১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা
ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী
অধ্যায় ১১: আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ থেকে
মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আর একটি বড় এনসিইআরটি নির্দেশিকা হল – সংশ্লেষ ও আত্তীকরণের প্রবণতা ও প্রক্রিয়া অবহেলা করা ও বাদ দেওয়া এবং জাতীয় সংহতির নামে একটি পূর্বনির্ধারিত সংমিশ্রিত সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো।
বাম হাত কী করেছে ডান হাত জানে না। প্রথমে আমাদের বলা হয়েছে যে ইসলামী আক্রমণকারীদের বিদেশী হিসাবে দেখানো চলবে না। এর পরে বলা হচ্ছে আমাদের আত্তীকরণ ও সংশ্লেষণের প্রবণতা ও প্রক্রিয়াগুলি অবহেলা না করার জন্য। একজন যথাযথভাবে প্রশ্ন তুলতেই পারে: ইসলামী হানাদার বাহিনী যদি বিদেশী না হত, তাহলে কীসের সঙ্গে কার সংশ্লেষ করা হচ্ছিল? এই হানাদাররা তাদের সাথে যে সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিল তা যদি বিদেশী না হয়ে থাকে, তবে কীসের আত্তীকরণ ঘটছিল? আর বহিরাগত ইসলামী সংস্কৃতি আদি আভ্যন্তরীণ হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে উদ্দেশ্যগত সংঘাতে লিপ্ত না থাকলে সম্মিলিত সংস্কৃতির উদ্ভাবন ও প্রচারের প্রয়োজনীয়তাই বা কোথায়?
ইসলামী আক্রমণকারীরাই ভারতে এসে বসতি স্থাপনকারী প্রথম বিদেশী ছিল না। পূর্ববর্তী সময়ে ইরানী, গ্রীক, পার্থিয়ান, সিথিয়ান, কুশান এবং হুনারাও ভারত আক্রমণ করেছিল এবং এখানে এসে থিতু হয়েছিল। উত্তর ও উত্তর-পূর্বে কিছু মঙ্গোলীয় আক্রমণও ঘটেছিল। কিন্তু ইসলামী হানাদার বাহিনী ভারতে আসার পরে এই সমস্ত বিদেশী মূল নিবাসীদের সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের সংস্কৃতি মূল নিবাসী ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে প্রকৃতই সংশ্লেষিত হয়েছিল। আমাদের কাছে কখনও ইরানী, পার্থিয়ান, গ্রীক, সিথিয়ান, কুশান, হুন বা মঙ্গোলিয়ানরা সংখ্যালঘু সংস্কৃতি বা সমস্যা ছিল না।
অন্যদিকে পারসিকরা মুসলমানদের সাথে প্রায় একই সময়ে ভারতে এসেছিল। তারা তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যযুক্ত সংস্কৃতির সাথে একটি স্বতন্ত্র সংখ্যা হয়ে রয়ে গেছে। আদি হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পার্সীদের আত্তীকরণ বা হিন্দু সংস্কৃতির সাথে পার্সী সংস্কৃতির সংশ্লেষণের কথা বলতে কোনও ইতিহাসবিদ, বা সমাজবিজ্ঞানী বা রাজনীতিবিদদের কখনও শোনা যায়নি। কিছুদিন আগে অবধি আমাদের মধ্যে একটি ইহুদি সংখ্যালঘু বসবাস করেছে, যারা হিন্দুদের জন্য কোনও সামাজিক রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সমস্যা তৈরি না করেই প্রায় দুই হাজার বছর ধরে নিজেদের বর্ণ ও সাংস্কৃতিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। দক্ষিণ ভারতে সিরিয়ান খ্রিস্টানরা আর একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু ছিল যারা প্রাথমিক খ্রিস্টান জনসংখ্যারই পরে একটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশ, তারা কখনও স্থানীয়দের জন্য বিপদ হয়ে ওঠেনি বা বিপন্ন বোধও করেনি, যতদিন না পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ভোরের সাথে আসতে শুরু করা জঙ্গী মিশনারিরা তাদেরকে বজ্জাতির জন্য ওস্কায়।
আমি যে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে চাই তা হল, বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীগুলির একীভূত হওয়া বা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আগে আগে তাদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির পরষ্পর আত্তীকৃত বা সংশ্লেষিত হওয়া জরুরি নয়। যখনই কোনও সংস্কৃতি একচেটিয়া অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তখন গভীর জলে তলিয়ে যায়।
