১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা
ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী
অধ্যায় ৫: ইসলামই ছিল দোষী
আলিগড়ের উমেদারদের অভিযোগ, মধ্যযুগীয় মুসলিম ঐতিহাসিকরা মুসলিম আক্রমণকারী ও শাসকদের করা বর্বরতা অতিরঞ্জিত করেছেন। এরপর তারা তুর্কীদের সহজাত বর্বরতাকে দোষারোপ করেছেন, যে অপরিবর্তনীয় ন্যূনতম নৃশংসতার সন্ধান নথিভুক্ত ইতিহাস থেকেও পাওয়া যায় না। এবং ইসলামের নামে সংঘটিত প্রতিটি অপরাধ থেকেই ইসলামকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
আমার প্রথম প্রশ্নটি হল: ইসলামের নবী আরবে যা করেছিলেন এবং আরবী সেনা সিরিয়া, ইরাক, ইরান, উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি, স্পেন ও সিন্ধুতে যা করেছিল, তার সঙ্গে কীভাবে ভারতে তুর্কীদের কীর্তিকলাপের এত ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে?
আলিগড় বিদ্যালয়টি কখনই আমাদের একথা বলে ক্লান্ত হয় না, যে তুর্কীদের পরিবর্তে আরবীদের দ্বারা ভারতে ইসলাম এসে থাকলে ইসলামের নজির অনেক অনেক উজ্জ্বলতর হত। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এই মিথ্যা গলাধঃকরণ করেই নিজের বেস্ট সেলার বইয়ের মাধ্যমে অন্তত দুই প্রজন্মের হিন্দু ছাত্রদের এই মিথ্যায় নিমজ্জিত করেছেন।
এখানে আলিগড় ঐতিহাসিকরা গড়পড়তা হিন্দু সমাজের আরব সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতার ওপরেই নির্ভর করেছেন। সেই ইতিহাস, যখন থেকে পৌত্তলিক নাগরিকদের ধর্মান্তরিত করা এবং ইহুদিদের হত্যাযজ্ঞের পরে ইয়াত্রিব নগরীকে মদিনায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল। নতুবা চোখকান বুজে এমন আদ্যন্ত ঘোর মিথ্যা আমদানির ঝুঁকি নিত না।
ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে আরবদের অনুশীলন ও যথাযথ করার জন্য সুদূর দেশে ভ্রমণের দরকার নেই। সিন্ধু নামক ভারতবর্ষের হতভাগ্য প্রদেশটিতে প্রবেশের অব্যবহিত পরেই আরবরা যা করেছিল, তাতেই তারা অন্যত্র যা করেছিল, তার পুনরাবৃত্তির বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।
সিন্ধুতে আরবদের নথিকৃত কর্ম
আরব বিজয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাস হল ‘চাঁচনামা’, যা মহম্মদ বিন কাশেম রাওয়ার দুর্গ রক্ষার জন্য অভিশপ্ত রাজা দাহিরকে পাঠানোর সময় কীভাবে হেনস্থা করেছিল, তার সচিত্র বর্ণনা দেয়। মোহাম্মদ দুর্গটি দখল করার পর সেখানেই দু’-তিন দিন ছিলেন। দুর্গে থাকা ছয় হাজার যোদ্ধাকে তরোয়ালসহ সশস্ত্র রেখে তিরন্দাজ যোদ্ধাদের সাহায্যে বেশ কয়েকজনকে তীর মেরে ধরাশায়ী করে। অন্যান্য যারা অসহায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল, তাদের তাদের স্ত্রী ও সন্তান সহকারে কারাবন্দী করা হয়েছিল। বন্দীদের সংখ্যা গণনার সময় দেখা যায় মোটামুটি ত্রিশ হাজার ব্যক্তিকে ধরা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ত্রিশজন সর্দারদের কন্যাও ছিল, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন স্বয়ং রাজা দাহিরের বোনের মেয়ে বা ভাগ্নী জাইসিয়া। তাদের হাজ্জাজের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। দাহিরের মস্তক এবং বন্দীদের এক পঞ্চম অংশকে মহারাখের পুত্র কোয়াবের দায়িত্বে প্রেরণ করা হয়েছিল। (জোর প্রযুক্ত)
