পর্ব চার
করঞ্জী গ্রামে তিনদিন ধরে যেভাবে ব্রত পালন করা হয় ধাওয়াইলের অনুষ্ঠান তার তুলনায় অনেক সংক্ষিপ্ত…..সেখানে ছাচিকা দেবীর কোনো থান নেই । কোনো ঢিপি নেই । কোন স্তূপ নেই । তবে হ্যাঁ মা আদ্যাশক্তি কালী রূপে আছে। কিভাবে? সে কথাই পরে বলছি। সেখানে ব্রতগানও অপ্রচলিত। সেখানে যাঁরা ব্রত পালন করেন তাঁদের পদবী পাল ।
ধাওয়াইল গাঁয়ে #আহুল_মারা অনুষ্ঠানই প্রধান । করঞ্জী গ্রামের আহুতি জাগান বা ধর্মের আগুনের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। শ্রদ্ধেয় শিশির মজুমদার উত্তরগ্রাম চরিতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ধাওয়াইল গ্রামে আহুল মারার থানে যোগ চিহ্নের মতো একটি গর্ত খোঁড়া অবস্থায় তিনি দেখেছিলেন।
ধাওয়াইল গ্রামে একটি কংস বধের বা কংসের বেদী আছে। কিন্তু তার সঙ্গে কাষ- ব অনুষ্ঠানের কোন যোগ পাওয়া যায় না । তাছাড়া এই কংসের বেদী আর কিছুই নয় , এই বেদীতে একটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন ভগ্ন নারায়ণ মূর্তি আছে । সেই মূর্তি কত প্রাচীন তার প্রত্নতাত্ত্বিক কোন হিসাব আজ অব্দি পাওয়া যায়নি । পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা প্রথম খন্ডের থেকে জানা যায় যে এই গ্রামে ত্রয়োদশীর দিন সন্ধ্যায় ঢাকঢোল বাজিয়ে নিকটস্থ পুকুরের জলে ডুব দিয়ে একটি কাষ্ঠখণ্ড তুলে আনা হয় । তারপর সেটিকে প্রচুর পরিমাণে তেলসিঁদুর মাখিয়ে ভক্তরা মাথায় করে নিয়ে সমস্ত গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন। লোকশ্রুতি আছে যে , অনুরূপ অনুষ্ঠান করঞ্জী গ্রামে এক সময় প্রচলিত ছিল। তবে শ্রদ্ধেয় শিশির মজুমদার নিজে ওই গ্রামে গিয়ে এই তথ্যের কোন সূত্র খুঁজে পাননি।
অধ্যাপক মিহিররঞ্জন লাহিড়ি মহাশয় মধুবনী শারদ সংখ্যায় যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন তাতে শেষ উক্ত তথ্যটি অনুপস্থিত। তাঁর বিবরণীতে আছে মাঘী পূর্ণিমা সন্ধ্যায় প্রায় তিন ফুট লম্বা এক খন্ড চৌক , মসৃণ Oখোদিত শালকাঠ , যার উপর গোটাতিনেক ত্রিশূল লাগানো , তা পাটকালীর মূর্তি রূপে গ্রামবাসীদের কাছে পূজিত হয় । আহুল মারা হল চারপাশে কর্ষিত জমির মাঝখানে অকর্ষিত একখণ্ড জমি । এই জমি কখনো কর্ষিত হয়নি বলেই গ্রামবাসীদের দাবী। এই জমিতেই পাটকালীর পূজা করা হয় । পূজা শেষ হলে পাটকালী তাঁর থানে ফিরে যান। তাঁর থান হল এক গৃহস্থের বাড়ির বারান্দার উঁচুতে ঝোলানো একটি তাক।
সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় যে, পুষ্করিণী থেকে কাষ্ঠখন্ড তোলার পুরনো নিয়ম এখন উঠে গেছে । তাছাড়া ধাওয়াইলের অনুষ্ঠানে ইদানিং বহু শিক্ষিত ব্যক্তির অংশগ্রহণ করায় প্রাচীন রীতি-প্রথা অনেকটাই বিনষ্ট হয়ে পড়েছে। করঞ্জীতেও এই অনুষ্ঠানের অনেক অংশই লুপ্ত হতে চলেছে। সম্ভবত এখন সেখানে আর ব্রতগান চালু নেই।
এইপর্যন্ত আলোচ্য ব্রতের যে পরিচয় পাওয়া গেল, বোধকরি তা থেকে স্পষ্ট যে এটি একটি কর্ষ ব্রত। ফলত , কাষ-ব কর্ষব্রতের অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত রূপ ।গ্রামগুলিতে প্রচলিত এই ব্রত প্রায় ৫০০ কি তারও অধিক বছরের পুরনো । ব্রতের পদ্ধতি ও গানের ভাষায় একে অর্বাচীন বলা চলে না কোনমতেই । এর মধ্যস্থিত বহুশব্দে আদি মধ্য বাংলা স্বারূপ্য মেলে। এমব বহু শব্দ যার অর্থ উদ্ধার করা এখনো সম্ভব হয়নি। যে বৃদ্ধ ভক্তিয়ারের নিকট হতে এই গানগুলি শ্রদ্ধেয় শিশির মজুমদার সংগ্রহ করেছিলেন, তিনি নিজেও বলতে পারেননি যে এর অনেক শব্দের অর্থ বা পরিচয় কি হবে?
পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত হয়েছিল গান । সেই বৃদ্ধ ভক্তিয়ার আপন স্মৃতিতে তা ধরে রেখেছেন। তাঁর জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুর এই ব্রতগান তিনিই করতেন। তবে তার বয়সের সঙ্গে স্মৃতিভ্রংশ ঘটেছে। ফলে , ব্রত গানের কিছু অংশ লুপ্ত হয়ে গেছে বলে শ্রদ্ধেয় শিশির কুমার মজুমদার মনে করেন। এই ভক্তিয়ার ছিলেন সম্ভবত শেষ গায়ক। কেননা এই ব্রতগান করা ও শেখার জন্য যে নিষ্ঠা, সংযম ও আগ্রহ আবশ্যক একালের গণেশপাড়ায় কারো মধ্যে তা অবশিষ্ট নেই।
এই ব্রত যাত্রাডাঙ্গিতে যেভাবে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে ধাওয়াইলে যেভাবে একটি সংক্ষিপ্ত ও প্রক্ষিপ্ত রূপে এসে দাঁড়িয়েছে সেভাবে কালের অমোঘ নিয়মে ক্রমশ অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে করঞ্জীতেও । তাই একজন সনাতনী হিসাবে , ভারতীয় হিসাবে, বাঙ্গালী হিসাবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত, বঙ্গ তথা সমগ্র ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে যে সমস্ত ব্রতকথা , লোকাচার, লোককথা ,ব্রতগান প্রচলিত আছে সেগুলোকে জীবিত রেখে দেওয়া বা প্রয়োজনে পুনরুজ্জীবিত করা। কিছু ঐতিহ্য , কিছু নিয়ম ,কিছু প্রথা , কিছু রীতিকে যদি আমরা জীবিত না রাখি নিজেদের তাগিদে – তাহলে ইতিহাস আমাদের কোনদিন ক্ষমা করবে না।
ব্রতকথা বা ব্রতগানের পরিবেশন ভঙ্গিটিও বিশিষ্ট্যদ্যক । যে সমস্ত ব্রতগানের কথা পূর্ব পর্বগুলিতে উল্লেখ করেছি তাতে মোটামুটি একটা ধারণা বোধ করি আপনারা পেয়ে থাকবেন । ভক্তিয়ার প্রথম ব্রতকথার একটি পদ সুর সহযোগে বলেন। পরে দুজন দোহার ওই পদটি ভক্তিয়ারের সুরে গেয়ে ওঠেন। পদগুলি প্রায়শই পুনরুক্ত হয়। অতি সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ব্রতগানে ক্রমশই একটি করে নতুন শব্দ ও পদ যুক্ত হচ্ছে । এই ব্রতের আদি গায়েন অতি আশ্চর্য কৌশলের উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে যোগ্য শিষ্যে স্মৃতিতে এই ব্রত ধরে রাখার শিক্ষা দিয়েছিলেন। বহু বছর ধরে এই ব্রত কথা স্মৃতিতে রক্ষা করার সচেষ্ট পুরুষানুক্রমে উত্তরবঙ্গের এই তিনটি গ্রামের মানুষজন। বেদ যেমন শ্রুতি, এই ব্রতগানও তো শ্রুতি। সেই শ্রুতিকেও রক্ষা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য বই কি।
দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহ জেলার যুক্ত মানচিত্রে লক্ষ্য করা যায়, এই ব্রত পালনের জন্য নির্দিষ্ট তিনটি গ্রাম উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণ পশ্চিম মুখী টানা একটি সরলরেখার উপর অবস্থিত এবং তিনটি গ্রামই একটি অপরটির থেকে সমপরিমাণ দূরত্বে চিহ্নিত । শুধু তাই নয় , ইতিহাস বিখ্যাত বই বৈরাহাট্টা , করঞ্জী ও ধাওয়াইলের মধ্যবর্তী স্থানে একডালা অবস্থিত। এক সময়ের রাজধানী পাণ্ডুয়া থেকে যাত্রাডাঙ্গা গ্রাম দূরে নয় । প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, করঞ্জী নদীর নিকটবর্তী টাঙ্গন নদী দক্ষিণে যাত্রাডাঙ্গার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে।
তদুপরি একটি প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দেয় । কাষ- ব যদি নিতান্তই একটি কৃষি উৎসব বা লোকব্রত হয়ে থাকে তবে কেন মাত্র তিনটি গ্রামে সীমাবদ্ধ ? পূর্বে উল্লেখ করেছি যে এই তিন গ্রামের লোকবিশ্বাস শ্রীকৃষ্ণ কংসকে এখানে বধ করেছিলেন এবং কংসের দেহ তিন টুকরো হয়ে তিন গ্রামে গিয়ে পড়েছিল । এইব্রত করঞ্জী গ্রামের গণেশ তাঁতি , ধাওয়াইলে ও যাত্রাডাঙ্গায় পালব্বা কুম্ভকার দ্বারা পালিত হয়। এই নির্দিষ্ট তিনটি গ্রামের বাইরে বলাবাহুল্য উক্ত সম্প্রদায়ের কেউই ব্রত পালনের জন্য অধিকারী নন । তাঁদের অধিকাংশই এই ব্রতের কথা জানেন না ।
এইসব কারণে রাজা গণেশের প্রসঙ্গ এসে পড়ে । কেননা করঞ্জী যে একদা তাঁর বাসস্থান ছিল এবং সম্ভবত এই ব্রতের প্রবর্তক ছিলেন তিনি।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. উত্তর গ্রামচরিত
২. পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা -১ ম খণ্ড
৩. মধুপর্নী শারদীয়া
৪. বিরাট