প্রভু জগদ্বন্ধুর কথা

যীশু খ্রীস্টের জন্মের পর পূর্বদেশ থেকে এক বিরাট দূরত্ব যাত্রা করে জ্যোতিষীরা এসেছিলেন বৈৎলেহেমে, যেখানে যীশু ও তাঁর অভিভাবকেরা ছিলেন। তাঁরা আকাশে একটি অস্বাভাবিক তারাকে অনুসরণ করে এসেছিলেন। যীশু তাদের কাছে যেন নতুন রাজা, আশা-ভরসার স্থল। জ্যোতিষীরা ভূমিষ্ঠ হয়ে শিশুটিকে প্রণাম করলেন, আরাধনাও করলেন।

জগদ্বন্ধুর ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল। নেপাল থেকে এলেন এক সন্ন্যাসী। পিতা দীননাথ ন্যায়রত্ন ছোট্ট শিশুর কোষ্ঠী এনে দেখালেন। সন্ন্যাসী বললেন, “কী আশ্চর্য, এর জন্যই তো আমার সুদূর নেপাল থেকে ছুটে আসা। কোথায় সেই বালক?”
জগৎ তখন ছোট্ট। সন্ন্যাসী শিশুটিকে কোলে নিয়ে তাঁর পা দুটি নিজের মাথায় ঠেকাচ্ছেন আর বলছেন, “এ তো দিগ্বিজয়ী মহাপুরুষ! শ্রীরামচন্দ্র এবং লক্ষ্মণের জন্মলগ্নে যে পাঁচটি গ্রহের সমাবেশ হয়েছিল, এর বেলাতেও তাই দেখছি৷”

প্রভু জগদ্বন্ধু ছিলেন এক আন্তর্জাতিক মহামানব। তিনি নিজেই বলছেন, “দেখ, সমস্ত নেশন আমাকে চায়। আমিও অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের সবাইকে চাই। সব নেশনে আমি আছি। ইউরোপবাসী মিশনারীরা চার্চে আমার কাছেই প্রার্থনা করে শান্তি চায়।” জগদ্বন্ধু যেন অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে সমস্ত নেশনে অণু-পরমাণুর মধ্যেই ঘুরে বেড়াতে চেয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব ধর্মসম্মেলনে মহানাম সম্প্রদায়ের কাছে আমন্ত্রণ এসেছিলো। আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান শ্রীপাদ মহেন্দ্রজী। মহেন্দ্রজী মহানামব্রত ব্রহ্মচারীকে ওই সম্মেলনে প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছিলেন।

প্রভু জগদ্বন্ধুর জন্ম সীতানবমীতে; ২৮ শে এপ্রিল, ১৮৭১ সালে। বলা হয়, তিনি এসেছিলেন রাজটীকা পড়ে, ১৯ টি লক্ষণ নিয়ে; ললাটে চন্দ্রভাল, দেহে চন্দ্রসুধা। অশোকফুলের কুঁড়ির আগার আভা যেন সর্বাঙ্গে; এক চিন্ময়-পুরুষ, পদ্মপলাশলোচন। বৈশাখমাস। যে মাসে সারা বাংলার সনাতনী মায়েরা তুলসীতলায় বসুধারা ব্রত উদযাপন করছেন, সেই মাসেই বামাসুন্দরী দেবীর কোল আলো করে গঙ্গার তীরে ডাহাপাড়ায় এলেন এক তুলসী-মহাজন৷ তিনিই ‘হরিকথা’ গ্রন্থে লিখছেন, “সুরধনী পারে রয়ে/অষ্টাঙ্গে প্রণাম হয়ে/ ভাসিব রে নয়ন ধারায়।”

