পর্ব তিন
ধান, কলা, কাঠ , বাঁশ , গোময় , কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় দড়ি এবং অন্যান্য যন্ত্রাদি ব্রতগানের মাধ্যমে কামনা করার পর , ভুইঞাদের কুম্ভকারের নিকট থেকে নির্মিত করিয়ে আনেন মাটির ঢাকুন।
ওহে কেহ মাটি কাটে কেহ মাটি বাছে
কেহ মাটি নান্দিয়া পাকায়
ওহে কেহ মাটি চাকো চড়ায়।
ওহে একোচাকে গড়াইল একচাড়া ঢাকুন।
ওহে ধর্মের দোহাই দিয়া পোনিতে চড়াইল।।
ওহে গড়িয়া পড়িয়া কুমার করলে নিশিপন
ওহে তাহা নৈয়া ভুইঞাদেব সত্বরে গমন।।
শুক্লা চতুদর্শী রাতে ভক্তিয়ারের কাঁধে #গাহুল বাঁধা হয়। গাহুল হল পাঁচটি ধানের থোপ। গাহুল বেঁধে ভক্তিয়ার দাঁড়ান নিশানধারী বা নিশানিয়ার পিছনে। তারপর , মালাকার, বারেক , মণ্ডল প্রভৃতি ব্রতীগণ। সকলে মিলে শোভাযাত্রা করে বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করতে করতে সা পুকুরে এসে উপস্থিত হন। সা পুকুরে ভক্তিয়ার ঘাট শুদ্ধর গান করেন –
বলকোটদানি ঘাটৎ ছানি
ই ঘাটে হামরা করিম শুদ্ধ
ই ঘাটে আছে ধাইধামনকাটি
পালা পালা তুই ধাই-ধামনকাটি
নাহি পালাব তোমারি বলে
হামরা যাম গোসাঞি-পুরী
গোসাঞি পুরীতে আনব এক কোদাই বাণে। …ইত্যাদি
প্রসঙ্গত বলে রাখি, দিঘি বা পুষ্করিণী কাটানো বা পরিষ্কার করার দরকার পড়লে যাঁঁদের ডাকা হয়, তাঁরাই এই অঞ্চলে #বলকোটদানি নামে অভিহিত হন। ধাইধামন অর্থাৎ কচুরীপানা। কোদাই মানে কোদাল।
কচুরীপানা , মৎস্যমকর, ঝিনুক, শামুক, কুমীর এবং নানান জলজ উদ্ভিদে ঘাট অশুদ্ধ তথা বিপজ্জনক থাকে। এসব পরিষ্কার করে ব্রহ্মপুত্র , গঙ্গা , পুনর্ভবা , তুলাই , টাঙ্গন , শ্রীমতী , বালিয়া প্রভৃতি নদীর জল এনে ঘাট ধুয়ে পবিত্র করে তোলার কথা গানে প্রকাশিত হয়।
ঘাট শুদ্ধির পর মালাকার ব্রহ্মপূজা করেন। ঘাটের কাদামাটি দিয়ে ব্রহ্মের একটি ছোট বেদী নির্মাণ করা হয়। তার দুপাশে দুটি ছোট ছোট কাঠি বা কঞ্চি পুঁতে তার উপর দুটি শোলার কদম ফুল ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর দুটি হাঁসের ডিম ঐ কঞ্চির কাঠির উপর ভেঙ্গে আটকে দেওয়াই রীতি। দুটি ছোট ছোট শঙ্খের উপর কলা ও আতপ চাল রেখে পূজা করা এই থানের বৈশিষ্ট্য। সেখানকার পূজা সেরে হাটখোলা থানে দেউলানী কালীর পূজা দিতে যাওয়া হয়। এরপর সকলে ফিরে যান যে যাঁর গৃহে। কেবলমাত্র ভক্তিয়ার দুজন সেরাত কাটান ছাচিকা দেবীর থানে।
পরের দিন মাঘী পূর্ণিমা। ওইদিন হাটখোলা থানে মেলা বসে। সকাল থেকে আশপাশের গাঁ গঞ্জ থেকে মানুষজন ছুটে আসেন দেবীর থানে ব্রত আর মেলা দেখতে। সেদিন করঞ্জীর গণেশপাড়া লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