মুসলিমরা সর্বত্র সমস্যা
একা ভারতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীই মুসলমানদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহ-অস্তিত্ব অর্জন করা অসম্ভব বলে মনে করেনি। মুসলিম জনসংখ্যাকে বহিষ্কার করার আগে পর্যন্ত গ্রীসে একই সমস্যা ছিল। পশ্চিমে যুগোস্লাভিয়া ও সাইপ্রাস এবং পূর্বের ফিলিপাইনস-এও আজ পর্যন্ত মুসলিম সমস্যা একটি অমীমাংসিত বিষয় রয়ে গেছে। স্পেনের কোনও মুসলিম সমস্যা নেই কারণ, তারা কয়েক শতাব্দী ধরে ছড়িয়ে পড়া লড়াইয়ে মুসলিম আক্রমণকারীদের পরাজিত করার পরে মুসলমানদের তার সীমান্তের মধ্যে থাকতে দেয়নি। রাশিয়া এবং চীন আপাতত তাদের মুসলিম সমস্যা সমাধান করেছে – বেশিরভাগ সন্ত্রাস এবং নির্মম দমন-পীড়নের মাধ্যমে। কতক্ষণ সংঘর্ষ বা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলবে সেটাই প্রশ্ন।
অন্যদিকে, যেসব দেশে ইসলামের অদ্বিতীয় ক্ষমতা অর্জন হয়েছে, সেসব কোনও দেশই অমুসলিম সংখ্যালঘুদের তারা বাঁচতে দেয়নি। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের নবী নিজেই ‘জিম্মি’র মর্যাদা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের জন্মভূমিতে তাদের কী অবস্থা হয়েছে? কয়েক শতাব্দী ধরে নীরব নিপীড়ন ও অপমান সহ্য করানোর পরে ইহুদিদের অবশেষে সমস্ত ইসলামী দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। খ্রিস্টান সংখ্যালঘুরাও একই পরিণতি ভোগ করেছে। মিশর এবং লেবাননের মতো যেখানে খ্রিস্টান সংখ্যালঘুরা কোনওমতে বেঁচে থাকতে পেরেছে, সেখানে তাদের খবই কঠিন সময় যাচ্ছে ‘ইসলামী মৌলবাদ’ হিসাবে আখ্যায়িত হওয়া ইসলামের সর্বশেষতম তরঙ্গের তত্বাবধানে। ইরানে আর কোনও জ়োরোঅস্ট্রিয়ান নেই। এখন এটাই গভীর প্রশ্নের, পেট্রোডোলার পুষ্ট নবীন ইসলামিক আগ্রাসনে বালি ও মালয়েশিয়ার হিন্দুরা আর কতদিন বেঁচে থাকবে। যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দুরা তাদের রক্ত ঝরিয়েছিল, সেখানে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে এবং তাদেরকে হত্যা করা ও শিকার করে তাড়ানো হচ্ছে।
ভারতে শাসিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক শ্রেণী একটি সংযুক্ত সংস্কৃতি তৈরি করে মুসলিম সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে, যা তাদের মতে মধ্যযুগে ভারতে ইসলামিক আগ্রাসনের পরে মুসলিম শাসনে গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। আমি তাদের সাফল্য কামনা করি। তবে আমি গুরুতর সন্দেহ করি, যে এই সমাধানটি কখনই কি একটি পোক্ত বাস্তবতায় পরিণত হবে।
সংমিশ্রিত বা যৌগিক সংস্কৃতিটি কী?
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার পৃষ্ঠপোষক সাধক পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এই যৌগিক সংস্কৃতির বীজকে মুসলিম হারেমে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছিলেন, যেখানে প্রচুর সংখ্যক হিন্দু নারীকে জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মন্তব্য আমন্ত্রণ করার পক্ষে প্রস্তাবটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক রকম ভ্রান্ত। স্থানীয় মহিলারা সবসময় বিদেশী হানাদারদের জন্য একটি খেলা হয়ে থাকে। যদি সেই হিন্দু মহিলাদের তাদের জন্মগত ধর্ম ধরে রাখার অনুমতি দেওয়া হত, বা আরও ভালো যদি হিন্দু পুরুষদেরও মুসলিম মহিলাদের সাথে বিবাহ করার অনুমতি দেওয়া হত, তাহলে এই প্রক্রিয়াটির কিছু অর্থ দাঁড়াতে পারত। ভারতের বহু মুসলিমের বর্তমানে এক পক্ষের উত্তরাধিকার অসহায় মধ্যযুগীয় হিন্দু মহিলাদের তরফ থেকে। কিন্তু তাদের মধ্যে কতজন তাদের হিন্দু উত্তরাধিকার নিয়ে গর্বিত? একমুখী রাস্তাকে বাই-লেনের হাইওয়ে হিসাবে অভিহিত করা উচিত নয়।
