প্রথম পর্ব
সে অনেক কাল আগের কথা। কত কাল আগে ? সেই তখন মগধ ষোড়শ মহাজন পদের এক অন্যতম শক্তিশালী মহাজন পদ ছিল। বর্তমানের বিহারের পাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল মগধ। রাজগৃহ ছিল মগধের রাজধানী। পরে অবশ্য পাটলিপুত্র হয় মগধের রাজধানী। শোন আর ভাগীরথীর মিলন স্থলে পাটলি নামক গ্রাম , সেই গ্রামেই দুর্গ স্থাপন করে নিৰ্মাণ করা হয়েছিল পাটলিপুত্র নামক সুবিশাল নগর। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় সনাতনী ধর্মের বিবিধ মার্গের সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে ইক্ষ্বাকু বংশজাত শাক্যসিংহের বৌদ্ধ মার্গ অন্যদিকে জৈন মার্গ , যার ২২ তম তীর্থঙ্কর নেমিনাথ ছিলেন যাদবশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণের বংশধর । অপর দিকে মহাবীরও ছিলেন ইক্ষ্বাকু বংশ জাত।
যা হোক , সে সময় মহাবীর দেহ রেখেছেন। ক্রমে জৈন মার্গ অনেক উচ্চ দর্শনে পরিণত হচ্ছিল। সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল। মার্গ , মার্গের মধ্যে নানা বিধ নিয়ম ও কঠিন অনুশাসন, পন্থায় মতবাদটি ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছিল।
সেই সময় মগধে সুগ্রাম বলে এক সুন্দর গাঁ ছিল। সেখানে আর্যবান রাষ্ট্রকূট এবং রেবতী নামে এক দম্পতি বাস করতেন। তাঁদের দুই পুত্র – ভবদত্ত এবং ভবদেব। ভবদত্ত মেধাবী, বুদ্ধিমান এবং স্থিরমনোবৃত্তির মানুষ ছিলেন। ভবদত্তের কনিষ্ঠ ভ্রাতাটি দাদাকে ভীষণই ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। শুধু তাই নয় , কনিষ্ঠ ভবদেব দাদাকে ভীষণ বিশ্বাস করতেন।
ভবদত্ত কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের সূচনা প্রান্তে এসে উপস্থিত হলেন। সাংসারিক অসারতাকে এড়ানোর নিমিত্ত একদিন গৃহত্যাগী হলেন। বহু পথ অতিক্রম করে জৈনাচার্য সুস্থিতির নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করে গুরুর পদতলে সেবা কার্যাদি করে কালাতিপাত করতে লাগলেন। ক্রমে ভবদত্ত নানা শাস্ত্রাদি পাঠ করে এবং যোগ ক্রিয়ায় প্রশিক্ষণ পেয়ে মহাপন্ডিত ও যোগীতে পরিণত হলেন। তপশ্চর্যার মাধ্যমে তিনি ক্রমে সিদ্ধিলাভ করে ঋষিতে পরিণত হলেন।
একদিন গুরু সুস্থিতের অপর এক শিষ্য গুরু পাদপদ্মে বসে বললেন , ” গুরুদেব , আমার পিতৃ গৃহে আমার এক অনুজ আছে। সে আমাকে বড় ভালবাসত । আপনি একবার যদি অনুমতি করেন তবে তাঁকেও আপনার পায়ে সঁপে দিয়ে বিদ্যা স্বরূপ মহামায়ার জগতের সঙ্গে পরিচয় করাই।” গুরু দ্বিরুক্তি না করে কয়েকজন শিষ্য সমেত তাঁকে পিতার গৃহে প্রেরণ করলেন।
গৃহে উপস্থিত হয়ে সেই সন্ন্যাসী দেখলেন বাড়িতে ভোজ লেগেছে, হৈ চৈ, হট্টমেলার আসর। তাঁর অনুজটি বিবাহ করতে চলেছেন। উৎসব ,কোলাহলে মুখরিত গৃহে অনুজটি এতই আনন্দিত যে , আপন অগ্রজকে উপেক্ষা করতেও দ্বিধা বোধ করলেন না।
সন্ন্যাসী বড় মনক্ষুণ্ণ হয়ে গুরুর নিকট ফিরে এলেন। বড় মর্ম্মাহত হয়ে গুরু সকল ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন। সেই সময় ঋষি ভবদত্ত গুরুর নিকট দন্ডায়মান ছিলেন। সন্ন্যাসীর অনুজের এরূপ আচরণাদির কথা শ্রবণ করে অতীব বিদ্রুপ করে বললেন , ” সন্ন্যাসী ,তোমার অনুজটি নিতান্তই অসভ্য। তার সামাজিক জ্ঞানটুকুও হয় নি। আপন ভ্রাতাকে অপমান করে সে তোমার পারিবারিক শিক্ষার অকর্মণ্যতাকে প্রকাশিত করেছে। ধিক্… এরূপ ভ্রাতা কারো যেন না হয়। এমন অনুজকে এই শ্রমনাশ্রমের সন্ন্যাসী বানাবে ভাবলে কি করে?”
