কোনারকের সুবিশাল কারুকার্য করা সূর্য মন্দির। যদিও এখন আমরা যেটা দেখি সেটা প্রাচীন মন্দিরের একটি অংশ মাত্র। কোনারক পৃথিবী সূর্য মন্দির এবং সূর্য উপাসনালয় হিসাবে বিশেষভাবে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে । উড়িষ্যাতে সূর্য মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল বহু বহু যুগ আগে । তার সব থেকে বড় নিদর্শন হল অনন্ত গুহা ।খ্রিস্টপূর্ব দুই শতকের এই গুহাটিতে খনন করে সপ্ত অশ্ব বিশিষ্ট রথে উপবিষ্ট সূর্য মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।
উড়িষ্যার বিভিন্ন উপাখ্যানে শ্রীকৃষ্ণপুত্র সাম্ব এর উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তিনি অর্কক্ষেত্র চন্দ্রভাগা নদীর তীরে কোনারকে সূর্য পূজা করেছিলেন । মুষল পর্বের কারণ ছিলেন এই সাম্ব। তার উদ্ধত আচরণের জন্য দুর্বাসা ঋষির অভিশাপে সাম্ব মুষলের জন্ম দেয় । তার শরীর থেকে উদ্ভুত সেই মুষলই যদু বংশ ধ্বংসের কারণ হয়। শুধুই তা নয় এই প্রচন্ড আচরণের জন্য পিতার নিকট সে অভিশপ্ত হয়ে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হয়। যে রোগের উপাশমের উপায় ছিল সূর্য পূজা।
“কুষ্ঠন্তং কুরু মে দেব তুষ্টহসি মে প্রোভ “
সূর্য উদিত হন উত্তরায়নের সময় পূর্বউত্তর কোণে এবং দক্ষিণায়নের সময়ে পূর্ব দক্ষিণ কোণে । সেই কারনে সূর্যকে #কোণাদিত্য নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। সাম্ব কোনারকে সূর্যমূর্তি স্থাপন করেন এবং সেই সময় থেকেই সমগ্র কোনারক সূর্য বন্দনায় মুখরিত হয়ে ওঠে। ১২ বছর ধরে সূর্য উপাসনা করে সাম্ব গলিত কুষ্ঠ থেকে মুক্তি পায়।
“ভূয় এব মহাভাগ নিরোগস্ত্্ ভবিষ্যসি”
যে দিনটিতে তিনি এই রোগ থেকে মুক্তি পান সেই দিনটিকে সাম্ব দশমী বলা হয়। পৌষ মাসের শুক্ল পক্ষের দশম দিন সমগ্র উড়িষ্যা জুড়ে এই দিনটি পালন ও সূর্য উপাসনা করা হয়।
কোনারক সূর্য মন্দির নির্মাণ করতে দশ হাজার লোকের বারো বছর লেগেছিলো। ‘কোণার্ক’ শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে পাওয়া যায়, কোণ + অর্ক। কোণ হচ্ছে কোণা আরকি! মানে angel। আর অর্ক শব্দের অর্থ সূর্য। এই মন্দিরটি সূর্যের বিভিন্ন অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে।
পরবর্তী সময়ে এই সূর্য মন্দির সম্পূর্ণভাবে নির্মাণ করা হয় মহারাজ প্রথম নরসিংহদেবের সময় কালে। পুরীর অরূপ কারুকার্যময় এই সূর্য মন্দিরটি নিয়ে সমগ্র উড়িষ্যা জুড়ে নানা সুন্দর সুন্দর উপ্যাখ্যান ছড়িয়ে আছে । তিনশ বছর অরণ্যের অন্তরালে থাকা সূর্যদেব যখন পুনরায় উদীয়মান হলেন তখন সেসব কথা লোক মুখে উড়িষ্যা ছাড়িয়ে অঙ্গ, বঙ্গ হয়ে ভারতের নানা স্থানে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সম্রাট নরসিংহদেবের সময় কালের প্রধান স্থপতির নাম ছিল শিবেই সান্তারা। লোকে বলত, শিবেইয়ের হাতে নাকি স্বয়ং বিশ্বকর্মা বাস করতেন। কোনরকের সুবিশাল মন্দিরের স্থাপত্য ,ভাস্কর্য , কারুকার্য তাঁরই পরিকল্পনানুযায়ী হয়েছিল বলে জানা যায়। যেখানে কৃষ্ণপুত্র সাম্ব নিজের অভিশপ্ত রোগ দূর করার জন্য ভগবান সূর্যনারায়ণের উপাসনা করেছিলেন ও দেবমূর্তি নির্মাণ করেছিলেন, সেই চন্দ্রভাগা নদী এবং সমুদ্রের সঙ্গম স্থলে মন্দির নির্মাণ হবে বলে স্থির হল। সেখানের জল খুব গভীর। সূর্য মূর্তি সেই গভীর জলে কোন এক অলৌকিক শক্তির বলে অবিচল রয়েছেন। কিন্তু চন্দ্রভাগা নদীকে বাঁধলে তবে সেখানে মন্দিরের ভিং নির্মাণ সম্ভব হবে। উত্তাল সমুদ্র ও চন্দ্রভাগার মিলন স্থলকে এক ঈশ্বর ছাড়া কেই বা বাঁধবে?
