সনাতন ধর্ম ও সংস্কৃতির দীপশিখা প্রায় ২৫০০ বছরের বৈদেশিক আঘাত সহ্য করেও যে সমস্ত মহাপুরুষদের জন্য বিশ্ব সভ্যতার কল্যাণে প্রজ্জ্বলিত হয়ে আছে তার মধ্যে আদি শঙ্করাচার্য অন্যতম।অষ্টম শতাব্দীতে কেরলের কালাডি গ্ৰামে শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের পূর্বেই ভারতবর্ষের সিন্ধ প্রদেশ আরবীয় লুটেরাদের দখলে চলে গেছে। ভারতবর্ষের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন মত ও সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে যারা নিজেদের উপাসনা পদ্ধতিকে শ্রেয় জ্ঞান করে বেদের প্রামাণিকতাকে স্বীকার করতেন না।ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের প্রাচীনতম গ্ৰন্থ বেদ আর ভারতবর্ষ বেদভূমি নামেই পরিচিত। ভারতীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করতে হলে বেদকে বিকৃত করতে হবে — একথা ইউরোপীয়রা বুঝেছিল বলেই বেদের বিকৃত অনুবাদ করেছে।ইংরেজ আমলে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী বেদের সঠিক অর্থ তুলে ধরেন।
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর আবির্ভাবের ১০০০ বছর পূর্বে আদি শঙ্করাচার্য ‘বেদভূমি’র সাংস্কৃতিক অখন্ডতা রক্ষা করতে বেদকে পাথেয় করেন।
বৈদিক ধর্ম থেকে দূরে সরে বাদ-বিবাদ , কুতর্ক, সামাজিক কুরীতি ও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ভারতবর্ষে; শঙ্করাচার্য অসাধারণ মেধা, অকল্পনীয় শাস্ত্রজ্ঞান ও দূরদৃষ্টির সাহায্যে সনাতন ধর্মের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ইতিপূর্বে ভারতবর্ষে গ্ৰীক , পার্সিয়া, শক ,কুষাণ,হুণ,আরবের আক্রমণ ঘটেছে আর শঙ্করাচার্যের তিরোধানের পরেও মোঘল , পর্তুগিজ, ইংরেজদের আক্রমণ ঘটেছে কিন্তু শঙ্করাচার্য নিজের ৩২ বছরের আয়ুষ্কালে সনাতন ধর্মকে এমন শক্ত ভীতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর তিরোধানের ১২০০ বছর পরেও বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে ভারতবর্ষ পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
শঙ্করাচার্য ৯ বছর বয়সে আচার্য গোবিন্দপাদের শিষ্যত্বে সন্ন্যাস গ্ৰহণ করেন আর ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে ব্রক্ষ্মসূত্র ,১১ টি উপনিষদ ও শ্রীমদ্ভগবদগীতার ভাষ্য রচনা করেন।এরপর জীবনের বাকি ১৬ বছরে হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা এবং আসাম থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত পদযাত্রায় পরিভ্রমণ করে সনাতন ধর্মে বলসঞ্চার করেন। ভারতবর্ষের চারপ্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক অখন্ডতা রক্ষার পথ নির্দেশ করেন।পূর্বে পুরীধামে গোবর্ধন মঠ আর পশ্চিমে দ্বারকায় শারদা মঠ, উত্তরে বদ্রীনাথে জ্যোতির্মঠ, দক্ষিণে রামেশ্বরে শৃঙ্গেরী মঠ প্রতিষ্ঠা করে যথাক্রমে খগ্বেদ, সামবেদ,অথর্ববেদ ও যজুর্বেদের জ্ঞানকে রক্ষার দায়িত্ব দেন।প্রত্যেক মঠকে আধ্যাত্মিকতার চরম বিন্দু হিসেবে চারবেদের চারটি মন্ত্র দেন।
