চতুর্থ অধ্যায়
সুপ্রাচীন এক তন্ত্র , নাম মালিনীবিজয়তন্ত্র। সেই সুপ্রাচীন তন্ত্রে কয়েকজন পূর্ণফলপ্রদা মহাবিদ্যার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে বাসলী বাগবাদিনী নামও আছে। এই তন্ত্র হতে ক্ষেমরাজ অতি প্রাচীন বচন বলে শ্লোক উদ্ধার করেছেন। ক্ষেমরাজ অভিনবগুপ্তের শিষ্য। এতে বর্ণিত মহাবিদ্যার নাম এইরূপ:
অথ বক্ষ্যাম্যহং যা যা মহাবিদ্যা মহীতলে।
দোষজালৈরসংস্পৃষ্টাক্তা সর্বাহি ফলৈঃ সহ।।
কালী নীলা মহাদুর্গা ত্বরিতা ছিন্নমস্তকা।
বাগবাদিনী চান্নপূর্ণা তথা প্রত্যজিরা পুনঃ।।
কামাখ্যা বাসলী বালা মাতঙ্গী শৈলবাসিনী।
ইত্যাদ্যাঃ সকলা বিদ্যাঃ কলৌ পূর্ণফলপ্রদাঃ।।
এই বাসলী তন্ত্রসম্মতা মহাবিদ্যা। বাসলী বাগেশ্বরী শব্দের রূপান্তর । বাগীশ্বরী – বাইসরী- বাসরী- বাসলী। এই শব্দ হাজার হাজার বৎসর পূর্বে তন্ত্রশাস্ত্রে স্থান পেয়েছে।
প্রসঙ্গত জৈন প্রাকৃতে বাইসরী ” বাএসরী” হয়েছে। তপগচ্ছীয় শ্রাবকপ্রতিক্রমণান্তর্গত ” কল্যাণকংদং” স্তুতির শেষ বা চতুর্থ গাথায় এই “বাএসরী” পদটি প্রাপ্ত হয় । গাথাটি হল –
কুন্দিন্দু গোকখীর- তুসারবন্না
সরোজহথ্থা কমলে নিসন্না
বাএসরী পুথ্থয়বগগহথা
সুহায় সা অমৃহসয়াপসখা।।
সংস্কৃতে এই শ্লোকটি হল –
কুন্দেন্দুগোক্ষীরতুষারবর্ণা
সরোজহস্তা কমলে নিষন্না
বাগীশ্বরী পুস্তকবর্গহস্তা
সুখায় সা নঃ সদা প্রশস্তা।।
দেবী সরস্বতী বাগীশ্বরীই বাসলী। এই দেবীকে তো চণ্ডীদাস উপাসনা করতেন। তাঁর বাসলী দেবী ছিলেন সাক্ষাৎ চতুর্ভুজা সরস্বতী মূর্তি। বীরভূমের নানুরে অলিখিত ভাবে আজও তিনি কুলদেবী। বাঁকুড়ার বেলেতোড়ে আর একটি চতুর্ভুজা দেবী সরস্বতী ” বাসলী ” মূর্তি আছে। আরও নানা স্থানে দেবী বাসলীর মূর্তি দেখা যায়।
বিষ্ণুপাদমন্দিরের প্রধান চত্বরে প্রবেশের জন্য দ্বিতীয় স্তরে যে দ্বার আছে এবং যেখানে ফুল ,জল, নৈবেদ্য বিক্রি হয় , সেই দ্বারে দক্ষিণ দিকের প্রাচীরগাত্রে এক কুলুজীতে অতি প্রাচীন প্রস্তর খোদিত দেবী সরস্বতীর মূর্তি আছে। সেখানে তিনি চতুর্ভুজা , বীণাপুস্তকহস্তা স্মিতবদনা। দেবী সেখানে বাসিরী ( বাগীশ্বরী) নামে প্রসিদ্ধা।
সনাতন, জৈন, বৌদ্ধ এসব কোনো পৃথক সম্প্রদায় ছিল না। ধর্ম একটি সনাতন। বাকি গুলি মার্গ। তাই প্রত্যেকেই সেই প্রথম আদি দেবীকে উপাসনা করেন। নানা বিশেষ অনুষ্ঠানে মতভেদ হওয়ায় পৃথক স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গড়ে ওঠে বটে, তবে কেউই তাঁরা সনাতনের বাইরে নন।
