নদীমাতৃকা দেবী সরস্বতী প্রথম পর্ব

প্রথম পর্ব

ধরাতলে

                 চঞ্চলতা সব-আগে নেমেছিল জলে।

                       সবার প্রথম ধ্বনি উঠেছিল জেগে

                                        তারি স্রোতোবেগে।

প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল জলে।পঞ্চমহাভূতের দ্বিতীয়টি তাই প্রকৃতির সম্পদে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে সর্বজনস্বীকৃত । জলই হল জীবন ।  আমাদের শরীরের শতকরা ৭১ ভাগই হল জল। ভূপৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ ও সমগ্র স্থলমন্ডলের এক-পঞ্চমাংশ কঠিন হয়ে যাওয়া জলের অর্থাৎ তুষার ও হিমকণা দ্বারা আবৃত।

 মৃৎপিন্ড জলরেখায়া বলায়িতঃ

ভূখণ্ডের অর্ধেকের অধিক অংশ জলীয় বাষ্পের মেঘে বা সূক্ষ্ম জলকণায় আচ্ছন্ন। যেখানে মেঘ নেই সেখানেও জলীয় বাষ্প সর্বদা রয়েছে। আন্তঃকোষ পদার্থে জলই হল প্রধান প্রবাহীতরল। তাই জলধারার সঙ্গে জীবনধারার তুলনা করা হয়। তাই বেদে উচ্চারিত হয়েছে –

তস্যা সমুদ্রা অধি বি ক্ষরন্তি তেন জীবন্তি প্রদিশশ্চতস্রঃ।

তত ক্ষরত্যক্ষরং তদ্বিশ্বমুপ জীবতি।। ( ঋগ্বেদ)

তার থেকে সমুদ্রের সকল জলরাশি উদ্ভূত , তার দ্বারা চর্তুর্দিক প্রাণীত হয়।  এ থেকে যে অবিনাশী বহতা ধারার সৃষ্টি , তাতেই জগতের সকল জীব প্রাণপ্রাপ্ত হয়। 

আপো হি ষ্ঠা ময়োভুবস্তা ন ঊর্জে দধাতন। 

মহে রণায় চক্ষসে।।

যো বঃ শিবতমো রসস্তস্য ভাজয়তে নঃ।

উশতীবির মাতরঃ ।।

হে জল তুমি সুখের আধার স্বরূপা। তুমি অন্ন সঞ্চয় দাও। তুমি বৃষ্টি দান কর। হে জল , তুমি স্নেহময়ী জননীর ন্যায় অতি সুখকর রসে ভোগী কর আমাদের। 

ঈশানা বার্যানাং ক্ষরন্তীশ্চর্যনীনাম্ । আপো যাচামি ভেষজম্।।

যা কিছু মহার্ঘ্য , অভিলাষিত – জলই তাদের অধীশ্বরী , যা কিছু প্রাণময় , গতি সমৃদ্ধ জলই তাদের ধাত্রী। সেই জলের নিকট আমি ওষধি প্রার্থনা করি। 

বেদের পৃথিবী সূক্তে বলা হয়েছে – 

যস্যাং সমুদ্র উত সিন্ধুরাপো যস্যামন্নং কৃষ্টয়ঃ সম্ভভুবুঃ।

যস্যামিদং জিন্বতি প্রাণদেজৎ সা নো ভূমিঃ দধাতু ।। ( অথর্ব বেদ ) 

ভূমাতা সর্ব অঙ্গের মধ্যে জলও একটি অঙ্গ। তাই ভূমাতার আরাধনার সঙ্গে জলের মহিমাও কীর্তিত হয়েছে। সমুদ্র বেষ্টিত প্রাণোচ্ছল বহতা নদী সমন্বিত এই যে এই যে পৃথিবী – যার ভূমি কর্ষণে  আমাদের অন্ন আসে, সেখানে প্রাণের সবকিছু পরিপোষিত , কম্পিত , রোমাঞ্চিত হয় –  সেই পৃথিবী আমাদের উপযুক্ত করুন অমৃতময় সেই জীবনবারির ওষ্ঠস্পর্শী পানে। জীবন যাত্রার সব পর্যায়ে জলের উপর একান্ত নির্ভরতা বেদের অপর একটি সূক্তে ব্যক্ত হয়েছে। 