সমগোত্রীয় আরেক শ্রেণী এই ধারণা পোষণ করে এসেছে, মুসলিম রাজ্যগুলোর হিন্দু কর্মচারীরা এবং কিছু হিন্দু শাসক ও ধনী ব্যক্তিরা মুসলিম পোশাক ও আদব কায়দা অবলম্বন করতে শুরু করে এবং ফারসী ভাষা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা আরম্ভ করে। কিন্তু সেটাকেও বড়ো জোর সাংস্কৃতিক আরোপ বা অনুকরণ বলা যায়। এখানেও প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি হল: একটি অণুবীক্ষণ সংখ্যালঘু ব্যতীত মুসলিম হামলাবাজরা কি কখনও কোনও হিন্দু পোষাক পরিধান করেছিল, বা কোনও হিন্দু শিষ্টাচার আচার বিচার গ্রহণ করেছিল, বা কোনও এদেশীয় মূল ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল? বাল্য বিবাহ ও পর্দা প্রথা যেগুলো হিন্দুরা মুসলিমদের কাছ থেকে শিখেছিল, সেগুলোকে আর যাই হোক সংস্কৃতি বলা যায় না। হিন্দুদের কাছ থেকে মুসলমানরা যে ‘পান’ খেতে শিখেছিল বা হিন্দুরা মুসলমানদের কাছ থেকে যে ‘হেনা’ ব্যবহার করতে শিখেছিল, তার পক্ষে তবু কিছু বলা যেতে পারে। তবে এগুলি কোনওটাই হিন্দু বা মুসলিম সংস্কৃতির তেমন উল্লেখযোগ্য অঙ্গ নয়। হালুয়া, শরবত, গুলকন্দ, আচকান, চাপকান, চাপাটি, খরবুজা (খরমুজ) ও তরবুজ (তরমুজ) এসবের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
একই ধর্মনিরপেক্ষ উপজাতির আরও কিছু স্তম্ভরা বহু সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য যা মূলতগতভাবে হিন্দু ছিল এবং যেগুলো বর্তমানে মূলত মুসলমান বিশেষত কৃষক ও কারিগর সম্প্রদায়ের লোকেরাই প্রদর্শন করে, তার উদাহরণ দেবেন। তারা ভুলে যায় যে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেন হিন্দু ধর্মান্তরিতরা যারা বাধ্য হয়ে বা ইসলামের আওতায় প্ররোচিত হয়ে চলে যাওয়ার পরেও অনেক দেশীয় রীতিনীতি ধরে রেখেছে। তাদের এই অভ্যাস বা ব্যর্থতার জন্যই স্থানীয় মুসলমানরা সহধর্মাবলম্বীদের দ্বারা ‘আশরফ’ বলে ঘৃণিত হয়েছে (বিদেশী বংশোদ্ভূত মুসলমান) ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের ফাটা রেকর্ড বাজিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও। মোল্লারা আদিম ‘জাহিলিয়া’র অবশিষ্টাংশ মুসলমানদের শুদ্ধ করার জন্য ধারাবাহিকভাবে তাবলীগের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষ তাদের অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করার চেষ্টায় বেশ কয়েকটি আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে – ধর্মান্তরিতকে এতটা পরিপূর্ণরূপে ইসলামীকরণ করা হোক, যাতে তাদের পূর্ববর্তী হিন্দু সংস্কৃতির কোনও চিহ্ন তাদের চেতনা বা বহিরঙ্গের জীবনে থেকে না যায়।
স্থাপত্যে নয়
মিশ্র সংস্কৃতির কয়েকজন প্রবক্তা হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্য ঐতিহ্যের মিলনকে কেন্দ্র করে এক ভাবের জগতে চলে যায়। মুসলিম শাসকরা অনেক মসজিদ, মাজার, খানকাহ, প্রাসাদ এবং বনভোজনের জায়গা বা পিকনিক স্পট নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই সৌধগুলিতে ব্যবহৃত উপকরণগুলি ভারতীয় বংশোদ্ভূত হতেই নেওয়া হয়েছিল। নিম্ন স্তরের দক্ষতায় নিযুক্ত মানুষেরা যেমন রাজমিস্ত্রি ও শ্রমিক – এরাও ছিল দেশীয়। এই স্মৃতিসৌধগুলিতে তাই হিন্দু স্থাপত্য শৈলীর একাধিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অন্যদিকে, কিছু হিন্দু শাসক এবং ধনী ব্যক্তিরাও স্মৃতিসৌধতে গম্বুজ এবং সত্য খিলান এসব