আদ্যিকালের দুই নির্মাণশিল্পীর কথা আমরা জানতে পারি, দানবকুলের ময়দানব আর দেবকুলের বিশ্বকর্মা। বিশ্বকর্মা বৈদিক যুগে দেবতা। লোকমুখে তাঁর নাম হয়েছিল, বিশাই।বাংলা মঙ্গলকাব্য তো লৌকিক দেবতাদের জয়গাথা, লোকগাথার সংকলন। তাই সেখানে বিশ্বকর্মা বন্দিত হয়েছেন বারেবারে এবং সেখানে তাঁর নাম যথারীতি বিশাই।
বিশ্বকর্মা বৈদিক দেবতা। আদি বেদ, ঋক বেদে পাঁচ বার তাঁর নাম উল্লিখিত হয়েছে। তখন থেকেই তিনি সৃষ্টির দেবতা। কুশলী কারিগর। ব্রহ্মাণ্ডের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে ব্রহ্মাণ্ডের নির্মাণ– সবটাই তাঁর নিপুণ হাতের কারসাজি। যদিও বেদের যুগে তিনি ছিলেন অগ্নি, ইন্দ্র ও ব্রহ্মারই ছায়াস্বরূপ, তাঁর নিজস্ব সত্তা নির্মিত হয়নি। তাই তখনও তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত লেখা হয়নি। সেটা লেখা হল, পুরাণের যুগে এসে। সেখানে লেখা হল, তিনি বৃহস্পতির বোন বারাস্ত্রী ও অষ্টবসুর এক বসু প্রভাসের পুত্র। ব্যস, জগৎসংসারের মাঝে তৈরি হয়ে গেল তাঁর নিজস্ব একটি সংসার।
নির্মাতা হিসেবে কেমন ছিলেন বিশ্বকর্মা? ত্রিলোকের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ স্বর্গপুরীও নির্মাণ করেছেন বিশ্বকর্মা। বিষ্ণুর চক্র, শিবের ত্রিশূল— প্রভৃতি তাঁরই উদ্ভাবন। ফলে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শুরু থেকেই হয়ে উঠেছিল তাঁর নিজস্ব দপ্তর। স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে তাঁর ডাক পড়েছে বারে বারে যেকোন শৌখিন নির্মাণের কাজে ও পরিকল্পনায়। উড়িষ্যার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন জগন্নাথ মূর্তি নির্মাণের জন্য যখন কোন শিল্পী পাচ্ছিলেন না, তখন স্বয়ং বিষ্ণু এই দেবশিল্পীকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর কাছে। তিনিই নির্মাণ করেছিলেন অপূর্ব সুন্দর জগন্নাথের ভুবন ভোলানো মূর্তি। তাঁর আগে ও পরে এমন মূর্তিপরিকল্পনা আর কেউ করতে পারেননি। মনসামঙ্গলের যুগে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন লখিন্দর-বেহুলার লোহার বাসর গড়তে।
যেটা রীতিমতো লক্ষ করার মতো ব্যাপার তা হল, আর সমস্ত দেবদেবীদের মতো বিশ্বকর্মাকে মর্ত্যে পুজো প্রচার করতে ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হয়নি। কলাকুশলতা ও সৌন্দর্যবোধের জন্যই তিনি কারিগর আর শ্রমজীবী মানুষের কাছে সেই আদি যুগ থেকেই গুরুর আসন পেয়েছেন, তাদের পুজো পেয়েছেন, এখনো পেয়ে চলেছেন।
পার্থসারথি পাণ্ডা