কল্যাণ চক্রবর্তী।
বাঙালির কাছে শিব যতটা না দেবতা, তার চাইতেও সে আপন পরিবারের অন্যতম এক সদস্য। একটি ছড়ায় তিনি জামাই হয়ে চিত্রকল্প রচনা করিয়ে দিয়েছেন লোককবিকে। আর তারই সুবাদে ছড়ার স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় গ্রামীণ জীবনে জামাই-আদরের এক ঝলক –
“এপার গঙ্গা, ওপার গঙ্গা, মধ্যিখানে চর ।
তারি মধ্যে বসে আছে শিব সদাগর ।
শিব গেল শ্বশুরবাড়ি, বসতে দিল পিঁড়ে ।
জলপান করতে দিল শালিধানের চিঁড়ে ।
শালিধানের চিঁড়ে নয় রে, বিন্নধানের খই।
মোটা মোটা সবরি কলা ,কাগমারে দই।”
শালিধানের চিঁড়ে, বিন্নিধানের খই, সবরি কলা আর কাগমারী দই দিয়ে শিব-কে ফলাহার করতে দিয়েছেন শ্বশুর বাড়ির লোকজন। শিব এসেছেন কোথা থেকে, না গঙ্গার মাঝে জেগে ওঠা চর থেকে। দু’পাশে দুই জলধারার মাঝে জেগে উঠেছে মাঝের চর। পলিমাটিতে অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ ভূমিতে হয়তো তিনি চাষাবাদ করেন। আর শিব যে কৃষি দেবতা তা তো বাঙালি আগেই প্রতিপন্ন করে দিয়েছেন ” ধান ভানতে শিবের গীত ” প্রবাদের মধ্যে।
আরেকটি ছড়ায় দেখা যায় শিব ঠাকুরের বিয়ের কথা, “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/নদে এলো বান,/ শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যা দান।” বর্ষার বৃষ্টি, নদীতে বান আসার কথা। অনুমান করে নেওয়া যায়, চরের জমিতে বোরোধান চাষ করা যায়, আউশধানও। কিন্তু বর্ষায় বান এলে চাষাবাদের পালা গুটিয়ে নিতে হয়। সাধারণ যাযাবর কৃষকের মতোই তিনি চরের অস্থায়ী ঠিকানা ছেড়ে এ কয় মাস গ্রামীণ জীবনে উঠে আসেন, আবারও অস্থায়ী ঠিকানা গড়ে ওঠে। বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তিনি। কৌলিন্য প্রথায় জামাই বাড়ন্ত। কৃষক শিবকেই তাই তিন কন্যা বিয়ে করে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার দায়ভার মুক্ত করতে হয়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এভাবে দেবতা শিবকেও জুড়ে দেন কল্পনাপ্রবণ বাঙালি। আর তখনই তিনি দেবতা না হয়ে গ্রামীণ মানুষের সুখ দুঃখের নিত্য জীবনের সঙ্গী হয়ে যান। দেবতাকে এত কাছের করে নিতে পারেন আর কে আছেন, বাঙালি ছাড়া।