সিন্ধু থেকে আসা এই অসহায় মানুষের প্রতি হাজ্জাজ কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়? চাচনামা বর্ণনায় অব্যাহত: “দাহিরের মাথা, নারীরা, এবং সমস্ত সম্পত্তি হাজ্জাজের সমীপে পৌঁছয়, তখন সে সজদা করে নিজেকে আল্লাহর সামনে নিবেদন করে, এবং সেইসঙ্গে কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা ব্যক্ত করলেন। হাজ্জাজ তখন কাটা মুণ্ড, ছাতা, লুণ্ঠিত সম্পদ এবং বন্দীদের ‘খলিফা’ ওয়ালিদের কাছে পাঠাল।” (জোর প্রযুক্ত)
আমর-উল-মুমিনান (বিশ্বাসীদের সেনাপতি), তার আচরণও ছিল অনুরূপ। চাচনামার বর্ণনায় – “যখন তৎকালীন খলিফা হাজ্জাজের চিঠিটি পড়েন, তখন তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করেন। তিনি সেই কন্যাদের কয়েকটিকে প্রধানদের মধ্যে বিক্রি করে দেন, আর কিছু বিলিয়ে দেন বিশেষ পুরষ্কার হিসাবে। যখন তাঁর নজর পড়ল দাহিরের ভগ্নী রাইয়ের কন্যার দিকে, তখন কন্যার মনমুগ্ধকার অপরূপ রূপে মোহিত হয়ে বিস্ময়ে নিজের আঙুল কামড়াতে থাকেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস মেয়েটিকে নিতে চাইলে খলিফা বলেন: “ওহে ভাইপো! আমি এই মেয়েটির অত্যধিক প্রশংসা করি এবং তার প্রতি আমি এতটাই মোহিত হয়েছি যে আমি তাকে নিজের জন্য রাখতে চাই। তা সত্ত্বেও, ভালো হয় যদি তুমি তাকে নিজের সন্তানের জননী হিসাবে গ্রহণ করো।” (জোর প্রযুক্ত)
এদিকে ইতিমধ্যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম ব্রাহ্মণাবাদের কিছু বণিকের সাথে ষড়যন্ত্র বা শলাপর্শ করে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন, যাতে তারা দেশদ্রোহ করে যুদ্ধের মাঝে দুর্গের দরজা খুলে দেয়। কাজটা সঠিক হচ্ছে কিনা তাই নিয়ে তার একটু সন্দেহ ছিল। তিনি হাজ্জাজকে সব জানিয়ে তড়িঘড়ি চিঠি পাঠান। চাচনামার মতে হাজ্জাজের জবাব ছিল এইরূপ: “আমার প্রিয় ভাই (তুতো)! আমি আপনার জীবনমুখী অনুপ্রেরণামূলক চিঠিটি পেয়েছি। আমি শিখেছি যে আপনি যে পদ্ধতি ও নিয়ম অনুসরণ করেন, তা আইন (ইসলামের) দ্বারা সিদ্ধ বা অনুমত। কিন্তু আপনি ছোট বড়ো সকলকেই সুরক্ষা দেন, এবং শত্রু মিত্রের মধ্যে কোনও প্রভেদ করেন না। কিন্তু আল্লাহ বলেন – কাফেরদের প্রতি দয়া মার্জনা না দেখিয়ে তাদের গলা কেটে দাও। জেনে রেখো, এটাই মহান আল্লাহর আদেশ। তাই আপনি সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বেশি উতলা হবেন না। কারণ এটা আপনার কাজকে দীর্ঘায়িত করবে। এরপরে থেকে নিতান্ত পদাধিকারী ছাড়া আর কোনও শত্রুকে মার্জনা করবেন না। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান, নতুবা আপনি মর্যাদাহানির দায়ে অভিযুক্ত হবেন।” (জোর দিয়ে)
সুতরাং মহম্মদ বিন কাশেম হাজ্জাজের মাধ্যমে প্রেরিত আল্লার আদেশ পালন করলেন। চাচনামার গল্প এগিয়ে যায় ব্রাহ্মণাবাদের পতনের পর: “যখন লুণ্ঠন সামগ্রী ও বন্দীদের কাশেমের সামনে আনা হয় এবং আটকদের প্রত্যেকের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয়, দেখা যায় দাহিরের স্ত্রী লড়ী অন্যান্য স্ত্রীদের দুই কন্যার সঙ্গে দুর্গে ছিলেন। তাঁদের মুখে ওড়না। তাঁদের একজন চাকরকে দিয়ে আলাদা করে রাখতে বলা হল। এক পঞ্চমাংশ বন্দীকে বেছে পৃথক করে রাখা হয়, যে সংখাটা ছিল বিশ সহস্রের মতো। বাকিদের সৈনিকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তিনি নিষ্ঠুরতার বলে সিংহাসনে আরোহণ করে তরবারির জোরেই শাসন শুরু করলেন। বলা হয় ছয় হাজার যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু অনেকের মতে নিহত সৈনিকের সংখ্যা ছিল ষোলো হাজার।” (জোর দিয়ে)
এইভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার পর বিজেতা পরবর্তী পদক্ষেপ নিলেন। চাচনামা অনুযায়ী: “মহম্মদ বিন কাশেম নবির আইন অনুসারে সমস্ত প্রজাদের ওপর কর লাগু করেন। যারা ইসলাম কবুল করে, তাদের দাসত্ব, সেলামী ও কিছু কর থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। আর যারা নিজেদের সম্প্রদায় পরিবর্তন করে না, তাদের ওপর তিনগুণ মাসুল চাপানো হয়।” (বিশেষ জোর দিয়ে)
এরপর মুসলিম, জয়ী বা ধর্মান্তরিতদের জন্য সুবিধা সংরক্ষণের পালা। চাচনামা অনুযায়ী: “যেহেতু বিশ্বাসীদের সেনাপতি খত্ত্বের পুত্র উমর শাম সিরিয়ার মানুষকে শ্রদ্ধা করার হুকুম দিয়েছিল, মহম্মদ বিন কাশেমও তেমনটাই করেছিলেন, যে প্রত্যেক মুসলিম অতিথিকে হিন্দুদের গৃহে মনোরঞ্জন করতে দিতে হবে পুরো একদিন ও এক রাত্রির জন্য; আর যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে অন্তত তিন দিন তিন রাত্রি সুশ্রুষা করতে হবে।”
অলস্কান্দায় আর একটি গণহত্যায় হিন্দুদের বশ্যতা স্বীকার করতে হয়, কারণ তাদের সেনাপতি পালিয়ে যান। তিনি (কাশেম) তখন দুর্গে ঢুকে নিজের রক্তপিপাসু তলোয়ার দিয়ে চার হাজার যোদ্ধাকে হত্যা করে তাদের পরিবারকে দাসত্বের জন্য পাঠিয়ে দেন। আর মুলতানে ছ’ হাজার যোদ্ধাকে মৃত্যু উপহার দিয়ে তাদের পরিবারকে দাসত্বের জন্য বন্দী করা হয়। (বিশেষ জোর প্রযুক্ত) চাচনামা মহম্মদ বিন কাশেমের সাময়িক বিজয় সম্পর্কে জনৈক ব্রাহ্মণের উক্তিকে বেছে নিয়েছে: “হিদেনধর্ম এখন শেষ হয়ে গেছে, মন্দিরগুলো ধূলোয়ে মিশানো হয়েছে, পৃথিবী ইসলামের আলোকে আলোকিত, এবং মূর্তিযুক্ত মন্দিরের জায়গায় মসজিদ নির্মিত হয়েছে।” সেই ব্রাহ্মণ ছিল সদ্য ধর্মান্তরিত। আল বিরাদুরি যিনি ৮৯২-৮৯৩ নাগাদ মারা যান, তিনি আরবদের সিদ্ধু বিজয়ের আরেকটি কাহিনী শুনিয়েছেন। নিজের ‘ফুতুহুল-বুলদান’ (Futûhul-Buldãn) গ্রন্থে লিখেছেন, “আমাদের বলা হয়েছিল, হাজ্জাজ একটি হিসাব করান – মহম্মদ বিন কাশেম যে সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটান ও সম্পদ আরোহণ করেন, তার খতিয়ান। তিনি ৬ কোটি দিরহাম খরচ করেছিলেন এবং তাঁর কাছে ১২ কোটি (120 million) দিরহাম ফেরত পাঠানো হয়েছিল।”
১২ কোটি দিরহাম ছিল মোট লুণ্ঠনের মাত্র এক পঞ্চমাংশ, আইনানুসারে খলিফাকে যে নজরানা বা সেলামী পাঠানো হয়েছিল। এ ছাড়াও আরও অতিরিক্ত ৪৮ কোটি (480 million) দিরহাম মুসলিম সৈনিকদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়। তারপরেও সেই মোট ৬০ কোটি দিরহামের মধ্যে কিন্তু সেই সময় ইসলাম দুনিয়ায় নরনারী শিশুদের কারারুদ্ধ করে যে নিলাম হয়েছিল, সেই বিক্রি থেকে সংগৃহীত অর্থ শামিল ছিল না।
পাঠানদের কীর্তি
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল: যে পাঠানরা তুর্কীদের ঘৃণা করত এবং সঙ্গে সর্বশক্তি দিয়ে লড়েছিল, হিন্দুদের প্রতি ব্যবহারে তারা কী করে তুর্কীদের পদাঙ্ক হুবহু অনুসরণ করল?