তৈরি করিয়েছিল – স্থাপত্যের যে দুটি উপাদান মুসলমানরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ধার করে নিয়ে ভারতে নিয়ে এসেছিল। তবে বিদেশী শাসকরা সর্বত্র দেশীয় উপকরণ, দেশীয় দক্ষতা, এমনকি নিজেদের শক্তি ও সম্পদ চিয়াত্রিত করার নিমিত্ত নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভগুলি তৈরি ক্ষেত্রেও দেশীয় শৈলীই ব্যবহার করেছে। কিছু দেশীয় প্রজা অবশ্য সর্বদা তাদের বিদেশী প্রভূদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার চেষ্টা করেছে।
এই স্মৃতিসৌধগুলি তৈরিতে যা সংশ্লেষ ও সংমিশ্রণ ঘটেছে তা বিশুদ্ধ বহিরাঙ্গ স্তরে সংঘটিত হয়েছে এবং এটি সম্পূর্ণরূপে বাহ্যিক পরিস্থিতির ফলাফল। আমি ভেবেছিলাম একীকরণ এবং সংশ্লেষণ বলতে বুঝি কিছু অভ্যন্তরীণ মিলন, কিছু মানসিক প্রক্রিয়াও বোঝাচ্ছে। যে কটি হিন্দু মন্দির বা হিন্দু সাধুদের সমাধি কিছু মুসলিম রাজা দ্বারা নির্মিত, এমনকি অর্থসাহায্য করা পৃষ্ঠপোষকিত, সেগুলো সংশ্লেষণের লক্ষণ হতে পারে। কিন্তু আমরা এই জাতীয় লক্ষণগুলির জন্য নিরর্থক অর্থ অনুসন্ধান করি। অন্যদিকে আমরা অনেক মসজিদ, মাজার, কানকাহ ও ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা হিন্দু মন্দির, সমাধি, বিহার এবং প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দ্বারা একই স্থানে নির্মিত বহু স্থান ও প্রাসাদও দেখতে পাই। তারপরেও কোনও হিন্দু মন্দির বা সমাধির রীতিতে নির্মিত মসজিদ বা মাজার খুঁজে পাওয়া শক্ত, যা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
চিত্র, সঙ্গীত বা নৃত্যে নয়
মুঘল আমল অবধি ভারতে মুসলমানরা কোনও চিত্রকলারই পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। মুঘল মিনিয়েচার বলে খ্যাত চিত্রকলা ছিল পুরোপুরি পার্সী ঘরানার, এমনকি সেগুলো হিন্দু রাজপুত হিন্দু রাজকুমারদের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত ও হিন্দু শিল্পীদের দ্বারা অঙ্কিত হয়ে থাকলেও। রাজপুত ও অন্যান্য হিন্দু শৈলীর চিত্রকলাগুলো কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন আত্মায় শ্বাস নেয় এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন উত্স থেকে অনুপ্ররিত। এখানে কোনও সংশ্লেষণ বা সংমিশ্রণ বা এমনকি পারস্পরিক প্রভাবেরও গল্প নেই।
একমাত্র হিন্দুস্তানি ধ্রূপদী সঙ্গীতের ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই হিন্দু ও মুসলমানরা একই ঐতিহ্যের শরিক। কিন্তু বহু মুসলিম সতীজ্ঞই এটার ইসলামীকরণ ঘটাননি কারণ ইসলামের নিজস্ব কোনও সঙ্গীত ছিলই না। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পাবে বলে কিছু হিন্দু সংঙ্গীতজ্ঞ ইসলাম গ্রহণ করেছিল মানে এই নয়, যে তাদের সঙ্গীতও একইভাবে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। সুফিদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হওয়া কাওয়ালি সম্ভবত ইসলামের একমাত্র অবদান। তবে এটি মুসলিম সমাজ, বিশেষত মুসলিম দরগা ও মাজারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। হিন্দুরা তাদের নিজস্ব শ্রুতি ও শৈলীতে নিজস্ব উপাসনালয়ে নিজস্ব ভজন গায়।
