আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥
ধৃতরাষ্ট্র বললেন , ” হে মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর তোমার জ্ঞানগর্ভ কথায় আমার শোক কিছুটা শান্ত হয়েছে। আমি তোমার নিকট মুক্তিলাভের তত্ত্ব সম্পর্কে অবগত হতে চাই। অপ্রিয় ঘটনা বা প্রিয়জনের মৃত্যু থেকে যে সকল থেকে যেসব দুঃখ মানুষকে বিভ্রান্ত করে তোলে , সেইসব দুঃখ থেকে জ্ঞানীরা কিভাবে মুক্তিলাভ করেন?”
হ্যাঁ , মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের গীতার বাণীর পর সব থেকে প্রাসঙ্গিক দুজনের জ্ঞান বা বাণী উল্লেখযোগ্য। একজন পিতামহ ভীষ্ম ,অপরজন হলেন বিদুর। শরশয্যা গ্রহণেরআটদিন পর যুদ্ধের শেষ হলে-
যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভ করে অভিষিক্ত
হলেন। এই সময় কৃষ্ণের
পরামর্শে যুধিষ্ঠির শরশয্যায় শায়িত
ভীষ্মের কাছে আসেন।
সেখানে কৃষ্ণের অনুরোধে ভীষ্ম
যুধিষ্ঠিরকে বিবিধ পরামর্শ দেন।
শরশয্যায় মোট আটান্ন দিন থাকার পর
ভীষ্ম মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের
অষ্টমী তিথিতে যোগযুক্ত
হয়ে ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেন। এই দিনের
স্মরণে হিন্দু আমরা ভীষ্ম-ত র্পণ
করে থাকি । ভীষ্ম কৃতক যুধিষ্ঠিরকে প্রদানকারী সেই জ্ঞান এবং সমগ্র মহাভারতে নানা সময় বিদুর দ্বারা প্রদান করা নীতি ও জ্ঞান আজও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নিমিত্ত ব্যাস শিষ্য , গাবল্গন পুত্র এবং ধৃতরাষ্ট্র সারথী ন্যায়পরায়ণ , সৎ সঞ্জয় আপন গুরুদেবের নিকট হতে দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্ত হয়ে সমগ্র কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং শ্রীকৃষ্ণের গীতার বাণী ব্যাখ্যা করেন সেই কথা হয়তো বৃদ্ধ, জিগিংসা ও পুত্র প্রেমে অন্ধ উপলব্ধি করে পারেন নাই। তাই যুদ্ধের পর দুর্যোধন,দুঃশাসন , দুঃসহন , দুঃশলন , জলগন্ধ , সমন, সহন , বিনন্ধন , অনুবিন্ধন প্রমুখ শতপুত্র, জামাতা ও আপন প্রিয় বন্ধু , আত্মীয়, দৌহিত্র প্রমুখকে হারিয়ে গভীর শোকে আছন্ন ধৃতরাষ্ট্র আপন হৃদয়ের শান্তির প্রাপ্তির নিমিত্ত বিদুরের নিকট নানা প্রশ্ন করেন। তার মধ্যে উক্ত প্রশ্ন হল একটি।
দুঃখে কাতর ধৃতরাষ্ট্র অঙ্গে ধূলা মেখে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বিলাপ করছিলেন। কেবল নিজের করা অতীত কর্ম এবং স্বয়ং বেদব্যাস , ভীষ্ম ও নারদের শুভ বাক্যকে গুরুত্ব না দেবার নিমিত্ত যে সর্বনাশ তিনি ডেকে এনেছেন , সেই কারণে আপন কপালে করাঘাত করেছিলেন। বিদুর এমতো অবস্থায় মহারাজকে বললেন , ” মহারাজ উঠে বসুন, কেন এমন করে বিলাপ করছেন ? নিজেকে নিজেই রক্ষা করুন , এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে সকল প্রাণেরই পরম গতি নির্দিষ্ট হয়ে আছে। বহু সমবায় হলেই ক্ষয় হয়ে থাকে, উন্নতি হলেই পতন হয় এবং সংযোগ ঘটলেই বিচ্ছেদ ঘটে। মৃত্যুতেই জীবনের অবসান। ব্রহ্ম ও শক্তির কালচক্রের নিয়মে যম বীর এবং ভীরু উভয়কেই আকর্ষণ করেন ,তখন ক্ষত্রিয়গণ যুদ্ধ না করে থাকতে পারেন?