সিকন্দর লোদীর কথাই ধরা যাক। তিনি ছিলেন পাঠান পিতার পুত্র। মা ছিলেন সিরহিন্দের হিন্দু স্বর্ণবণিক। আবদুল্লা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে নিজের ‘তনখ্-ই—দাউদি’ গ্রন্থে লিখেছেন: “বাদশাজাদার সঙ্গে এটাও সংশ্লিষ্ট, যে তাঁর সিংহাসনে অভিষেকের আগে যখন একটি বিশাল হিন্দু জনতা কুরুখেতে জড়ো হয়েছিল, তখন তিনি থানেসর যেতে চান এমন সবাইকে হত্যা করেন।” তিনি নিজের মুসলমানত্ব নিয়ে এতটাই উৎসাহী ছিলেন যে কাফেরদের বিভিন্ন উপাসনার স্থানগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলেন কোনও অবশেষ না রেখে। তিনি কাফের ধর্মের আকর বলে মথুরার মঠগুলোকে প্রায় পুরো নষ্ট করে দেন এবং হিন্দু উপাসনালয়গুলিকে ধ্বংস করে সেই জায়গায় কাফেলা ও উচ্চবিদ্যালয় নির্মাণ করান। পাথরের মূর্তিগুলো কসাইদের দেওয়া হল মাংস ওজনের বাটখারা হিসাবে ব্যবহার করার জন্য। সমস্ত হিন্দুদের স্নানের ঘাটে মস্তক মুণ্ডন ও দাড়ি কামানো নিষিদ্ধ করা হয়। বাদাউনি নিজের ‘মুন্তাখাব-উৎ-তাওয়ানখ্’-এ লিখেছেন, “তিনি দুর্গ (উন্তগড়) দখল করে কাফেরদের দিয়ে তরবারির ক্ষুন্নিবৃত্তি করেন। তারপর মন্দিরের মূর্তিগুলিকে ভেঙে একটা সুউচ্চ মসজিদ নির্মাণ করান।” পরের বছর একই কাজের পুনরাবৃত্তি করেন নরওয়ারে এবং পরবর্তীতে আরও বহু স্থানে।
হিন্দু ধর্মান্তরিতদের আচরণ
আমার তৃতীয় প্রশ্ন হল: যারা তুর্কী নয় ছিল ধর্মান্তরিত হিন্দু, তাদের ব্যবহারকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব, যাদের আচরণ অপেক্ষাকৃত ভালো তো ছিলই না, বরং বহু নিন্দিত তুর্কীদের চেয়েও আরও সাঙ্ঘাতিক ছিল?
