১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা
ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী
অধ্যায় ৪: মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
NCERT স্কুল স্তরে ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকের জন্য আরেকটি নির্দেশিকা দিয়েছে যে, ‘রাজনৈতিক সংঘর্ষে ধর্মকে গুরুত্ব দেওয়া চলবে না।’
ইতিহাসের নতুন পাঠ্যপুস্তকে কী লেখা চলবে এবং কোনটা চলবে না এই ব্যাপারে রাষ্ট্রের কঠোর নির্দেশ আপাতত থাক। তার আগে প্রথমে দেখা যাক, মধ্যযুগের ঐতিহাসিকরা কী নথিভুক্ত করেছেন এবং সেগুলো কীভাবে বিভিন্নরূপে ব্যাখ্যায়িত হয়েছে।
হিন্দু দৃষ্টিকোণ থেকে সংঘর্ষ
মধ্যযুগে কয়েক শতাব্দী ধরে হিন্দুরা বাধ্য হয়ে নিজেরা বহিরাগত মুসলিম আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে যেসব যুদ্ধ করেছিল, সে ব্যাপারে বিশেষ কিছু লিখে যায়নি। মধ্যযুগের হিন্দুদের রচনায় যা পাওয়া যায়, তা হল তৎকালীন সাহিত্যে মুসলিম বিধ্বংসী রূপ সম্পর্কে কিছুটা আবেগমথিত বর্ণনা। মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মোটামুটি সাতটি প্রধান অভিযোগ ছিল:
১. তারা ব্রাহ্মণ ও গোরুদের হত্যা করেছিল;
২. তারা হিন্দু নারীদের সতীত্ব লুণ্ঠন করেছিল;
৩. তারা মন্দির ভেঙে দেবমূর্তিগুলোকে অপবিত্র করছিল;
৪. তারা মাথার টিকি বা শিখা কেটে ফেলত এবং পৈতে ছিঁড়ে দিত;
৫. তারা জনগণকে সুন্নত করে ও গোমাংস ভক্ষণে বাধ্য করে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করত;
৬. তারা মানুষ বিশেষত মহিলা ও বাচ্চাদের আটক করে রক্ষিতাবৃত্তি ও দাসত্বের জন্য বিক্রি করত;
৭. তারা মানুষের সম্পত্তি লুঠপাঠ করত এবং যেসব সম্পদ বয়ে নিয়ে যোওয়া সম্ভব ছিল না, যেগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলত।
সূত্রানুযায়ী বিজয়নগর, মারাঠা ও শিখদের উত্থানের ফলে ধর্মীয় প্রেরণা তীব্রতর হয়েছিল। এই নথিগুলো নিঃসন্দেহে এটাই প্রমাণ করে ‘হিন্দুধর্ম’ রক্ষাই ছিল মাধব বিদ্যানারায়ণ, সামর্থ রামদাস ও গুরু তেগ বাহাদুরের মনে প্রাথমিক চিন্তা। হিন্দু কবিদের হরিহর ও বুক্কা, শিবাজী ও শিখদের প্রশংসায় লেখা কবিতায় তরবারির নেপথ্যে ধর্মীয় অনুপ্রেরণাই পরিষ্কার পরিস্ফুট হয়। উদ্দেশ্য ছিল গোরক্ষা, ব্রাহ্মণের শিখা ও পৈতে রক্ষা, হিন্দু নারীদের সম্ভ্রম রক্ষা এবং হিন্দুদের উপাসনালয়ের পবিত্রতা রক্ষা। প্রাক ইসলামী যুগের হিন্দু নথিতে এক সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পাওয়া যায়। গ্রীক, শিথিয়ান, কুশান ও হুনদেরও বিরুদ্ধেও নৃশংসতা, কাম ও লুঠতরাজের অভিযোগ আছে। কিন্তু তারা হিন্দু ধর্মকে আক্রমণ করেছিল বলে অভিযোগ নেই। তারা হিন্দু ধর্ম ও তার বাহ্যিক প্রতীকগুলোকে বেছে বেছে আক্রমণ করেছে, এমন অভিযোগ আনা হয়নি। বরং আমাদের কাছে এমন তথ্যও আছে প্রাথমিক রণোন্মত্তোতা কেটে যাওয়ার পর এই বহিরাগতরা নিষ্ঠাবান শৈব, বৈষ্ণব কিংবা বৌদ্ধ হয়ে ভারতে স্থায়ী বসত শুরু করে।
মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে সংঘর্ষ
অন্যদিকে মধ্যযুগে ভারতের বহু মুসলিম ঐতিহাসিক সমৃদ্ধির বর্ণনা দিয়ে গেছেন এবং বিশদে নিত্যদিন নিরবিচ্ছিন্ন অন্তহীন হিন্দু মুসলিম সংঘাতের ছবি এঁকেছেন। এই সূত্রগুলোর প্রধান বিষয়বস্তু হল মুসলিমরা শহিদ ও হিন্দু কাফেরদের নরকে পাঠানো হচ্ছে, শহর ও দুর্গগুলো অবরোধ করা হচ্ছে, নাগরিকদের গণহত্যা চলেছে, ব্রাহ্মণদের হয় গোমাংস ভক্ষণে বাধ্য করা হচ্ছে কিংবা মেরে ফেলা হচ্ছে, মন্দিরগুলো ধূলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, দেবমূর্তিগুলো টুকরো টুকরো করে সেগুলো দিয়ে বিশ্বাসীদের দ্বারা পদদলিত হওয়ার জন্য রাজকীয় মসজিদের প্রধান রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে, যুদ্ধের উপহাররূপে পাওয়া লুণ্ঠিত সামগ্রী হাতি, উট, ঘোড়া বা ষাঁড়ের গাড়িতে করে পাচার করা হচ্ছে, সুন্দরী হিন্দু মেয়েদের লুঠ করে সুলতান ও তার সেনাপতি বা রাজপুরুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, হিন্দু পুরুষ-নারী-শিশু সবাইকে নির্বিচারে দাসত্বের জন্য ইসলামী দুনিয়ার সর্বত্র বিক্রি করা হচ্ছে এবং কাফেদের তলোয়ারের আগায় প্রকৃত বিশ্বাসীতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। মুসলিম ঐতিহাসিকরা প্রতিটি যুদ্ধকেই নবী ও পবিত্র খলিফার উদ্দেশে নিবেদিত জেহাদ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
এই মুসলিম সূত্রগুলিতে কোথাও মায়াদয়ার লেশমাত্র নেই; নিজেদের নিষ্ঠুরতা ও ধর্ষণের জন্য সামান্যতম অনুতাপ বা লজ্জার প্রতিফলনও পাওয়া যায় না। বরং মুসলিম ঐতিহাসিকরা এই ভূখণ্ডে অন্ধকার ও মূর্তিপুজো ঘুচিয়ে ইসলামের আলো এনে আল্লাকে সন্তুষ্ট করা গেছে বলে রীতিমতো উল্লাস ও পরিতৃপ্তি ব্যক্ত করেছেন। এই মুসলিম ঐতিহাসিক তো যুদ্ধ আরোহিত ধনসম্পদ ইসলামের সেবায় লাগানো এবং সেসব ইসলামী শিক্ষা ও শক্তি বিস্তাতের জন্য নিয়োজিত মুজাহিদ, উলেমা ও সুফিদের মধ্যে বণ্টনের সোৎসাহ বর্ণনা দিয়েছেন।
ঐ একই মুসলিম ঐতিহাসিকরা মুসলিম রাজকুমারদের মধ্যে ঘটা যুদ্ধেরও বর্ণা দিয়েছেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সেখানে কিন্তু কাফিরদের বিরুদ্ধে মুমিনের বিজয়, মন্দিরের বিপক্ষে মসজিদ, মূর্তির বিপ্রতীপে নিরাকারবাদ, ব্রাহ্মণদের বিপরীতে গোমংসভূক, নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্র কামুকবৃন্দ, কিংবা যুদ্ধে বন্দী শিশু ও নারীদের বিরুদ্ধে দস্যুদের কোনও নাটকীয় বর্ণনা পাওয়া যায় না। সেখানে শুধু চুক্তি ভঙ্গ, সেলামি অনাদায়, রণকৌশল অবলম্বন, হাতি ঘোড়া স্থানান্তর, অস্ত্রশস্ত্রের জোগাড় ও ব্যবহার, পরাজয় ভোগ ও জয় লাভ এবং যুদ্ধে নষ্ট হওয়া মানুষ ও আয়ূধের বিবরণ পাওয়া যায়। তার মধ্যে কিছু অবরোধ, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসের ছবিও থাকে। কিন্তু সেসব বর্ণনায় মুসলিমরা মুসলিমদের মারছে – যে ব্যাপারে পয়গম্বরের কড় নিষেধ ছিল, তাই নিয়ে যথেষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে।