বৌদ্ধতন্ত্রেও ষষ্ঠভূজা , দ্বিভূজা সরস্বতী দেবী অবস্থান করেন। বৌদ্ধতন্ত্র মতে শ্রেষ্ঠ বোধিসত্ত্ব হলেন অবলোকিতেশ্বর। তারপর স্থান মঞ্জুশ্রীর। তাঁর অপর নাম মঞ্জুনাথ বা মঞ্জুঘোষ। বৌদ্ধতন্ত্রে ইনি বিদ্যার অধিপতি। তাঁকে বাগীশ্বরও বলা হয়। তবে সুবিখ্যাত সংস্কৃত বৌদ্ধগ্রন্থ যেমন – ত্রিপিটক বা লালিতবিস্তর, দিব্যাবদান ইত্যাদিতে এমন কোনো দেবতার উল্লেখ নেই। সুখাবতীব্যূহে , লঙ্কাবতারসূত্রে তাঁর উল্লেখ হয়েছে। অখন্ড ভারতের বহু স্থানে মঞ্জুশ্রীর পূজা হতো।
মঞ্জুশ্রীর এক শক্তি বাগীশ্বরী বা সরস্বতী। তিনি শক্তি হিসাবে না থাকলে মঞ্জুশ্রীও থাকেন না। তাই বৌদ্ধতন্ত্রে তাঁর উপাসনা একান্ত প্রয়োজনীয়।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি , দেবী সরস্বতী বাগীশ্বরী নামে অভিব্যক্ত সে কথা পূর্বে পূর্বে বলেছি। বৈদিক,ও পৌরানিক,তান্ত্রিক এই তিন রকম যজ্ঞাদি কালে বাগশ্বরের সঙ্গে ক্রিয়ারত বাগীশ্বরীকে আহবান করা হয়! কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় বাগেশ্বর কে?অনেকের ধারনা যেহেতু বেদ ব্রহ্মা থেকে প্রকাশিত তাই বাগেশ্বর ব্রক্ষাই হবেন! কিন্তু বিষ্ণুপুরানে,নারদ পঞ্চরাত্র, গরুর পুরানে এই স্থল গুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে বিষ্ণুর হয়গ্রীব অবতারের কথা! সৃষ্টির সূচনাকালে ভগবান হয়গ্রীব ব্রহ্মাকে এই বেদ জ্ঞান দান করেন, ব্রহ্মা সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে বেদ রচনা করেন তাই হয়গ্রীব হলেন বাগীশ্বর!হয়গ্রীব বেদের মূর্তস্বরূপ চিত্ত বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী, সেই হয়গ্রীবের পূজার মন্ত্রগুলি হয়গ্রীব উপনিষদ্ বা হয়গ্রীবোপনিষদে উল্লিখিত হয়েছে। তাঁর শক্তি বাগীশ্বরী বা সরস্বতী। সুতরাং কিভাবে বিষ্ণুর অবতার মঞ্জুশ্রী হয়ে গেলেন সে বিষয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাই সরস্বতীর পূজা বৈদিক , তন্ত্র সকল মতেই সরস্বতী দেবীর উপাসনা আবশ্যক। পঞ্চরাত্ৰগমে উল্লিখিত হয়েছে দেবী ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা। চার হাতে তাঁর দন্ড, পুস্তক, মালা, কমন্ডুল। তিনি ধেনু বাগীশ্বরী , তিনিই সৌভাগ্য বাগীশ্বরী। তিনি জটাজুটধারী। দেবী সরস্বতী ধেনু বাগীশ্বরী তন্ত্রমতে শব্দ ব্রহ্ম।