যা আপো দিব্যা উত বা স্রবন্তি খনিত্রমা উত বা যঃ স্বয়ংজাঃ।

সমুদ্রার্থা যা শুচয় পাবকাস্তা আদৌ দেবারিহ মামবন্তু।।

যে জল অন্তরিক্ষে উৎপন্ন হয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে। যা ভূমি প্রবাহিত , অথবা যা খননের দ্বারা লাভ করা যায় বা যা স্বয়ং উৎপন্ন হয়ে সমুদ্র অভিমুখে ধাবিত হয় , দীপ্তিমান পবিত্রকর সেই জলের দেবীরা আমায় রক্ষা করুন। 

সেই জল বা নদীকে কেন্দ্র করে যুগ হতে যুগান্তে গড়ে উঠেছে সভ্যতা, গ্রাম, সমাজ , নগর , বাণিজ্য , অর্থনীতি। সেখান হতেই সনাতনী অখন্ড ভারতে নদী হয়েছেন দেবী, অমৃত স্বরূপা। তেমনি একটি নদী হলেন #সরস্বতী। তিনি দেবী। তিনি মহাবিদ্যা। তাঁকে নিয়ে তাঁর সভ্যতা নিয়ে আমাদের মনে হাজারো প্রশ্ন ।  দেবী হতে নদী , নদী হয়ে দেবী কিন্তু তাঁকে নিয়েই এত প্রশ্ন কেন ? গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা, গোদাবরী থেকে স্বতন্ত্র দেবী সরস্বতী নদী। তাঁকে নিয়েই তো আলোচনার দরকার আছে। তিনি প্রাচীন , তিনি সনাতনী। ত্রিবেণী সঙ্গমের তৃতীয় নদীর সম্পর্কে আমরা সনাতনীরা জানব না ? কেন কেবল তিনটির স্থানে দুটি নদীর সঙ্গমে স্নান করে পুন্য লাভ করব ? তাই দেবী স্বরূপা নদী সরস্বতী র সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন আছে বৈকি….

যিনি বিদ্যা , প্রজ্ঞা, বুদ্ধি স্বরূপা থেকে জীবনদায়ী অমৃতধারা স্বরূপা হয়ে  বেদ , বেদান্ত ( ব্রাহ্মণ , আরণ্যক, উপনিষদ ইত্যাদি) থেকে শুরু করে প্রতিটি পুরাণ ,মহাভারত জুড়ে অবস্থান করছেন তাঁকে জানাই তো আমাদের জীবনের অমৃত প্রাপ্তির সমান। কেন তাঁর এত আদর কোথায় হারিয়ে গেলেন তিনি? 

বেদের সব থেকে প্রাচীনভাগ হল ঋগ্বেদ। তার প্রতিটি মন্ত্রের নিমিত্ত ব্রহ্ম বা শক্তি আছেন। ব্রহ্ম এবং শক্তি অর্থাৎ যা নিরাকার অথচ সর্বব্যাপী , যা কল্যাণকামী কিন্তু প্রয়োজনে ভয়াল। যিনি মন্ত্রটি রচনা করেছেন সেই ঋষির নাম আছে এবং আছে কোন ছন্দে শ্লোকে মন্ত্রটি রচনা করা হয়েছে।

বেদের শক্তিরূপা আদি পরাশক্তি, দিতি, অদিতি , ঊষা , সরস্বতী , ইলা , ভারতী, ইন্দ্রাণী, সীতা, সরমা, যমী প্রমুখের নাম উল্লেখ আছে। এর সকলের মধ্যে আদি পরাশক্তি যিনি পরম ব্রহ্মের সঙ্গে লীন তিনি ব্যতীত এক এবং একমাত্র সরস্বতী হলেন অযোনি সম্ভবা । তিনি দেবী , শক্তি স্বরূপা বিদ্যা এবং নদী। দেবী সরস্বতীর এই উত্তরণ বড় আশ্চর্য ঘটনা , এক এবং অদ্বিতীয়।

সুপ্রাচীন কাল মানব সনাতনী। মানব নিরাকার যেকোনো শক্তিকে উপাসনা করে এসেছেন। সেই শক্তি আদি, অন্তত। সেই শক্তি আসে নানারূপে এবং নানা ভাবে মহাশূন্য থেকে। সেই শূন্য এবং শক্তি কল্যাণকামী। তার উপাসনা চিরকাল ছিল। এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। মহামায়ার সংসারে সুখকে খুঁজে নিতে হয়। মৃত্যুময় জগতে মানবকে অমৃতের সন্ধান করতে হয় । 

শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা

আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূ ।।

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্‌

আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ ।

তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি

নান্যঃ পনথা বিদ্যতে অয়নায় ।।

            (শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ )

                          শোনো বিশ্বজন ,

শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ

দিব্যধামবাসী , আমি জেনেছি তাঁহারে

মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে

জ্যোতির্ময় । তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি

মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো , অন্য পথ নাহি ।

যা বা যার থেকে মানব খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান পায় বা উপকৃত হয় তাই পূজ্য। আদিম সনাতনী বিশ্বাস এমনই। প্রতিটি মানবজাতির মধ্যেই সেই ব্রহ্ম ও শক্তির অবস্থান ছিল নানাভাবে , নানা রূপে। সেখানে ব্রহ্মই হলেন রুদ্র , সয়ম্ভূ, আদিম এবং শক্তি হলেন আদি পরাশক্তি। তাঁরা বৃক্ষ, শিলা, জল, বাতাস , আলোক , নদী , ভূমি , সূর্য , চন্দ্র, গ্রহ, তারা  সর্বত্র অবস্থান করেন। নিরাকার থেকে তখন তাঁরা সাকার হয়ে ওঠেন।  

বিষ্ণু রূপে শালগ্রাম শীলা, শিব রূপে লিঙ্গ , ধর্ম রূপে কুর্ম , দেবী রূপে বিবিধ যন্ত্র এবং ঘট পবিত্র বস্তু।  এগুলিই শূন্য ও শক্তি স্বরূপ। তুলসী সহ দেবতার পূজা প্রকৃতি , শূন্য অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পূজার নামান্তর।  সকল দেবদেবীর জর উপাসনা করা হয় তা সবই ব্রহ্মের উপাসনা। বিষ্ণু , শিব,  দুর্গা , কালী, শ্ৰী, সরস্বতী প্রমুখেরা ব্রহ্ম স্বরূপ। আমরা পরম ব্রহ্মকে যে ভাবে দেখি সেভাবেই তিনি দেখা দেন। সুরেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেছেন – ” অতএব বিষ্ণু, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সমস্ত দেবতাই তাঁদের উপাসকের  মধ্যেও উচ্চ নীচ নিরূপন হতে পারে না। “

আমরা দেখিতে পাই , নিরাকার সেই পরম ব্রহ্মের উপাসনা দেহিদের পক্ষে অতি কষ্টকর । এইজন্যই নানা রূপে  তাঁহার উপাসনা ব্যবহার দেখা যায়।”

সেই সুপ্রাচীন কাল হতেই অরণ্য , জল, সূর্য, বায়ু, ওষধি, ভূমি ,প্রকৃতি ও প্রকৃতির বিবিধ উপাদান মানবকুলের আরাধ্য। সনাতনে তাই প্রকৃতিই ধর্ম , ধর্মই প্রকৃতি। বনবাসী ,গুহাবাসী ত্রিকালজ্ঞ মুনি , ঋষি হতে সাধারণ তাই নানাবিধ বৃক্ষকে উপাসনা করে এসেছেন সেই প্রাচীন কাল হতে। বৃক্ষের পবিত্র, স্নিগ্ধ, শীতল ছায়ায় তাই ঋষির আশ্রম থেকে দেবতার অবস্থান যুগ হতে যুগান্তে। 

আমাদের পূর্ব পুরুষরা অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। তাঁরা ধন্যবাদ জানাতেন , তাঁরা প্রণাম করতেন  সেই ব্রহ্মকে যিনি অগ্নি, জল, ওষধি , বনস্পতি এবং বিশ্বভুবনে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। সেই সুপ্রাচীন কালে , মুনি ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃতির শক্তির সঞ্চার ঘটলেই  জীবকুলের জীবন ধারণ সম্ভব হবে। 

মহর্ষি কাত্যায়ন ঋক্ সংহিতার অনুক্রমনিকায় বলছেন, ” যাঁর বাক্য তিনি ঋষি। তিনি যা বলেন তাও দেবতা সম এবং তাঁর দ্বারা যে বস্তু প্রতিপাদ্য হয় তাও দেবতা।”

এবার আসি স্বরসতী প্রসঙ্গে – 

ঋগবেদে ৯৫ সূক্ত  , উচ্চারিত হয়েছে ঋষি বশিষ্ঠ দ্বারা ত্রিষ্টুপ ছন্দে।

প্ৰ ক্ষোদস্য ধায়সা সস্র এষা সরস্বতী ধরুণমায়সী পূঃ।

প্রবাবধানা রর্থ্যেব যাতি বিশ্বা অপো মহিনা সিন্ধুরন্যাঃ।।

সরস্বতী নিজে বিশাল জলধারা হয়ে প্রবাহিত হচ্ছেন ,অন্য সব জলধারাকে মহিমা দ্বারা বাধা প্রদান করেছেন।