নথিভূক্ত ঘটনা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই
নথিভূক্ত ইতিহাসের কিছু ঘটনা আছে। এর অতি সামান্যই হিন্দু সূত্রগুলিতে পাওয়া যায়, এবং সেটাও যথেষ্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে অগোছালোভাবে। বিস্ময়কর পরিমাণ ঘটনার ভাণ্ডার বরং মুসলিম ঐতিহাসিকদের দ্বারা রচিত হয়ে মুসলিম ইতিহাসে সঞ্চিত রয়েছে যথেষ্ট সুসজ্জিতভাবে, বংশের পর বংশ, বাজত্বের পর রাজত্ব, যুদ্ধের পর যুদ্ধ পরম্পরায়। এই মুসলিম ইতিহাসগুলো পাণ্ডুলিপি অবস্থাতেও পাওয়া যায়; আবার সেইসঙ্গে আধুনিক যুগে সেগুলোর মূল ভাষ্য ও বিশ্বের প্রধান ভাষায় অনুদিত হয়ে মুদ্রিত রূপেও পাওয়া যায়। সেগুলো সভ্য জগৎ জুড়ে আর্কাইভ ও গ্রন্থাগারে উপলভ্য। এই ইতিহাসগুলির সংগ্রহ দুর্মূল্য সংগ্রহ হিসাবে মুসলিম সম্ভ্রান্ত সমাজে বিশেষ মর্যাদা পায়।
সুতরাং নথিভুক্ত ইতিহাস নিয়ে বিশেষ বিতর্ক নেই। একই সময়ে একই শাসকের আমলে ঘটা একই ঘটনার বিবরণে বিভিন্ন সূত্রের মধ্যে সামান্য ফারাক থাকতে পারে। কোনও কোনও সূত্রে সামান্য স্ববিরোধ রয়েছে। কিন্তু সেসব নগণই, যে ফারাকটা প্রাপ্ত সূত্রগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দূর করা যায়।
উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ধরা পড়ে ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা ও বিচারমূলক সিদ্ধান্ত নির্ণয়ে। এখানেই ব্যাখ্যাকারের বিষয়গত ও আদর্শগত প্রবণতার একটা বড় ভূমিকা থাকে। এই বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও মূল্যায়নগুলোই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ভারতের স্কুল কলেজে পাঠ্যপুস্তকের পক্ষে মনে হচ্ছে না। NCERT প্রদত্ত নির্দেশিকাগুলোর উদ্দেশ্যও এই ব্যাখ্যাগুলি সাজিয়ে বাছাই করা।
বিভিন্ন ব্যাখ্যা
গোঁড়া বা মুসলিম ঐতিহাসিকরা যারা পেট্রোডলারের সাহায্যে সামনের সারিতে আসছেন, তাঁরা মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতোই সন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা তরবারির জোরে ভারতে ইসলামের বিজয়কে অনুমোদ তো করেনই, তাই নিয়ে নির্লজ্জের মতো বেশ উৎফুল্লও। তাঁদের কোনও সন্দেহ নেই মধ্যযুগে হিন্দু মুসলিমরা হিন্দু ও মুসলিম হিসাবেই লড়েছিল। তাঁরা এই দ্বন্দ্বগুলোকে ইসলাম ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে যুদ্ধ হিসাবেই দেখেছেন। NCERT এই গোঁড়া মুসলিম ঐতিহাসিকদের ভালো করেই জানে এবং তাই সতর্ক করেছে ‘মধ্যযুগের শাসনকে অতি গৌরবান্বিত করা উচিত হবে না; এবং লেখকরা যেন গোঁড়ামি, অসহিষ্ণুতা ও একচেটিয়তার নিন্দাকে কম করে না দেখেন।