মহাভারত মহাকাব্য ভগবান নারায়ণের জীবনের এক গৌরবময় উপাখ্যান, যিনি সৎ মানুষের রক্ষা, দুরাচারীকে শাস্তি দেওয়া এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ধরাধামে।
কৃষ্ণ ছিলেন অর্জুন সহ বাকি পান্ডবদের পথপ্রদর্শক। পঞ্চপান্ডবদের ন্যায়বিচার পাওয়ানোর লড়াইয়ের মাধ্যমে তিনি সারা বিশ্বের কাছে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র ধর্ম এবং নির্ভীক ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে একজন কিভাবে সমস্ত বাধাবিপত্তি কাটিয়ে জয়ী হতে পারে সেটাই ছিল এই নব দিশার মূল উপজীব্য।
তিনি ছিলেন গীতাচার্য। শুধু অর্জুনকেই নয়, বরং নিষ্ক্রিয়তা ও হতাশায় তলিয়ে যাওয়া প্রত্যেকের হাতেই তিনি অর্পণ করেছেন গীতা রূপ অমৃত।
বিভিন্নরূপে জন্মগ্ৰহন করা দুষ্ট অশুভদের ভার থেকে ধরিত্রী মা’কে মুক্ত করার জন্যই এই ঐশ্বরিক পরিকল্পনাটি গৃহীত হয়েছিল। এইসমস্ত আসুরিক অশুভ শক্তির অত্যাচার, উৎপীড়নে জর্জরিত দেবী বসুন্ধরা সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্তি জানিয়েছিলেন সমগ্ৰ সৃষ্টির সুরক্ষার জন্য। সুরাসুরের স্রষ্টা এই অশুভ শক্তির হাত থেকে ধরনীকে রক্ষা করার দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজের হাতে, আর হয়ে উঠেছিলেন এই পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণ, অধর্মের বিনাশের জন্য শিশুপালের মতো অধর্মীদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তৃতীয় পান্ডব অর্জুনের রথের সারথি হয়ে তিনি শুধু লড়াইয়ে সময় সঠিক দিকনির্দেশ করেননি বরং জীবনের ক্ষেত্রেও সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন এবং অবশেষে অধর্মের বিনাশের ঘটিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ধর্ম, ন্যায় এবং সুশাসন।
এই পবিত্র পরিকল্পনায় ভগবান নারায়ণ প্রত্যক্ষভাবে এবং মহাদেব পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পৃথিবীর বুক থেকে অধর্মকে সমূলে ধ্বংস করার এই মহাযজ্ঞে ভগবান মৃত্যুঞ্জয়ের উপস্থিতির সাক্ষী হয়ে থেকেছি আমরা।
পাণ্ডবদের সাথে দ্রৌপদীর বিবাহে শিবের ভূমিকা ছিল:
বেদব্যাস রাজা দ্রুপদের কাছে তাঁর কন্যার জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করার সময় জানিয়েছিলেন যে পূর্বজন্মে দ্রৌপদী সদাশিবের কাছে থেকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে নিজের স্বামী হিসাবে পাওয়ার প্রার্থনা করেছিলেন এবং নলয়িনী কিভাবে ভগবান শিবের কাছ থেকে পরজন্মে পাঁচজন স্বামীকে পাওয়ার আশীর্বাদ পেয়েছিলেন সেই কথাও তিনি রাজাকে জানান। এই কাহিনী শোনার পর রাজা দ্রুপদ এই অস্বাভাবিক মৈত্রী বন্ধনের তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলেন। এই বিবাহ কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না বরং বলা যায় যে, এটাই ছিল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ।
পাণ্ডবদের ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্যই অলক্ষ্যে থেকে ভগবান শিব এই বিবাহকে সমর্থন করেছিলেন। দুরাচারী দুর্যোধন ও তাঁর অনুগামীদের ধ্বংস করার পিছনে এই বিবাহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