নাচ ও নাটকের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। প্রধান ঘরানা ও শৈলীগুলি খাঁটি হিন্দু থেকে যায় কখনও কখনও মুসলিম রাজপুরুষদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে থাকলেও। বেশ্যাদের গাওয়া ‘মুজরাহ’ সম্ভবত একমাত্র মুসলিম অবদান, যা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের দুশ্চরিত্র দ্বারাই পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত। বাকি সমগ্র ভারতবর্ষের যাবতীয় লোকনৃত্য ও লোকনাট্য, যেমন – সোয়াং, ভাংড়া, যাত্রা, নৌটঙ্কী, তামাশা, ওদিকে দক্ষিণ ভারতীয় মঞ্চ ছিল পোশাক ও ভাবভঙ্গিমায় আদ্যন্ত হিন্দু। এটা একেবারেই অন্য ব্যাপার, যে মোল্লারা রেগে ভ্রূকুটি করলেও মুসলিম জনগণ এই অনুষ্ঠানগুলো আন্তরিকভাবে উপভোগ করত। তবে এই অনুষ্ঠানগুলিতে মুসলিম শ্রোতাদের উপস্থিতি সম্মিলিত সংস্কৃতির কিছুই প্রমাণ করে না। এর একটাই অর্থ – ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরেও ধর্মান্তরিত মুসলিম জনগণ কিছু হিন্দু রুচি ধরে রেখেছিল।
বিজ্ঞান বা সাহিত্যেও নয়
মুসলমানদের সর্বদা হিন্দুদের কাছ থেকে অনেক কিছু শুধু শেখার ছিল, আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে শেখানোর তো বিশেষ কিছু ছিলই না। তারা তাদের সাথে বিজ্ঞান বলতে কেবল গ্রীক ঔষধ ব্যবস্থা নিয়ে আসে। তবে হিন্দুরা ইসলামের আবির্ভাবের আগেও এই পদ্ধতির সাথে বিশেষ অপরিচিত ছিল না। বহু হিন্দু এই হাকিমি ঔষধ ব্যবস্থায় বিশেষজ্ঞ হয়েছেন এবং বহু হিন্দু বহু বছর ধরে এর দ্বারা উপকৃতও হয়েছে। এটি একটি দুর্দান্ত বিজ্ঞান। তবে আয়ুর্বেদও তাই। বর্তমান প্রেক্ষিতে যেটা তাৎপর্যপূর্ণ, সেটা হল হিন্দু ভেষজ ঔষধ ব্যবস্থা অনুসরণ করছেন এমন একজন মুসলিম অনুশীলনকারীকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, তাদের হিন্দু বিদ্বেষ এতটাই প্রবল। আমি বিস্মিত হব যদি দেখি হাকিম উপলভ্য আছে এবং নিতান্ত আতান্তর নয়, এমন পরিস্থিতিতেও কোনও মুসলিম কোনও বৈদ্যের কাছে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে।
পরবর্তী এক ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহাসিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত ধ্রুপদী সাহিত্যগুলির আরবী এবং ফারসী অনুবাদের একটি তালিকা সংকলিত করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, যে মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানরা পরস্পরের কতটা নিকটবর্তী হয়েছিল। কিন্তু এই অনুবাদগুলির কোনওটিই মুসলমানদের হিন্দু চেতনার কোনও অংশ বা হিন্দু সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখতে শেখায়নি। তেমনি সেই অনুবাদগুলি ঐ জাতীয় বিশাল সাহিত্য সম্পদের উত্তরাধিকারীদের প্রতি মুসলমানদের মনকে নরম করতেও পারেনি; সেসব সাহিত্যকে তারা কাফির ও কিরাদের চেয়ে উত্তম বলে কিছু মনে করেনি। জয়সি, কুতুবান, মানঝন ও আরও কিছু সুফি ভারতীয় ভাষায় তাদের মহাকাব্য রচনা করেছিলেন, কারণ ইসলামের পৃষ্ঠপোষকিত কোনও ভাষাই তাঁরা জানতেন না। যেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ না তা হল, ইসলাম তখনও সদ্য ধরর্মান্তিত হিন্দু সম্প্রদায় থেকে সেই মানুষগুলোকে কলুষিত করতে পারেনি। আমি অনেকজন সুফির উদাহরণ দিতে পারি, যারা ভারতীয় ভাষায় লিখত, কিন্তু মুসলিম সম্রাটদের ইসলামী আইন দ্বারা হিন্দুদের পঙ্গু করে রাখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। রাসাখানের মতো মুসলিম ছিলেন বিরল ব্যতিক্রম। পরবর্তী কালের একজন মুসলিম সাহিত্যিক বা সুফির সন্ধান করে দেখা যাক, যার এই জাতীয় ধর্মত্যাগীদের প্রতি কোনও সদয় উক্তি আছে।
হিন্দু ও মুসলিম সাহিত্যের ঐতিহ্যের দুটি পৃথক ধারা ছিল যারা একে অপরকে আদৌ প্রভাবিত করেছিল কিনা সন্দেহ। ভারতীয় ভাষাগুলো বহু আরবী, তুর্কী ও ফারসী শব্দ ধার করে আত্তীকরণ করেছে। তবে ইসলামের এই ধ্রূপদী ভাষাগুলি কিন্তু হিন্দু ভাষাগত প্রভাবের কাছে মোটামুটি দুর্ভেদ্য রয়ে গেছে। তারা ভারতীয় উৎসের প্রতিটি শব্দকে এক হাত তফাতে রেখে দিয়েছে। উর্দু তবু কিছুটা প্রতিশ্রুতি রেখেছিল, কারণ এর বাক্যবিন্যাস (syntax) ও তৎসহ রচনাশৈলীর একটা বড় অংশের শিকড় রয়েছে এই মাটিতেই। তবে মুসলমানরা উর্দুকে তাদের সংস্কৃতির ভাষা হিসাবে দাবি করা শুরু করে, ফলত যে সেতুটি নির্মিত হতে পারত, তা ধ্বংস হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে এই ভাষাটির অতিরিক্ত আরবীকরণ ও পার্সীকরণ হয়ে হিন্দুদের জন্য মোটামুটি গ্রীক ভাষায় পরিণত হয়ে গেছে।