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ব্রিটিশ আমলাদের পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব শিক্ষাক্ষেত্রের ঐতিহাসিকরা রাজত্ব করেছেন এবং ভারতীয় ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন, অধিকাংশই সূত্রগুলোকেঅভ্রান্ত ধরে নিয়ে কালানুক্রমিক ভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁরা কদাচিত মধ্যযুগে হিন্দু মুসলিম সংঘাতকে সঠিকভাবে অনুধাবন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের নৈতিক বিচার অধিকাংশত কোনও নির্দিষ্ট পক্ষের করা সন্ধির যৌক্তিকতা বা অর্থহীনতার মতো ছোটখাটো বিষয়ে আবদ্ধ থেকেছে। তাঁদের চিন্তাভাবনা অধিকাংশ সময় সফল ব্যক্তির সাফল্যের কারণ ও ব্যর্থ মানুষের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে রত থেকেছে।
অনেক সেকুলারবাদী আবার ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের বিরুদ্ধে মুসলিম শাসনকে বিচারহীন ও বিকৃত করে দেখিয়ে হিন্দু মুসলিমে বিভেদ সৃষ্টি করে divide-and-rule কৌশল অবলম্বনের অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু সঠিক প্রতিফলন ব্রিটিশদের সেই দোষ খণ্ডাতে পারে। ব্রিটিশরা চলে গেছে, তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। কিন্তু হিন্দু মুসলিম সমস্যার সমাধান খুবই দুরূহ। সেকুলারিস্টরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিক’দের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে, যে অভিযোগ আগে তারা ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের বিরুদ্ধে এনেছিল। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের একটাই দোষ ছিল, তাঁরা মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিকদর মতো সত্য গোপন করেননি। অধিকাংশ অ্যাকাডেমি ঐতিহাসিক ব্রিটিশ অগ্রজদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। কিন্তু নতুন সেকুলারবাদী ফ্যাশন দ্বারা তাঁদের ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িক’ হিসাবে চিহ্নিতকরণ সোজাসুজি বজ্জাতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
‘আধুনিকপন্থী’ মুসলিম ঐতিহাসিকরা, বিশেষত আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপাদনরা, ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছেন শিক্ষায়তনের ঐতিহাসিকদের ‘দৃষ্টিভঙ্গী সংশোধন’ করতে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে আলিগড় ঘরানা কখনই দেশভাগের পূর্বেকার প্রেক্ষাপটে মেরমত করার চেষ্টা করেননি, মহম্মদ হাবিবের মতো দু-একজন কমিউনিস্ট ঐতিহাসিক ছাড়া। তাঁর ক্ষেত্রেও মধ্যযুগের ইতিহাসের কমিউনিস্ট সংস্করণ আসলে গোঁড়া মুসলিম সংস্করণেরই চতুর ঢাকাচাপা রূপ। বাকি আলিগড়ীরা হালি, ইকবাল তথা মৌলানা আজ়াদের মতোই মুসলিম মৌলবাদীদের মতো ভারতে ইসলামের বিজয় এবং হিন্দুদের যন্ত্রণাময় পরিণতি নিয়ে গর্বিত। একমাত্র স্বাধীনতার পরেই আলিগড় ঘরানা নিজের কৌশল বদলেছে।