শিবেই শ্রেষ্ঠ এক স্থপতি , সারা কলিঙ্গ, ওড্র , উৎকলভূমি ছাড়িয়ে সসাগড়া ভারতব্যাপী তাঁর নাম বিখ্যাত সব শিল্পীদের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। জনগণ বলে তাঁকে শিল্পীরূপী জটা মহাদেব, বিশ্বকর্মা , ময়দানব স্বয়ং আশীর্বাদ করে গেছেন। স্বয়ং সরস্বতী যেন তাঁকে বরপুত্র করেছেন। শিবেই ভাবল – “এমন কঠিন কাজ একমাত্র আমিই পারব। আমিই পারব উত্তাল সঙ্গমকে বেঁধে ঈশ্বরের যোগ্য করে তুলতে। ” শিবেই পঞ্জিকা দেখে শুভ দিনক্ষণ ঠিক করলেন। তারপর শুভ দিনে, শুভ তিথিক্ষণে শীলাপূজন সম্পন্ন করে, সহস্র সহস্র গোশকট, অশ্ব এবং হস্তী বোঝাই প্রস্তরখণ্ড এনে নদীর জলে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু শিবেই তো আর ভগবান শ্রীরাম নন। তাঁর সঙ্গে কোনো শ্রদ্ধাশীল ভক্তও নেই , নেই কোনো ঈশ্বরবিশ্বাসী কাঠবেড়ালী। কারণ , নাম খ্যাতির গর্বে শিবেই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। তাই , নিজের অহংকে বল করে চন্দ্রভাগার বুকে সারাদিন পাথর ফেলিয়ে গেলেন। শান্ত সাগর সঙ্গমের নির্জনতা শ্রমিক, লোকজন, সারথী, পশুদের শব্দে ভেঙে টুকরো হয়ে গেলো। প্রভাত গড়িয়ে অপরাহ্ন হয়ে সন্ধ্যা হল, পাথর পড়ল নদীর জলে, কিন্তু নদীর স্রোত যেমন ছিল তেমনই রইল। শিবেই কেবলমাত্র অবাকই হলেন না , তাঁর অধীনস্থ কর্মচারী, শ্রমিক, রাজপুরুষ সকলের কাছে তাঁর মাথা হেঁট হয়ে গেল। কি হল তাঁর শিল্প শিক্ষা ?