‘কালাপাহাড়’-এর কাহিনী এবং বাংলা ও উড়িষ্যায় তার ব্যবহার আলিগড়ী দালালরা হয়তো হিন্দু মহিলাদের বানানো আষাঢ়ে গল্প বলে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু মালিক কাফুরের কীর্তি ও অর্জন যে গালগল্প নয়, তার প্রমাণ সেই সমসাময়িক স্বয়ং আমির খুসরু দ্বারা লিপিবদ্ধ আছে। মালিক কাফুর যাকে আলাউদ্দিন খলজির দুই সেনাপতি উলুঘ খান ও নুসরত খান ১২৯৮ সালে গুজরাট আক্রমণের সময় বন্দী করে দাস বানিয়েছিল। তাকে নুসরত খান সহস্র দিনার দিয়ে কিনে নেয় ও ইসলামে ধর্মান্তরিত করে দিল্লীর সম্রাটের কাছে পেশ করে। আলাউদ্দিন কাফুরের প্রতি মুগ্ধ হন এবং এরপর খুব শীঘ্র সাম্রাজ্যের সেরা সেনাধিকারিকের পদে ‘মালিক নায়েব’-এর পদোন্নতি হয়।
কাফুর নিজের বিখ্যাত দাক্ষিণাত্য অভিযান করে ১৩১০-১১ সাল নাগাদ। দেবগিরি তখন ইতিমধ্যেই দিল্লীর সুলতানের করদ রাজ্য ছিল। দ্বারাসমুদ্রর হৈসালা রাজাকে ভয় দেখিয়ে বশ্যতা স্বীকার করানো হয়। কিন্তু মাদুরাইয়ের পাণ্ড্য রাজকুমার অর্থের বিনিময়ে শান্তি কিনতে রাজি হননি এবং প্রবল যুদ্ধ করেন। নিজের প্রহার ও রণকৌশল দ্বারা মালিক নায়েবকে আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মালিক নায়েব সাধারণ অযোদ্ধা মানুষ এবং মন্দিগুলোকে নিশানা করে। ব্রহ্মাস্তপুরে (অধুনা চিদাম্বরম) সাধারণ নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালায়, স্বর্ণ মন্দির ধূলোয় মিশিয়ে দেয়, এবং এর ভিত্তিও খুঁড়িয়ে ফেলে। অতঃপর শ্রীরঙ্গম ও কান্নাউরের আশপাশের মন্দিরগুলো অবরোধ করা হয়। মাদুরাইতে সোকাণ্ঠ/সুকণ্ঠ-র মন্দিরে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেখানে তাকে হিন্দুদের মারাত্মক প্রতিরোধকে প্রতিহত করতে হয়। কিন্তু সঙ্গে করে অপরিমিত লুণ্ঠন সামগ্রী ও বন্দীদের নিয়ে নিতে ভোলে না, যাদের রাজধানী দিল্লী ফেরার পথে দাস হিসাবে বিক্রি করতে করতে ফিরে যায়।
কিংবা সুহাভট্টর কথা ধরা যাক, যে কাশ্মীর শাসক সিকন্দর বুৎসিকানের (১৩৮৯-১৪১৩খ্রিস্টাব্দ) প্রধান মন্ত্রী ছিল। সুহাভট্ট যে নিজের বংশের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে জোনারাজার রাজতরঙ্গিনীতে সুহা নামে পরিচিত হয়। কাশ্মীরের এই ঐতিহাসিক নথিকৃত করেছেন: “ম্লেচ্ছ (সুহা)-র নির্দেশ পেয়ে রাজা উত্তেজিত হয়ে ভগবানের মূর্তি ভেঙে ফেলেন। রাজা নিজের রাজন্য কর্তব্য ভুলে দিনরাত মূর্তি ভাঙার বিলাসিতায় মগ্ন হন। তিনি মার্তণ্ড, বিষয়া, ইয়ানা, চক্রবর্ত্তী ও ত্রিপুরেবরের মূর্তি ভেঙে ফেলেন। সুহা ও তুরুস্কের জন্য ভগবানের মূর্তি অক্ষত ছিল, এমন কোনও শহর কোনও গ্রাম অবশিষ্ট ছিল না।”
সুহাভট্ট সিকন্দেরর পুত্র আলি শাহর (১৪১৩-১৪২০) প্রধানমন্ত্রীত্বে বহাল হয়। সিকন্দরের আমলে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা কিছুটা বন্ধ ছিল। কিন্তু নতুন শাসকের আমলে ব্রাহ্মণদের ওপর প্রবল অত্যাচার শুরু হয়। তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়। ব্রাহ্মণদের চিরাচরিত ভাতা বন্ধ করা হয়। ব্রাহ্মণরা এর ফলে ভিক্ষুকে পরিণত হয়, খাদ্যের সন্ধানে কুকুরের মতো যাদের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়াতে হয়। অনেকেই নিজেদের জায়গা জমি ছেড়ে পালিয়ে নিজেদের জাত বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা করার জন্য আধিকারিক অনুমতি মিলত না। ফলে বহু ব্রাহ্মণ আগুনে পুড়ে, বিষ পান করে, জলে ডুবে, গলায় দড়ি দিয়ে কিংবা খাড়া পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। এসবের মধ্যে সুহাভট্টকে ব্রাহ্মণদের ওপর নির্যাতনের জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত দেখা যায়নি, নির্যাতনের কথা স্বীকারই করেনি, বরং সে দাবি করে সে ইসলামের প্রতি নিজের কর্তব্য করছে মাত্র!