মানুষ যুদ্ধ না করলেও মৃত্যু হয়। আবার যুদ্ধ করলেও জীবিত থাকে। কালের নিয়মকে কেউ অতিক্রম করতে পারেন না। জন্মের পূর্বে যে অভাব থাকে, মধ্যভাগে স্থিতি হয় মৃত্যু হলে পুনরায় অভাব উপস্থিত হবে। সুতরাং মৃতের জন্য দুঃখ করে কি লাভ ? “
সঞ্জয় তখন বললেন , “আপনি বোধয় শ্রীকৃষ্ণের একটি বাণী ভুলে গেছেন , তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে উচ্চারণ করেছিলেন – জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ ।
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।”
বিদুর বললেন , ” নিহত ব্যক্তিগণ ব্রহ্ম, বেদ এবং বেদান্তে বিশ্বাসী ছিলেন , তবে কেন তাঁদের জন্য শোক করছেন ? পন্ডিতগণ বলেন আত্মীয়দের অশ্রু মৃতজনকে দগ্ধ করে থাকে। তবে কেন আপনি শোক করছেন ? যুদ্ধে নিহত উভয় পক্ষই যশস্বী হন।
কালের নিকট কেহ প্রিয় বা অপ্রিয় হন না । কাল কারোর প্রতিই উদাসীন নন। ব্রহ্ম ও শক্তির কালচক্রে সকলেই আকর্ষিত হন। ব্রহ্ম এবং শক্তিই নিত্য বাকি সকল অনিত্য। রূপ, সম্পদ , যৌবন, অহংকার সকলই একদিন কালের চক্রে মিশে যায়। অতএব বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিরা ভোগের আশায় এসবে আসক্ত হন না।
তাছাড়া আপনার এক পুত্র যুযুৎসু জীবিত। তিনি সম্পূর্ণ জীবন ন্যায়ের পথে ছিলেন। তাঁকে আপনার তথাকথিত শত্রু ,মিত্র সকলেই সম্মান করেন। আপনি তাঁর নিমিত্ত গর্ব বোধ করুন। “
এরপর শোকাহত সম্রাট মুক্তির সন্ধান করলে , বিদুর বললেন , ” মহারাজ , যে উপায়ের মাধ্যমে মনে দুঃখ এবং সুখ থেকে মুক্তি প্রাপ্তি হয়, জ্ঞানীরা সেই উপায় উদ্ভাবন করে সুখ এবং দুঃখকে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করে শান্তি লাভ করেন। কারণ আমরা যাকিছুই চিন্তা করি তা সকলই অনিত্য। মানব ওষধিবৃক্ষের ন্যায় দুর্বল এবং ক্ষণস্থায়ী। ধনী অথবা দরিদ্র , মূর্খ অথবা পন্ডিত যখন সকলকেই একদিন শ্মশানভূমিতে যেতে হয় তখন কিন্তু তাঁদের যাকিছু আত্মতৃপ্তির কারণ তা অর্থহীন হয়ে যায়।”
সঞ্জয় স্মিত হেঁসে বললেন , ” আপনি মহাজ্ঞানী মহামন্ত্রী । আপনি সঠিক। শ্রীকৃষ্ণ এই উপদেশই অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্রে দান করেছিলেন। তিনি যা বলেছিলেন তা যুগ হতে যুগান্তর ধরে এই বিশ্বে প্রতিধ্বনিত হবে। –
যোগযুক্তো বিশুদ্ধাত্মা বিজিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়ঃ।
সর্বভুতাত্মভূতাত্মা কুর্বন্নপি ন লিপ্যতে।।
যোগযুক্ত জ্ঞানী বিশুদ্ধ বুদ্ধি, বিশুদ্ধ চিত্ত ও জিতেন্দ্রিয় এবং তিনি সমস্ত জীবের অনুরাগভাজন হয়ে সমস্ত কর্ম করেও তাতে লিপ্ত হন না।
নৈব কিঞ্চিৎ করোমীতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিৎ।
পশ্যন্ শৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্নশ্নন্ গচ্ছন্ স্বপন্ শ্বসন্।।৮।।
প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্নন্নুন্মিষন্নিমিষন্নপি।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্।।৯।।
চিন্ময় চেতনায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তি দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা ও নিঃশ্বাস আদি ক্রিয়া করেও সর্বদা জানেন যে, প্রকৃতপক্ষে তিনি কিছুই করছেন না। কারণ প্রলাপ, ত্যাগ, গ্রহণ, চক্ষুর উন্মেষ ও নিমেষ করার সময় তিনি সব সময় জানেন যে, জড় ইন্দ্রিয়গুলিই কেবল ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়েছে, তিনি নিজে কিছুেই করছেন না। “