দর্শন ও ধর্মে নিতান্ত কম
দর্শন তো কখনোই ইসলামের দুর্গ ছিল না। এর প্রায় সমস্ত দার্শনিক জল্পনা কল্পনা করা হয়েছে গ্রীকদের কাছ থেকে এবং সেটাও বেশ খারাপভাবে, কোরান এবং হাদিসের স্থূলতা দ্বারা আরোপিত সীমাবদ্ধতার কারণে। এমনকি এই ঋণ গ্রহণের ব্যাপারটাও সর্বদা ইসলামের উলেমাদের কাছ থেকে কঠোরভাবে অভিযুক্ত হয়েছে। আল্লামা ইকবাল তো একেবারে নিশ্চিত ছিলেন, যে গ্রীক দর্শন ইসলামী একেশ্বরবাদের আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতাটিকে কলুষিত করেছে ও ক্ষয়সাধন করেছে। আর মুসলিম চিন্তাবিদদের হিন্দু ঐতিহ্যের চিন্তাভাবনার প্রতিও মোটামুটি একইরকম অনীহা ছিল। হিন্দু মনুবাদ হিন্দু সর্বেশ্বরবাদের মতই অভিশাপ মনে হত তাদের। অন্যদিকে, মধ্যযুগীয় ভারত জুড়ে হিন্দু দর্শন কোনও ইসলামী প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন পথ অনুসরণ করেছিল।
আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ পণ্ডিতরা তথাকথিত ‘নির্গুণা’ চিন্তাধারা, সুফি ও হিন্দু সাধুদের প্রসঙ্গ উঠলে আরও শক্ত জমি পেয়ে যায়। এখানে তাদের বক্তব্য এই মতাদর্শ সংশ্লেষণের একটি নিশ্চিত লক্ষণ এবং সেটাও মানবিক আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে। তবে যারা সুফিবাদ এবং নির্গুণ ভক্তি এই দুটি বিষয় নিয়ে তুলনামূলক অধ্যয়ন করেছেন, তারা সকলেই একমত পোষণ করেছেন, যে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা আসলে গুরুতর ভুল করছে।
এটি লক্ষ্যণীয়, যে কোনও নির্গুণ সাধু একজনও ভারতীয় সুফির নাম উল্লেখ করেনি, যেখানে তাদের অধিকাংশ রাবিয়া, মনসুর আল-হাল্লাজ, জুনেইদ, বায়াজ়িদ, শামস তাবরিজ় ও আধম সুলতানের মতো পূর্ববর্তী সুফিদের সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত। এর কারণ এইসব আদি সুফিরা সত্যিকারের রহস্যবাদী, যারা ইসলাম দ্বারা মধ্য প্রাচ্যে প্রচলিত আরব পৌত্তলিকতা, নব্য-প্ল্যান্টনিজ়ম, জ়োরোয়াস্ট্রিয়ানিজ়ম ও বৌদ্ধধর্মের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে নিভিয়ে ফেলার পূর্ববর্তী ছিল। সুফি কবিতার সুর ও মেজাজ নজরে পড়ার সাথে সাথেই ইসলামের উলেমারা এই আদি সুফিদের ওপর খাপ্পা হয়ে ওঠে। আল-গাজ়ালি একটি সমঝোতা সূত্র বার করেন – সুফিরা গান, নাচ করুক বা কৃচ্ছসাধনে লিপ্ত হোক, তবে শর্ত একটাই তারা ইসলামকে বিশ্ব-জয়ে এবং সারা বিশ্বকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে সাহায্য করবে। সুফিবাদ ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের অস্ত্রে পরিণত হওয়ার পরেই ইসলাম সন্ত্রাসবাদের রূপ নেয়। এমনকি সম্মানিত সুফি ফরিদুদ্দীন আত্তর তাঁর “মান্তিক-তয়ের” গল্পে এই ব্যাপারটিকে বেশ সমর্থনসহ সোৎসাহে তুলে ধরেন: “বলা হয় যে সুলতান (মাহমুদ গজনবি) সোমনাথকে দখল করে মূর্তিটা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন। ব্রাহ্মণরা মূর্তিটি বাঁচাতে তার ওজনের সমান সোনা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তাঁর আধিকারিকরা তাকে প্রস্তাবটি গ্রহণের সুবিধার দিকটা ইঙ্গিত করে; কিন্তু তিনি জবাব দেন: “আমার ভয় হয়, শেষ বিচারের দিন যখন সমস্ত মুশরিককে ঈশ্বরের সামনে হাজির করা হবে, তখন তিনি বলবেন, অধর এবং মাহমুদকে একত্র করো; একজন মূর্তি নির্মাতা, অন্যজন মূর্তি বিক্রেতা।” সুলতান তারপর সেটির চারদিকে আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দেন। মূর্তিটি ফেটে তার ভেতরে থেকে ২০ মণ মূল্যবান পাথর ঠিকরে বেরিয়ে আসে।”