তিনি শুধু নিজে ভাসেননি, ভাসিয়েও দিয়েছেন কৃষ্ণপ্রিয় মানুষকে। হরিনামে, কৃষ্ণনামে, নিতাই-গৌরাঙ্গ নামে ভাসিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, “মধুর তোমার শেষ যে না পাই ওগো।” বলা হয়, তিনি কৃষ্ণলীলা ও গৌরাঙ্গলীলার সমষ্টি; একাধারেই সব। বলেছেন, “সকলকে নিষেধ করে দিস, যেন কেহ আমার জন্য নিতাই-অদ্বৈত প্রভৃতি না সাজে।” শুধু রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু নন; তিন প্রধান সখীও গৌরসুন্দরে মিলিত রয়েছেন, এমনই বিশ্বাস ভক্তমণ্ডলীর। এ এক অভিনব তত্ত্ব। ‘হরিকথা’ গ্রন্থে নিজেই লিখেছেন, “রাই-কুন্দ-ললিতিকা/শ্যামসুন্দর-বৃন্দিকা,/মহাযোগ, বিরহ-প্রতাপে।” ‘রসতত্ত্ব’ সখী বাদ দিয়ে অসম্পূর্ণ। সখীগণ সেখানে অপরিহার্য। সখীরা না থাকলে প্রেম-আস্বাদনে অসামঞ্জস্য হয়। রাধাগোবিন্দ যদি দুইজনেই প্রেম আস্বাদনে বিভোর হন, তবে আপামর ভক্ত সাধারণকে প্রেম-বিতরণ করবেন কে? প্রেম বিতরণ করবেন সখীরা। কারণ রাধা-মাধব সখীদেরই সম্পত্তি। এবার গৌরসুন্দর তাই সখী-ভাবের অঙ্গীকার নিয়ে ধরা ধামে এসেছেন, এমনটাই ভক্ত-বিশ্বাস৷ প্রভু জগদ্বন্ধু আপন লীলার মধ্যে তা কেবল দেখান নি, দেখিয়েছেন তাঁর রচনাগ্রন্থে, তাঁর বাণীসম্পুটের মধ্যেও৷

মহানাম সম্প্রদায়ের দ্বারা পূজিত প্রধান দেবতা হচ্ছেন রাধাকৃষ্ণ, গৌর-নিতাই এবং প্রভু জগদ্বন্ধু। তিনি আটটি গ্রন্থ লিখেছেন, যার মধ্যে আছে প্রভু জগদ্বন্ধুর অনুভূতি, তাঁর ঋদ্ধসত্য। তাঁর ছ’টি গ্রন্থ পদাবলী সাহিত্যের অন্তর্গত। এরমধ্যে রয়েছে শ্রীমতী সংকীর্তন, শ্রীনাম কীর্তন, শ্রীবিবিধ কীর্তন। তিনটি মিলিয়ে ‘সংকীর্তন পদামৃত’। বাকী তিনটি হল শ্রীশ্রী সংকীর্তন পদাবলী, শ্রীশ্রী হরিকথা এবং শ্রীশ্রীচন্দ্রপাত৷

জগদ্বন্ধু কীর্তনসম্রাট, তিনি কীর্তনকে বিগ্রহ করে তুলেছিলেন। কীর্তন সাহিত্যে এমনই বৈষ্ণব মহাজন তিনি, যিনি গৌরচন্দ্রিকা বিষয়ক পদও যেমন লিখেছেন, লিখেছেন অষ্টকালীন লীলাবিষয়ক পদও।

এবার আলোচনা করবো, প্রভু জগদ্বন্ধু কেন এলেন? তাঁর মহাব্রতই বা কী? তিনি মহানাম প্রচার করতে জগতে এসেছিলেন। মহানাম-অঙ্গনে যার পরিভাষা হচ্ছে ‘মহা অবতরণ’ বা ‘মহা উদ্ধারণ লীলা’। মহানামের মধ্যে আছে সৃষ্টিরক্ষার নিগূঢ় মন্ত্র। বলা হয়, হরিনাম হল ‘বৈদ্য-বটিকারূপ’; Spiritual Hospital -এ পরিবেশিত বটিকা হল ‘হরিনাম’। বন্ধুপ্রভু বলছেন, “আমি Sweeper, ঝাড়ু দিয়া purify করতে এসেছি।” বলছেন, “হরিনাম লও ভাই/আর অন্য গতি নাই/প্রলয় এল প্রায়।”