কিছু পন্ডিত ডাকা হল। তাঁরা আবার এককাঠি উপর দিয়ে যান। বলল, ” সমুদ্রের বড় বড় মাছ সেইসব পাথর খেয়ে ফেলেছে। ” রাজার কাছে সে খবর যেতে , এসব আজগুবি কথা শুনে রাজা বড়ই বিরক্ত হলেন। শিবেইকে দরবারে ডেকে বললেন , ” শোনো হে ভাস্কর ,আমার আজগুবি কথা শোনার সময় নেই। কিভাবে নদী বাঁধবে , কি করে মন্দির করবে সেসব তুমি আঁক কষে নির্ণয় নাও। সময় মতো মন্দির না হলে আমি জানব এতদিন ধরে ভস্মে ঘি ঢেলেছি। তোমার কুখ্যাতি রটতেও সময় লাগবে না। “
এসব শুনে শিবেই একেবারে হতাশ হয়ে পড়লেন। খ্যাতির মোহ তাঁকে এমন করে জড়িয়ে নিয়েছিল , যে নিজের হিসাব কোথাও ভুল হয়েছে, সেটি শুধরে নিলে নদীকে বাঁধা সম্ভব এটুকুও ভাবতে ভুলে গেলেন। কেবল ভয় হল বদনাম হবার। কিন্তু ঈশ্বরের কাজ করতে গেলে ক্রোধ , হিংসা, দ্বেষ, লোভ, মায়া , মোহ এসবকে ত্যাগ করতে হয়। শিল্প সাধনার মতো। ষড়রিপুর দোষ ত্যাগ না করলে জগন্নাথ দয়া করবেন কেন ? ভয়ে, চিন্তায় শিবেই নাওয়া খাওয়া ত্যাগ করে দিন কি রাত, সমুদ্রের ধারের , চন্দ্রভাগার কিনারে, গাঁ থেকে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
দিন যায়, রাজার চাপ বাড়তে থাকে। ভয়ে , দুশ্চিন্তায় শিবেই শীর্ণকায় হয়ে পড়লেন, দেহ কালি হল, চক্ষু কোটরাগত, তবু জগন্নাথ স্বামী কোনো পথ দেখালেন না। এমন করে চললে তাঁকে দেশত্যাগ করে আত্মগোপন করতে হবে লজ্জায়।
একদিন শিবেই ক্লান্ত , অবসন্ন হয়ে এক গাছতলায় বসলেন। বহুদিন খাদ্য নেই, স্নান নেই, মূর্ছা গেলেন তিনি। এসময় সেখান দিয়ে কলসী কাঁখে এক বৃদ্ধা যাচ্ছিলেন। তিনি শিবেইকে ওই অবস্থায় দেখে ,মুখে, হাতে পায়ে জল দিয়ে সুস্থ করে তুললেন।
ক্লান্ত শিবেই সেই অজানা অচেনা বৃদ্ধার গৃহে আশ্রয় নিলেন। বুড়ি তাঁকে স্নান করে আসতে বলে, নিজে অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে গেলেন। শিবেই স্নান করে এল। বুড়ি আসন পেতে , ঘটিতে জল গড়িয়ে একটা সুন্দর শ্বেত পাথরের বাটিতে পায়েস খেতে দিলেন। দুধের মধ্যে সুগন্ধী চাল সিদ্ধ, তাতে মিছরি, এলাচ দেওয়া। গন্ধে বুড়ির কুটির, জঙ্গল , চারিপাশের বাতাস ম ম করতে লাগল। আহা, এমন চরু তো প্রভুর মন্দিরের ভোগে প্রস্তুত হয়। শিবেই সন্তারার মনে পড়ল, তিনি অনেক দিন কিছু খান নি, গন্ধে তাঁর জঠরাগ্নি লেলিহান শিখার ন্যায় জ্বলতে লাগল। তপ্ত পায়েসান্নের বাটির মধ্যভাগ হতে সে কিছু পায়েস তুলে মুখে পুরে দিল। এদিকে , মুখ পুড়ে গেল, হাত পুড়ে গেল, জীবে ফোস্কা পড়ল। কষ্টে শিবেই আর্তনাদ করে উঠলেন।
বৃদ্ধা শিবেইয়ের কাজকর্ম দেখে ভারী বিরক্ত হলেন। ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ” তুমি কেমন লোক হে? মাথায় কি বুদ্ধি সুদ্ধি কিছু নেই ? বাটির মাঝ হতে খুবলে খাও শিবেই?”
