দ্বিতীয় অঙ্ক
সচরাচর দৈর্ঘ্যে ৬৪ হাত ও বিস্তারে ৩২ হাত নাট্যমণ্ডপ নির্মাণ করা হতো। শাস্ত্রমতে লম্বায় ও চওড়ায় এর থেকে বেশি করা উচিত নয়। প্রেক্ষাগৃহের আয়তন এ অপেক্ষা বৃহৎ করলে নাট্য অস্ফুট হয়ে পড়বে। মন্ডপ আরো বড় করলে অভিনেতাদের আওয়াজ কিছু শোনা যাবে না । আর শোনা গেলেও শ্রোতাদের নিকট অভিনেতাদের স্বর বিস্বর বোধ হবে। তাছাড়া অঙ্গভঙ্গি ও দৃষ্টি দ্বারা অভিনেতা যে সকল লাস্যগত ভাব দর্শকদের দেখাতে চেষ্টা করবে, আয়তন অত্যন্ত বড় হওয়ার দূরস্থ দর্শকের নিকট সে সকল ভাব অস্পষ্ট এবং অব্যক্ত হয়ে পড়বে। সুতরাং , প্রেক্ষাগৃহের আয়তন মাধ্যমে পরিমাণের হওয়া দরকার। আর তাতে পাঠ্য ও গান শোনা যেতে পারবে ।
ভরত নাট্যশাস্ত্র সংকলনে রঙ্গপীঠ বা মঞ্চ নির্মাণ করার বিধি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তৎপূর্বে বলেছেন –
ভূমের্বি পূর্বংতু পরীক্ষেত প্রয়োজকঃ।
ততো বাস্তু – প্রমাণেন প্রারভেত শুভেচ্ছায়া ।।
প্রেক্ষাগৃহের ভূমিভাগ আগে পরীক্ষা করে বাস্তুপ্রমাণ গৃহারম্ভ করা প্রয়োজন। নাট্যমণ্ডপ নির্মাণ করার উপযোগী ভূমি দেখে তাতে নাট্যমণ্ডপ প্রস্তুত করতে হবে। এরূপ ভূমি পাঁচ রকমের হয় – সম, স্থির ,কঠিন ,কৃষ্ণ , শ্বেত।
সমা স্থিরা তু কঠিনা কৃষ্ণা গৌরী চ যা ভবেৎ।
ভূমিস্তত্রৈব কর্ত্তব্যঃ কর্ত্তৃভির্নাট্যমণ্ডপঃ।।
তারপর ভূমিকে শোধন করতে হবে। লাঙ্গল দিয়ে কর্ষণ করে অস্থি ,কীলক ,কপাল, তৃণ , গুল্মাদি উৎসারিত করে পরিষ্কার করতে হবে। তারপর –
শোধয়িত্বা বসুমতী প্রমাণং নির্দ্দিশেত্ততঃ।
ছেদ নেই এমন রজ্জু দিয়ে বিশেষ সাবধান হয়ে ভূমি মাপ করবার ব্যবস্থা । মাপ করার নিয়ম এই – দড়ি দিয়ে মেপে ৬৪ হাত লম্বা জমি করে নিতে হবে । এটি হবে মন্ডপের দৈর্ঘ্য । তাকে আবার দু’ভাগে ভাগ করতে হবে। এই দুই ভাগ করা ভাগের পিছনে যে ভাগ থাকবে তাকেও আধাআধি ভাগ করতে হবে । এরই এক ভাগে রঙ্গপীঠ নির্মাণ করা হবে।
এইবার মৃদঙ্গ, দুন্দুভি, শঙ্খাদির ধ্বনি করে গৃহস্থাপন করা হয় । এরপর ভিত্তিকর্ম্ম । ভিত্তিকর্ম্ম শেষ হলে হয় স্তম্ভস্থাপন। শুভ সূর্যোদয়ে আচার্যের সাহায্যে এই ব্যাপারের অনুষ্ঠান করা উচিত। সেই রাত্রে উৎসর্গের ব্যবস্থা….
