১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা
ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী
অধ্যায় ৩: সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
এরপর আসা যাক NCERT-র পরবর্তী নির্দেশিকায়, যেমন ‘মধ্যযুগকে হিন্দু মুসলিম সংঘাত হিসাবে চিত্রায়িত করায় নিষেধাজ্ঞা’। এর অন্তর্নিহিত উপপাদ্য হল মধ্যযুগের মুসলিম আগ্রাসকরা তাদের প্রতিরোধকারী হিন্দুদের মতোই ভালো ও দেশভক্ত ছিল, এবং যে অসংখ্য যুদ্ধ হিন্দুরা লড়তে বাধ্য হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে, সেগুলো নিছক ঘরোয়া বিবাদ ছাড়া কিছুই ছিল না। যারা আলিগড় ঘরানার ইতিহাস পড়েছে এবং তাদের কমিউনিস্ট দোসররা এই প্রস্তাবের সমর্থনে নানান যুক্তির সঙ্গে ভালোই পরিচিত।
সরলীকৃত সমীকরণ
প্রথমত আলোচ্য, যেসব মুসলিম আগ্রাসক ভারতে বসবাস শুরু করেছিল তারা আর বিদেশী নেই। এই বিন্দুটি নিয়ে আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে ইতিমধ্যে আলোচনা করেছি।
দ্বিতীয়ত, আমাদের বলা হয়েছে, হিন্দু রাজারা শুধু মুসলিম সম্রাটদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দু রাজাদের সঙ্গেও লড়াই করত। অন্যদিকে মুসলিম সম্রাটারাও শুধু হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে নয়, মুসলিম শাসকদের সঙ্গেও লড়াই করত।
তৃতীয়ত, বহু দৃষ্টান্ত দেখানো হয়েছে, যেখানে হিন্দু রাজারা মুসলিম সম্রাটদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে অন্য হিন্দু রাজাকে পরাস্ত করবে বলে, যেখানে মুসলিম বাদশারাও অন্য মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য হিন্দু রাজাদের সাহায্য চেয়ে পেয়েছিল।
সবশেষে আমাদের একটাই যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শাসকরাই একইভাবে ও একই সময়ে পরস্পর যুদ্ধ করতেন নিজেদের অবস্থান উন্নত করার জন্য; এবং এ ব্যাপারে তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মধ্যে কোনও তফাত করার প্রয়োজন নেই।
এই ফর্মুলার অতিসরলীকৃত চরিত্রটি ধরা পড়ে, যখন মধ্যযুগে ঠিক কী হয়েছিল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতে নিজেদের জন্য সাম্রাজ্য বিস্তারে ব্যস্ততার সময় কী হয়, এগুলো আমরা সমান্তরালভাবে বিচার করি।
ব্রিটিশরা অষ্টাদশ শতকের প্রথম চতুর্থাংশের সময় এসেছিল। মুঘল সাম্রাজ্য তখন আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক শাসনে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায়। রাজপুতরা তাদের স্বাতন্ত্র্য পুনরুদ্ধার করছিল। মারাঠা, শিখ ও জাঠেরা রাজনীতির ময়দানে গুরুত্ব অর্জন করছিল।
ব্রিটিশরা তখন এই দেশে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপকারী একমাত্র বহিরাগত ছিল না। পর্তুগীজ় ও ওলপন্দাজরা ব্রিটিশ ও ফরাসীদের কাছে নাকাল ও প্রহৃত হয়েও পরবর্তী ইনিংস শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দক্ষিণ ভারতে দীর্ঘদিন ফরাসীরা ইংরেজদের প্রায় সমতুল্য সময় ও শক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা করছিল। উত্তর পশ্চিমে প্রতিবেশী পারস্য ও আফগানিস্তান থেকে নাদির শাহ ও আহমেদ শাহ আবদালি ডুবন্ত ইসলামী সাম্রাজ্যকে নিজেদের অধিকারে পুরুদ্ধারের চেষ্টায় হাজির হয়।
আপাতদৃষ্টিতে ভারত ছিল সবার জন্য মুক্ত যেখানে প্রতিটি প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে একই সময় লড়ছিল এবং নিজেদের মধ্যে জোট গড়ে তুলছিল। মুসলিমরা মুলসিমদের বিরুদ্ধে লড়তে অমুসলিমদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। মারাঠারা মাঠাদের সঙ্গে বিবাদে অমারাঠাদের সঙ্গে সমঝোতা করে। একইভাবে রাজপুত, শিখ ও জাঠেরাও তাই করে। আর সকলেই সম্প্রদায় ও জাতি নির্বিশেষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একক বা জোটবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অন্যদিকে ব্রিটিশরা একই সঙ্গে ফরাসী ও ওলোন্দাজদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করছিল, আবার স্থানীয় শক্তিগুলোর সঙ্গেও। তারা কখনও এই নেটিভের সঙ্গে মিত্রতা করে তো কখনও তার সঙ্গে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সময় ধরে দেশী ও বিদেশী শক্তিগুলির সেই সংঘাত ও সহযোগিতার সমবায় ও বিন্যাস সহজে বিবৃত করা সম্ভব নয়।