একাচেতং সরস্বতী নদীনাং শুচির্যতী গিরিভ্য আ সমুদ্রাৎ।

রায়শ্চেতন্তী ভুবনস্য ভূরের্ঘৃতং পয়সা দুদুহে নাহুষায়।।

গিরি থেকে সমুদ্র পর্যন্ত গমনশীলা নদী সরস্বতী পৃথিবীকে সম্পদ দিয়েছিলেন। নহুষকে বহু ঘৃত ও দুগ্ধ প্রদান করেছিলেন। অর্থাৎ, ভীষণা প্রবাহমানা নদী সরস্বতী পাহাড় ভেঙ্গে প্রবাহিত হয়ে রুক্ষ ভূমিকে শস্য শ্যামলা করে খাদ্য ও গোধন প্রদান করে জীবনকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছেন।

স বাবৃধে নর্ষো যোষণাসু বৃষা শিশুর্বৃষভো যজ্ঞিয়াসু।

স বাজিনং মঘবদ্ভ‍্য্যো দধাতি বি সাতয়ে তন্বং মামৃজিত।।

শিশু এবং অভীষ্টগণের হিতের জন্য সেচনকারী নদী সরস্বতী বৃদ্ধি পেলেন। তাঁর উপাস্যদের সুস্থ ও শক্তিশালী সন্তান দান করলেন। 

উত সা নঃ সরস্বতী জুষাণোপ শ্রবৎসুভগা যজ্ঞে অস্মিন্।

মিতজ্ঞুর্ভিমসৈরিয়ানা রায়া যুজা চিদুত্তরা সখিভ্য।।

সুভগা সরস্বতী আমাদের স্তুতি শুনুন , দেব দানব দৈত্য আপনার নিকট নতজানু। আপনি ধনবিশিষ্টা ও সখিগণের প্রতি দয়াবতী। 

ইমা জুহ্বানা যুষ্মদা নমোভিঃ প্রতি স্তোমং সরস্বতী জুষস্ব।

তব শর্মন্ প্রিয়তমে দধানা উপ স্থেয়াম শরণং ন বৃক্ষম্।।

হে সরস্বতী আমরা আপনার হোমযজ্ঞ করে আপনাকে সন্তুষ্ট করব। আপনি তুষ্ট হলেই আমাদের মঙ্গল হবে এবং সম্পদ প্রাপ্তি ঘটবে । হে সরস্বতী আমাদের এই সেবা গ্রহণ করুন। আপনি বৃক্ষের ন্যায় আমাদের নিকট প্রিয়। আমরা আপনারই শরণাগত।

অয়মু তে সরস্বতী বশিষ্ঠ দ্বারাবৃতসা সুভগে ব্যাবঃ।

বর্ধ শুভ্রে স্তুবতে বাজ‍্য‍নুয়ং পাত স্তিতিভিঃ সদা নঃ।।

হে শুভ্রবর্ণা দেবী , বশিষ্ঠ আপনার যজ্ঞ করছে, আপনি বর্ধিত হন , অন্ন দান করুন , আমাদের পালন করুন।

এরপরের সূক্ত ও বিষয় আলোচনার পূর্বে কিছু কথা বলি। অন্ন অর্থাৎ যে কোনো ধরনের খাদ্যবস্তুকে বোঝায়। অন্ন = যা খাবার যোগ্য। 

সরস্বতী কুলে বসবাস করে ঋষিগণ সুখে ছিলেন। অন্য বনবাসী, সাধারণ মানব এবং জীবকুল সুখে ছিলেন। তাই তাঁর বন্দনায় তাঁকে কেবল আরো সুখ , সম্পদ , ধন প্রদান এবং পালন করার জন্য অনুরোধই করা হচ্ছে না , মা সরস্বতী যেন আরো বর্ধিত হন , আরো শক্তিশালী হন সেই আবেদনও করা হয়েছে। 

ঋষি বশিষ্ঠ দেবীমাতৃকা স্বরূপা সরস্বতীকে হোম দ্বারা উপাসনা করেন। প্রবলা সরস্বতী অন্য সকল নদীকে নিজের মধ্যে বিলয় করেছিলেন। তাঁর সুবিশাল জলাধার পর্বত হতে সিন্ধু সাগরে গিয়ে সঙ্গমিত হয়েছিল। 

সুপ্রাচীন ঋগ্বেদে সপ্তম মন্ডল ৯৬ সূক্তটিও সরস্বতীর উদ্দেশ্যে ঋষি বশিষ্ঠ রচিত এবং এর সূক্তের ছন্দ হল গায়েত্রী।