দুপুরেই ছাচিকা দেবীর থানে পূজার বাজনা আর মেহনা বেজে ওঠে। ভক্তিয়ারদ্বয়ের অবশিষ্ট ব্রতগান ও নাচের পালা হয় শুরু। এই তিনদিনের কঠিন ব্রত পালনের ছাপ তখন তাঁদের চোখে মুখে স্পষ্ট। গানের কন্ঠ হয় ক্ষীণ , উচ্চারণ অস্পষ্ট ।
এখানকার গানে আছে শণের চাষ করার আকাঙ্খা।
ওহে তাহা হৈতে চাহি আমরা শণে ক্ষেতি।
ব্রতকথায় আছে ভাই ভাতিজা গোসাইপুরীতে শণের ক্ষেতি করার কথা জানালে গোসাই শণের গুরুত্ব তাদের বোঝান। শণের বীজের সন্ধানে ভাই ভাতিজা বর্মপুরী বা ব্রহ্মাপুরী হয়ে শিবের পুরীতে এসে উপস্থিত হন। ভাই ভাতিজার প্রার্থনায় শিব বীজের ধামা এনে গোটা কয়েক উকুটিয়া বীজ দেন। তারপর ভাই ভাতিজা শিবের কাছে শণ চাষের রীতি জেনে নিতে চান । শিব তখন বলেন –
সোনার লাঙ্গল সোনার জুঙ্গাল জুড়াবেন রূপার ফাল।
মামা ভাগিনা গোরু জুড়িবেন হাল।।
বারো পাট চাষ দিবেন , তেরো পাট মই।
তবু তো না মরে কেননা দুব্বা নই।।
অতএব , কেননা দুব্বা বাছিয়াক ফেলাবেন অনেক দূর। এই শণের বীজ বোনার আগে,
আতপ চাইলে বাইঞ্চা দুধে সংযম খাবেন।
তাহাক পোহালেক শণ বুনিবারে যাবেন।
যখন বাড়িবেক শণ একেক পাতেসে।
তখন অঘুরিবে শণ একো আদেশে ।।
যখন বাড়িবেক শণ দুই দুই পাত।
তখন অঘুরিবে শণ দুই আদেশে।।
যখন বাড়িবে শণ তিন তিন পাতে।
তিরশাল কুড়িবর পাইয়া শণ হলফল বাড়ে।
ব্রতগান শেষ হলে মালাকার ছাচিকা দেবীর পূজা আরম্ভ হয়। পূজার মন্ত্রের একাংশ উল্লেখ করছি –
আঙ্গটি মাঙ্গটি শিবের ঘরণী
বাদে যাও বাদে আইস
বাদে ঠাকুরাণী
আমার হাতে লয় ফুলজলপানি।
অর্থাৎ ,পূজার মন্ত্র থেকে স্পষ্ট দেবী ছাচিকা হলেন আদ্যাশক্তি মহামায়া। তিনিই শিবশক্তি। এই দেবী মূর্তি সম্ভবত মঙ্গলচণ্ডীর। তবুও মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক পরিচয় অজ্ঞাত। বাদে যাও বাদে আইস , মানে কখনো যাও কখনো আস।
পূজার পর বাদ্য , মেহনা বাজানো হয় খুব দ্রুত লয়ে। মালাকার একটি হাঁড়িতে জ্বলন্ত পাটকাঠির গোছা নিয়ে কোমরে একটি লাল কাপড় জড়িয়ে দ্রুতপায়ে পাঁচবার প্রদক্ষিণ করেন। স্থানীয় ভাষায় এই হাঁড়িকে বলা হয় #সাঞ্জালের_হান্ডি। এরপর , লোকবিশ্বাসে মালাকারের মধ্যে পাতা পড়ে বা ঘোড়া নামে। মানে সোজা কথায় বলা যায় ভর হয়।