আশ্রমে এরূপ ব্যবহার , এমন ক্রুর কথা অনেকেই ভালোভাবে নিলেন না। কারুর ভ্রাতা যদি খারাপ হয় তবে সেক্ষেত্রে অগ্রজের কি দোষ থাকতে পারে, বিশেষত যিনি অনুজের শৈশবেই গৃহ ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছেন ? অতএব অপর এক সন্ন্যাসী ভবদত্তকে স্পষ্টতই বললেন , ” আপনি তো কৈবল্য লাভ করেছেন । আপনি চরম জ্ঞানী ও পন্ডিত। সে কথা সকলেই জানি। আপনারও তো শুনেছি একটি প্রাণ প্রিয় অনুজ আছে ! তাকে একবার সন্ন্যাস দেবার প্রচেষ্টা করুন। যদি পারেন ,তখন না হয় পরের সমালোচনা মুখরোচক হবে।”
ভবদত্ত বড় জ্ঞানী। বুদ্ধিও ধরেন অধিক। তাই একটু বক্রকটাক্ষ করে বললেন , ” যদি আমি শৈশবের সুগ্রামে কোনোদিন যাই তবে , তখন দেখে নিও।”
কালের নিয়মে কাল অতিবাহিত হতে লাগল। একদিন আচার্য সুস্থিতি তাঁর প্রিয় শিষ্য ঋষি ভবদত্তকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষান্নেষণ করতে করতে মগধে ভবদত্তের বাসগ্রামে উপস্থিত হলেন। সুগ্রামে উপস্থিত হয়ে ভবদত্তের পূর্ব প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ হল। প্রতিজ্ঞা রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি গুরুর নিকট একটিবার গৃহ গমনের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। আচার্য শিষ্যকে ভালোই চিনতেন , শিষ্যের পান্ডিত্য, বুদ্ধি এবং কর্মের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। তিনি বিনা সঙ্গীতে শিষ্যকে গৃহে পাঠিয়ে দিলেন।
গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখলেন গৃহে উৎসব লেগেছে; বিবাহ উৎসব। তাঁর অনুজটি বিবাহ করতে চলেছে। বহুকাল পরে গৃহের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে পেয়ে মাতা পিতা , আত্মীয়স্বজন , বন্ধুবান্ধব , পাড়াপ্রতিবেশী উল্লাসিত হয়ে উঠলেন। তাঁকে জোরপূর্বক নিয়ে গিয়ে বসিয়ে যত্নআত্তি করতে লাগলেন।
অনুজ ভবদেব তখন অন্তঃপুরে বর বেশে সজ্জায় ব্যস্ত। কুলাচার অনুযায়ী ভাবী নববধূ নাগিলা মহার্ঘ্য আভূষণ , সুগন্ধী পুষ্পে সুসজ্জিতা হচ্ছিলেন। আগামী জীবনের কথা চিন্তা করে দুজনেই আনন্দিত , শিহরিত। আর মাত্র কিছুক্ষণ….তারপর ঈশ্বর , অগ্নি সাক্ষী রেখে , বেদ মন্ত্র উচ্চারণ করে দুই আত্মা এক হবে। নাগিলার সুন্দর ললাট ও কপোল কুমকুম, চন্দনের আল্পনায় যক্ষিনীর ন্যায় অপরূপ হয়ে উঠেছে।
সব দেখে শুনে ভবদত্ত বললেন, ” তোমরা বড় ব্যস্ত । এমন যজ্ঞি বাড়িতে আমার আসা উচিৎ হয় নি। আমি অন্যত্র যাই।” হয়ত , মহামায়ার অন্য ইচ্ছে ছিল। তাই , তাঁকে সকলে বাঁধা দিলেন। অন্তঃপুরে খবর গেল , সিদ্ধি লাভ করে ভবদত্ত মুনি হয়েছেন এবং তিনি আজ এই শুভক্ষণে গৃহে পদার্পন করেছেন। অনুজ ভবদেব আনন্দে অধীর হয়ে অন্তঃপুর হতে ছুটে এলেন। সেই কোন শৈশবে তাঁর অগ্রজ ভ্রাতাটিকে দেখেছিলেন। সকলে তাঁদের দেখে বলতেন , হরিহর আত্মা। হর চলে গিয়ে যোগী হয়েছেন । হরি কেমন করে থাকেন…