আলিগড়ী উমেদার
গোড়াতেই বলতে হয় আলিগড় ঘরানা আমাদের সতর্ক করে দেয়, তুর্কি সাম্রাজ্যবাদকে ইসলামের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। তুর্কীরা ইসলামে ধর্মান্তরিত সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মানে এই নয়, তারা আর তুর্কী নেই। তুর্কী, অর্থাৎ আফ্রিকার স্টেপি তৃণভূমি থেকে মধ্য এশিয়ায় আসা বর্বরদের নিজস্ব ঐতিহ্যগত নিষ্ঠুরতা ঐ কম সময়ের মধ্যে ইসলাম সারিয়ে উঠতে পারেনি। তুর্কীরা যে নিষ্ঠুরতা করেছে তার দায়িত্ব ইসলামের ওপর বর্তানো চলবে না। তুর্কীরা যা করার নিজেরা করেছে, ইসলামের নামে সুবিধা নিয়ে মাত্র।
দ্বিতীয়ত, তুর্কীদের বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুরতার অভিযোগ আনা হয়, তাকে নতুন ভাবে পরখ করে দেখতে হবে। আমাদের ভোলা চলবে না, মধ্যযুগের মুসলমান ইতিহাসবিদরা সবাই প্রথম ও প্রধানত সভাসদ ছিলেন। তাঁরা নিজেদের স্বকপোলকল্পিত অতিরঞ্জিত অনেক কিছু বানিয়ে লিখে থাকবেন নিজেদের সুলতানী বা বাদশাহী পৃষ্ঠপোষকদের খুশি করতে। যেমন ধরা যাক, একশো হিন্দু ও কিছু মুসলিম কোনও সংঘর্ষে মারা গিয়েছিল। সভাসদ ঐতিহাসিকরা এই সংখ্যাটা রং চড়িয়ে হয়তো হাজার খানেক হিন্দুকে নরকে পাঠানো ও গুটিকয় মুসলিমের শহীদ হওয়ার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। এই জাতীয় প্রতিবেদন মুসলিম বীরত্বকে বাড়িয়ে দেখানোর জন্য। আবার ধরা যাক, কোনও মন্দির লুণ্ঠন করল কোনও নিম্ন পদস্থ সৈনিক নিছক ধনসম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে। সভাসদ ইতিহাসকাররা নিজেদের লেখায় দেখালেন; দশটা মন্দির ধূলিস্যাৎ করা হয়েছে, এবং যা মূর্তি ভাঙা হয়েছিল তার দ্বিগুণ করে ও সেই ভগ্নাবশেষ দিয়ে যত মসজিদ গড়া হয়েছিল বাস্তবে, সংখ্যাটা তার তিনগুণ করে দেখালেন। এর দ্বারা পবিত্র মুসলিম রাজকুমারদের মূর্তিবিরোধী উন্মাদনা বেশ অতিরঞ্জিত করা গেল। এইরকম আরও অনেক আছে। সুতরাং মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিকরা যত গো-ব্রাহ্মণ জবাই, যত নারীর সম্ভ্রম নষ্ট, যত সম্পদ আহরণ ও যত বন্দী কয়েদ করা, বা যত হিন্দুকে বলপ্রয়োগে ধর্মান্তরিত করার কথা বলে গেছেন, বাস্তবে সেই সংখ্যাটা মুষ্টিমেয় ধরতে হবে।
তুর্কীদের (মুসলিম নয় কিন্তু) বর্বরতাকে ছোট করার এই আয়োজন দিয়ে আমাদের বোঝানো হয়, যে যদি সত্যিই ঐতিহাসিকদের বর্ণিত সংখ্যায় ঘটনাগুলো ঘটে থাকত, তাহলে সুদীর্ঘ ইসলাম শাসনে সারা ভারতবর্ষই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে যেত। ভারতবর্ষ দীর্ঘ ইসলাম শাসিত থাকার পরেও হিন্দু প্রধান দেশই ছিল – এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে বলপূর্বক ধর্মান্তরণটা নিয়ম নয়, ছিল ব্যতিক্রম মাত্র। যদি কোনও ধর্মীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে থাকে, সেটা ছিল আদর্শগত দিক থেকে, যেমন একদিকে যেরকম ‘সুফি সিলসিলা’ ছিল, সেরকম অন্যদিকে ছিল হিন্দুত্বের নানা পন্থ।