রাজকুমারী দ্রৌপদীর সাথে পঞ্চপান্ডবের এই বিবাহে রাজা দ্রুপদ প্রথমে রাজী না হলেও পরে
ব্যাসদেবের কাছ থেকে পূর্বজন্ম রহস্যের কাহিনী শোনার পর তিনি নিজের কন্যার বিবাহে সম্মতি দিয়েছিলেন। এই বিবাহের পর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রাজত্ব থেকে পান্ডবদের প্রাপ্য অংশ দেওয়ার দাবি জানানোর বিষয়টি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিবের কৃপায় অম্বা জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীখন্ডী হিসাবে:
কাশীর রাজকন্যা অম্বা’কে ভীষ্ম স্বয়ম্বর সভা থেকে অপহরণ করেছিলেন। পরে ভীষ্ম অম্বা’র নির্বাচিত সালওয়ার কাছে যাওয়ার অনুমতি দিলেও অম্বা সেখানে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন এবং পরে পরশুরাম ও ভীষ্মের মধ্যে হওয়া যুদ্ধের কারন হয়ে ওঠেন এই অম্বা।
ভীষ্মের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে মরিয়া অম্বা তপস্যা, উপাসনার মাধ্যমে সদাশিবকে প্রসন্ন করেছিলেন এবং পরবর্তী জন্মে নিজের ইচ্ছাকে পূর্ণ করার আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন।
এর আরও একটি দিক ছিল এবং এই প্রতিশোধের গল্পটির সাথে দ্রুপদও জড়িত ছিলেন। ভীষ্মকে হত্যা করার জন্য দ্রুপদ একটি পুত্র সন্তান চেয়েছিলেন যে নিজের ক্ষমতা ও সংকল্পের জোরে বলীয়ান হয়ে পিতার ইচ্ছাপূরণ ঘটাবে। সেইজন্য তিনি তপস্যা করে শিবকে সন্তুষ্ট করেছিলেন।
দৃষ্টদুম্ন এবং দ্রৌপদীকে লাভ করার আশায় দ্রোন এবং তাঁর যজ্ঞকে অপমান করার অনেক আগেই এই ঘটনাটি ঘটেছিল।
ভীষ্ম এই কাহিনী উদ্যোগ পর্ব (৫.১৯৯)-এ দুর্যোধনের কাছে বর্ণনা করেছিলেন।
দ্রুপদ সদাশিবের কাছে পুত্র লাভের আশায় প্রার্থনা করেছিলেন কিন্তু শিব বলেছিলেন যে তাঁর সন্তান হবে পুরুষ ও স্ত্রী উভলিঙ্গের। শিব তাঁকে আরও বলেছিলেন যে এটাই তাঁর নিয়তি যা নিজের নিয়মেই চলবে।
এরপর আমরা দেখতে পাই অম্বা এবং দ্রুপদের ভাগ্য কিভাবে একসাথে মিলে গিয়েছিল এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শিখন্ডীর উপস্থিতিতে ভীষ্মের পতন ছিল পূর্বনির্ধারিত, যার কারিগর ছিলেন স্বয়ং মহাদেব।
স্বয়ম্বর সভার সাফল্যের জন্য মহেশ্বরের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন দ্রুপদ:
অর্জুনকে নিজের জামাতা হিসাবে লাভ করা ছিল দ্রুপদ রাজের অনেক দিনের বাসনা। লাক্ষ্মাগৃহে পান্ডবদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা পরেও যে তাঁরা সকলেই বেঁচে ছিলেন সেই কথা তিনি উপসূতির কাছে শুনেছিলেন।
অর্জুনকে সময়মতো স্বয়ম্বর সভায় এনে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করার জন্য দ্রুপদ কঠিন একটি লক্ষ্য স্থির করেছিলেন এবং মহেশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে সদাশিবের আশীর্বাদে স্বয়ম্বর হয়ে উঠবে সাফল্যমন্ডিত। তিনি কিন্ধুরা নামক একটি ধনুক রেখেছিলেন এই সভায়। এই ধনুক ভগবান তাঁর পূর্বপুরুষ সৃঞ্জয় ভাইয়াঘড় পদকে প্রদান করেছিলেন।
কিরতের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন অর্জুন :
বন পর্বের মূল অংশ ছিল কিরতা-অর্জুন। এই গল্পটি সংস্কৃত সাহিত্যের পাঁচটি মহাকাব্যের অন্যতম। ভারভী’র লেখা “কীরতার্জুনীয়ম্” সংস্কৃত সাহিত্যের সম্পদ।
