অগ্নি সংযোগ না হয়, পরিবারের মানবিক সম্পদ লুণ্ঠিত না হয়। ‘অক্ষয়তৃতীয়া’ উদযাপন মানে সেই আবহ তৈরি করাও বোঝায়। নইলে এই যে পূর্ববঙ্গে সম্ভ্রান্ত হিন্দুর এত সম্পদ ছিল, এত সুখ ছিল, এত শান্তি ছিল! এক নিমেষে তা কোথায় হারিয়ে গেলো? পূর্ব পাকিস্তান আর বাংলাদেশ হয়ে যাবার পর তা কী অক্ষয়-অটুট আছে? তাদের অধিকারে আছে?
আমাদের পূর্ব প্রজন্মও তো অক্ষয়তৃতীয়ায় শান্তি-স্বত্যয়ন, মন্ত্রপাঠ করেই চান্দ্র বৈশাখের শুক্লা তৃতীয়ায় অক্ষয় হতে চেয়েছিলেন! কিন্তু তা হতে পারেন নি। কারণ বাঙালি হিন্দু পূজাপার্বণের রূপক-সংকেত ধরতে পারেন নি।
অক্ষত থাকার জন্য শ্রীবিষ্ণুর অবতার জমদগ্নি-কুমার পরশুরাম, যার আবির্ভাব অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই, যিনি বারেবারে পৃথিবীব্যাপী অত্যাচারী ক্ষত্রিয় নিধন করেছেন, তাঁকেও মনে রাখতে হবে। অত্যাচারী শাসককে সরানোর কাজও হিন্দু অবতারের দায়িত্বশীল কৃত্য ছিল।
“করেতে কুঠার জমদগ্নির কুমার।
নিঃক্ষত্রা করিল ক্ষিতি তিন সপ্ত বার।।”
সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্য কদাচারী ক্ষত্রিয় শাসকদের একে একে সবংশে বিনাশ করছেন তিনি। তবে মানুষের সম্পদ অক্ষয় হয়েছে। তবে সমাজ সংশোধিত হয়েছে। তাই তাঁর কাছে নিরন্তর শক্তি প্রার্থনা করতে হবে এবং শক্তিমান হতে হবে। বাঙালি হিন্দু আজ শক্তিমান হতে ভুলেই গেছেন। সমানে-সমানে শক্তিতে-শক্তিতে টক্কর দিলেই বিপরীত শক্তি আপনাকে সমীহ করবে। বোঝাপড়া সমানে সমানেই হয়। সবলে-দুর্বলে হয় না। নইলে রোজই সীমান্ত পাড়ায় আপনার বাসতবাটিতে হাড়গোড় ছুঁড়ে আতঙ্কিত করে তুলবে বিরুদ্ধ-শক্তি। ভয় পেয়ে আপনি জলের দরে বাড়িটি বিক্রি করে শহরের আরও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসবেন। কখনও সে সুযোগ হবে, কখনও হবে না। বিনামূল্যে দখল করে নেবে আপনার ‘অক্ষয়’ সম্পদ। আপনি তাই এতদিন ‘তাদেরই অক্ষয় সম্পদ’ বানিয়ে চলেছেন। রোজ রোজ পালিয়ে অক্ষয় সম্পত্তি গড়ে তোলা যায় না। হিন্দু বাঙালি যদি শক্তি-সাধকদের ভুলে যান, সায়ুধবাহন দেবদেবীকে ভুলে যান, সম্প্রীতির ঠিকা নিয়ে দেবী দুর্গার হাতের অস্ত্রগুলি খুলে নেন, তবে তাঁর ধনসম্পদ অক্ষয় হতে পারে না। তখন তাঁর গৃহটি পরিত্যক্ত হবে অথবা দখলীকৃত হয়ে আপনার চিত্ত ব্যাকুলতার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
প্রাণ একটি অমূল্য সত্তা। তার জীয়নকাঠি যে-সে পাত্রে রাখা চলে না! ঘুমিয়ে কী প্রাণ দেওয়া চলে? যারা সচেতন নন, তারা ঘুমন্ত প্রাণ। ঘুমন্ত যারা, ভীম-আনন্দে রুদ্র-সংগীত কেমন করে গাইবেন? অক্ষয় হতে গেলে নিঃশেষে প্রাণ দিতে হয়, বলেছেন রবীন্দ্রনাথ।
‘মরণনৃত্যে ছন্দ মিলায়ে’ হৃদয়ডমরু বাজাতে হয়। তিমিরান্তক শিবশঙ্করের অট্টহাসি হাসতে হয়। জীবনেশ্বরের কাছে জীবন সঁপে দেওয়ার বোধ গ্রহণ করতে হয়। প্রলয়ের জটা ছড়িয়ে দিতে হয়। নিজেদের মধ্যে মিলনযজ্ঞে নিরন্তর অগ্নি জ্বালিয়ে দিতে হয়। এদিন ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। সেই অক্ষয় তৃতীয়া যদি পালন করতে পারেন, তবেই তা সত্যি হল! গত ২০২০ সালে অক্ষয় তৃতীয়ায় দিনে দেশব্যাপী রব উঠেছিল, “ক্ষয় হোক করোনার, অক্ষয় হোক দেশ।” দেশ অক্ষয় কীভাবে হবে? শুধু চীনা-ভাইরাস দূর করলে হবে না, সেইসঙ্গে দেশের কোণে কোণে ধুলোর মতো জমে থাকা দেশবিরোধী বিদেশী শক্তিকে পরাস্ত করার সমবেত প্রচেষ্টা চাই। অক্ষয়তৃতীয়ায় ‘দেশের ক্ষয়রোগের জীবাণু’-গুলি দূর করার কৃত্য করতে হবে। হবেই।
কল্যাণ গৌতম।