মনে রাখতে হবে, তিনি নিম্নবর্গের হিন্দুদের প্রতি অপার প্রেম দিয়েছেন বলেই, তিনি ‘জগদ্বন্ধু’।
১. তিনি ফরিদপুরকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণকান্দা, বাকচর, গোয়ালচামট শ্রীঅঙ্গনে ‘মহা উদ্ধারণ’ করেছেন। ফরিদপুরের উপকণ্ঠে ব্যাভিচারি বুনো বাগদিদের হরিনাম প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ফলে ধর্মান্তকরণের প্রচেষ্টা রুখে গেল। নবজীবন পেলে বুনো বাগদিরা। শুধু তাই নয়, বুনো-বাগদিকে মোহন্ত করে তুলছেন তিনি। মোড়লকে বুকে জড়িয়ে ধরছেন। বলছেন, শ্রীকৃষ্ণের দাস। মোড়লের নাম দিচ্ছেন ‘হরিদাস’। তাঁকে প্রাণভরে কৃষ্ণনাম করতে বলছেন। একসঙ্গে গ্রহণ করছেন রাধাগোবিন্দের প্রসাদ। ব্যাস, বিধর্মীদের চেষ্টা ব্যর্থ হল। মুসলমান, খ্রীস্টান না হয়ে রইলেন সনাতনী হিন্দু হয়েই।
২. উত্তর কলকাতার রামবাগান বস্তিতে বসবাসকারী অচ্ছুৎ ডোম সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন আনলেন। একেই বলা যায় নাম-প্রেম দিয়ে ‘পতিত-পতিতা উদ্ধার’। ‘হরিজন’ সম্প্রদায়কে প্রেম দিলেন। কখন? তখনও গান্ধীজীর ‘হরিজন’ রাজনীতির আবির্ভাব হয় নি। প্রভু জগদ্বন্ধু সেই সময়ই অন্তেবাসী-প্রান্তবাসী মানুষকে প্রকৃত হরিজন করে তুলছেন। পাঁকের মাঝে পদ্ম ফোটাচ্ছেন।
৩. প্রভুকে দেখছি বারবণিতাকে সাধিকা করে তুলতে। মানিকতলার বারাঙ্গনারা উদ্ধার পেলেন। বারবনিতা সুরতকুমারী কৃপা পেলেন, প্রভু তাঁকে বৈরাগ্য দান করলেন, রূপান্তর করে তুললেন ‘সুরমাতা’।

তাঁর কাছে সমগ্র মানব একটিই জাতি, নরজাতি। নরজাতির দুটি ভাগ। প্রথম, মহাজাতি, যারা হরিভক্ত। দ্বিতীয়, অপজাতি, যারা ভক্তিহীন। তাঁকে আশ্রয় করে ‘মহানাম সম্প্রদায়’ গঠিত হল। হয়ে উঠলো এল মহীরুহ। শ্রীপাদ কুঞ্জদাসজী, সেই মহীরুহের কাণ্ড অংশ, নাম-প্রচারণার দলপতি। শ্রীপাদ মহেন্দ্রজী, মহীরুহের লম্বমূল। এলেন শ্রীমৎ গোপীবন্ধুদাসজী, শ্রীমৎ জয়বন্ধুদাসজী, শ্রীমৎ কল্যাণবন্ধুদাস ব্রহ্মচারী প্রমুখ। মহানাম সম্প্রদায়ে মহেন্দ্রজী যদি হন প্রদীপ, কুঞ্জদাসজী কিরণ। মহেন্দ্রজী যদি হন সঙ্গীত, কুঞ্জদাসজী তবে সুর। শ্রীঅঙ্গন কীর্তনে, সুজনে, পাখির কূজনে পরিপূর্ণ হল।