সনাতন সংস্কৃতি ও বৈদিক জ্ঞানকে ভারতবর্ষব্যাপী ছড়িয়ে দিতে দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উদ্ভব করেন।বন,অরণ্য,গিরি,পর্বত,সাগর,তীর্থ,আশ্রম,পুরী,ভারতী ও সরস্বতী সম্প্রদায় ১৪০০ বছর পরেও নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে চলেছে।ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক অখন্ডতা রক্ষা করতে যে ,শাস্ত্রজ্ঞ সন্ন্যাসীর সাথে শস্ত্র চালনায় দক্ষ সন্ন্যাসীর প্রয়োজন তা প্রখর দূরদৃষ্টির অধিকারী শঙ্করাচার্য বুঝেছিলেন। যে নাগা সম্প্রদায় মরুদস্যুদের হাত থেকে ভারতীয় নারীর সম্মান ও সনাতন সংস্কৃতি রক্ষার্থে প্রাণ বলিদান দিতেও পিছপা হয় নি, তা ভগবান শঙ্করাচার্য দ্বারা সৃষ্ট এই দশনামী সম্প্রদায়ের একটি শাখা।১৩৩৬ সাল অর্থাৎ শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের প্রায় ৫৫০ বছর পরে আরবীয় অপসংস্কৃতি কে পরাস্ত করে যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তার মূলে ছিল শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্গেরী মঠের মঠাধীশ স্বামী বিদ্যারণ্য বা মাধবাচার্যের কুটনৈতিক জ্ঞান। শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব না হলে হয়তো ভারতীয় সংস্কৃতি বৈদেশিক অপসংস্কৃতি, অভ্যন্তরীণ কুরীতি, মতভেদ ও বাইরের নৃশংসতায় মায়া, মিশর,রোম, ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের মতো বিলুপ্ত হয়ে যেতো।
শঙ্করাচার্য সনাতন ধর্মের সমস্ত মতবিরোধকে বিলুপ্ত করতে বেদান্তকেই ঐক্যসূত্র রূপে গ্ৰহণ করেছিলেন আর তার প্রায় ১১০০ বছর পরে বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ আদি শঙ্করাচার্যের পথেই বেদান্তকে শুধু ভারতবর্ষের জন্যই নয় বরং বিশ্বের সমস্ত সম্প্রদায়ের , সমস্ত উপাসনা পদ্ধতির মিলনক্ষেত্র রূপে চিহ্নিত করেছেন।
অষ্টম শতাব্দীতে একদিকে যখন আপন মত প্রতিষ্ঠার জন্য ইউরোপ ও আরবে খোলা তলোয়ার হাতে শক্তি প্রদর্শন আর রক্ত ঝরানোর প্রতিযোগিতা চলছে আদি শঙ্করাচার্য তখন সারা ভারতবর্ষে তর্ক ও যুক্তির মাধ্যমে বেদের জ্ঞানকে প্রমাণ করছেন। কর্মকাণ্ডের সমর্থক মন্ডন মিশ্র তর্কে পরাজিত হয়ে শঙ্করের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।সারা পৃথিবীর ইতিহাসে তর্কের মাধ্যমে মতপ্রতিষ্ঠা ও শিষ্যত্ব প্রদানের এহেন উদাহরণ ভারতবর্ষ ব্যতীত আর একটিও নেই।
শঙ্করাচার্য সৃষ্টিতত্ত্ব তথা স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কিত যে অদ্বৈত দর্শন দিয়েছিলেন তা দিয়েই পরবর্তীকালে বৈষ্ণব আচার্য রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও শ্রীচৈতন্যদেবের অচিন্ত্য ভেদাভেদ দর্শনের আলোচনার পথ তৈরি হয়।বলা যেতে পারে বেদান্ত দর্শনকে আলোচনার কেন্দ্রে স্থাপন করা এবং সগুণ ও নির্গুণ ব্রক্ষ্মোপাসনার মাধ্যমে ভক্তি আন্দোলনের সূচনাকারী শঙ্করাচার্য ,যিনি বৈদেশিক আক্রমণ ও পাশবিকতার মধ্যে ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিকতার প্রাণপাখি বেদান্তকে বাঁচিয়ে রাখার পথিকৃৎ।
পিন্টু সান্যাল