নাগিলার মন কিন্তু কু গাইল। বক্ষ দুরু দুরু করল। কি যেন এক আশঙ্কায় তাঁর মন ব্যস্ত হয়ে পড়ল…সজ্জা ত্যাগ করে তিনি বাইরের দিকে পা বাড়ালেন। সখীগণ বললেন, ” দেবী আরো একটু ক্ষণ পড়েই নয় যাও। সজ্জা প্রসাধন শেষ কর। নাইলে বড় অকল্যাণ হবে।”
নাগিলা বললেন , ” না । হৃদয় কেমন করছে। মনে হয় খুব প্রিয় কিছু আজ চলে যাবে। সেই প্রিয়কে দেখতে মন চাইছে। একবার , শেষবার সেই প্রিয়কে চোখের দেখা দেখতে চাই।”
চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,
এ কথা বলিতে চাও বোলো।
এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল –
তার পরে যদি তুমি ভোল
মনে করাব না আমি শপথ তোমার,
আসা যাওয়া দু দিকেই খোলা রবে দ্বার –
যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,
আবার আসিতে হয় এসো।
সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,
তবু ভালোবাস যদি বেসো।।
এদিকে ভবদেবও নিজ সজ্জা ক্ষান্ত দিয়ে , ” এক্ষুণি আসছি…” এরূপ বলে চলে এলেন বাইরে।
নাগিলা ও ভবদেবের পশ্চাতে বাকি পুরনারীগণও এলেন। বাইরে এসে ভবদত্তের তেজঃপূর্ণ সৌম্য যোগীমূর্তি অবলোকন করে ভবদেব নিশ্চল বাকরোহিত দন্ডায়মান হয়ে রইলেন। এমন মন্ত্রমুগ্ধ কর রূপ তিনি কোনো দিন দেখেন নি। ভবদত্ত কোনো কথা বললেন না অনুজের সাথে। কেবলমাত্র নিজের ভিক্ষাপাত্রটি ভ্রাতার হস্তে অর্পণ করেই গমন করলেন। ভবদেব কি করে কি না করে এমন দ্বিধায় কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন। হাতে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ভিক্ষাপাত্র। অগত্যা ভবদেব অগ্রজকে অনুসরণ করতে লাগলেন। কৌতূহলবশতঃ অনেকেই তাঁদের পিছনে চললেন। কিন্তু শেষ অবধি তত পথ চলার ক্ষমতা নেই, কোথায় যে ভবদত্তের গন্তব্য তাও জানেন না। কোথায় গিয়ে সে নদী সাগরের কোনদিকে মিশবে না বুঝে সকলে ফিরে এলেন। সকলের মুখেই বিষাদের ছায়া। কি হয়েছে বুঝতে পেরেও আটকাতে পারেন নি। কেমন যেন সব বুদ্ধি , চিন্তা শক্তি হরিত হয়েছিল। কি থেকে কি যে হয়ে গেল ?
কেবল ফিরলেন না দুজন … একজন ভবদেব , কারণ তাঁর হাতে অগ্রজের ভিক্ষা পাত্র , দ্বিতীয়জন, বধূ বেশে সজ্জিতা নাগিলা। কারণ নাগিলার ভাবীস্বামী ভিক্ষাপাত্র নিয়ে অগ্রজকে অনুসরণ করছেন। মনে মনে যেহেতু নাগিলা ভবদেবকে স্বামী হিসাবে বরণ করেছেন সেহেতু তাঁকে অনুসরণ করাই কর্তব্য… তাছাড়াও এই ঘটনার সঙ্গম কি হয় তাও তো দেখতে হবে ?