বিদুর বললেন, ” সঞ্জয় তুমি সৌভাগ্যবান। তুমি তাঁর সেই বাণী স্বকর্ণে এবং তাঁর রূপকে আপন চক্ষে অবলোকন করে কৃতার্থ হয়েছ। তিনি অমোঘ তিনি সত্য …” এরপর তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন , ” জ্ঞানীরা জীবের দেহকে গৃহের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন , কারণ দেহ গুলি গৃহের সমতুল্য। কালের সঙ্গে একমাত্র চিরন্তন পুরুষদের অনুগত থাকে। যেরূপ মানব তার পুরাতন বস্ত্র ত্যাগ করে নতুবা বস্ত্র ধারণ করে , আত্মাও পুরাতন দেহ পরিত্যাগ করে নব দেহ ধারণ করে। তবে এটিও সত্য প্রতি জীব আপন আপন কর্ম অনুসারে সুখ এবং দুঃখের ভোগী হয়। “
সঞ্জয় বললেন , ” হ্যাঁ মহারাজ , মহামন্ত্রী যথার্থ বলেছেন। এই কথা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ বলছিলেন মধ্যম পাণ্ডবকে আপনি চিৎকার করে বলেছিলেন , ” ওকে থামতে বল সঞ্জয় , এসব শ্রবণ করলে অর্জুন প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হবে , তাতে সে সেই কর্মই সম্পাদন করবে যা বিশ্বকে ন্যায়ের পথে নিয়ে যায়। তখন ….আমার পুত্রদের কি হবে?” আমি কিন্তু আপনাকে যুদ্ধের বিবরণ দিতে তারপরেও থামি নি। কারণ আমি আমার গুরু মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের আজ্ঞায় ও আশীর্বাদে সেই কর্ম সম্পাদন করছিলাম। আপনি ভাবুন মহারাজ সেই অমিত শক্তিশালী পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছিলেন ? মনে পড়ে ? তিনি বলেছিলেন –
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরানি।
তথা শরীরানি বিহায় জীর্ণা-
ন্যানানি সংযাতি নবানি দেহী ॥
বেদও তো একই কথা বলে মহারাজ…. তাই সেই ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান মুহূর্তে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন – বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব বেদ্যো
বেদান্তকৃদ্বেদবিদেব চাহম্ ।
সকল বেদে আমিই একমাত্র জ্ঞাতব্য বিষয়,-আমিই বেদান্তের প্রণয়ন-কর্ত্তা, আমিই বেদের জ্ঞাতা। “
বিদুর বললেন , ” মহারাজ , প্রাণীরা কর্ম অনুসারেই পরলোক এবং ইহলোকে সুখ ও দুঃখ ভোগ করে। তারা স্বাধীন বা পরাধীন অবস্থায় সুখ ও দুঃখকে পেয়ে থাকে। যেমন মাটির কোনো পাত্র কুম্ভকারের হাতে কিয়দ নির্মাণ হওয়া মাত্র ,কিংবা সম্পূর্ন হয়ে যাবার পরে অথবা শুষ্ক ও দগ্ধ অথবা সেই পাত্র কিছুদিন ব্যবহার করার পরে একদিন নষ্ট হয়ে এই পঞ্চভূতে মিলিয়ে যায়। পৃথিবীতে সকল প্রাণীর দেহ সেইরূপ। “
এসকল কথা শ্রবণ করে তখন ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধ দুই চক্ষুর কোটর নির্গত অশ্রু শুকিয়ে গেছে। কেবল তাঁর হৃদয় ক্রমশ নির্মল পবিত্র হয়ে উঠছে। তাঁর বড় মনে পড়ছে সেই যেদিন যাদবশ্রেষ্ঠ স্বয়ং শান্তি দূত হয়ে এসে পঞ্চপান্ডবের নিমিত্ত মাত্র পাঁচটি গ্রাম যাঞ্চা করেছিলেন। তবুও কেন যে দিলেন না ? সেই যে অসম্ভব জ্যোতিকে একবার মাত্র দেখেছিলেন কোন এক দৈব বলে …সেই জ্যোতির্ময়কে তাঁর কেবল মনে পড়তে লাগল। তাঁর হৃদয়ের সব অন্ধকার যেন তাঁকে চিন্তা করলেই ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে।
সঞ্জয় বললেন , ” মহারাজ, দ্বারকাধীশ যুদ্ধক্ষেত্রে যোগাবিষ্ট অবস্থায় মধ্যম কৌন্তেয়কে বলেছিলেন – শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্চাপ্যুৎক্রামতীশ্বরঃ ।
গৃহীত্বৈতানি সংযাতি বায়ুর্গন্ধানিবাশয়াৎ ॥
বায়ু যেমন ফুলের গন্ধ নিয়ে অন্যত্র গমন করে, তেমনই এই জড় জগতে দেহের ঈশ্বর জীব এক শরীর থেকে অন্য শরীরে তার জীবনের বিভিন্ন ধারণাগুলি নিয়ে যায়। – মহারাজ বলুন এমন বাণী এত সহজ করে কে বলবেন ? ”