তাই উক্ত সময়টার চরিত্র কি এভাবে দেখাটাই কি উচিত নয়, যে ঘরোয়া ও বৈদেশিক বিবাদে ব্রিটিশরা ছিল একটি শক্তি মাত্র? NCERT-র ঐতিহাসিকরা প্রথম ঐ জট পাকানো ভয়াবহ সময়টাতে দেশী ও বিদেশী, দেশপ্রেমী ও সাম্রাজ্যবাদী এসব চেনার চেষ্টা করে। কিন্তু এই জিগ-শ-পাজ়ল বা গোলকধাঁধাকে বিশ্লেষণ করার আগে তাদের একটা উপযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তোলার উপদেশ দেওয়া উচিত।
উপযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গী
সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী কী? এক্ষেত্রে বিভিন্ন ইতিহাস ও চরিত্রের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে দৃষ্টিভঙ্গী হতে হবে নিম্নলিখিত:
১. মুঘল সাম্রাজ্য ভারতে একটি বহিরাগত আরোপিত শক্তি যা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে চলেছে;
২. রাজপুত, মারাঠা, শিখ ও জাঠরা নিজেদের ভূমিতে নিজেদের পিতৃপুরুষের অধিকার দাবি করতে উঠে আসছিল;
৩. প্রাদেশিক মুসলিম সামন্তপ্রভূরা নিজেদের স্বার্থেই পেছনে থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের কিছু অংশ উদ্ধার করতে চাইছিল;
৪. মুসলিম সামন্তরা সীমান্ত জুড়ে অন্যান্য ইসলামী সাম্রাজ্যবাদীদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল জটিল আবর্তের মধ্যে থেকে পূর্ববর্তী ইসলামী সাম্রাজ্য উদ্ধারের চেষ্টায়;
৫. ব্রিটিশ, ফরাসী ও অন্যান্যরা ঘোলাজলে মাছ ধরার মতো স্থানীয় ও মুসলিমদের অনুপযোগিতার সুযোগ নিচ্ছিল নিজেদের দখল নিশ্চিত করার জন্য।
এই দৃষ্টীকোণ দ্বারা মারাঠাদেরকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হেরে নতুন সাম্রাজ্যবাদকে ভারতে অনুপ্রবেশের পথ দেওয়ায় একটু কঠিনভাবে বিচার করা হয়েছে। কারণ সেই সময় ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে একমাত্র মারাঠারাই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ছিল, যার দ্বারা ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকেও রক্ষা করতে পারত।
মধ্যযুগে ভারতের অন্তর্বর্তী বহুমুখী কলহকে তুলে ধরতে অনুরূপ দৃষ্টিকোণ অবলম্বন করাতে আমাদের দ্বিধা কীসের? কলহ বা দ্বন্দ্বকে এভাবে সাজানো যায়:
১. ইসলামী আগ্রাসনের প্রাক্কালে ভারতে বহু হিন্দু রাজপুরুষরা নিজেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতা অর্জনের জন্য দ্বন্দ্ব লিপ্ত ছিল।
২. বহিরাগত মুসলিম আগ্রাসকরা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একে একে হিন্দু রাজকুমারদের পরাস্ত করে এবং একের এক নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
৩. প্রত্যেকটি ইসলামী সাম্রাজ্য নতুনতর হিন্দু প্রতিরোধ দ্বারা ধ্বস্ত হয়ে অকস্মাৎ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়;
৪. প্রতিবার নতুন ইসলামী হানাদার এসে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে যতদিন না ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আবির্ভাব হয়।
৫. কখনও কখনও দুর্বল মুসলিম সাম্রাজ্য বহিরাগত মুসলিম হানাদারদের যুঝতে হিন্দু শক্তিদের কাছেও সাহায্য নিয়েছিল।
ইসলামী আগ্রাসনের প্রাক্কালে ও পরবর্তীতেও হিন্দু রাজকুমাররা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল মানে এই নয়, যে ইসলামি হানাদাররা বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী ছিল না। আবার হিন্দু রাজকুমাররা কখনও সখনও মুসলিম রাজকুমারদের সঙ্গে হাত মিলয়ে নতুন বহিরাগত মুসলিম আগ্রসকদের প্রতিহত করেতে চেষ্টা করেছিল বলেই মুসলিম রাজপুরুষদের দেশপ্রেমী বলা যায়। হিন্দু রাজকুমাররা লড়াই করছিলেন তাদের জন্মভূমি ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষার্থে। অন্যদিকে মুসলিম রাজকুমাররা লড়ছিল নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতা প্রসারিত করার ও যে সুবিধা তারা পূর্বে ভোগ করে এসেছিল, তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে।
মধ্য ও আধুনিক যুগের মধ্যে একটাই পার্থক্য – মুসলিম সাম্রাজ্যবাদীদের মতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করেনি। কিন্তু এই পার্থক্য নিতান্ত সামান্য ও গৌণ যার ভিত্তিতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আলাদা করা যায় না। আমাদের এটাও ভাবতে হবে, দিল্লীতে স্থায়ীভাবে বসত করা মামলুকের সময় থেকে ব্রিটিশদের মারাঠা অধিকৃত অঞ্চল ‘মুক্ত’ করার সময় সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ভারতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও সুযোগ-সুবিধা দখলের জন্য মুসলিম রাজকুমারদের মধ্যে পারস্পরিক কলহ এই সত্যটি বদলাতে পারে না, যে স্থানীয় হিন্দুদের বেলা তারা সকলেই একইরকম শত্রু এবং অত্যাচারী ছিল। আবার একই সময়ে হিন্দু রাজকুমাররা একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন বলেই তাঁদেরকে বহিরাগত মুসলিম হানাদারদের সঙ্গে একই পংক্তিতে বসনো যায় না।
