১। জাতীয় সংহতির নামে
২। ভারতে মুসলিম শাসনের চরিত্র
৩। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর দাবি
৪। মধ্যযুগের ভারতে সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
৫। ইসলামই ছিল দোষী
৬। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ১
৭। মুসলিম অত্যাচারের মাত্রা – ২
৮। মুসলিম সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তী
৯। হিন্দুদের পরাজয়ের নির্ণায়ক কারণ
১০। ইসলামী দেশে/রাজ্যে হিন্দুদের অবস্থান
১১। আত্তীকরণ ও সংশ্লেষ
১২। ইসলাম বনাম মানবতা
ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী
অধ্যায় ১: জাতীয় সংহতির নামে
কমরেড র্যাডেক যাঁকে ত্রিশ দশকের শেষভাগে স্টালিন হত্যা করিয়েছিলেন, ছিলেন একজন তীব্র শ্লেষাত্মক রসবোধ সম্পন্ন কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী। কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত দেশের সৌজন্যে বেশ কিছু রঙ্গ তিনি তুলে আনেন। মস্কোয় তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া এমন একটি চুটকি ছিল:
একদিন কমরেড র্যাডেক রেড স্কোয়ারে উজ্জ্বল দিবালোকে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। একজন সাহসী নাগরিক এগিয়ে এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে, “কমরেড কমিসার, আপনার কি পুলিসের ভয় নেই?”
র্যাডেক কটমট করে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন. “পুলিস, কোথায় পুলিস?”
নাগরিকটি স্কোয়ারের চারপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা পুলিসদের দিকে নির্দেশ করে বলল, “ঐ সে একজন পুলিসম্যান, ঐ ওদিকে আরেকজন, ঐ তো আরও একজন। কিন্তু গোটা জায়গাটা পুলিসে পুলিসে গিজগিজ করছে কেন?”
র্যাডেক জবাব দেন, “তুমি ওদের দেখতে পাচ্ছ, আমি না। আমি দলের সদস্য। আমার ওদের দেখতে পাওয়ার কথা নয়। পার্টি সদস্যদের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কোথাও কোনও পুলিস নেই।”
ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজবাদী ভারতের শাসক শ্রেণীরও অনুরূপ আদর্শগত অন্ধত্বের দশা। এদের ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র তরঙ্গ দেখে ফেলা চলবে না। তাহলে তাদের প্রগতিশীল, উদার ও বৃহৎ-হৃদয় ভাবমূর্তিতে কাদা লাগবে, কিংবা তা ত্যাগ করতে হবে। শাসক শ্রেণীর স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ রক্তপিপাসু হয়ে কীভাবে আমাদের মাতৃভূমির পূর্ব ও পশ্চিমে বাহু কেটে নিয়েছিল। এই শাসক শ্রেণীর স্মৃতিতে এখনও জ্বলন্ত, ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ হিন্দু কাফেরদের অভিশাপ থেকে কীভাবে পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তানকে পরিচ্ছন্ন করেছিল। এবং এই সেই শাসক শ্রেণী, যাদের নাকের ডগাতেই পেট্রোডলার পুষ্ট ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ ভারতের অবশিষ্ট অংশকেও দাবি করছে অতীত বিজয়ের ধুয়ো তুলে।
ইসলামী সাম্রাজ্যবাদকে একমাত্র এই বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করতে হবে, যে ভারত হিন্দুদের নিজস্ব মাতৃভূমি, যেখানে সুপ্রাচীন হিন্দু সমাজের বসবাস, তার মধ্যে বিভিন্ন অহিন্দু সম্প্রদায়েরও মিলিমিশে থাকা উচিত।
আমাদের সেকুলারপন্থী সমাজতান্ত্রিক শাসক শ্রেণী যেটা অবিলম্বে দেখতে পায় সেটা হল, হিন্দু সমাজ বহুবিধ জাতি, ধর্ম, পন্থ, জাত, শ্রেণী, ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, স্থানীয় ঐতিহ্য, জীবনচর্চা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদির সংমিশ্রণ যারা একমাত্র ব্রিটিশ শাসনের দাসত্ব করতে গিয়েই একতাবদ্ধ হয়েছিল।
