‘ক্লীং’ এবং ‘রাং’। বীজমন্ত্রে কৃষ্ণ ও রাধার প্রাণায়াম এবং ধ্যান সম্পন্ন হয়েছে। তারপর আবাহন, তাদের সাদর সম্ভাষণ। শাস্ত্রসম্মতভাবে আচমন করে বসা হয়েছে কল্পবৃক্ষের তলায় – হয়তো কদম বা কেলিকদম্বের তলে, কিংবা বকুল তলায়, অথবা তমাল-তলে সেঁজুতি-সন্ধ্যাদি সম্পাদন করে। আতপচাল হাতে নিয়ে স্বস্তিবাচন করেছি “…শ্রীভগবদরাধাকৃষ্ণস্য রাসোৎসবকর্মণি ওঁ পুণ্যাহং….”। পুষ্পপাত্রে রেখেছি পদ্ম, তুলসী, তিল, নানান পুষ্পসম্ভার, অগুরু-চন্দন। রাধাকৃষ্ণের মুকুট, তারই উপর আজ পরিয়েছি ফুলের অলঙ্কার — রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া গুল্মের প্রস্ফূটিত পুষ্পবিন্যাস ( Caesalpinia pulcherrima , family Fabaceae), গলায় ফুলের মালা। আকাশে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণচন্দ্র; না গরম, না ঠাণ্ডা – এক অপূর্ব আবহে রাধাকৃষ্ণের আবাহন —
“ওঁ আগচ্ছ পরমানন্দ সর্বব্যাপিন্ জগণ্ময়।
সান্নিধ্যং কুরু রাসার্থং গোপীভিঃ সহ মণ্ডলে।।”
একমনে ডাকা হল পুরুষোত্তম ভগবান কৃষ্ণকে। তারপর ধ্যানে এলেন পরম প্রকৃতি রাধারাণী “…. হরিমুখকমলে যুঞ্জতীং নাগবল্লীং পূর্ণাং কর্ণায়তাক্ষীং ত্রিজগতি মধুরাং রাধিকাং ভাবয়ামি।” কৃষ্ণভক্ত-পূজকের জন্ম সার্থক হল শ্রীরাধার চরণ বন্দনা করে। শ্রীরাধা, যিনি কৃষ্ণপ্রাণাধিকা, যিনি বিষ্ণুপ্রাণাধিকা, হরিপ্রিয়া, তাঁকে প্রণাম —
“তপ্তকাঞ্চনগৌরাঙ্গীং রাধাং বৃন্দাবনেশ্বরীম্।
বৃষভানুসুতাং দেবীং তাং নমামি হরিপ্রিয়াম।।”
রাসমণ্ডপে গোপিনীমণ্ডলী এবং রাধাকৃষ্ণের মৃন্ময় মূর্তি। কিন্তু মানসচক্ষুতে দেখতে পাচ্ছি চাঁদনি আলোয়, পুষ্পসুগন্ধে, অগুরু-চন্দনে শোভিত হয়ে বৃন্দাবনের গোপীমণ্ডলী এক বৃহৎ বৃত্ত রচনা করে নৃত্যরতা। শ্রীকৃষ্ণ যেন অসংখ্য ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন! গোপিনী দের সবাই পেয়েছেন ভগবানের সামীপ্য। চন্দ্রাবলী, শশিকলা, ললিতা, বিশাখা, রতিমঞ্জরী, শ্যামলা, চিত্রা, সুমুখী, মদনসুন্দরী, সুদেবী, চম্পকলতা, অঙ্গদেবী, তুঙ্গবিদ্যা, ভদ্রা, পদ্মা, সব্যা, শশিরেখা, হরিপ্রিয়া সবাই দিব্য পরিবেশে নাচ করে চলেছেন ভগবানের সঙ্গে। আর মধ্যিখানে ভগবান কৃষ্ণ আর শ্রীরাধিকা। গোল হয়ে নৃত্য, আবার কেন্দ্রীয় নৃত্য। যেন ঘূর্ণায়মান নক্ষত্র-কেন্দ্র, চারপাশে আনন্দ-গ্রহ! পূজক তাই যথোপচারে ‘কোটিযোগিনীভ্যো নমঃ’ বলে গোপিনীদের উদ্দেশ্যেও ফুল-চন্দন দিয়েছেন৷
তারপর আঠাশটি রক্তকরবী ফুলের সমিধে হোম সুসম্পন্ন হবে। আগেই সঙ্কল্প করেছি — “…..অষ্টাবিংশতিসংখ্যক-সাজ্যকর-বীরসমিদ্ভির্হোমমহং করিষ্যে।” উৎসব-চত্বরের আলোকমালার মধ্যে বেজে উঠবে গীতবাদ্য। মণ্ডপের চারপাশে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহকে প্রদক্ষিণ করিয়ে যখন রাসমঞ্চের মণ্ডপের মাঝে বসানো হল, তখন রাত ঘন হয়ে আসছে। মানস মঞ্চে সেই বৃন্দাবন, সেই যমুনার তীর, সেই কুসুমোদ্যান, সেই পৌণর্মাসী চাঁদ …..। শ্রীরাধা, যোগিনীকোটি, শ্রীকৃষ্ণ। এমন রূপকল্পনা যদি বাস্তব হয়ে ওঠে তবে ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক —
“যবে দোলার ফুলরশি
দিবে নীপশাখায় কষি
যবে দখিন-বায়ে বাঁশির ধ্বনি
উঠবে আকাশ ঘিরে
মোরা রাখাল মিলে করব মেলা
নীল নদীর তীরে।”
অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এবং কল্যাণ চক্রবর্তী।