এই দৃষ্টিভঙ্গীতেই আমরা হিন্দু রাজকুমারের কতগুলো ব্যাপারে একত্রিত হতে ব্যর্থতার জন্য কঠোর সমালোচনা করেছি। যেমন: ১) ভারতে প্রথমবার আক্রমণকারী ইসলামী হানাদারকে প্রতিহত করাতে ব্যর্থতা; ২) নতুনতর হিন্দু প্রতিরোধ দ্বারা সেই হামলাবাজরা দুর্বল হয়ে যাওয়ার পরেও তাকে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দেওয়াতে ব্যর্থতা; এবং ৩) নতুন ইসলামী আক্রমণকারীদের দ্বারা হিন্দুদের মৃত্যুর, অসম্মান ও হতাশা ঠেলে দেওয়া তাণ্ডব প্রতিরোধ করতে ব্যর্থতা।
সময় সরণী বেয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তির জাতীয় সংগ্রামের দিকে অন্তরঙ্গ দৃষ্টিপাত করা যাক। এখানেও আমাদের একই মিশ্র পরিস্থিতি রয়েছে, এবং এটিকেও ঝাড়াই বাছাই করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়েছে। আমাদের উদারপন্থী এবং সংবিধানবাদীরা একই সময় উগ্রবাদী ও আন্দোলনবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। পরবর্তীকালে আমাদের অহিংস অসহযোগকারী এবং বিপ্লবীরা একে অপরকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারপরেও আমাদের বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দখল করার জন্য লড়াই করতে দেখেছি। পাশাপাশি, আমাদের হিন্দু মহাসভাও ছিল যা ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করেছিল, কিন্তু ইসলামী সাম্রাজ্যবাদকে তুষ্ট করার কংগ্রেসী সংস্কৃতিতে অংশ নেয়নি। এবং আমাদের মধ্যে সেই হিন্দু রাজকুমাররাও ছিল, যাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখে ভীত হয়ে ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ ব্রিটিশদের বাহ্যিকভাবে চাটুকারিতা করলেও জাতীয় সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং গোপনে তাতে সাহায্যও করেন।
একই সঙ্গে, দৃশ্যটি গুলিয়ে দেয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ইতিপূর্বে সাহায্য করে আসা মুসলিম লীগ নামক সেই শৃগাল, যে ওঁৎ পেতে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে যেটুকু দাবিদাওয়া আদায় করতে সমর্থ হয়, তার সিংহভাগ ঝাঁপিয়ে হস্তগত করার জন্য। আর একটি বিভ্রান্তিমূলক কারণ ছিল সোভিয়েত পঞ্চম কলাম– ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, যা বছরের পর বছর ধরে ‘বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী’ বলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমালোচনা ও বিদ্রূপ করেছে, কিন্তু শেষে যুদ্ধটির চূড়ান্ত পর্বে যোগদানের সময় নিজেরাই সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে চলে যায়।
এখন এই নাটকটিকে আমরা কীভাবে দেখব, যেখানে এতগুলি চরিত্র এতগুলি ভূমিকায় অভিনয় করেছিল? আমরা কি ব্রিটিশদেরকে সাম্রাজ্যবাদী অভিযোগ থেকে শুধু এই কারণে মুক্ত করতে পারি, যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রামীরা নিজেদের মধ্যেও লড়ছিল? ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসনকে কিছু হিন্দু রাজকুমার সহযোগিতা করছিল, শুধু কারণেই কি তাকে সাম্রাজ্যবাদী হিসাবে সনাক্ত করব না? একটি বড় সমস্যা নিয়ে কংগ্রেসের সাথে সংঘাতের কারণেই কি আমরা হিন্দু মহাসভার দেশপ্রেম অস্বীকার করব? পরবর্তীতে ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রাক্কালে ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষদের সঙ্গে কিছুটা মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল, শুধু এই কারণেই কি মুসলিম লীগকে শবভূক ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলা যাবে না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত রাশিয়া ব্রিটেনের সাথে লুটপাট ভাগাভাগি নিয়ে কলহে লিপ্ত হওয়ার পরই ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালানোর চেষ্টা চালায় – শুধু এই কারণেই কি সোভিয়েত পঞ্চম কলামটি আমাদের দেশপ্রেমিক ভ্রাতৃসম হয়ে ওঠে?
এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর স্ফটিক স্বচ্ছ, কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী এখনও বিকৃত হয়ে যায়নি। (এনসিইআরটি নির্দেশিকা এখন এটিকেও বিকৃত করার চেষ্টা করছে)।
দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবের যুক্তি
কিন্তু একজন সেই অবস্থাটা কল্পনা করতে পারে, যখন খ্রিস্টান মিশনারীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিরাট সংখ্যক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করতে সফল হবে। খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরতিরাও তখন তাদের সমধর্মাবলম্বী ব্রিটিশদের বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রসক হিসাবে সনাক্ত করায় আপত্তি করবে। যারা ব্রিটিশ শাসকদের হিন্দু শাসকদের মতোই দেশীয় মনে করে না, ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরা তাদের ভোট দেবে না। সেই অবস্থায় ব্রিটিশদের ভারতের পক্ষে মহান উপকারী হিসাবে গৌরবান্বিত না করলে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরাও রাস্তায় বেরিয়ে এসে দাঙ্গা করতে পারে।
তখন হয়তো ‘জাতীয় সংহতি পরিষদ (National Integration Council)-এর আরেকটি প্রভাবশালী সভা হবে যা শিক্ষা মন্ত্রককে নির্দেশ দেবে, যাতে NCERT নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য আবার নতুন একদফা নির্দেশিকার উদ্ভব করে। এই নির্দেশিকা তাদের খুব পরিচিত লাগবে, যাদের কাছে এনসিইআরটি-র নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী ইতিহাস পরিবেশিত হয়েছে। ভারতে ব্রিটিশ শাসনকাল সম্পর্কে তারা পড়বে: ‘ব্রিটিশ শাসকদের বিদেশী হিসাবে সনাক্ত করা যাবে না। ব্রিটিশ যুগকে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিদেশী শাসকদের মধ্যে সংঘাত হিসাবে চরিত্রায়িত করা চলবে না। ব্রিটিশ আমলাদের শাসক ও ভারতীয়দের প্রজা হিসাবেও সনাক্ত করা চলবে না। ব্রিটিশ শাসনকালে অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক ক্ষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া চলবে না।’
স্বাধীনতা সংগ্রামে নায়ক ও খলনায়কদের ঠাস চরিত্রায়ন এই নতুন পরিবেশনায় একইরকম আগ্রহোদ্দীপক মনে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তখন ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতার ইঁদুর দৌড়ে শামিল পাতি রাজনৈতিক চরিত্র মনে হবে। মহাত্মা গান্ধীও ‘জাতির পিতা’ আসন থেকে চ্যুত হয়ে বিড়লাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষাকারী সামান্য বেনিয়া প্রতিভাত হবেন! নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসও ভারতপ্রেমী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জার্মান ও জাপানের ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে দেশদ্রোহী সাব্যস্ত হবেন! আর পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে বিদ্রূপ করা হবে ডন কুইকজ়োটের মতো বাস্তববোধহীন হিসাবে, যিনি যে স্বাধীনতায় কখনই গ্রহণ লাগেনি, সেই স্বাধীনতা চাওয়ার মতো হাস্যকর প্রস্তাবে সভাপতিত্ব করেছিলেন!