সুতরাং ব্যাপারটা ‘সঠিক দৃষ্টিকোণ’ থেকে বিশুদ্ধ রাজনৈতিক যুদ্ধ হিসাবেই দেখা উচিত, যেখানে কিছু রাজ্য মুসলিম সুলতান শাসিত ছিল তো কিছু রাজ্য ছিল হিন্দু রাজা দ্বারা শাসিত। হিন্দু রাজাদের মতোই মুসলিম সুলতানরা নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মনযোগী ছিলেন। আর হিন্দু সমাজের বিচিত্র জাতিভেদ প্রথার কারণে যদি হিন্দু সমাজ মুসলিম সুলতানদের বিজয় উপহার দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা মুসলিম সুনতানদের দোষ নয়। সুতরাং মহম্মদ হাবিবের ভাষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল নিছক একদিকে ‘স্মৃতি’ ও অন্যদিকে ‘শরিয়ত’-এর মধ্যে।
কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকবৃন্দ
এই পর্যায়ে ইসলামের সাফাই গাইতে ‘কমিউনিস্ট ইতিহাসবিদ’রা নেমে পড়েছে, যারা দায়িত্ব নিয়েই হিন্দু সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মের বিরুদ্ধে যথেষ্ট আপত্তিকর অবস্থান নিয়ে নিয়ে থাকে। কমিউনিস্টরা ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবিদ’দের সর্বাদা দোষ দেয়, যে তাঁরা মধ্যযুগে নিজেদের দিকে আলোকপাত করা এবং মানুষ ও ঘটনাবলীর প্রতি সৎ দৃষ্টি নিক্ষেপ করার বদলে মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গীর তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপারেও অস্বাস্থ্যকর রকম মনোনিবেশ করেন। আমাদের বলা হয়, উচ্চবর্ণের হিন্দুরা চিরকাল হিন্দু সমাজের বৃহদংশকে শোষণ পদদলিত এবং হত্যা করেছে। তাহলে তুর্কীরা পরিস্থিতির চাপে সামান্য কিছু হতভাগ্য দলিতকে হত্যা করেছে বলে কুম্ভীরাশ্রু ফেলার কী আছে?
আমাদের বলা হয়েছে, হিন্দু নারীরাও হিন্দু শাসক গোষ্ঠী দ্বারা যৌন হ্যানস্থা, সম্ভ্রমহানি ও দাসত্বের বলি হয়েছে, যার দ্বারা সমাজে সামান্যতম তরঙ্গটুকু ওঠেনি। তাহলে তুর্কীরা হিন্দু নারীদের দাসত্বমোচন করে হারেমে রেখে কিছুটা সম্মান দিয়ে থাকলে অত হৈচৈ কীসের?
আমাদের বলা হয়, পুরো ভারতবর্ষই গরীব মানুষদের জন্য এক বিশাল কয়েদখানা। তাহলে তুর্কীরা তাদের, মুক্ত করে পৃথিবী দেখাতে বাইরে নিয়ে গিয়ে থাকলে এত গগন বিদারণ কেন?
বৈদিক যুগে কি হিন্দু গোমাংসখোর ছিল না? ব্রাহ্মণ শ্রেণী তাদের পৌরোহিত্যের কাজ কুক্ষিগত না করে না রাখলে তারা এই সুষম খাদ্যটি ত্যাগ করত না। এমন পাগলাটে হল্লা কেন, যদি কিছু ব্রাহ্মণ নিজেদের পুরোনো ও বেশি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাসে ফিরে যায়?
মন্দিরে পুরোহিতদের দ্বাবা সঞ্চিত ধনসম্পদ কি দরীদ্র শ্রমজীবী শ্রেণীকে লুঠ করা টাকায় ছিল না এবং সেগুলো কি অন্ধকূপে সম্পূর্ণ বেকার পড়ে ছিল না? তুর্কীরা এই হিমায়িত সম্পদের কিছু অংশ মুক্ত করে কোনও গঠনমূলক কাজ করে থাকলে, তাই নিয়ে এত হেচৈ করার কী আছে?