মহাদেবের কাছ থেকে পশুপতাস্ত্র না পাওয়া পর্যন্ত ইন্দ্র তাঁর পুত্রকে স্বর্গের থেকে অন্যান্য অস্ত্র সংগ্রহের অনুমতি দেননি। ইন্দ্র পরিষ্কারভাবে অর্জুনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে আদি ধনুর্দ্ধর শিবই হলেন সকল অস্ত্রের উৎস। আর তাই তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া অস্ত্র লাভ করা অসম্ভব।
শিব অর্জুনকে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র প্রদানের আগে তাঁর দক্ষতা এবং ক্ষমতা পরীক্ষা করেছিলেন। তারপরে তিনি অর্জুনকে স্বর্গে গিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণের অনুমতি দিয়েছিলেন।
শিবের কৃপায় কেবলমাত্র অর্জুন সমস্ত প্রকার অস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জয়দ্রথকে শিবের বর দান:
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পটপরিবর্তনের ক্ষেত্রে জয়দ্রথকে মহাদেবের বর দান ছিল একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে অপহরণ করার পর পাণ্ডবরা তাঁকে অত্যন্ত অপমান করেছিলেন। সেই অবমাননার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন জয়দ্রথ। আর তাই শুরু করেছিলেন কঠোর তপস্যা। সন্তুষ্ট করেছিলেন মহাদেবকে।
শিব তাঁকে কাঙ্খিত বরদানে সম্মত হয়েছিলেন শুধুমাত্র একটি প্রার্থনা ছাড়া। শুধু একদিনের জন্য অর্জুন বাদে বাকি চার পাণ্ডবের কাছে জয়দ্রথ হয়ে উঠবে অপরাজেয় এবং সেদিনটি ছিল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিন। অভিমন্যু অর্জুনের অনুপস্থিতিতে চক্রব্যুহে প্রবেশ করে কৌরব পক্ষের মহারথীসহ বাকি কৌরব সেনাদের উপর আঘাত হেনেছিল। কিন্তু জয়দ্রথ তাঁর বর কাজে লাগিয়ে চার পাণ্ডবের সামনে চক্রব্যুহের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অভিমন্যু তাই পান্ডবদের পক্ষ থেকে কোনরকমের সহায়তা পায়নি এবং নিজের ক্ষমতা ও দক্ষতার চরম প্রদর্শনের পর বীরের মতো মারা যায়।
পরের দিন সূর্যাস্তের আগে অর্জুনের জয়দ্রথকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা কৌরবদের জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়েছিল। যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবার অর্জুন ক্রোধের সাথে লড়াই করেছিলেন এবং জয়দ্রথের সাথে সাতটি অক্ষোহিনী বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করেছিলেন।
জয়দ্রথের উপর শিবের এই আশীর্বাদ প্রকৃতপক্ষে বিজয়ীদের জন্যই সুফল বয়ে নিয়ে এসেছিল।
কৈলাশ যাত্রা:
অভিমন্যুর মৃত্যুর রাতে অর্জুন নিজের পুত্রের হত্যায় অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন এবং সেই রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন কৈলাশে গিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য মহাদেবের কাছ থেকে পশুপতাস্ত্র গ্ৰহনের দৃশ্য।
কৃষ্ণ বলেছিলেন সেই বিশেষ মন্ত্র যদি অর্জুনের স্মরণে না থাকে তাহলে তিনি যেন ত্রি-নয়নের অধীশ্বরের কাছে সেই মন্ত্র পুনরায় লাভ করার জন্য প্রার্থনা করেন।
অর্জুন ব্রাম্ভ্র মুহূর্তে কায়মনোবাক্যে ভগবান শিবের কাছে নিজের প্রার্থনা জানাতে বসেছিলেন। এই সবকিছুই তাঁর স্বপ্নে ঘটছিল। তিনি ভব’কে মনে মনে প্রনাম জানিয়ে নির্ভুল পশুপত মন্ত্রের জ্ঞান পুনরায় লাভ করতে চাইলেন।
