‘ওঁ দেবি ত্বং জগতাং মাতঃ স্বস্থানং গচ্ছ পূজিতে।
সংবত্সর ব্যতিতে তু পুনরাগমনায় চঃ।’
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব। দেবী দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া জগৎ জননী। অশুভ শক্তিধর অসুরাধিপতি মহিষাসুরকে বধ করে তিনি শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীশ্রীচণ্ডী থেকে পাই, ব্রহ্মার বরে বলীয়ান প্রবল ক্ষমতাশালী মহিষাসুর স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করে দেব সৈন্যসমূহকে পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। পরাজিত দেবতাগণ প্রবল পরাক্রমশালী মহিষাসুরের হাত থেকে রক্ষা পেতে ত্রিদেব (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর) -এর শরণাপন্ন হন। দেবরাজ ইন্দ্র তথা সকল দেবতাদের মুখে মহিষাসুরের অত্যাচারের কাহিনী শুনে ত্রিদেব -এর শরীর থেকে মহাতেজ নির্গত হলো। সেই সাথে অন্যান্য দেবতাদের তেজপ্রবাহ মিলিত হয়ে সৃষ্ট হল এক দেবী মূর্তি। অসুর নিধনের লক্ষ্যে এই দেবী মূর্তিকে রণ সজ্জায় সজ্জিত করলেন দেবতারা। বিভিন্ন দেবতারা অলংকার, যুদ্ধাস্ত্র ও বাহন দিয়ে দেবীকে সজ্জিত করলেন। দেবীর গর্জনে আকাশ পরিপূর্ণ হলো, প্রতিধ্বনি ত্রিলোক কম্পিত করল। দেবী ‘জয়া’ নাম ধারণ করলেন। সকল দেবতারা মহামায়াকে ভক্তিভরে প্রণাম নিবেদন করলেন। ‘মহিষাসুর বধ’ সংক্রান্ত কাহিনীতে বর্ণিত আছে দেবী নয় দিন নয় রাত মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধ করে দশম দিনে তাকে পরাজিত করে বিজয় লাভ করেন। সেটি শুক্লা দশমী তিথি – যা বিজয়া দশমী হিসেবে পালিত হয়।
রামচন্দ্র রাবণ বধের পূর্বে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। মর্ত্যে তখন থেকেই দুর্গাপূজার প্রচলন। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের প্রথমা থেকে দশমী তিথিতে পূজা সম্পন্ন হয়। তারমধ্যে পঞ্চমী থেকে দশমী তিথি অবধি বিশেষ পুজোপাঠ হয়। বিজয়া দশমীর দিন দেবী তার পিতৃ আবাস ছেড়ে কৈলাস পাড়ি দেন। অনেক বনেদি পরিবারে আজও প্রতিমা বিসর্জনের প্রাক্কালে নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয় এই পাখি মহাদেবকে দেবী দুর্গার পুনরাগমনের সংবাদ পৌঁছে দেয়। রামায়ণেও এই পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়।
দশমী তিথি বাঙালি মনকে ভারাক্রান্ত করে। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অনুকরণে সকলের বলতে ইচ্ছা করে, “যেও না নবমী নিশি লয়ে তারা দলে তুমি গেলে দয়াময়ী এ পরাণ যাবে।”ঘরের মেয়ে উমা ফিরছে, আবার একটি বছরের অপেক্ষা তাই তাকে ঘিরে চলে বরণ, সিঁদুর খেলা, প্রাণের আকুতি মিশিয়ে প্রার্থনা – ‘মা, তুমি আবার এসো’।
এ প্রসঙ্গে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের একটি কাহিনী উল্লেখযোগ্য। রানী রাসমনির জামাতা মথুরামোহন জানবাজারে দুর্গোৎসবের শেষে দশমীর দিন মাকে বিসর্জন দেওয়ার ভাবনায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, প্রাণ থাকতে দেবী দুর্গাকে তিনি বিসর্জন দিতে পারবেন না। এই কথা শুনে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব তাকে অভয় দিয়ে বলেন যে, মা কি কখনো সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারে ? মা এতদিন তোমার বাড়ীর দালানে বসে পুজো নিয়েছেন এবার তোমার হৃদয়ে বসে পুজো নেবেন। মাকে কোথায় বিসর্জন দেবে ? বিসর্জন দেবে নিজের হৃদয়ে। ‘প্রাধানিক রহস্য’ গ্রন্থে বলা হয়েছে ‘নিরাকারা চ সাকারা সৈব…”। অর্থাৎ যিনি নিরাকার তিনিই সাকার – এই তত্ত্ব অত্যন্ত সরল ভাষায় মথুরা বাবুকে বুঝিয়ে দিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন, একটি জাতির সংস্কৃতির নিউক্লিয়াস তার ঘরোয়া সংস্কৃতি। বিজয়া দশমী তেমনই একটি ঘরোয়া সংস্কৃতি, এক মিলন উৎসব।এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য মিষ্টিমুখ। এইদিন গুরুজনদের প্রণাম ও আশীর্বাদ গ্রহণের সাথেই চলে মিষ্টিমুখ করা। আগে দশমী থেকে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পর্যন্ত চলত বিজয় দশমীর প্রণাম পর্ব। মুঠোফোন এসে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা বার্তা একটি স্পর্শেই চলে যাচ্ছে অন্যের কাছে। তবে দশমীর প্রণাম ও কোলাকুলি বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য – মুঠোফোনের বার্তা তাকে পূরণ করতে পারেনা। সময় বদলেছে, প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়েছে তবে আপামর বাঙালির হৃদয়ে দুর্গাপূজার উন্মাদনা চির অমলিন চির ভাস্বর।
প্রবন্ধের শুরুতে যে শ্লোকটির অবতারণা করা হয়েছে তার অর্থ – হে দেবী জগত জননী পূজিতা হয়ে তুমি নিজের স্থানে গমন করো এবং এক বছর পরে তুমি অবশ্যই আসবে। ভক্তের হৃদয় মন্দিরে সদা বিরাজমান মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তির বিসর্জন হলেও নিরাকারা দেবী সর্বব্যাপী, সর্বত্র বিরাজমান।
সুচরিতা চৌধুরী