দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে যে দুটি জ্যোতির্লিঙ্গ দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত তার মধ্যে একটি হল রামেশ্বর। মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রী রাম এই জ্যোতির্লিঙ্গ স্থাপন করেন। রামেশ্বর শব্দের অর্থ হল শ্রীরামের ঈশ্বর। দেবাদিদেব মহাদেব হলেন শ্রীরামের ঈশ্বর। আবার রামেশ্বর শব্দের অর্থ ‘শ্রী রাম যার ঈশ্বর’ – এটাও বোঝায়। এই অর্থেও রামেশ্বর দেবাদিদেব মহাদেব কেই বোঝায়। কারণ দেবাদিদেব মহাদেব এবং ভগবান শ্রীরাম – এই দুজনের মধ্যে এক অদ্ভুত পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক বর্তমান। তুলসী দাসের
শ্রীরামচরিতমানস গ্রন্থে আমরা দেখি দেবী পার্বতীকে রামকথা শোনাচ্ছেন স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব। যাইহোক রামেশ্বর অতি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। রামেশ্বর এ জ্যোতির্লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত সম্বন্ধে দুটি কাহিনী শোনা যায়। দুটি কাহিনীর সঙ্গেই জড়িয়ে
রয়েছে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রাম এর নাম।
প্রথম কাহিনী এইরূপ :
রাক্ষসরাজ রাবণ লঙ্কাতে হরণ করে নিয়ে গিয়েছেন সীতাদেবীকে। বানর সেনা নিয়ে শ্রী রামচন্দ্র এবং লক্ষণ গেলেন ভারতের শেষ ভূখণ্ড মন্ডপমে। সামনে উত্তাল সমুদ্র। সীতাদেবীকে উদ্ধার করতে গেলে পার হতে হবে এই সমুদ্র। কিন্তু কিভাবে?
শ্রী রামচন্দ্রের নির্দেশে বানর সেনারা সারাদিন ধরে যা হাতের কাছে পায় তাই দিয়ে সেতু বাঁধার চেষ্টা করে। কিন্তু রোজ রাতে রাবণ এসে সেই সেতু ভেঙে দেয় শ্রীরামের সেতু আর এগোতে পারে না।
এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর শ্রীরাম এর অন্যতম সেনাপতি জাম্ববান বললেন রাবণ পরম শিবভক্ত। তাই যতটা সেতু বাধা হবে তার শেষ প্রান্তে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত করে পূজা করে এলে রাবণ আর সেতু ভাঙতে পারবেন না ,কারণ সেতু ভাঙলে শিবলিঙ্গের ক্ষতি হবে।
যথারীতি জাম্ববানের কথামত কাজ হল । সারাদিন সেতু বাধার পর শ্রী রামচন্দ্র শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করলেন আর পুজো করে ফিরে এলেন। রাত্রে রাবণ এসে সেতু ভাঙার পরিবর্তে শিবলিঙ্গকে প্রণাম করে ফিরে গেলেন ।
শ্রীরামচন্দ্র যে জায়গাটিতে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই জায়গাটির বর্তমান নামই রামেশ্বরম। কথিত আছে
শ্রীরামচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ জ্যোতির্লিঙ্গ হিসেবে পূজিত হচ্ছেন আজও।
দ্বিতীয় কাহিনীটি এইরূপ:
রাম রাবণের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে দুর্গা মাতার বলে বলিয়ান হয়ে শ্রী রামচন্দ্র বধ করলেন রাবণকে। উদ্ধার করলেন সীতাকে ।কিন্তু রাবনকে হত্যা করে শ্রীরামচন্দ্র ব্রহ্মহত্যা পাপে পতিত হলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য রাবণের পিতা বিশ্রবা মুনি ছিলেন ব্রাহ্মণ, আর মাতা কৈকেসি ছিলেন রাক্ষস। তাই রাবণ ছিলেন ব্রহ্মরাক্ষস।