বসন্তবায় সন্ন্যাসী হায়
চৈৎ-ফসলের শূন্য খেতে,
মৌমাছিদের ডাক দিয়ে যায়
বিদায় নিয়ে যেতে যেতে–
আয় রে ওরে মৌমাছি, আয়,
চৈত্র যে যায় পত্রঝরা,
গাছের তলায় আঁচল বিছায়
ক্লান্তি-অলস বসুন্ধরা।
ভবদত্ত নাগিলাকে লক্ষ্য করলেন না বা লক্ষ্য করেও উপেক্ষা করলেন তা বলা মুশকিল। বহুক্ষণ চুপ থাকার পর ভবদেব কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে অবিদ্যা স্বরূপ মায়ার সংসারের সুখ দুঃখের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। মহামায়ার অবিদ্যা স্বরূপ সংসারে থেকে ভবদেব হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তিনি বিদ্যা স্বরূপ মহামায়ার সন্ধানে ছিলেন। সেসব কথা জ্যেষ্ঠকে ভবদেবের সঙ্গে আলোচনা করে বোঝা অনেক হালকা হল। নানা কথায় উভয়ে গুরু সুস্থিতি সমীপে উপস্থিত হলেন।
ধ্যান ভেঙে গুরু দেখলেন তাঁর সুমুখে প্রিয় শিষ্য দন্ডায়মান এবং তাঁর প্রিয় শিষ্যের পিছনে ভিক্ষাপাত্র হস্তে বিমূঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন এক বর্ষাস্নাত পবিত্র নবীন শ্যাম কিশলয়ের ন্যায় সদ্য যৌবন প্রাপ্ত মানব। এদিকে গুরুকুলের বাকি শিষ্য, গুরুভাইদের মুখে জিজ্ঞাসা। ভবদত্তের মুখে সূক্ষ্ম হাসির রেখা….আজ তিনিই জয়ী।
আচার্য সবই জানতেন। তিনি ত্রিকালজ্ঞ। তবুও সকলের অবগতির নিমিত্ত জিজ্ঞাসা করলেন , ” ওহে মুনি! এই কচি দূর্বাদলের ন্যায় সুন্দর যুবকটি কে ? ” ভবদত্ত বললেন , ” এই হল আমার অনুজ। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আমি তা পালন করলাম। এখন আমি একে আপনার শরনে দান করলাম। বাকি আপনি নির্ণয় করুন।”
গুরু দেখলেন কিছু দূরে বধূর সাজে নাগিলা দণ্ডায়মান। তাঁর চক্ষে শঙ্কা , ব্যাকুল তাঁর হৃদয়। নাগিলা জানেন এই পরীক্ষায় জয়ী হলে একটা পুরস্কার , বিজিত হলে আরেকটা…তবুও কি যেন হারাবেন। প্রশান্ত দৃষ্টিতে গুরু ভবদেবকে প্রশ্ন করলেন , ” তুমি সন্ন্যাসী হবে ? পারবে ? যে মায়া , যে প্রেম তোমার পিছনে দণ্ডায়মান তাকে ত্যাগ করে বৈরাগী হতে পারবে? মায়ার সংসারে তুমি মা অম্বিকার নিকট কি উত্তর দেবে? কারুর নিকট অপরাধী হয়ে থাকবে না তো ?”
ভবদেবের হৃদয়ে প্রলয়। সামনে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে জ্যেষ্ঠ । পিছনে আকুল প্রেম, ব্যাকুল হৃদয় নিয়ে অপেক্ষা করছেন নাগিলা। নাগিলা , যার জন্য যে কেউ নিজের রাজ্যটাও দিয়ে দিতে পারেন। সেই নাগিলা আজ তাঁর জন্য সব ছেড়ে এসেছেন । এখন ধর্ম কি ? নাগিলাকে না দেখেও তিনি উপলব্ধি করছেন তাঁর শঙ্কা ব্যাকুল আঁখি দুটি। অগ্রজ অপেক্ষমান তাঁর উত্তরের আশায়। জ্যেষ্ঠর সৌম্য দৃষ্টি কেবলই তাঁকে কেমন চিন্তাহীন শান্ত শীতল স্থানের কথা মনে করাচ্ছে , যেখানের অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে ইচ্ছে ধেয়ে চলা যায়। যেথায় কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নেই।
ভবদেব আর সহ্য করতে পারলেন না। যদি বিবাহ না করেন তাহলে হয়ত লোকে গঞ্জনা দেবেন। কিন্তু যদি আপন সিদ্ধযোগী ভ্রাতাকে তাঁর জন্য প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে হয় তবে, জ্যেষ্ঠ মিথ্যা বাদী প্রমাণিত হবেন। সে পাপ তবে কোথায় রাখবেন? সেই পাপে উভয় জনই পাতকী হবেন ।