বিদুর বললেন , ” হে কৌরবরাজ , জীব গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে , কিংবা কিয়দদিন জীবিত থেকে অথবা বিগত যৌবনে পৌঁছে বা মধ্য বয়সে এসে অথবা বৃদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। এরপর প্রাণীর নিজস্ব কর্ম অনুসারে জন্ম হয় বা হয় না। এটিই জগতের স্বভাবসিদ্ধ নিয়ম। “
সঞ্জয় বললেন , ” হে সম্রাট , মনে করুন মহারাজ পুরুষোত্তম কি বলেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে – অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্ ।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি ॥
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥…. তিনি বলছেন – কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি।।
মহারাজ, জনক আদি রাজারাও কর্ম দ্বারাই সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অতএব, জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার কর্ম করা উচিত।
যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।।।
শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরা তার অনুকরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, সমগ্র পৃথিবী তারেই অনুসরণ করে।”
বিদুর বললেন , ” হ্যাঁ মহারাজ শ্রীকৃষ্ণের সেই অমোঘ বাণীই তাই এক ও শ্রেষ্ঠ – আপনি কিসের জন্য তাহলে দুঃখ পাচ্ছেন ? কার জন্য অনুতাপ ? আপনার কৃতকর্মের জন্য কি ? তাহলে ভুলে যান , আর সেই যুদ্ধক্ষেত্রে গোবিন্দের মুখনিঃসৃত বাণীর কথা চিন্তা করুন ।
মহারাজ , যেমন জলে সাঁতার দেবার সময় প্রাণী ডুব দেয় , আবার ভেসে ওঠে , ঠিক তেমনি এই সংসারে প্রাণীদের উৎপত্তি এবং বিনাশ হয়। যাদের এই বিষয় কোনো জ্ঞান নেই তারা কর্ম অনুসারে সংসারে জড়িয়ে পড়ে বা বদ্ধ হয় , আর সেই বদ্ধতার নিমিত্ত কষ্ট ভোগ করে। আর যাঁরা এই বদ্ধ অবস্থা থেকে বা সংসার থেকে মুক্তি পাবার জন্য ভালো বা মন্দ লোকদের সঙ্গে থেকে তাঁদের দোষ বা গুণ উপলব্ধি করার পর, কেবল সত্ত্বগুণে অবস্থান বা স্থিত হয়ে থাকেন , তাঁরাই উত্তমগতি লাভ করেন।”
সঞ্জয় করজোড়ে বললেন, ” মহারাজ , সেই কারণেই যুদ্ধের সূচনায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন – ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জ্জুন ।
-“ত্রিগুণময়ী প্রকৃতির খেলাই বেদের আলোচ্য বিষয়; অর্জ্জুন, তুমি ত্রিগুণের অতীত হও…”
এরূপ সকল বাক্য শ্রবণ করার পর ধৃতরাষ্ট্র হৃদয়কে শান্ত করলেন। বিদুরের সহ সঞ্জয় তাঁকে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এই সুবিশাল ব্রহ্মান্ডের সত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটালেন। তিনি উপলব্ধি করলেন , মানুষ নিজেই নিজের শত্রু ,নিজেই নিজের বন্ধু। নিজেই নিজের ভালো বা মন্দ কাজের সাক্ষী হয়ে থাকে। ভালো কাজের অনুষ্ঠানে সুখ এবং মন্দ কাজের অনুষ্ঠানে দুঃখ হয়। সকলেই কাজ অনুসারে তার ফলাফল ভোগ করে , কেউ কাজ না করে তার ফলভোগের যোগ্যতা অর্জন করে না।
পরিশেষে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পুণ্যতোয়া প্রসন্নসলিলা মা গঙ্গার তীরে উপস্থিত হয়ে তর্পণাদির জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ–
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে ॥
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. মহাভারত : কালীপ্রসন্ন সিংহ
২. মহাভারতম্ : হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য
৩. মহাভারতের অদৃষ্ট, বিলাপ ও সান্ত্বনা : প্রবীর সেন