বৃহদু গায়িষে বচোহসূর্যা নদীনাম্ ।

সরস্বতীমিন্মহয়া সুবৃক্তিভিঃ স্তোমৈর্বশিষ্ঠ রোদসী।।

হে বশিষ্ঠ , তুমি নদী গনের মধ্যে শ্রেষ্ঠা সরস্বতীর স্তোত্রগান কর। তাঁকে স্তোম দ্বারা স্তুতি কর। 

উভে যত্তে মহিনা শুভে অন্ধসি অদিক্ষিয়ন্তি পুরবঃ।

স নো বোধ্যবিত্রী মরুৎসখা ,  রাধো মঘোনামৃ।।

হে সরস্বতী , মনুষ্যগণ ও জীবকুল আপনার নিকট দুই প্রকার অন্ন পায়। আপনি আমাদের রক্ষা কর। আপনার প্রবলবেগের জন্য মরুৎগণ আপনার সখা। আপনি তাঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পদ প্রদান করুন।

ভদ্রমিস্তদ্রা কৃণবৎ সরস্বত্যকবারি চেততি বাজিনীবতী।

গৃণানা জমদগ্নিবৎ স্তুবানা চ বশিষ্ঠবৎ।।

হে গতিময়ী সরস্বতী আমাদের কল্যাণ প্রদান করুন।  আমাদের প্রজ্ঞা দান করুন। জমদগ্নিবৎ স্তব করলে বশিষ্ঠের মতো স্তব লাভ করুন।

জনীয়ন্তো স্বগ্রবঃ পুত্রীরান্তঃ সুদানবঃ।

সরস্বন্তং হবামহে।।

হে সরস্বতী আমরা আপনার স্তুতি করছি। আপনি আমাদের স্ত্রী এবং সুসন্তান দান করুন।

যে তে সরস্ব ঊর্মরো  মধুমন্ত ঘৃতশ্চুতঃ ।

তেভির্নো হবিতা ভব।।

হে সরস্বতী , আপনার প্রবল ঊর্মি সম্বলিত জল মধুময়, ঘৃতক্ষরণকারী। আপনাকে তাই উপাসনা করি। 

পাপিবাংসং সরস্বতী স্তনং যো বিশ্বদর্শতঃ।

ভক্ষীমহি প্রজামিষম্।।

মাতৃকা সরস্বতী শিশুকে স্তন দানের ন্যায় আমাদের খাদ্য প্রদান করছেন। তিনি মাতৃরূপে সকল বিশ্বের নিকট বন্দনীয়। 

অর্থাৎ , বিপুলা সরস্বতী নদী কেবল এবং কেবলমাত্র মানব তথা জীব তথা বিশ্ব কল্যাণ করতেন। তাঁর জল ছিল ওষধি স্বরূপ। তিনিই অন্নদাত্রী, তিনিই পালন কর্ত্রী। তাই তিনি অবশ্য পূজনীয়। তিনি মহাদেবী । তাঁর বলেই জীবকুলের প্রজ্ঞা লাভ হয়। তাই তাঁকে আরাধনা কর। তিনি নিরাকার হয়ে আকার ধারন করে মাতৃরূপা। তিনি শুভ্রবর্ণা । তাঁর জল মধু ন্যায় মিষ্ট এবং ঘৃতসঞ্চারণকারী। 

সেই আগের কথায় ফিরে যাই। পৃথিবীর সৃষ্টির পর যেদিন মানুষ গোষ্ঠী বদ্ধ হতে শিখল বা তারও আগে জল, নদী র তীর তার বাসের স্থান ছিল। নদী ছিল সভ্যতা এবং উন্নতির সূচনা কর্ত্রী। তাই প্রবলা নদী মাতা সরস্বতীর অবদান নিয়ে সুপ্রাচীনকালে মানুষের মনে কোনো সংশয় ছিল না। প্রকৃতির মানব ও জীবকুল নির্ভর। এ চিরসত্য কোনোদিন বদলাবে না। কারণ মানব উপলব্ধি আজও করে যে পৃথিবীর সব কিছু তাদের করায়ত্ত নয়, হয় না, হবে না। তাই প্রকৃতির প্রতিটি যা উপকারে আসে তা সকলই পূজ্য। কারন তাঁরা সকলেই হলেন মাতাপিতা , নির্ভরযোগ্য , শুভ। 

#ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১) লুপ্ত সরস্বতী

২) প্রাচীন ভারতের পরিবেশ চিন্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.