তারপরে তিনি তাঁর চিরসখা কৃষ্ণের সাথে হিমালয় যাত্রার দৃশ্য দেখেছিলেন।
অর্জুন স্বপ্নে কৈলাসে অধিষ্ঠিত সদাশিব এবং তাঁর শক্তি প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
মহেশ্বরের দেহ থেকে নির্গত প্রতিরূপ এক ব্রহ্মচারীকে এই বিশেষ ধনুক ব্যবহারের মন্ত্র এবং পদ্ধতি প্রদর্শন করেছিলেন।
অর্জুন মন্ত্র ব্যবহারের পদ্ধতি জানার পাশাপাশি নিজের প্রতিজ্ঞা পূরনের জন্য ত্রিনয়নের অধীশ্বরের কাছ থেকে আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন।
শিবের আশীর্বাদ প্রাপ্ত অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করে নিজের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেছিলেন।
স্বয়ং মহাদেব কর্ণ-অর্জুনের চূড়ান্ত লড়াই প্রত্যক্ষ করেন এবং পান্ডবদের বিজয়ী পক্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন:
১৭তম দিনে যখন কর্ণ এবং অর্জুন একে অপরের মুখোমুখি হতে চলেছেন তখন সমস্ত ঈশ্বর স্বর্গলোক থেকে এই যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে থেকে ছিলেন। সদাশিব এবং ব্রহ্মাও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বন্দ্বটি প্রত্যক্ষ করতে এসেছিলেন।
ইন্দ্র এবং সূর্য উভয়েই তাদের পুত্রদের সাফল্য কামনা করেছিলেন এবং শিব ও ব্রহ্মাকে তাঁদের আশীর্বাদ এই দুই মহারথীর উপর দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
এই দুই দেব পার্থকে বিজয়ী হিসাবে ঘোষণা করেন কারণ এই জয় ছিল ঈশ্বরের উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য। তার সাথে এটাও জানান যে এই নর এবং নারায়ন পুরো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কাছে অজেয় হয়ে থাকবে।
এইভাবেই শিব অর্জুনকে আশীর্বাদ করেছিলেন যাতে তিনি কর্ণকে হারিয়ে পাণ্ডবদের বিজয়ের পথ প্রশস্ত করতে পারেন।
রুদ্রের ইচ্ছাতেই পাঞ্চালদের এবং সৃঞ্জয় ও উপ পাণ্ডবদের নিশ্চিহ্ন করতে পেরেছিলেন অশ্বত্থামা:
যুদ্ধের শেষে মধ্যরাত্রে মধ্যে ঘটা সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছিল দেবাদিদেব মহাদেবের ইচ্ছাতেই। মধ্যরাতে অশ্বত্থামা পান্ডব শিবিরে প্রবেশ করে পাণ্ডবদের পাঁচ পুত্র, দৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, যুধিমান্যু, উত্তমৌজ সহ বাকি যুদ্ধ ফেরতদের হত্যা করেছিলেন। তিনি নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ভগবান রুদ্রর কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেন এবং ত্রি নয়নের অধীশ্বর তাঁকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের বধ করার অনুমতি দিলেন।
তারপর ভগবান মহাদেব অশ্বত্থামার দেহের প্রবেশ করে হয়ে উঠলেন অসীম শক্তিধর, ঈশ্বরিক সত্তায় ভরপুর একটি দেহ। দেবতা থেকে প্রাপ্ত সেই শক্তির বলে তিনি হয়ে উঠলেন সর্বশক্তিমান। যক্ষ, রাক্ষস সবাইকে পিছনে ফেলে তিনি রওনা হলেন তাঁর শত্রুদের শিবিরে প্রবেশের জন্য। (১০.৭)।
এইভাবেই আমরা পুরো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জুড়ে শিবের উপস্থিতি এবং একাত্মতা দেখতে পাই। এমনকি অর্জুন এ’কথা ব্যাসদেবকে জানিয়ে ছিলেন যে তিনি মহেশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন।
অর্জুনের রথের সম্মুখভাগে ছিলেন স্বয়ং মহাদেব :