ভর মুক্ত হলে মালাকার-সহ সকলে যান ব্রতের শেষ ধর্মের আগুন জ্বালাতে আহূতি জাগানোর থানে।ভক্তিয়ারদ্বয় তখন দেবীথান থেকে সোজা চলে যান সা-পুকুরে ব্রত সমাপন স্থানে। আহূতি জাগানোর থানে তখন প্রচুর জনসমাগম হয়। দুপুরের মধ্যেই সেখানে একটি বড় গর্ত খোঁড়া হয়। সেই গর্তের ঠিক মাঝখানে ঠিক চিতার মতো করে তেঁতুলকাঠ এবং বাঁশ সাজানো থাকে। এরই ফাঁকে মাঝখানে বালি ভর্তি একটি মাটির সরা এবং তার উপর একটি মাটির হাঁড়ি বসানো থাকে। সেই হাঁড়িতে তেল সরবরাহকের দেওয়া ৫ সের তেল চালে গ্রামেরই একজন নাউ বা নাপিত। সেই হাঁড়িতে দেওয়া হয় পাশোসি বা পাঁচ শস্য , যথা – পাট, ধান, সর্ষে , কলাই ও দূর্বা। এই পাঁচ শস্য মানব জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান গ্রহণ করে আছে।
এবার পাশের গর্ত থেকে ত্রয়োদশীর রাত্রে আগুন জ্বালানো খড়ের আঁটি, শুকনো গোবর ও খড়ি তুলে নিয়ে এলে যঞ্জস্থানে ধর্মের আগুন দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠে যজ্ঞাগ্নি। তখন মালাকার তিন জোড়া পায়রা উৎসর্গ করেন। আগুনের তেজে হাঁড়ির সব তেল পুড়ে যায়। তারপর একটি লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁধা ছোট ঘটি থেকে দুধ , মধু মিশ্রিত পবিত্র জল পাঁচবার পাঁচটি প্রশ্ন সহ হাঁড়িতে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে হাঁড়ি থেকে লাফ দিয়ে ওঠে একটি আগুনের হলকা। এই মুহূর্তে উপস্থিত সকলে কাষ-ব , কাষ -ব বলে সহর্ষে চিৎকার করে ওঠেন।
এই অগ্নির হলকা যত উঁচুতে ওঠে তদানুযায়ী মেলে প্রশ্নের জবাব । প্রশ্নগুলি এই রকম –
আগামী সনে পাটের ফলন কি রকম ?
আগামী সনে ধানের ফলন কি রকম ?
আগামী সনে সর্ষে ফলন কি রকম ?
ইত্যাদি ….
যদি এইসব প্রশ্নের সঙ্গে আগুনের হলকা খুব উঁচুতে ওঠে তবে তার অর্থ হল আগামী সনে ফসল ভালো হবে। বিপরীত হলে খারাপ।
যজ্ঞের আগুন নিভে গেলে হাঁড়ি ও বালি ভর্তি মাটির সরা ওই কুন্ড থেকে তুলে আনা হয়। উত্তপ্ত মাটির সররা গনগনে বালির উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় নানা শস্য। দেখা হয় এতে কোন শস্য পুড়ে যায়, কোন শস্য থাকে অক্ষত। যে শস্য পুড়ে যায় আগামী সনে তার অভাব বলে গ্রামবাসীদের বিশ্বাস। হাঁড়ির নীচে সামান্য যে পোড়া তেল থাকে তা সংগ্রহ করার জন্য উপস্থিত সকলের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। মানুষের বিশ্বাস এই তেল নাকি ঘা সারানোর মহৌষধ।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. উত্তর গ্রামচরিত
২. পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা -১ ম খণ্ড
৩. মধুপর্নী শারদীয়া
৪. বিরাট