সা বিদ্যা পরমা মুক্তির্হেতুভূতা সনাতনী – তৃতীয় অধ্যায়

তৃতীয় অধ্যায়

ওঁ ভদ্রকাল‍্য্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।

যিনি ভদ্রকালী মহাকালী তিনিই সরস্বতী।  মহাভারতে ভীষ্মপর্বে তাই বেদব্যাস লিখেছেন – অর্জুন দুর্গাস্তবে উচ্চারণ করেছিলেন – 

ত্বং মহাবিদ্যা বিদ্যানাং মহানিদ্রা চ দেহিনাম্।

স্কন্দমাতৰ্ভগবতি দুর্গে কান্তারবাসিনি।।

স্বাহাকারঃ স্বধা চৈব কলা কাষ্ঠা সরস্বতী।

সাবিত্রী বেদমাতা চ তথা বেদান্ত উচ্যতে।।

GNANA SARASWATI TEMPLE

সাধনসমুচ্চয়ে বজ্রসরস্বতী , বজ্রবীণা – সরস্বতী , বজ্রসারদা , কৃষ্ণযমারিতন্ত্রোক্ত বজ্র সরস্বতীর কথা উল্লিখিত হয়েছে। দেবী মহাসরস্বতী, তিনি শুভ্র বর্ণা, তিনি চন্দ্র মন্ডলেরও দেবী। তিনি সেথায় স্নেহময়ী, করুণাময়ী, সদা হাস্যমুখী। তিনি মুক্তা আভরণে সুসজ্জিতা। তিনি দক্ষিণহস্তে বরদমুদ্রা , বামহস্তে সনাল শ্বেত পদ্ম ধারণ করছেন। তিনি শ্বেত পদ্মাসনা। শুভ্রবসনা দেবীর পুষ্প, চন্দন শুভ্র। মনে পড়ছে আমাদের উচ্চারিত সরস্বতী দেবীর পুষ্পাঞ্জলি ইত্যাদি মন্ত্রের কথা – 

ওঁ তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষণ্ণা সিতাব্জে।

নিজকরকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ সকলবিভবসিদ্ধৈ পাতু বাগ্দেবতা নঃ।।

      বা

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে। বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমোঽস্তুতে।। নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ। বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।। এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।

 মাহদেবীর চারিদিকে জীবাত্মাকে পরিচালনা করার জন্য অবস্থিত চার দেবীর অবস্থান- সামনে প্রজ্ঞা , পশ্চাদভাগে মতি , দক্ষিণে মেধা , বামে স্মৃতি। মহাসরস্বতী চন্দ্রমন্ডল ,তন্মধ্যে শ্বেত পদ্ম, পদ্মের চারিদিকে হ্রীঃকার সেখানে ধ্যানমগ্না। 

তেন চ ভগবতীং মহাসরস্বতীমনুবিচিন্তয়েৎ শরদিন্দুকরাকারাং সিতকমলোপরি চন্দ্রমন্ডলস্থাং দক্ষিণকরেণ বরদাং বামেন সনালসিতসরোজধরাং স্মেরমুখীমতিকরুণাময়াং শ্বেতচন্দনকুসুমবসনধরাং মুক্তাহারোপশোভিতহৃদয়াং নানারত্নালঙ্কারবতীং দ্বাদশবর্ষাকৃতিং মুদিতকুচমুকুলদন্তুরোরস্তটীং স্ফুরদনন্তগভস্তিব্যূহাবভাসিতলোকত্রয়াম্। ততস্তৎপরুতো ভগবতীং প্রজ্ঞাং দক্ষিণতো মেধাং পশ্চিমতো মতিং বামতঃ স্মৃতি এতাঃ স্বনায়িকা সমানবণাদিকাঃ সম্মুখমবস্থিতাশ্চিন্তনীয়াঃ। – সাধনমালা

বজ্রবীণা সরস্বতী রূপে দেবী দুই হাতে বীণা ধারণ করেন। সাধনমালায় বলা হয়েছে – 

সপ্তমস্য দ্বিতীয়স্থমষ্টমস্য চতুর্থকম্।

প্রথমস্য চতুর্থেন ভূষিত তৎ সবিন্দুকম্।।

তদুদ্ভবাং সরস্বতীং বীণাবাদতৎপরাম্।

চন্দ্রাবদাতনির্ভাসাং সর্বালঙ্কারভূষিতাম্।।

বজ্রসারদা রূপে দেবীর দক্ষিণ হস্তে পদ্ম , অপর হস্তে পুস্তক। তিনি ত্রিনয়নী , সর্বালঙ্কারভূষিতা। শ্বেতবর্ণা দেবী পদ্মাসীনা , শিরে তাঁর অর্ধচন্দ্রশোভিত। 