এই শাসক শ্রেণীকে বুঝিয়ে লাভ নেই, যে ব্রিটিশরা এই বিশাল ও বৈচিত্র্যময় হিন্দু সমাজের অন্তর্নিহিত ঐক্য সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিল। নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ব্রিটিশ শাসকরা এই ঐক্য নষ্ট করার জন্য যে নিজেদের সবরকম চেষ্টা চালিয়ে গেছে, তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
এই শাসক শ্রেণী তাদের ব্রিটিশ গুরুদের কাছ থেকে অনেক কিছু উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। যেমন পেয়েছে ব্রিটিশ রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে ইংরেজী ভাষা ও আধুনিক পাশ্চাত্য শ্রুতি না জানা নেটিভদের কথার কোনও দাম নেই। এই শ্রেণী ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার পেয়েছে উচ্চ মানের জীবনযাত্রা, যার দ্বারা দীন দরিদ্র নিরক্ষর সাধারণ জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা যায়। এই শ্রেণী ব্রিটিশদের কাছ থেকে লাভ করেছে ব্রিটিশ পিতৃতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব, যার ফলে তার মনে হয়, সে একাই একমাত্র সাধারণ মানুষের ভালো বোঝে। সর্বোপরি উত্তরাধিকার লাভ করেছে ব্রিটিশদের সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু হিন্দু সমাজকে বেঁধে রাখা গভীর অন্তর্নিহিত ঐক্য সম্পর্কে ব্রিটশদের যে ধারণা ছিল, একমাত্র সে বোধটাই শুধু এর উত্তরাধিকারের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে।
তাই এই শাসক শ্রেণী যে বেশ জোরালো ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গীতেই প্রকাশ করে, হিন্দুরা কখনই কোনও রাষ্ট্র ছিল না, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ফলত এই শ্রেণী স্বাভাবিকভাবেই দাবি করে, যে আজকের তারিখে হিন্দুদের নিজস্ব রাষ্ট্র পাওয়ার, এমনকি পেতে চেষ্টা করার পক্ষেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। সোজা কথায় আর সম্ভব নয়। আমাদের বলা হয়, ভারত হল বহু জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশ। এই অবস্থায় মিশ্র সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হল ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বানিয়ে রাখা। শাসক শ্রেণী এই বিচিত্র জাতীয়তাবোধের প্রজননভূমি। এই চর্চাকেই ‘জাতীয় সংহতি’ বলে আধিকারিকভাবে প্রচারের চেষ্টা হয়।
মুসলিমদের করা প্রতিটি দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে এই জাতীয় সংহতির উগ্র ও প্রায় উন্মত্ত দাদামা বাজানো খুব তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে পড়ে। আমাদের শাসক শ্রেণী অনতিবিলম্বে হিন্দুদের ওপর চেঁচামেচি শুরু করে – বেচারা সংখ্যালঘুদের সাম্প্রদায়িক হত্যা নয়, দাদাগিরির প্রবণতা ত্যাগ করো, ছোট ভাইদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করো, মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকারকে সম্মান করো…ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই শাসক শ্রেণী কখনই নিজেরই নিয়োগ করা তদন্ত কমিশনের দাঙ্গার কারণ সংক্রান্ত অনুসন্ধানের জন্য অপেক্ষা করে না। মুসলিমরাই সবকটি ক্ষেত্রে দাঙ্গার সূত্রপাৎ করেছে এই তথ্য উন্মোচিত করা কোনও তদন্ত রিপোর্টই এই শাসকরা কখনই মনে রাখে না বা ইচ্ছাকৃতভাবে বিস্মৃত হয়।
হিন্দুদের এই শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে নতমস্তকে আত্মবীক্ষণের নৈতিক উপদেশ দেওয়া বক্তৃতা শুনতে হয়। যে হিন্দু এই বক্তৃতার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কিংবা তদন্ত কমিশনের প্রমাণগুলি তুলে ধরে, তারাই মিথ্যা দোষারোপের শিকার হয়। সে তখন শুধু হিন্দু সাম্প্রদায়িক বা কট্টর হিন্দুত্ববাদী হিসাবেই নয়, সেই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের ভবিষ্যৎ গোল্লায় পাঠানো প্রতিক্রিয়াশীল ও পুনরুত্থানবাদী হিসাবেও চিহ্নিত হয়। শাসক শ্রেণীর সুরে গলা মেলায় কিছু বিশিষ্ট মানুষ বিশেষত গান্ধীবাদীরা, যাদের মতে অনুতাপহীন হিন্দুরা আসলে হিন্দুই নয়। চলে নানারকম ভাষার কারসাজি চারপাশে।