শিবেই চমকে উঠল, বৃদ্ধা তাঁর নাম জানলে কি করে? শিবেই অবাক হয়ে বৃদ্ধার দিকে? বললেন , ” আমি কত বড় স্থপতি জানেন আপনি ? আমাকে আপনি নির্বোধ বলেন কোন সাহসে? “
বৃদ্ধা বললেন, ” তুমি নির্বোধ নও, তোমার বুদ্ধি অহংকারে নষ্ট হয়ে গেছে। সেই জন্যই বাটির মাঝ থেকে তুলে গরম চরু খাও আর সে জন্যই চন্দ্রভাগার বুকের মাঝে বড় বড় পাথর ফেল! জানো না পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছেন –
কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য আস্তে য মনসা স্মরন |
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে ||
যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জুন |
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে ||
সেই ব্যক্তি মূঢ় হয় , সে ব্যক্তি মূর্খ এবং মিথ্যাবাদী হয় যে ঈশ্বরের দেওয়া সব থেকে বৃহৎ বস্তু বুদ্ধি, দৈহিক শক্তিকে ব্যবহার না করে, কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়বিষয়ে স্মরণপূর্বক অবস্থান করে। সেই ব্যক্তিকে বিদ্যা স্বরূপ মহামায়া পরিত্যাগ করে যান। বৈদিক কর্ম চতুর্বিধ – নিত্য , নৈমিত্তিক, কাম্য এবং নিষিদ্ধ। যিনি বিবেকযুক্ত মনের দ্বারা চক্ষুকর্ণাদি পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় সংযত করে অনাসক্তভাবে কর্ম করে , তিনিই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হন।
তুমি তো , ইন্দ্রিয়জাত দোষ যত আছে তাদেরই পরিত্যাগ করতে পার নি। তুমি ঈশ্বরের নামে স্থাপত্য নির্মাণ করবে কি করে ? নিষ্কাম কর্ম করে নিজের আত্মাকে তৃপ্ত করতে হয়। নিষ্কাম কর্ম যেকোনো ব্যক্তির মুক্তির কারণ হয় –
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্য়ং কর্ম সমাচর |অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ ||
অধ্যাত্মচেতনা-সম্পন্ন হয়ে তোমার সমস্ত কর্ম ব্রহ্মকে সমর্পণ কর এবং , নিষ্কাম হয়ে তুমি কর্ম কর। অহংকার পরিত্যাগ করো। অহংকারে সব নাশ হয়।”
শিবেই বললেন , ” তুমি কে মা ? আর কি হবে উপায় সেই মন্দির নির্মাণের ?”
বৃদ্ধা বললেন , ” পায়েসের পাত্রের ধার দিয়ে ধীরে ধীরে খেতে শুরু করলে তোমার হাত মুখ পুড়তো না এবং তোমার ক্ষুন্নিবৃত্তির সাথে সাথে পায়েসের স্বাদও গ্রহণ করতে পারতে। শ্রীরাম ও তাঁর সেনা কি সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে পাথর ফেলেছিলেন , নাকি কিনারা দিয়ে শুরু করেন ? জীবনে চলার জন্য অবিদ্যা ও বিদ্যা স্বরূপ দুই মায়াকেই প্রয়োজন। কিন্তু অবিদ্যাকে অধিক আকঁড়ে ধরলে মুক্তির পথ পাবে কি করে? “
শিবেই চিৎকার করে বললেন , ” তুমি কে মা? তুমি কে? ” ক্লান্ত শিবেই জ্ঞান হারালেন।
যখন ঠান্ডা হাওয়ায় জ্ঞান ফিরল, তখন শিবেই দেখলেন কোথায় কি, কোথায় বৃদ্ধা, কোথায় কুঁড়ে ? একটি বৃহৎ বটের ছায়ায় শুয়ে আছেন। সূর্যদেব পশ্চিমে পাঠে যাচ্ছেন, পশ্চিমাকাশে কে যেন সিন্দুর গুলে ঢেলে দিয়েছে। পাখপাখালীর কলতানে বন্য পরিবেশ মুখরিত। সকলে বাসায় ফিরছে ,আপন আপন কর্ম সম্পাদন করে। শিবেই উঠে বসে দেখলেন , তাঁর সামনে একটি পাতার টুকরিতে খানিকটা পায়েস রাখা আর মাটির ভাঁড়ে জল। শিবেই তাড়াতাড়ি জল দিয়ে আচমন করে, কিছু পায়েস ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে, বাকি টুকু খেয়েই চন্দ্রভাগার সেই অর্কক্ষেত্রে ছুটে গেলেন। সেখানে যেন সূর্যদেব দাঁড়িয়ে হাসছেন। সন্ধ্যার শেষ রক্তিম আভাটুকু তাঁর মুখে এসে পড়েছে।
পর দিবস প্রাতে স্নান পূজা সেরে শুদ্ধ চিত্তে পাথর নিয়ে গেলেন চন্দ্রভাগার তীরে। তারপর সমস্ত অহং ত্যাগ করে নদীর ধার ধরে বাঁধতে লাগলেন চন্দ্রভাগাকে। দেখতে দেখতে বাঁধা পড়ল চন্দ্রভাগার স্রোত, বাঁধা পড়ল সঙ্গমের উত্তালতা। সৃষ্টি হলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কীর্তি, কোনরক সূর্যমন্দির।
© দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ভারতের উপকথা ( ওড়িয়া পর্ব)