মইনুদ্দিন চিশতীর আবির্ভাবের পরে যে “সূফী সিলসিলা”গুলির ভারতে আগমণ ঘটে, সেগুলি ছিল ইসলামের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠার বিভাগ। এগুলো কোনওটাই হিন্দুদের প্রতি সদয় দৃষ্টিতে তাকায়নি বা হিন্দুরাও তাদের মধ্যে কাউকে সম্মান করেনি, কিছু নির্বোধ ছাড়া যারা দয়াধর্মের পরিচয় দিতে চেয়েছিল, কিংবা এমন কিছু স্ব-সন্ধানী যারা সুফিদের সাহায্যে মুসলিম দরবারে সুবিধা আদায়ের ধান্দায় ছিল। অধিকাংশ সুফিরা ছিল পরবর্তী যুগের খ্রিস্টান মিশনারিদের মতো যাদের হিন্দুদের প্রতি বিতৃষ্ণা বৈরীভাব যথেষ্ট সুপরিচিত। নির্গুণা সাধুরা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন না এবং হনওনি। প্রকৃতপক্ষে কিছু নামী সুফির নাম নির্গুণা কবিতায় দোকানদার এবং ছিনতাইবাজ হিসাবে উল্লিখিত রয়েছে। অন্যদিকে নির্গুণা সাধুগণ ক্রমাগত ইসলামের একচেটিয়া দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা হিন্দু সমাজকে যে শক্তি দিয়েছিল তা সুফিরা দমিয়ে রাখতে বা প্রতিস্থাপন করতে পারেনি।
সংশ্লেষণ আত্তীকরণ এবং সংমিশ্রিত সংস্কৃতির এই বিষয়টির সংক্ষিপ্তসার লিখতে গিয়ে ভালো হয় যদি আমি আধুনিক ভারতে জ্ঞাত অন্যতম সেরা ও অবশ্যই সবচেয়ে বহুমুখী ঐতিহাসিক ডঃ আর.সি. মজুমদারকে উদ্ধৃত করি। তিনি লিখেছেন: “জনপ্রিয় বা জাতীয় ঐতিহ্যের এবং সামাজিক ও ধর্মীয় ধারণা, বিশ্বাস ও অনুশীলন এবং জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে স্বতন্ত্র্য রূপ দিতে পারে এমন প্রতিষ্ঠান– এইসবের সাপেক্ষে সৌহার্দ্যপূর্ণতার কোনও অবকাশই নেই। সংক্ষেপে দুটি সম্প্রদায়ের মনুষ্য চরিত্রের গভীরে প্রোথিত অর্থপূর্ণ যাবতীয় ব্যাপারে বস্তুগতভাবে মৌলিক পার্থক্য দূর করতে পারে, এমন পারস্পরিক প্রভাব ছিল নিতান্ত ওপর ওপর। সুতরাং যদিও দুটো বিশাল সম্প্রদায় পাশাপাশি থেকে এসেছে, কিন্তু উভয়েই যে যার নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরেছে এবং তাদের কোনওদিন মিলন হবে এমন কোনও চিহ্ন এখনও পাওয়া যায়নি। আরও বলেছেন: “হিন্দু মন্দির ও দেব মূর্তি তথা চিত্র ধ্বংস করার বেলা মুসলমানরা কখনও তাদের উদ্যোগে ভাঁটা পড়তে দেয়নি। মহম্মদ বিন কাশেম ভারতে পা রাখার পর থেকে অষ্টাদশ শতকে রাজনৈতিক ক্ষমতা হারানোর দিন পর্যন্ত এই ব্যাপারে তাদের মনোভাব অপরিবর্তরিত ছিল।”
[“There was no reapprochement in respect of popular or national traditions, and those social and religious ideas and beliefs and practices and institutions which touch the deeper chord of life, and give it a distinctive form, tone and vigour. In short, the reciprocal influences were too superficial in character to affect materially the fundamental differences between the two communities in respect of almost everything that is deep-seated in human nature and makes life worth living. So the two great communities, although they lived side by side, moved each in its own orbit and there was yet no sign that the twain shall ever meet.” Again: “Nor did the Muslims ever moderate their zeal to destroy ruthlessly the Hindu temples and images of gods, and their attitude in this respect remained unchanged from the day when Muhammad bin Qasim set foot on the soil of India till the 18th century A.D. when they lost all political power.”]