শুভ্ৰাম্বুজোপরি লসত্তনুমাদধানাং

নেত্রত্রয়ং মুকুটসংস্থিতমর্ধচন্দ্রম্।

বামেন পুস্তকধরাম্বুজমন্যহস্তে

পশ্চাৎ স্বদেহসমতামনয়ং প্রযত্নৎ।।

বজ্রসরস্বতী রূপে তাঁর দক্ষিণ হস্তে রক্তপদ্ম , বাম হস্তে প্রজ্ঞাপারমিতা পুস্তক। তিনি শুভ্রবর্ণা শ্বেতবসনা। চন্দ্রবীজাদি নিষ্পন্না এই দেবীর অপর নাম আর্যসরস্বতী। সাধনমালায় বলা হয়েছে – 

সিতবর্ণাং মনোরমাং দক্ষিণেন রক্তাম্বুজধারিনং বামেন প্রজ্ঞাপারমিতা পুস্তক ধারিণীম্। 

দেবী আর্যবজ্রসরস্বতী রূপে ত্রিবদনা রক্তদ‍্য্যু্তিসমন্বিতা। সদভূষণালঙ্কৃতা দেবী প্রত্যালীঢ়পদে অবস্থিতা। ষষ্ঠভূজা দেবী দক্ষিণ তিন হস্তে পদ্ম , অসি ও কর্ত্রী ধারণ করছেন। বামদিকে ব্রহ্মকপাল , রত্ন ও চক্র ধারণ করছেন। দেবীর দক্ষিণ মুখ নীলবর্ণা , বামভাগ মুখ শ্বেতবর্ণা। সাধনমালায় বলা হয়েছে – 

তস্মাদ্ রক্ত মহাদ্যূতিং ভগবতীং সদ্ভূষণালঙ্কৃতাং

প্রত্যালীঢ়পদস্থিতাং ত্রিবদনাং ষড়বাহুভিৰ্ভূষিতাম্।।

সব্যে নীলমুখাং বিভর্তি চ করে পদ্মাসিকর্ত্রীংশ্চ বৈ।

বামে শুল্কমুখাং চ পাত্রসহিতাং সদ্রত্নচক্রং তথা।।

কৃষ্ণষমারিতন্ত্রে বজ্রসরস্বতী যে ধ্যান আছে তা এইরূপ – 

ত্রিমুখাং ষড়ভূজাং রক্তাং সরস্বতীং ভাবয়েদব্রতী।

পদ্মহস্তাধরাং সৌম্যাং প্রজ্ঞাবর্ধনহেতবে।।

দেবী আদ্যাশক্তি , তিনি নাদব্রহ্ম বা শব্দব্রহ্ম। তিনিই বাগ বৈ ব্রহ্মা। তিনিই ত্রিধা , গুপ্তরূপিদেবী। তিনি সত্ত্বগুণাত্মিকা সরস্বতী, তিনি রজসগুনাত্মিকা লক্ষ্মী , তিনিই তামসগুনাত্মিকা মহাকালী।  তিনিই ধী , ঈশ্বরী, বেদগর্ভা , আর্যা, ব্রাহ্মী । তাই মহাকালী মহামায়ার ধ্যানে যে ভাব প্রস্ফুটিত হয়েছে , মহাসরস্বতীর ধ্যানেও সেই ভাব ও তত্ত্ব অনুস‍্যূত। তিনি অষ্ট তারিণী , সেই তারিণীর একরূপ দেবী সরস্বতী।  তন্ত্রসার বলছে – 

তারা চোগ্রা মহোগ্রা চ বজ্রকালী সরস্বতী।

কামেশ্বরী চ চামুণ্ডা ইত্যাষ্টৌ তারিণীগণাঃ।।

দেবী তন্ত্রের নীল সরস্বতী ।

 তারাদ্যা পঞ্চবর্ণেয়ং শ্রীমন্নীলসরস্বতী।

সর্বভাষাময়ী শুদ্ধা সর্বদেবৈর্নমস্কৃতা।।

তন্ত্রসারে বলা হয়েছে – 

নীলা চ বাকপ্রদা চেতি তেন নীলসরস্বতী।

তিনি সৌভাগ্য প্রদান করেন। 

মাতর্নীলসরস্বাত ! প্রণমতাং সৌভাগ্য সম্পৎপ্রদে।

শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য নীল সরস্বতীর আরাধনা করেছেন। তিনিই যে আদ্যাশক্তি সে বিষয় এরপর কারো সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়। তাঁর একটি নাম মহাশ্রী। তিনিই মহাবিদ্যা। তিনিই মহানীলসরস্বতী । কোথাও মহালীলসরস্বতী নামে উল্লিখিত হয়েছেন। তন্ত্রসার বলেন – 

লীলয়া বাকপ্রদা চেতি তেন লীলসরস্বতী।

তারাস্ত্ররহিতা ত্র‍্য‍র্ণা মহালীলসরস্বতী।।

প্রপঞ্চসার তন্ত্রের সপ্তম পটলে জপের কথা লেখা আছে। তার পূর্বে মাতৃকান্যাস। এই মাতৃকামন্ত্রের ঋষি হলেন – ব্রহ্মা , ছন্দঃ – গায়ত্রী এবং দেবতা – সরস্বতী। সরস্বতী ছয় অঙ্গ বর্ণমালার সমস্ত বর্ণ।