এমত অবস্থায় শ্রীরামচন্দ্র শরণাপন্ন হলেন মুনি এবং ঋষিগণের। তাঁরা সবাই এক বাক্যে ব্রহ্মহত্যা জনিত পাপ দূর করার জন্য শিবলিঙ্গ স্থাপন করে পূজার পরামর্শ দিলেন।
ভগবান শ্রীরাম তখন হনুমানকে কৈলাস পর্বত থেকে শিবলিঙ্গ নিয়ে আসার জন্য আদেশ দিলেন । হনুমান কৈলাস পর্বতে গেলেন কিন্তু শিবের দেখা তিনি পেলেন না। এদিকে জ্যোতির্লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা দিনক্ষণ অতিক্রান্ত হওয়ার উপক্রম। সীতাদেবী তখন সমুদ্রের বালি দিয়ে করলেন এক শিবলিঙ্গ। সেই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা হল ।পূজা করলেন শ্রীরামচন্দ্র । সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গমূর্তির মূল প্রোথিত হলো ধরিত্রীর কেন্দ্রবিন্দুতে।
শ্রী রামচন্দ্র লিঙ্গ মূর্তি প্রতিষ্ঠার কিছু পরেই জ্যোতির্লিঙ্গ নিয়ে আবির্ভূত হলেন হনুমান। তিনি যখন দেখলেন শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তখন তিনি খুবই দুঃখ পেলেন এবং লেজ দিয়ে বেঁধে শিবলিঙ্গ কে উৎপাটিত করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি পারলেন না। রাগে অন্ধ পবন নন্দন তখন গদা দিয়ে লিঙ্গ মূর্তি ভেঙে ফেলতে উদ্যত হলেন । তখন শ্রীরামচন্দ্র শান্ত করলেন হনুমানকে এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ মূর্তির পাশে প্রতিষ্ঠা করলেন হনুমান আনীত লিঙ্গ মূর্তিকে। পূজা করলেন সেই লিঙ্গ মূর্তি, এবং সেই মূর্তির নাম হল বিশ্বলিঙ্গ। শ্রী রামচন্দ্র হনুমানকে বললেন:
“এখানে এসে প্রথমে বিশ্ব লিঙ্গ মূর্তি পূজা করতে হবে তারপরে হবে রামেশ্বরের পূজা। আগে রামেশ্বরের পূজা করলে সে পূজায় কোন ফল হবে না।
রামেশ্বরম একটি ছোট্ট দ্বীপ ।এই দ্বীপে যেতে গেলে নামতে হয় মন্ডপম নামক স্টেশনে। এখানে যেতে গেলে এখনো পেরোতে হয় একটি ব্রিজ যেটি সমুদ্রের মাঝে অবস্থিত। এই ব্রিজের উপর দিয়েই আড়াই কিলোমিটার চলে ট্রেন। এই ব্রিজটা তৈরি করেছিলেন এক বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার যাঁর নাম বি. সি. গাঙ্গুলী। পরে তিনি রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।ট্রেন যখন ব্রিজের উপর দিয়ে যায় তখন তার গতি থাকে অতি মন্থর। নীচে উত্তাল সমুদ্র আর সমুদ্রের ঢেউ গুলো আঘাত করে ব্রিজের পিলার গুলোতে। আড়াই কিলোমিটার ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেন এসে থামে রামেশ্বরমে।
শোনা যায় এই মণ্ডপমে রাবণ সীতাকে হরণ করে প্রথমে এনেছিলেন। তারপর এইখান থেকে গিয়েছিলেন নিজের রাজ্য লঙ্কাতে । শ্রীরামচন্দ্র এখানে এসেই সেতুবন্ধন করেছিলেন। এই স্থানে এখনো শ্রীরামচন্দ্রের পায়ের ছাপ রাখা আছে।
রামেশ্বরম দ্বীপটির আকৃতি অদ্ভুত। অনেকটা শঙ্খের মত দেখতে এই দ্বীপ। মধ্যিখানে পেটটা মোটা আর দুদিকে সরু। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে ছিল ধনুষ্কোডি বন্দর। ঝড়ে সেই বন্দর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পর তৈরি হয়েছে রামেশ্বরম জেটি।রামেশ্বরম থেকে জাহাজ যায় শ্রীলঙ্কায়। এখানে বর্তমান আছে শ্রী রামচন্দ্রের তৈরী সেতুর একটু অংশ ।হয়তো রামেশ্বর আছেন বলেই এখনো রয়ে গেছে এই অংশটি। ধনুষ্কোডি থেকে পরিষ্কার দেখা যায় শ্রী রামচন্দ্রের সেতুবন্ধন এর ধ্বংসাবশেষ।