অবশেষে ভবদেব নিশ্বাস চেপে বললেন , ” আমার জ্যেষ্ঠ কখনো মিথ্যা বলেন নি, বলেন না এবং বলবেন না।” ভবদেব শেষ বারের জন্য একবার ঘুরলেন পিছনে, দেখলেন অপরূপ সুন্দরী নাগিলা ভাবী স্বামীর অপেক্ষায়রতা। তিনি নাগিলার নয়ন হতে আপন নয়ন সরিয়ে নিলেন , বললেন, ” আমার অগ্রজ ভ্রাতার ইচ্ছাই আমার নিকট অন্তিম শব্দ। এই জন্যই আমি সংসার ত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস জীবন বেছে নিলাম।” তুমি এখনই চলে যাও। “
ভবদেবের দীক্ষা হয়ে গেল। স্বজন পরিজন, মিত্রাদি আশ্রম খুঁজে ছুটে এলেন। কেউ ধিক্কার দিলেন। কেউ কান্নায় ভেঙে পড়লেন। লোকে দুয়ো দিয়ে বলতে লাগলেন , ” একি করলে? অমন রূপে লক্ষ্মী , গুণে সরস্বতী মেয়ে , যার জন্য রাজা মহারাজারা অপেক্ষা করেছে, সেই মেয়েকে তুমি এমন করে ত্যাগ করতে পারলে ? কার কু প্ররোচনায় তোমার এমন মতিভ্রম হল ? এ কেমন সন্ন্যাস ? এ কোন শাস্ত্রে লেখা ? “
ভবদেবের বড় কষ্ট হল । বড় কঠিনভাবে আত্মসংযম করে সকলের কু কথা শুনতে লাগলেন। কারণ এখানে তাঁর সিদ্ধ ভ্রাতার সম্মানের প্রশ্ন ছিল। দেখলেন ভবদেবের কোনো বক্তব্য নেই, কেবল শুনছেন। তখন লোকে গিয়ে ভবদত্তকে ধরলেন। ভবদত্ত ভাবলেন, কোনো ভাবেই এই সন্ন্যাস জীবনে তিনি হেরে যাবেন না। তাঁর প্রতিজ্ঞা ভাঙবেন না। নাগিলা সুন্দরী। তাঁর অন্যত্র বিবাহ হয়ে যাবে। তাই শান্ত কন্ঠে বললেন , ” ভবদেব বড় হয়েছে। সে নির্বোধ নয়। তাহলে তার ব্রহ্মচর্য চর্চায় আমি কেন বিঘ্ন ঘটাই? ” … সকলে নিরাশ হয়ে চলে গেলেন।
এদিকে ভবদেব সংঘের সকল নিয়মাদি পালন করে কেশলোচন করলেন। মুন্ডিত মস্তক হয়ে তিনি শ্রবক হলেন। ক্রমে নানা বিদ্যা , শাস্ত্র , ধ্যান ,যোগ পদ্ধতি অধ্যয়ন করতে লাগলেন। কিন্তু হায় , সেই সন্ন্যাস জীবনে তাঁর মন বসে কৈ ? একাকী হলেই কেবল তাঁর মনে পড়ে সুন্দরী ,নম্র , প্রেমময়ী নাগিলার মুখ খানি। পক্ষীর কলতানের ন্যায় নাগিলার মধুর হাঁসি তাঁর কর্ণ কুহরে বাজতে থাকে। এমন করে কি সন্ন্যাস জীবন চলে ? এত কঠিন সংযমী জীবনে নাগিলার স্মৃতি যেন আপনদেহের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গের ন্যায় রয়ে গেলেন । কখনো আশ্রমের বাগিচায় কোনো গাছের ছায়া একলা বলে ভবদেব ভাবেন , ” বড় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেইদিন। উচিত হয় নি। আমি নাগিলাকে কষ্ট দিয়েই বা কোন ধর্ম রক্ষা করলাম? ভ্রাতার কথা রক্ষা করতে গিয়ে আমি একসঙ্গে কত মানুষের মনে কষ্ট দিলাম …?” নাগিলার রঙ ভবদেবকে এমনি করে রাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যে, সেই রঙ তাঁর আপন রাগে, তাঁর গোপন রাগে, তাঁর তরুণ হাসির অরুণ রাগে , তাঁর অশ্রুজলের করুণ রাগে মেখে একাকার হয়ে গেল। নাগিলার রঙ তাঁর মর্মে , তাঁর সকল কর্মে লাগল, সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগল, গভীর রাতের জাগায় লাগল॥
জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয় –
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না।
না হয় আমার নাই সাধনা,
ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
কাল ক্রমে বারোটি বৎসর অতিক্রান্ত হল…..তারপর কি হলো?
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ Nagila ( Jainsquare.wordpress. com . nagila)