সোজা কথায় জাতীয় ঐক্য বলতে বোঝাচ্ছে একটাই বিষয়, নম্র হিন্দু সমাজকে জঙ্গী মুসলিম মিল্লাতের সঙ্গে একতা বজায় রাখতে হবে। মুসলিম দর্পিত গোঁড়ামির সামনে ফিসফিসিয়ে আওয়াজ তুলতেও অসহায়ভাবে অপেক্ষা করতে হবে। মুসলিমদের যখন খুশি হিন্দুদের এটা সেটা দাবি করে অভিযোগ করার ঈশ্বরদত্ত অধিকার আছে। আর হিন্দুদের আছে মুসলিমদের দুরারোগ্য ধর্মান্ধতা প্রসূত প্রতিটি সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদী দাবি মেনে নেওয়ার ঈশ্বরদত্ত দায়িত্ব।
দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শাসক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত এই জাতীয় সংহতির ফল সবাই দেখতে পাচ্ছে, একমাত্র এর রচয়িতা ছাড়া যার সত্যকে না দেখার আদর্শগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। হিন্দু সমাজকে জুড়ে রাখার ও শক্তিশালী করার অন্যতম উৎস জাতিপ্রথাকে ক্যান্সারে পরিণত করা হয়েছে, যা আমাদের রাজনীতির ভিত্তিতেই বিষ প্রয়োগ করেছে। স্থানীয় দেশাত্মবোধ, মিশনারিদের কার্যকলাপ ও আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদ দ্বারা পুষ্ট প্রাদেশিকতা এমন ভয়াবহ কলেবর ধারণ করেছে, যা আমাদের মাতৃভূমির ঐক্যকেই শেষ করে দিতে উদ্যত। আর এর ফলে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ দেশভাগের প্রাকমুহূর্তের চেয়েও বেশি আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভুলমন্য হয়ে উঠেছে।
হিন্দু ঐক্যের চরিত্র
শাসক শ্রেণী প্রচারিত এই জাতীয় সংহতির পথে হোঁচট খাওয়ার মতো একটাই জগদ্দল রয়েছে, তা হল হিন্দু সমাজের ঐক্য, যা আজও বিদ্যমান। বেশ কিছুদিন যাবৎ হিন্দুরা নিজেদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র যা তাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনচর্চাকে একতাবদ্ধ রেখেছে, সেই সম্পর্কে সচেতনতা হারিয়ে ফেলেছিল। বর্তমানে হিন্দু একতার একমাত্র উৎস হল নিজেদের সাধারণ ইতিহাস সম্পর্কে সচেতনতা, বিশেষত ইসলামী ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে নিজেদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।
হিন্দু সমাজ এখনও মানবতার আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক সম্পদে অতীতে নিজেদের মহান অবদান নিয়ে গর্বিত। হিন্দু সমাজ এখনও তার মহান সাধু সন্ন্যাসী বিজ্ঞানী জ্ঞানী ও দেশনেতাদের স্মৃতি লালন করে। হিন্দু সমাজ এখনও মনে রেখেছে বহিরাগত হামলাবাজদের, যারা শুধু জবাই অগ্নিদগ্ধ ও লুণ্ঠন করে বা দাসত্বের জন্য বন্দী করে ক্ষান্ত হয়নি, বলপূর্বক নিজেদের বর্বতার তকমাও এঁটে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর কঠোর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে একটা সাধারণ সচেতনতাই হিন্দু সমাজকে মামলুক, খলজি, তুঘলক, বাহমনি, শারকি, সৈয়দ, লোদি এবং মুঘলদেরকে মৌর্য, শুঙ্গ, গুপ্ত, চোল, মুখারি, পাণ্ড্য, পাল, রাষ্ট্রকূট, যাদব, কাকতিয়াস, হয়সাল, সঙ্গম, সুলভা, মারাঠা, শিখ ও জাঠদের মতো দেশীয় রাজবংশ হিসাবে মেনে নিতে বাধা দিয়েছে। হিন্দু সমাজ কখনই মনে করে না, মুসলিম আগ্রাসনকে প্রতিহতকারী কাবুলের জয়পাল, গুজরাটের মহারানী নায়কীদেবী, দিল্লীর পৃথ্বীরাজ চৌহান, কনৌজের জয়চন্দ্র, দেবগিরির সিংহনাদদেব, মাদুরার বিকর্ণ পাণ্ড্য, অন্ধ্রের প্রলয় নায়ক, বিজয়নগরের হরিহর বুক্কা ও কৃষ্ণদেবরায়, মহারাণা কুম্ভ, রাণা সঙ্গ, রাণা প্রতাপ, শিবাজী, বন্দা বাহাদুর, মহারাজা সূরজমল এবং রণজিৎ সিং প্রমুখ ছিলেন ব্যক্তিস্বার্থে ষড়যন্ত্র করা নিছক স্থানীয় সামন্তপ্রভূ। হিন্দু সমাজ এই বীরদেরও ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে শ্রদ্ধা করে, ঠিক যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্মান করে।
ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র
আমাদের ‘জাতীয় সংহতি’-র প্রবক্তাদের সমস্যার অন্ত না হওয়ার এটাই কারণ। তথাকথিত ‘মিশ্র জাতি’র মুসলিম উপাদানের এই হিন্দু ইতিহাস বীক্ষণ ও বীর-পূজোর প্রতি প্রবল আপত্তি আছে। মুসলিম ভারতীয়রা প্রাক-মুসলিম যুগের ভারতের ইতিহাস নিয়ে মোটেই গর্বইত নয়, তারা সেই সময়ে উত্থান হওয়া বীর নায়কদের সম্মান জানাতেও প্রস্তুত নয়। তারা চায় হিন্দুরাও প্রাক-ইসলামী ভারতবর্ষকে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসাবে অবজ্ঞা করুক। নিজেদের শপথ নিয়ে বলে, এটাই ইসলাম ধর্মগ্রন্থের দাবি। সেই সঙ্গে এটাও চায়, যে হিন্দুরাও মহম্মদ বিন কাশেম, মাহমুদ গজ়নবী, আলাউদ্দিন খলজি, মহম্মদ তুঘলক, সিকন্দার লোদি, বাবর, অউরঙ্গজ়েব ও আহমেদ শাহ্ আবদালির মতো দুষ্কৃতকারী ডাকাত লুঠেরা গণহত্যাকারী অত্যাচারী অপরাধীদের সম্মান করবে। তারা আশা করে হিন্দুরা মধ্যযুগে ইসলামী আগ্রাসনকে প্রতিরোধ ও শেষ পর্যন্ত উচ্ছেদকারী হিন্দু বীরদের বিশ্বাসঘাতক হিসাবে না হলেও অন্তত বেয়াড়া বিদ্রোহী হিসাবে নিন্দা করবে।
বর্তমানের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, মুসলিম ভারতীয়রা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা হিন্দু বিপ্লবীদেরও সম্মান জানাতে প্রস্তুত নয়। গুটিকতক মুসলিম যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করেছিল, তাদের দেখিয়ে হিন্দুদের ‘দেখনদারি’র নিন্দা করে। কিন্তু তারা আশা করে শাহ্ ওয়াল্লিউল্লাহ্ ও সৈয়দ আহমেদ বরেলভির মতো ইসলামী মৌলবাদী বা স্যার সৈয়দ আহ্মেদ খান ও আলি ভাইদের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের, অথবা ওয়াহাবি ও মোপলাদের মতো হিন্দু হত্যাকারীদের, কিংবা মহম্মদ আলি জিন্নার মতো অপসরণবাদীদের হিন্দুরা শ্রদ্ধা করবে।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সংস্কৃত, প্রাকৃত ও আঞ্চলিক ভাষায় রচিত ভারতীয় সাহিত্যকে সরাসরি ঘৃণা না করলেও মুসলিমরা এক ধরণের অবজ্ঞা পোষণ করে। তাদের কাছে ভারতীয় দর্শন ও বিজ্ঞানের কানাকড়ি মূল্য নেই, যদিও সেখান থেকেই অনেক কিছু ধার করে তাকে আরবী পার্সী পোশাক পরিয়ে ইসলামী চেহারা দেওয়া হয়েছে। হিন্দু আধ্যাত্মিকতা তো তাদের কা্ছে ‘বহুত্ববাদ’ ও ‘সর্বেশ্বরবাদ’ হিসাবে অত্যন্ত ঘৃণ্য। হিন্দু স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও অন্যান্য কারুশিল্পের প্রতি তো কোনও প্রশংসা নেই। একমাত্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কিছুটা আগ্রহ দেখিয়েছে যেহেতু ইসলামী সঙ্গীত বলে কিছু ছিল না, আর বহু সঙ্গীতজ্ঞ হিন্দু থেকে মুসলমানে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন বা গেছেন। গোঁড়া মুসলিমরা মুসলিমদের সঙ্গীত প্রীতিও অনুমোদন করে না।
কিন্তু মুসলিম সংস্কৃতি বলতে তারা যা বোঝাতে চায়, আশা করে হিন্দুরা তার প্রতি নিজেদের সংস্কৃতির মতোই অত্যুৎসাহী হবে। তারা চায় হিন্দুরা অবিরল তাদের পার্সী ও উর্দু কবিতাকে ‘বাহ্ বাহ্’ করে যাবে, এবং আমির খুসরুর মতো হিন্দু-বিদ্বেষী বা পাকিস্তানের প্রবক্তা মহম্মদ ইকবালের রচনাকেও জাতীয় ঐতিহ্য হিসাবে মান্যতা দেবে। তারা চায় হিন্দুরা মুসলিম স্থাপত্য, ক্ষুদ্র চিত্রকলা (miniature painting), ক্যালিগ্রাফি, রন্ধন শিল্প, পোশাক, হাবভাব, কেতা সব কিছুর জন্যই হামলে পড়বে। তাদের দাবি হিন্দুরা ইসলামী ঐতিহ্যের সবটুকুকে জাতীয় ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে শ্রদ্ধা করবে।