এই তন্ত্রে মাতৃকামূর্তি সরস্বতীর একটি ধ্যান আছে – 

পঞ্চাশদ্বর্ণভেদৈর্বিহিতবদনদোঃপাদযুক্কুক্ষিবক্ষো – 

দেশাং ভাস্বৎকপর্দাকলিতশশিকলামিন্দুকুন্দাবদাতাম্।

অক্ষস্রক্ককুম্ভচিন্তালিখিতবরকরাং ত্রীক্ষণাং পদ্মসংস্থা-

মচ্ছাককল্পামতুচ্ছস্তনজঘনভরাং ভারতীং তাং নমামি।।

এই ধ্যানের দেবী পদ্মাসনা , ত্রিনয়না , ভাস্বদ্ মূর্তি। তিনি ইন্দু এবং কুন্দের ন্যায় শুভ্র এবং তাঁর অঙ্গ পঞ্চাশটি বর্ণে বিহিত। মস্তকের উপর কেশগুচ্ছ ও শশিকলা। দেবীর উপরের দক্ষিণ হস্তে অক্ষমালা বা জ্ঞানমুদ্রা, নীচের দক্ষিণ চিন্তা , উপরের বামহস্তে কুম্ভ, নীচের বামহস্তে পুস্তক। 

একাদশ পটলে প্রকৃতির স্তব আছে । তার পঞ্চম শ্লোকে তাঁকে সরস্বতী বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে তিনি লেখনী ধারণ করেন। 

সচিন্তাক্ষমালা সুধাকুম্ভলেখাধরা ত্রীক্ষণার্ধেন্দুরাজৎকপর্দা।

সুশুক্লাংশুকাকল্পদেহা সরস্বত্যপি ত্বন্ময়ৈবেশিবাচামধীশা।।

দেবী ভারতী অর্থাৎ সরস্বতীর নবশক্তি । তাঁরা হলেন – মেধা , প্রজ্ঞা, প্রভা, বিদ্যা, ধী, ধৃতি, স্মৃতি, বুদ্ধি, বিদ্যেশ্বরী।

সাধক সরস্বতী, তাঁর শক্তি ও আবরণ দেবতার পূজা করে থাকেন। পূজায় গন্ধ ,পুষ্প, দীপ, ধূপ ও অন্ন আবশ্যক। তাই সরস্বতী যাগের মূল উপাদানই হল চরু। 

ময়া সো অন্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্……..

যে অন্ন আহার করে, যে দর্শন করে, যে প্রাণ ধারণ করে,যে বাক্য শ্রবণ করে তারা আমার শক্তিতেই সে সব করে থাকে, ঈদৃশী যারা আমাকে জানে না তারা ক্ষীণতা প্রাপ্ত হয় ! 

তন্ত্রে অক্ষরের মূর্তি আছে। স্বরবর্ণের কেশব , নারায়নাদি ১৬ টি বৈষ্ণব মূর্তি। এই ১৬ মূর্তির ১৬ শক্তি। তন্মধ্যে সরস্বতী হলেন  সংকর্ষণের শক্তি।  নারদপঞ্চরাত্রাগমের তৃতীয় রাত্রির প্রথম অধ্যায়ের দ্বাদশ সংখ্যক বৈষ্ণব মূর্তি সংকর্ষণের শক্তি সরস্বতী বলিয়া উল্লিখিত। ব্যঞ্জনবর্ণে রুদ্রমাতৃকা , মহাকালী, সরস্বতী, সর্বসিদ্ধি, গৌরী, ভদ্রকালী প্রভৃতি ৩৫ টি মূর্তি।

প্রপঞ্চসারের ২৩ অধ্যায়ের ২৪ শ্লোকে আছে –

 দংস্ট্রায়াং বসুধা সশৈলনগরারণ্যাপগা হুংকৃতৌ বাগীশী…। 

রসাতলে যাওয়া পৃথ্বীকে উদ্ধার করবার নিমিত্ত বিষ্ণু  বরাহ অবতার গ্রহণ করেন। বরাহবতারের দংস্ট্রায় পৃথ্বী ছিলেন এবং তাঁর সেই সময় প্রচন্ড যে হুংকার নির্গত হয়েছিল সেই হুংকারে শব্দব্রহ্ম রূপে দেবী সরস্বতী অবস্থান করেছিলেন। 

দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার পূজা বহুপ্রকারে হয়ে থাকে। বয়স অনুসারে দেবী পূজা যখন হয় তখন তিনি ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত হন। এক বৎসর কন্যা দেবী সন্ধ্যা , দুই বৎসর কন্যা হলেন দেবী সরস্বতী , সাত বৎসর কন্যা হলেন চন্ডিকা, আট বৎসর কন্যা দেবী সম্ভাবি ইত্যাদি। 

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. ঋগ্বেদ্

২. মার্কণ্ডেয় পুরান

৩. শ্রী শ্রী চণ্ডী

৪. সরস্বতী তত্ত্ব

৫. সরস্বতী সভ্যতার ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.