রামেশ্বরম দ্বীপের পূর্ব প্রান্তে জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির অবস্থিত। এই মন্দির ৮৬৫ ফুট লম্বা আর ৬৫৭ ফুট চওড়া। পূর্ব দিকে একটি গম্বুজ রয়েছে। সেটি ১২৬ ফুট উঁচু ।মন্দিরের প্রাঙ্গণে আরো কয়েকটি ছোট মন্দির আছে। দক্ষিণ দিকে রয়েছে দেবী পার্বতীর মন্দির। প্রতি শুক্রবার দেবী মূর্তি নবরত্নে সাজিয়ে, সোনার পালঙ্কে বসিয়ে শোভাযাত্রা বের হয় মন্দিরের সামনে।এখানে রয়েছে চুন- বালিতে তৈরি ১২ ফুট লম্বা নন্দী মূর্তি। তার পাশ দিয়ে এসে গর্ভ মন্দিরে যেতে হয়, যেখানে রয়েছে রামেশ্বরম লিঙ্গ মূর্তি। মন্দির এলাকায় বাইশটি কুন্ড রয়েছে। এই কুণ্ড গুলির মধ্যে একটি হলো রুদ্র কুন্ড। এই রুদ্র কুন্ডতে স্নান করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ এবং মুক্ত হয়েছিলেন মাতুল কংস হত্যার পাপ থেকে। এই মন্দির চত্বরে রয়েছে বিষ্ণুমন্দির যেখানে শ্বেতপাথরের মাধব রূপী বিষ্ণু প্রতিষ্ঠিত। এখানে এসেছিলেন আদি গুরু শ্রী শংকরাচার্যও। পায়ে হেঁটে গঙ্গা থেকে জল নিয়ে এসে সেই জল তিনি রামেশ্বরের মাথায় ঢেলে ছিলেন। এছাড়াও ভগবান শ্রী চৈতন্যদেব এবং জগৎ জননী মা সারদা এসেছিলেন এই রামেশ্বরমে এবং পূজা করেছিলেন রামেশ্বরের।
মন্দিরটি দ্রাবিড় স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। সিংহলের রাজা পরাক্রমবাহু দ্বাদশ শতাব্দীতে গর্ভগৃহ সহ মূল মন্দিরটি তৈরি করান । রামনাদের রাজারা মন্দিরের পুরনো অংশগুলি সংস্কার করান এবং সেইসঙ্গে তৈরি করেন আরও কয়েকটি মন্দির। তবে এ মন্দিরটি তৈরি নিয়ে নানারকম মত রয়েছে। শোনা যায় শ্রীরাম চন্দ্র লঙ্কা জয়ের পর সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়েছিলেন তাঁর এক বীর ভক্তের উপর । তখন থেকেই এই বংশ সেতুপতি নামে পরিচিত । প্রাচীন নথি থেকে জানা যায় সেই ভক্ত সেতুপতি প্রথম রামেশ্বরম মন্দির তৈরি করেছিলেন। বর্তমান মন্দির শুরু হয় ১৪০০ সালে এবং শেষ হতে সময় লাগে সাড়ে তিনশ বছরের বেশি।
মন্দিরের কাছেই অবস্থিত নাটমন্দির ।আর সেই নাটমন্দিরের সামনে একটি সোনার তালগাছ রয়েছে । তার পরেই রয়েছে একটি সোনার বেষ্টনী দেওয়া বেদী। সেখানে বেদ পাঠ করা হয়। নাটমন্দির এর পর বারান্দা পেরিয়ে মন্দির । সেখানে সোনার বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত জ্যোতির্লিঙ্গ যা সোনার তৈরি পঞ্চমুখ দিয়ে ঢাকা । তার মাথার উপরে পঞ্চফণা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছেন কালনাগ। রামেশ্বরের দক্ষিণ দিকে রয়েছে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, সীতা দেবীর মূর্তি আর রামেশ্বর মন্দিরের পাশেই রামেশ্বরী দেবীর মন্দির। সপ্তাহে একদিন রামেশ্বরী দেবীকে শোভাযাত্রা ও বেদপাঠ সহকারে নিয়ে যাওয়া হয় রামেশ্বরের কাছে।
রামেশ্বর মন্দির এর মধ্যে মোট ২২ টি তীর্থ আছে। এগুলি হল- মহালক্ষী, সাবিত্রী, গায়ত্রী, সরস্বতী, মাধব, গন্ধমাদন, গবাক্ষ ,গয়, নল, নীল ,শঙ্খ, শংকর, ব্রহ্মহত্যা বিমোচন তীর্থ, সূর্য, গঙ্গা, চন্দ্র, যমুনা ,গয়া, শিব, সত্যামৃত, সর্ব, কোটি তীর্থ। স্কন্দ পুরাণে এই তীর্থের মহিমা বর্ণিত রয়েছে। এই তীর্থ ভ্রমণ করলে ভক্তের অমোঘ ফল লাভ হয়।