দ্রোণ পর্বের শেষে, অর্জুন ব্যাসকে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর রথের সম্মুখভাগে কোন মহাবীর অধিষ্ঠিত ছিলেন যিনি তাঁর তীর নিক্ষেপের আগেই প্রতিপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করছিলেন।
ব্যাস তখন অর্জুনের কাছে মহাসত্যটি উদ্ঘাটন করে জানান যে সেই মহাবীর ছিলেন স্বয়ং দেবাদিদেব মহেশ্বর। তিনি হলেন এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির কারণ, স্বর্গ-মর্ত-পাতালের অধীশ্বর এবং সমগ্ৰ ব্রহ্মাণ্ডের রক্ষক। যাঁর অপর একটি নাম হ’ল ঈশান।(৭.২০২)
ব্যাস এখানে শতরূদ্রকে ভিন্ন ভিন্ন নামে বর্ননা করেছেন যা সদাশিবের মহিমাকে আরও গৌরবান্বিত করে তুলেছে।
ব্যাসদেব অর্জুনকে বলেছিলেন যে বেদ-এ পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা স্তোত্র যারা শুনবে এবং পাঠ করবে তারা জীবনে সমৃদ্ধি এবং বিজয় লাভ করবে। তিনি অর্জুনকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে স্বপ্নে তিনি কৈলাশ পর্বতে অধিষ্ঠিত যে ঈশ্বরের দর্শন পেয়েছিলেন তিনিই হলেন এই পরমেশ্বর।
আরও কিছু ঘটনা যেখানে ভক্তদের উপর মহাদেবের আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছিল:
গান্ধারী ছিলেন এক মহান শিবভক্ত। তিনি শিবের আশীর্বাদে শতপুত্র লাভ করেছিলেন।
চিত্রাঙ্গদা (অর্জুনের স্ত্রী) চিত্রবাহনের কন্যা, যার বংশ শিবের কাছ থেকে এমন এক সন্তান লাভের বর পেয়েছিলেন, যে যুদ্ধাপরাধী হবে।
উপমন্যু ছিলেন মহান শিবভক্ত। তিনি কৃষ্ণের কাছে শিবের সহস্রনাম জপ করে কিভাবে তাঁর দর্শন পেয়েছিলেন সেই ঘটনার বর্ণনা করেছিলেন।
শিবের কৃপায় পুত্র লাভের জন্য রুক্মিনীর সাথে কৃষ্ণ তপস্যা করেছিলেন। তিনি শিবের আশীর্বাদে তাঁর অন্য পুত্র সাম্ব-কে পেয়েছিলেন, যাঁর মাতা ছিলেন জাম্ববতী।
আনুশাসন পর্বে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উমা এবং মহেশ্বরের কথোপকথন দেখা যায়।
শিব এবং কেশব একে অপরের থেকে আলাদা নয়
মহাভারতে ব্যাসদেব শিব-কেশবের অভিন্নতার তত্বকে মহিমান্বিত করেছেন। তিনি আমাদের পঞ্চম বেদের মাধ্যমে বিষ্ণু সহস্রনাম এবং শিব সহস্রনাম উপহার দিয়েছেন। মহাভারত থেকে এই সত্যকে উপস্থাপিত করা হয়েছে যে শিব হলেন বিষ্ণুর হৃদয় এবং বিষ্ণু হলেন শিবের হৃদয়।
বন পর্বের মধ্যে যখন অর্জুন শিবের দর্শন পেয়েছিলেন, তখন তিনি দেখেছিলেন যে প্রতি রাতে কৃষ্ণের প্রতি নিবেদন করা উপাসনা-সামগ্রী দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে রয়েছে। (৩.৯৯)
বেদব্যাস এই একই সত্য হরিবংশ পর্বে তুলে ধরেছেন।
শিব বিষ্ণুরূপে এবং বিষ্ণু শিব রূপে ত্রিলোক শাসন করছেন। তাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই এবং উভয়ই পবিত্রতা, মঙ্গল প্রদান করেন। সুতরাং মহাভারত মহাকাব্য কৃষ্ণের সাথে সাথেই শিব’কেও পেয়েছে যাঁরা দ্বাপর যুগে ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রধান কারিগর ছিলেন।
উৎস উল্লেখ:
মহাভারতের বরি সমালোচনা সংস্করণ, সংস্কৃত সংস্করণ
কেএম গাঙ্গুলি-র অনুবাদিত মহাভারত, ইংরেজি অনুবাদ।
মহাভারত দক্ষিণী সংস্করণ, কুম্ভকোনম সংস্করণ
গীতা প্রেস গোরক্ষপুর হিন্দি অনুবাদ মহাভারতের
হরিবংশ। মহাভারতের সম্পদ।
ডঃ লক্ষী তেলিদেভরা