শ্রীঅঙ্গনে ভগবৎ সত্তার তিনটি লক্ষণ দেখতে পেলেন সবাই।
১. স্বয়ং ভগবানের জীবন্ত বিগ্রহ।
২. দেখা গেল একটি চমৎকার প্রেমদাতৃত্র শক্তি বয়ে চলেছে।
৩. প্রকাশ পাচ্ছে শুদ্ধ মাধুর্যের পূর্ণতা, তাতে বালকত্ব, তাতে তন্ময়তা।
তিনি ত্রয়োদশ-দশা লাভ করেছিলেন। দিব্য জ্যোতি, স্বর্গীয় সুরভি, টাটকা ফুলের গন্ধ। রামদাস বাবাজীর সঙ্গে তিনি একবার যমুনায় নেমেছেন। বৃন্দাবন। জলে নেমে গায়ের কাপড় সরাতেই দিব্যজ্যোতি দেখে রামদাসজী মূর্চ্ছা গেলেন। সমগ্র অঙ্গে রূপ ভেসে যাচ্ছে।

বৃন্দাবন, নবদ্বীপ প্রভৃতি তীর্থে গেলেও, তিনি কখনও পুরীধাম যান নি৷ পুরী ‘মহাধাম’। বলতেন, “ও ধামে গেলে দেহ থাকতো না, একেবারে গলে যেতো।” শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন গয়ায় যেতে পারেন নি।

কৈশোরে জগৎ রাঁচিতে দাদার কর্মস্থলে গিয়ে বেয়াদপ ঘোড়াকে বশ করেছিলেন। লাগাম ধরে ছুটিয়ে উধাও হয়ে গেছিলেন। প্রাণবন্ত সেই তিনিই প্রকটদশার শেষভাগে গেলেন গম্ভীরলীলায়। মৌনী হলেন। ১৩০৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাস থেকে ১৩২৫-এর ১৬ ই ফাল্গুন, দীর্ঘ ১৬ বছর আট মাস চলল এই ব্রত। একখানা ক্ষুদ্র অন্ধকার কক্ষ, তাতে একটিই দরজা, কোনো জানালা নেই, ছিদ্র নেই, কক্ষে আলো জ্বালাবার নিয়ম নেই। দিবারাত্রি একলা। সামান্য আহার।

তার পরেও আরও তিন বছর প্রকট ছিলেন। তখন আর খাওয়া-দাওয়ার তেমন কড়াকড়ি ছিল না। দোলায় চড়ে মাঝেমধ্যে শহর পরিক্রমা করতেন। অবশেষে ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ১ লা আশ্বিন এলো; ১৯২১ সালের ১৭ ই সেপ্টেম্বর। আমাদের স্থূলচোখে ‘লীলা সংবরণ’ করলেন। কিন্তু ভগবত-দার্শনিকদের কাছে এই অপ্রকট অবস্থা হল ‘মহা উদ্ধারণ লীলার সাময়িক দশা’। যেন মহাপ্রলয় থেকে জগৎ উদ্ধারের জন্য ভাবসমাধিতে থাকা। এক অনির্বচনীয় তপস্যা। পুনরায় জেগে উঠবেন তিনি। তিনি নাম শুনছেন। তাই আমাদের হরিনাম সংকীর্তন চালিয়ে যেতে হবে।

তিনি আমাদের কাছে কী চান? আমাদের কাছে নিত্যতা চান। নিত্য থাকতে বলেছেন আমাদের। বলেছেন দেবতারাও অনিত্য। সমস্তই প্রলয়ে লয় হয়। লয় হয় না কেবল মহানাম, ব্রজের সামগ্রী। “নামের শক্তি নামী হতেও বেশি।” প্রভু জগদ্বন্ধুর নাম, তাঁর প্রকটতা থেকেও অধিক।

তিনি তো অভয়দান করেই রেখেছেন, “তোরা আমায় স্মরণ করিস আর না-ই করিস, আমি তোদিগকে নিত্য চিরকাল স্মরণ করবো।”
তাঁর অহেতুকী প্রেমকে তাই আমরা কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্মরণ করি৷
“গৌরগদাধরৈকাত্ম শ্রীহরিভজনাষ্টকম্।
পাঠক-হর্ষদং বন্ধুপ্রেমসেবা প্রদায়কম্।।
বন্দে প্রাণজগদ্বন্ধুং নিত্যপুরুষনামিনম্।
মহানাম-মহারূপং হরিনাস্বরূপিণম্।।”
শ্রীহরিপুরুষ, মহা উদ্ধারণ প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরকে সার্ধ শতবর্ষে আমার শতকোটি প্রণাম জানাই।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.