তুর্কীরাও ইসলামের নৃশংসতার শিকার হয়েছিল
আমার চতুর্থ প্রশ্ন হল: তুর্কীরা কি সত্যিই অন্ধকার বর্বর ছিল যেমনটা তাদের আলিগড়ী কৈফিয়তদাতারা চিত্রায়িত করেছে? তাহলে কিছু তুর্কী রাজার হিন্দুদের প্রতি ভয়ানক হলেও সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে মুসলিমদের প্রতি অমন উদার পরোপকারী ব্যবহারের নিদর্শন পাই কী করে?
মহম্মদ গজনবীর কথা ধরা যাক যিনি হিন্দুদের কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত মুসলিম আগ্রাসক ছিলেন। আধুনিক কালের ঐতিহাসিক মহম্মদ নাজ়িম নিজের তথ্যনিষ্ঠ মনোগ্রাফে The Life and Times of Sultan Mahmud of Ghazna-তে লিখেছেন: সুলতান ছিলেন চরিত্রে স্নেহপরায়ণ ছিলেন। সুলতান মাহমুদ প্রশাসন ও বিচারের ব্যাপারে যথেষ্ট কড়া ছিলেন। সুলতাম মাহ্মুদ শিক্ষিত ও কবি ছিলেন। তিনি তফরিদুল ফুরু (Tafridul-Furu) নামে একটি রচনা করেছিল বলে কথিত, যা ‘ফিক’ (Fiqh)-এর মান্য গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত। সুলতান ছিলেন শিক্ষাদীক্ষার দারুণ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাঁর সভা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র থেকে আগত শিক্ষিত জ্ঞানীগুণী দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল। তাঁর নগণ্যতম পুরস্কারও ছিল কমপক্ষে এক হাজার দিনার। এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের স্মৃতিচারণায় পাওয়া যায়, তিনি হাতির পিঠে করে সোনা রূপো দান করতেন। ফিরিশ্তা লিপিবদ্ধ করেছেন, সুলতান যুদ্ধে কনৌজ থেকে আহরিত ধনদম্পদ গজনিতে দর্শনীয় মসজিদ, বিশাল সংখ্যক বইয়ে ভর্তি বিরাট গ্রন্থাগার সমেত বিশ্ববিদ্যালয় এবং নানা দুর্মূল্য প্রত্ন নিদর্শনে সমৃদ্ধ একটি সংগ্রহশালা নির্মাণে কাজে লাগান।
কিংবা জালালুদ্দিন খলজির কথা ধরা যাক। হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের নিরীখে তিনিই ছিলেন মুসলিম রাজাদের মধ্যে দ্বিতীয়। কিন্তু মালিক ছাজ্জু যখন জালালুদ্দিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বিস্তর রক্তপাতের কারণ হয়, তখন তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে এনে সুলতানের সামনে হাজির করা হলেও, উপদেষ্টাদের কঠিন শাস্তি দানের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে জালালুদ্দিন বলেন মুসলমানের রক্তপাত করার পরিবর্তে তিনি বরং নিজের সিংহাসন ত্যাগ করতে পারেন। আবার রণথম্বোরের রাণা যখন বশ্যতা স্বীকার করতে অস্বীকার করেন, তখন এই জালালুদ্দিনই তাঁর সেনাপতিদের বিরোধিতা সত্ত্বেও দুর্গ অবরোধ করা ছেড়ে দেন এই বলে, যে এমন দশটা দুর্গও একজন মুসলিমের মাথার একটি চুলেরও সমতুল্য নয়!
ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন শিক্ষাদীক্ষার বড় পৃষ্ঠপোষক, বড়ো বড়ো নগরের পত্তনকারী, পুকুর বাগান ও খালের মতো অনেক জনমুখী কাজের পৃষঠপোষক। নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন: “Better a people’s weal than treasures vast; better an empty chest than hearts downcast.” অর্থাৎ “মানুষের মঙ্গল প্রচুর সম্পদের চেয়ে শ্রেয়, নীচু মনোবৃত্তির চেয়ে হৃদয় না থাকা ভালো”। কিন্তু এখানে ‘people’ বা মানুষ বলতে তিনি শুধু মুসলিমদের বুঝিয়েছেন। হিন্দুদের জন্য দানবের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিলেন না।
বহু নিন্দিত তুর্কীদের আরেকটা দিক ছিল, বর্বরতার থেকে যার দূরত্ব বিস্তর। এটা অন্য ব্যাপার যে তুর্কীদের পরোপকারী সত্তা ছিল সবসময় ও শুধুমাত্র মুসলিম ‘উম্মাহ’দের জন্য এবং কদাপি হিন্দুদের প্রতি নয়। তুর্কীরা যে ভারতে যে অপরাধ করেছে, তা কখনই তাদের জাতিগত সহজাত বর্বর স্বভাব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু যিনি ইসলামের করা অপরাধের দায় তুর্কী বর্বরতার ওপর চাপাতে চেয়েছেন, তিনিও কোথাও উল্লেখ করেছেন তুর্কীরা ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে বৌদ্ধ ছিল। তাহলে বৌদ্ধধর্ম তুর্কীদের নৃশংস করেছিল? নাকি বৌদ্ধধর্ম তুর্কীদের মানবতা শেখানোতে ব্যর্থ হয়েছিল।
আমরা যদি তর্কের খাতিরে ধরেওনি যে, তুর্কীরা জন্মগতভাবে বর্বর, তাহলেও মূল প্রশ্ন উত্তরহীনই থেকে যাবে। কিছু মধ্যযুগের ঐতিহাসিকরা তুর্কী ছিল না। তারা ছিল আরবী বা পার্সী যাদের আলিগড় উমেদাররা ইসলামী সংস্কৃতির বেত্তা বলে কৃতিত্ব দেন। তাদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে ভালোভবে শিক্ষিত মোল্লা কমই ছিল। কিন্তু তাও যে পদমর্যাদা ও সুবিধা তারা তুর্কী শাসকের দরবারে পেত, সেটা ছিল পুরোপুরি তাদের শিক্ষা ও গভীরতার জন্য। তাই আমার পঞ্চম ও শেষ প্রশ্ন হল: মধ্যযুগীয় এই মুসলিম ঐতিহাসিকরা তাদের পৃষ্ঠপোষকদের করা অপরাধগুলো কেন তুলে ধরেছিল, যদি না তারা সেগুলো করে থাকে; কিংবা কেনই বা মুসলিম শাসকদের করা সামান্য নিষ্ঠুরতাগুলো অতিরঞ্জিত করেছিল?
এই পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে মধ্যযুগে মুসলিম সম্রাট ও তাদের ক্ষুদ্র সংস্করণদের দ্বারা নির্যাতনের পরিমাণ বা মাত্রার দিকে তাকানো যাক যেগুলো মুসলিম সভাসদ ঐতিহাসিকরাই চিত্রিত করেছেন। দেখা যাক সেইসব অপরাধের বর্ণনা কোনও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা ধরণ তুলে ধরছে কিনা। তারপর এগিয়ে বিশ্লেষণ করা যাবে, সেই ধরণ বা প্যাটার্ন মোটামুটি স্বাভাবিক মনুষ্য চরিত্রের সঙ্গে মেলে, নাকি তা ধর্মের (religion) নামে কোনও অমানবিক মতাদর্শের অনুশাসন।
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়