নাট্যশালা দু’ভাগে বিভক্ত। একভাগ দর্শকের বসবার জন্য , অপর ভাগ রঙ্গ। এখানে অভিনয় হয়। দর্শকদের স্থান স্তম্ভ দ্বারা চিহ্নিত করা হতো । সম্মুখে থাকত সাদা রঙের স্তম্ভ , তারপর থাকতো লাল স্তম্ভ, উত্তর-পশ্চিমে হলুদ রঙের স্তম্ভ এবং উত্তর-পূর্বে নীল রঙের স্তম্ভ ।এগুলি যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রদের বসার জন্য নির্দিষ্ট হতো।
স্তম্ভগুলি নির্মাণের ক্ষেত্রে সোনা, রূপা, তামা এবং লোহার মত ধাতু ব্যবহার করা হতো। কিন্তু সকল স্তম্ভমূলে লোহা দেওয়া একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল। এরপর রঙ্গপীঠ করার নিয়ম। বসবার আসনগুলো কাঠের ও ইটের । এগুলি থাক্ থাক্ করে সারি দিয়ে সাজানো থাকতো । সামনে রঙ্গের পাশে চারটি স্তম্ভের উপর বারান্দা – এটি সম্ভ্রান্ত দর্শকদের জন্য নির্মিত হতো। দর্শকদের সম্মুখে রঙ্গ চিত্র ও মূর্তি দিয়ে সাজানো । এটি একটি বর্গক্ষেত্র – দৈর্ঘ্য প্রস্থ দুইই ৮ হাত করে। রঙ্গের শেষ দিকের নাম – রঙ্গশীর্ষ। এটিও নানা রকমের মূর্তি দিয়ে সাজানো। রঙ্গশীর্ষে ছয়টি কাঠের খুঁটি বা স্থাণু থাকা দরকার। এইখানেই রঙ্গদেবতার পূজা হয়। রঙ্গশীর্ষের গর্ভ কালো রঙের মৃত্তিকা দ্বারা ভরাট করা। সেই মাটিতে কাঁকর বা ঢিল পাটকেল থাকলে তা পরিষ্কার করা একান্ত বাঞ্চনীয়।
রঙ্গপীঠ আদর্শতলবৎ করাই নিয়ম – কূর্ম বা মৎস্যপৃষ্ঠাকার হলে হবে না। রঙ্গপীঠের উপরদিকে – মাথায় কতকগুলি রত্ন বসাতে হয়। যেখানে তা বসাতে হয় সেই স্থানের নাম রঙ্গশির। এর পূর্বদিকে হীরক , দক্ষিণে বৈদুর্য , পশ্চিমে স্ফটিক, উত্তরে প্রবাল এবং মধ্যে কনক দিতে হয়। এমন রঙ্গশির নির্মাণ করে তবে তাতে কাঠের কাজ করতে হয়। কাঠের কাজকে দারুকর্ম্ম বলা হয়। কাঠে নানারকম শিল্প- রচনা করতে হতো। সিংহ – ব্যাঘ্রাদি পশু , অট্টালিকা , নানারকম পুতুল , বেদি, বস্ত্রজালগবাক্ষ, কুট্টিমের উপর স্তম্ভ নির্মাণ করে কাঠের কাজ শেষ করা হতো।
রঙ্গের পিছনে যবনিকা । এটি একটি রঙ করা পর্দা । এর নাম পটি বা অপটি। এছাড়াও এটি তিরস্করণী বা প্রতিশিরা নামে পরিচিত। যখন একজন দ্রুত প্রবেশ করে , অপরটি বেশ জোরে টেনে নেওয়া হয়। এর নাম অপটিক্ষেপ। যবনিকার রঙ সর্বদাই লাল হয়ে থাকে। কোনো কোনো মতে যবনিকার রঙ প্রয়োজন অনুসারে নানা রকমের হতো।
আদিরসে শুভ্র , বীররসে পীত , করুণরসে ধূম্র , অদ্ভুতরসে হরিৎ , হাস্যরসে বিচিত্র , ভয়ানকরসে নীল , বীভৎসরসে ধূমল এবং রৌদ্ররসে রক্ত বর্ণের ব্যবস্থা কেউ কেউ করতেন। কিন্তু কোনো মতে যবনিকা সকল ক্ষেত্রেই লাল । আধুনিককালে অভিনয় সূচনার পূর্বে প্রতি অঙ্কের যবনিকা দিয়ে রঙ্গের সম্মুখভাগ ঢেকে রাখার নিয়ম আছে।
পুরাকালে যবনিকা দুভাগে বিভক্ত থাকত। কোন ভূমিকার অভিনেতার প্রবেশের সময় যবনিকার দুটি খণ্ড দুইটি সুন্দরী কুমারী দুপাশ দিয়ে গুটিয়ে নিত। এখনকার মতো যান্ত্রিক পদ্ধতিতে উপরে তুলে দেওয়া হতো না। এই সুন্দরীদ্বয়ের কর্ম ছিল যবনিকা ধরে রাখা। পর্দার পিছনে নেপথ্য- গৃহ। এটি সাজঘর – অভিনেতাদের অধিকৃত। নেপথ্য গৃহ হতে দৈববাণীর ব্যবস্থা করা হয়। একসঙ্গে অনেকের উচ্চকন্ঠধ্বনি প্রভৃতি এস্থান হতে করা হয়। যে সকল অভিনেতার রঙ্গে উপস্থিতি অসম্ভব অথবা অনভিপ্রেত তাদের কন্ঠস্বর এখান হতে উচ্চারিত হতো। নেপথ্য – গৃহের দুইটি পীঠদ্বার করতে হয়। সাজঘর ও রঙ্গপীঠের মাঝখানে দুইটি দরজা দিয়ে সাজঘর হতে রঙ্গপীঠে প্রবেশ করতে হয়। নেপথ্য বলতে যদি রঙ্গের থেকে উন্নত কোনো স্থান কেউ বোঝেন তাহলে তা সম্পূর্ণ ভুল। কেননা , ব্যুৎপত্তি অনুসারে নেপথ্য ( নি- পথ ) বলতে নিম্নগামী পথই বোঝায়। নেপথ্য রঙ্গাপেক্ষা নিম্নভূমিতে অবস্থিত।
অভিনেতাগণের রঙ্গে প্রবেশ করাকেই বলা হয় রঙ্গাবতরণ । যদি এমন শব্দ শুনে সহসা কারুর মনে হয় যে কোনো উচ্চস্থান থেকে নীচে নেমে আসা , তবে তা ভুল।
রঙ্গ হতে নেপথ্যে যাবার দুটি দ্বার থাকত। বাদ্য বাদকদের স্থান এই দ্বার দ্বয়ের মধ্যেই ছিল।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. ভারতীয় নাট্যশালার গোড়ার কথা
২. কলকাতার সিনেমা হল