অখন্ড ভারতবর্ষের এমন বহু সরস্বতী মূর্তি প্রাপ্ত হয় যার নিচে – কোট্টিয়গণ , স্থানিয়কুল, বৈরশাখা , শ্রীগুহসম্ভোগ ইত্যাদি লেখা আছে। এগুলি সবই জৈন মার্গীয় ব্যাপার। এই লিপি হতে প্রমাণিত হয় যে, খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে অন্ততঃ শ্বেতাম্বর জৈনদের মধ্যে দেবী সরস্বতীর অর্চনা হতো। জৈন মার্গীয়দের তীর্থঙ্করগণ মহাপুরুষ। তাঁদের নিকট ঈশ্বরের মুখ নির্গতা বাণীই শ্রুত। তাঁদের মতেও শ্রুত ও সরস্বতী অভিন্ন। দেবী সরস্বতী হলেন শ্রুতদেবী।বহু জৈন গ্রন্থে দেখা যায় যে তীর্থঙ্করগণ শ্রুতদেবীকে প্রণাম করতেন।
কোটশিতং স্বাদশ চৈব কোটী, লক্ষাণ্যশীতিস্ত্র্যধিকানি চৈব।
পঞ্চাশমষ্টৌ চ সহসুসংখ্যামেতচ্ছুতং পঞ্চপদং নমামি।
জ্ঞাতা ধর্মকথা সূত্রে বর্ধমানাদি সহিত সরস্বতীর নমস্কার আছে –
নমঃ শ্রীবর্ধমানায় শ্রী পার্শ্বপ্রভবে নমঃ।
নমঃ শ্রীমৎসরস্বত্য্যৈ সহায়েভ্যো নমো নমঃ।।
অখিল বিদ্যার অধিষ্ঠাতৃদেবী শ্রুতদেবী। শ্রুত সম্বন্ধে দিগম্বর জৈনদিগের গ্রন্থে একটি উপদেশ আছে। শেষ তীর্থঙ্কর শ্রী বর্ধমান মহাবীর স্বামী মোক্ষমার্গের উপদেশ দান করেন। শ্রাবণ মাসের প্রতিপদ্ তিথিতে সূর্যোদয়ের সময়ে রৌদ্র মুহূর্তে যখন চন্দ্র অভিজিৎ নক্ষত্রে ছিল, সেই সময়ে তিনি এই উপদেশ প্রদান করে সুখ দুঃখে কাতর জীবের প্রতি কৃপা প্রদর্শন করেন। বলা হয় ওই সময় বাগ্ দেবী ওনার কন্ঠে অবস্থান করেছিলেন।
ইন্দ্রভূতি গৌতম গণধর ঐদিন সন্ধ্যকালে মহাবীরের এই বাণীকে একাদশ অঙ্গ এবং চতুর্দশ পূর্ব রূপে বিভক্ত করেন। বহু ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে এই ১১ অঙ্গ এবং ১৪ পূর্বের অন্তর্গত করে তাঁর সহধর্মী সুধর্মা স্বামীকে উপদেশ দেন। তিনি আবার জম্বুস্বামীকে উপদেশ দেন। পরে জম্বুস্বামী আরো বহু শ্রমনকে দান করেন। এই রূপে এই শ্রুতের প্রচার হয়। শ্রবণ বেলগোলায় একটি অষ্টধাতুর সরস্বতী যন্ত্র বা শ্রুতকযন্ত্র আছে।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. ঋগ্বেদ্
২. মার্কণ্ডেয় পুরান
৩. শ্রী শ্রী চণ্ডী
৪. সরস্বতী তত্ত্ব
৫. সরস্বতী সভ্যতার ইতিহাস