আর মূর্তির কথা উঠলে আমাদের বলা হয়, যদিও ঐসব মূর্তিগুলো বহুমূল্য রত্বখচিত সোনা দিয়ে তৈরি, কিন্তু সেগুলো কুসংস্কার ও আদ্যিকালের পুরোহিততন্ত্র ছাড়া আর কিছুরই সূচক ছিল না। তুর্কীরা ঐসব ভগবানরূপী শিশুবলি পিপাসু ছদ্মবেশীদের দুরমুশ করে হিন্দুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিই করেছে।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী মুসলিম বিজয়ের গল্প নিতান্ত সহজ ও সোজাসাপটা। তুর্কীরা শুধু পরাধীন দাসত্বশৃঙ্খলে বন্দী হিন্দুদের অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে সাহায্য করেছিল। ইসলাম সামাজিক সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের বার্তা এনেছিল যা হিন্দু সমাজে জাদুর মতো বিস্ময়কর প্রভাব ফেলে। কবীর, নানক ও রবিদাস এবং অন্যান্য হিন্দু সমাজ সংস্কারকের উদাহরণ দেখলে বোঝা যায়, তাঁরা মুসলিমদের এই বার্তা সঠিকভাবে গ্রহণ করে জাতিহীন ও শ্রেণীহীন ভারতীয় সমাজের জন্যই আন্দোলন করেছিলেন।
ঠিক এই কথাগুলোই সরাসরি কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরা মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে তাঁদের উপস্থাপনায় বলেন না। কিন্তু এটাই হল মনস্তত্ত্ব যা তাঁদের সেই সময়কার ঘটনাবলীর উপস্থাপনাকে চালিত করে। কৈফিয়তদাতা আলিগড়ীরা উমেদাররা স্বস্তির শ্বাস ফেলেন, যে কমিউনিস্ট ইতিহাসবিদরা তাঁদের উদ্ধার করতে নেমে পড়েছেন এবং বিতর্ককে একটা যুক্তির ভিত্তিতে দাঁড় করাতে পারছেন। তাছাড়া যেহেতু অধিকাংশ কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরাই হিন্দু, তাই তাদের অধিকতর বিশ্বাসযোগ্যতাও আছে।
হিন্দুদের সবকিছুকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখার এই কমিউনিস্ট মনস্তত্ত্ব এবং মুসলিমদের সবকিছুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বজায় রাখার চেষ্টা সমাজবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক বলে গর্ব করা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও সঞ্চারিত। এই মনস্তত্ত্বই চুঁইয়ে পড়েছে তাদের মধ্যে যারা ভারতের ইতিহাস নতুন করে লিখতে চায়, বিশেষত মধ্যযুগের মুসলিম শাসনের ইতিহাসকে। এই মনস্তত্ত্বের রাজনীতিকরাও মুসলিম ভোট-ব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে ঘটনার বিকৃতি ঘটান।
ইতিহাসের হিন্দু ঘরানা প্রয়োজন
ইতিহাসবিদদের একটা হিন্দু ঘরানার খুব প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার এখনও কোনও লক্ষণ নেই। আমি তাই মধ্যযুগের মুসলিম শাসন সম্পর্কে কোনও হিন্দু দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উপস্থাপন করতে পারছি না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে মুহূর্তে ঐতিহাসিকদের মধ্যে হিন্দু ঘরানারা জন্ম নেবে, এবং মধ্যযু্গকে মূল্যায়নের দায়িত্ব নেবে, তখন তা মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিদের থেকে ভিন্নমত হয়ে মধ্যযুগের ভারতকে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত রূপেই সনাক্ত করবে, যেখানে ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মুসলিম ঐতিহাসিকদের সঙ্গে তফাৎ হবে, এতদিন যারা নায়ক হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছে, এই ঘরানা তাদের খলনায়ক হিসাবে মূল্যায়ন করবে এবং খলনায়কদের নায়ক হিসাবে। এটা মধ্যযুগে ভারতে ইসলামের তথাকথিত বিজয়কে হয়তো ১৫ শতকে স্পেনে যা পরিণাম হয়েছিল, তার পর থেকে ইসলামের ভোগ করা সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হিসাবেও দেখাতে পারে।
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়