অন্যদিকে ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস, কর্নওয়ালিস, ওয়েলেসলি, ডালহৌসি ও কার্জ়নকে দেশপ্রেমী সিংহহৃদয় হিসাবে মতো মহিমান্বিত করা হবে, যাঁরা আমাদের Pax Brittania-র অনুরূপ শান্তি ও সুস্থিতি দিয়েছিলেন, ঠগ ও পিণ্ডারি দস্যুদের দমন করেছিলেন, যাঁরা ‘সতী’র মতো সমাজিক কুপ্রথা দূর করেন, যাঁরা বিধবা বিবাহকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন, এবং যাঁরা এই বিশাল ভূখনণ্ডকে রাজপথ, রেললাইন, খাল, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ইত্যাদি অগণিত সুবিধা দিয়ে ছেয়ে ফেলেন!
মহম্মদ আলি জিন্নাও সেক্ষত্রে দেবদূত প্রতিভাত হবেন, যিনি ব্রিটিশরা যখন অরাজকতায় ক্লান্ত হয়ে সব ছেড়ে দিতে চাইছিল, তখন ব্রিটিশদের দায়িত্ব আংশিক কমানোর জন্য এগিয়ে আসেন! পি.সি. জোশীকে মহান রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে মহিমান্বিত করা হবে, যিনি ভারতকে জাপানি সাম্রাজ্যবাদ থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট ব্রিটিশদের রণোদ্যোগে জল ঢালতে উন্মত্ত কংগ্রেসকে বাধা দেন এবং যিনি কংগ্রেস ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতায়ন যখন কিছুতেই প্রতিহত করা যাচ্ছিল না, সেই সময় পাকিস্তানের দাবিকে সমর্থন জানান।
এই NCERT প্রণীত এই নতুন পরিকল্পনা থেকে যুক্তিগ্রাহ্য যে তাৎপর্য বেরিয়ে আসে, তা দূরগত দুঃস্বপ্নের মতো, যা আমাদের বর্তমানকে হয়তো অবশ করছে না; কিন্তু মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে আমরা ইতিমধ্যে সেই ভ্রমে ভরা দুঃস্বপ্নের মধ্যেই আকণ্ঠ ডুবে আছি।
প্রমাণ ছাড়া যারা বিশ্বাস করে না, তাদের জন্য উল্লেখ আছে Indian History Congress-এর পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন দিল্লীর People’s Publishing House দ্বারা প্রকাশিত A Comprehensive History of India-র ৫ম খণ্ডে। ভারতের সুলতানী ইতিহাস সম্পাদনা করা মহম্মদ হাবিব তাঁর গল্প শুরু করেছেন আরবে পয়গম্বর মহম্মদের উন্মেষ থেকে, এবং ভারতের মুসলিম শাসনকে সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা ও ইওরোপ জুড়ে মুসলিম শাসনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে দেখিয়েছেন। তিনি এটাকে খুবই উজ্জ্বল মখমলের মতো মসৃণ পর্ব হিসাবেই দেখেছেন যা মাঝেমধ্যে চেঙ্গিজ় খাঁ ও হালাকু-র মতো বর্বরদের দ্বারা ছিন্ন হয়েছে। ১১৯২ সাল প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, পৃথ্বীরাজ চৌহানকে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়! পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সময়কার ঐতিহাসিকরাও এই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে একই কথা বলতে পারেন তাঁতিয়া টোপী, কুকাবৃন্দ ও ভগৎ সিং-এর মতো বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে।
যদি এই যুক্তিগ্রাহ্য অবধারিত প্রভাব এড়িয়ে যেতে চাই, তাহলে ভোট শিকারী রাজনীতির স্বার্থ রক্ষা না করে তথ্যকে বিকৃত না করে সোজাসুজি উপস্থাপন করা হোক। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ছলে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ বা ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’র দাবিদার কমিউনিস্টদেরকেও ইতিহাসের বিকৃত উপস্থাপনা করতে দেব না।
তথ্যগুলো থেকে এক বিন্দু সন্দেহের অবকাশ থাকে না, যে ইসলামী শাসনে মধ্যযুগ ছিল হিন্দু মুসলিমের মধ্যে আবিরাম সংঘর্ষের সময়। হিন্দুরা ছিল দেশপ্রেমী যারা নিজেদের মাতৃভূমি ও পিতৃপুরুষের উত্তরাধিকারসূত্রে লব্ধ সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করছিল। অন্যদিকে মুসলিমরা ছিল অপরাধপ্রবণ মতবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত যাবাবর চরিত্রের সাম্রাজ্যবাদী হানাদার, যারা হিন্দুদের ওপর নিজেদের যাবতীয় কিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছিল।
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়