জাতীয় ঐক্যের বৈশিষ্ট্য
আমাদের শাসক শ্রেণী প্রাক-ইসলামী যুগের অতীত নিয়ে হিন্দু সচেতনতার কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পান না। অন্তর্বর্তী কালীন দীর্ঘ মুসলিম অগৌরবের ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করার চাপ দেওয়ার মধ্যেও কোনও অন্যায় দেখে না। যাকে এরা ‘সাম্প্রদায়িক কলহ’ বলে, তার সমাধানের একমাত্র পথ এদের মতে হিন্দু ইতিহাসকে যথাসম্ভব লঘু করে দেওয়া এবং মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করা, আর সেই সঙ্গে মুসলিম ইতিবৃত্তকে উদারপন্থী হিসাবে রাঙিয়ে তাকেই জাতীয় ইতিহাস বলে চালানো। এটাই হল ‘জাতীয় সংহতি’ মঞ্চের প্রধান খুঁটি বা পাটাতন।
এই অসত্যের পরীক্ষা এ যাবৎ পর্যন্ত মুসলিম ও কমিউনিস্ট ‘ঐতিহাসিক’ দ্বারাই চালানো হয়েছে যারা ক্রমশ Indian History Congress, Indian Council of Historical Research এমনকি University Grants Commission-এর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছে। বর্তমানে এই দায়িত্ব তুলে নিয়েছে National Integration Council. ভারত সরকারের শিক্ষামন্ত্রক (The Ministry of Education of the Government of India) এই পরীক্ষাটিই প্রতিটি রাজ্যের বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে শামিল করার নির্দেশ দিয়েছে। সত্য অবদমন ও মিথ্যা প্রচারের এই বিকৃত কর্মসূচীই রাষ্ট্র ‘সত্যমেব জয়তে’ শিলমোহর দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
শ্রীমতী কুমি কাপুর ১৭ই জানুয়ারি ১৯৮২ সালে Indian Express কাগজে National Council of Educational Research and Training (NCERT)-কে একটি নির্দেশিকার সারসংক্ষেপ দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন:
“History and Language textbooks for schools all over India will soon be revised radically. In collaboration with various state governments the Ministry of Education has begun a phased programme to weed out undesirable textbooks and remove matter which is prejudicial to national integration and unity and which does not promote social cohesion. The Ministry of Education’s decision to re-evaluate textbooks was taken in the light of the recommendations of the National Integration Council of which the Prime Minister is Chairman. The Ministry’s view was that history had often been used to serve narrow sectarian and chauvinistic ends.”
অর্থাৎ জাতীয় সংহতির স্বার্থে অপ্রিয় ঐতিহাসিক অধ্যায় বর্ণিত আছে এমন অবাঞ্ছিত বইগুলি সরিয়ে রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে মিলে ইতিহাস ও ভাষা শিক্ষার পুস্তকগুলির আমূল সংস্কার করা হবে ‘জাতীয় সংহতি পরিষদ’-এর সুপারিশ অনুযায়ী। কারণ শিক্ষা মন্ত্রকের মতে ইতিহাস প্রায়শ আঞ্চলিকতা ও বৈষম্য রক্ষার স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। সেই মতো কুড়িটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল NCERT-র নির্দেশিকা মেনে মূল্যায়ন শুরু করে দিয়েছে। সেপ্টেম্বর ১৯৮১-তে প্রতিটি রাজ্য থেকে দু’জন মূল্যায়নকারী NCERT-র দিল্লীস্থিত হেডকোয়ার্টারে প্রশিক্ষণ নেন। তারাও এখন নিজেদের স্ব স্ব রাজ্যের সংশ্লিষ্ট বইগুলি পরখ করে রিপোর্ট জমা দিচ্ছেন। মূল্যায়নগুলি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি খতিয়ে দেখবেন।
আমরা এবার NCERT-র নির্দেশিকাগুলি পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করে দেখব।
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়