একদিন আমার এক শিল্পী বন্ধু আমাকে একটি চিত্তাকর্ষক গল্প বলেছিল: “একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন যিনি কারুশিল্পের ক্ষেত্রে অতীত ও বর্তমানের যাবতীয় কাজের সঙ্গে তুলনা করলে সবচেয়ে সুন্দর একটি নারীর ছবি আঁকার অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাড়িত হয়ে শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে যান। তিনি সারা বিশ্বের শিল্প গ্যালারিগুলো ঘুরে দেখেন এবং সেই সঙ্গে নানা গদ্য ও পদ্য পড়েন যাতে নারীর অবয়বের – চোখ, কান, নাক, ঠোঁট, চিবুক, গাল, বক্ষ, স্তন, নিতম্ব ইত্যাদির নিখুঁততম বৈশিষ্ট্যগুলি সন্নিবেশ করে ছবিটি আঁকতে পারেন। অবশেষে তিনি ছবিটি রচনা এবং আঁকার জন্য বসলেন। এই অপার বিস্ময়কর কাজটি করতে তাঁর আরও অনেক বছর সময় লেগে যায়।”
এইটুকু বলে আমার বন্ধু নীরব হয়ে যায়। আমি প্রশংসায় গদগদ হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করছিলাম: “এই মাস্টারপিসটি কোথায়? আমি কি কোনও শিল্পের বইতে তার অনুলিপি দেখতে পাব?” আমার বন্ধুটি হেসে বলল, “দুঃখিত, এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারব না। শিল্পী তার কাজ শেষ করার সাথে সাথে তার হস্তশিল্পটি নষ্ট করে দেয় এবং তারপরে আত্মহত্যা করে।” আমি হতবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করি, “কেন?” আমার বন্ধু জবাব দেয়: “কারণ শিল্পী আবিষ্কার করেন কোনও চিত্রশিল্পীর তুলি থেকে বেরিয়ে আসা এটিই সবচেয়ে বেদনাদায়ক সৃষ্টি।”
এটি আর রসিকতার বিষয় নয়। সম্মিলিত মিশ্র সংস্কৃতির প্রচারকরা বছরের পর বছর ধরে নিজদের কাজ হাসিল করতে ব্যস্ত। তারা হিন্দু সংস্কৃতি ভেঙে বহু পৃথক সমাজ-সাংস্কৃতিক শাখা উপস্থাপনা করতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে – অস্ট্রিক, দ্রাবিড়ীয়, আর্য, মঙ্গোলীয়, সিথিয়ান এবং এরকম আরো অনেক। তারা হিন্দু সংস্কৃতির ঐক্যকে পুরোপুরি ভেঙে এর উপাদানগুলোকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জোড়তাপ্পি মনে হয় এমন বিপরীতক্রমে না সাজানো পর্যন্ত থামবে না। তবে এটি হৃদয় বিদারক গল্পের অর্ধেকও নয়। তারা হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে জোর করে বিবাহ দেওয়ার চেষ্টা করছে। শেষের উৎপাদনটি সমস্ত বিভীষিকাকে ছাড়িয়ে যাবে।
সম্মিলিত সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে আমি যা লিখেছি সেগুলি দ্বারা, আমি কখনই বলতে চাইনা, যে আমি দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বোঝাপড়া এবং পুনর্মিলনের বিরোধী। আমি কেবল এটাই বলতে চাই যে অতীতে কোনও উল্লেখযোগ্য মিলন বা সংশ্লেষ ঘটেনি, এবং কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ইতিহাসকে বিকৃত করা ও মিথ্যা কথা বলা উচিত নয়। আমরা যদি মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাস থেকে লাভজনকভাবে যদি কিছু শিখে থাকি, তবে তা হল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কোনও বোঝাপড়া সম্ভব নয় যতক্ষণ না ইসলামের প্রাথমিক পরিসরটিকেই যুক্তি সর্বজনীনতা ও মানবতাবাদের ভিত্তিতে আমূল সংশোধন করা হয়।
দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলি বিশ্লেষণ ও নির্মূল না করে ধর্মনিরপেক্ষীয় উন্মাদনায় ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই’ করা কেবল ইসলামের হৃদয়কে কঠোরতর করার কাজ করেছে এবং এটিকে আরও আত্মনির্ভুলমন্য করে তুলেছে। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কেউ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘাতের মীমাংসার সন্ধানে মহাত্মা গান্ধীর মতো আন্তরিকতা দেখাননি। আসলে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের হিন্দু-মুসলিম বিরোধের মধ্যেই একটি স্বার্থান্বেষী আগ্রহ রয়েছে, যা তাদেরকে নিজেদের উচ্চতর অবস্থানের আত্মতৃপ্তি দেয় এবং তাদের ধান্ধাবাজিকে রক্ষাও করে। কিন্তু তাদের মহাত্মার মতোই নিষ্ঠাবান ধরে নিলেও মহাত্মা যেখানে মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে এদের নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কোনও মানেই হয় না। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের উচিত তাদের নিজস্ব মন এবং হৃদয় মন্থন করা এবং ইতিহাসের পাতায় বুনো হাঁসের সন্ধানে না দৌড়ে হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতি গভীরভাবে অধ্যয়ন করা।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আসল মনটাকে প্রকাশ করেন ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার তাঁর ১৯৬৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া ‘কমলা বক্তৃতায়’। তিনি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন: “ভারতে আজ একটি ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সঙ্গে একটি ইসলামিক সংস্কৃতি রয়েছে। কেবল হিন্দু সংস্কৃতি নেই। এই শব্দটাই এখন সভ্য সমাজে একটি অস্পৃশ্য (অপাঙক্তেয়)। হিন্দু শব্দটি এখন বিস্মৃত হওয়ার পথে। কারণ অনেক লোক বিশ্বাস করেন যে এই শব্দটি মনের সংকীর্ণতা এবং একটি মরিয়া সাম্প্রদায়িকতার প্রতীক।”
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়