নীলপুজোর হারামণি গান

চৈত্রমাসে নীলের গাজনের আগে এক পক্ষকাল ধরে বাংলায় যে নিজস্ব লোকসংস্কৃতির চর্চা হতো তার অন্যতম আঙ্গিক ‘অষ্টক’। একে ‘নীলপুজোর গান’ বলেই জানতেন লোকসমাজ। এ এক শেকড়-ছেঁড়া লোকসংস্কৃতি। পূর্ববঙ্গ থেকে নির্যাতিত হিন্দুসমাজ ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে বাঁচবার তাগিদে সমগ্র সংস্কৃতিটাকেই ছিঁড়ে এনে ধীরেধীরে বসিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। তাই অষ্টক এক ‘ছিন্নমূল লোকসংস্কৃতি’। কিছু অবশেষ ওপার বঙ্গে এখনও টিকে থাকলেও তা এপার বাংলার মানুষেরই সম্পদ। সমগ্র বাংলায় যেমন ‘গাজন’, মালদায় ‘গম্ভীরা’, মুর্শিদাবাদে ‘বোলান’; তেমনই নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণার ‘অষ্টক’ বাংলার শিব-সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত এক উজ্জ্বল লোকসংস্কৃতি। এই গানকে লোকনাট্য বলাই উচিত, কারণ গানে রয়েছে সুনির্দিষ্ট পালা, নাটকীয়তা, সংলাপ, নৃত্য এবং অভিনয়। ক্ষুদ্র হলেও প্রতিটি গানের অন্দরে সুনির্দিষ্ট পালা এবং গায়ন রীতি একে নাট্যধর্মী করে তুলেছে।

গাজন এবং গম্ভীরা-য় শিবের প্রসঙ্গ প্রত্যক্ষভাবে উপস্থাপিত হলেও বোলান এবং অষ্টক গানে শিবের উপস্থিতি সরাসরি নেই। তবে এই গান নীলপুজোয় গাওয়া হয় কেন? ভগবান শিব বা নীল এখানে লোকসংস্কৃতির প্রেক্ষাপট। যারা বলেন, ধর্মের সঙ্গে এর সরাসরি যোগাযোগ নেই, তারা সঠিক বলেন না। নীলপুজো ছাড়া এই গানের অস্তিত্ব ঠাওর করা সম্ভব নয়। গানের টেক্সট কখনও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক, কখনও পুরাণ কাহিনি, রামায়ণ মহাভারতের কথা, কখনও মনসামঙ্গলের কাহিনি, কখনও দেব-বন্দনা হলেও অন্তরে অন্দরে সর্বদা ‘শিব শিব’ প্রশান্তির ভাব। এটি শৈব-সংস্কৃতির সঙ্গে বৈষ্ণব, রামায়ত প্রভৃতির প্রতি সমন্বয়ের বার্তা বলে মনে হয়।

অষ্টক গান একান্ত ভাবেই হিন্দু-লোকসংস্কৃতি। গম্ভীরা গানের মতো শিব প্রতিস্থাপিত হয়ে এখানে মুসলমানি ‘নানা’ হয়ে যান নি। একমাত্র গাজনের সন্ন্যাসী বা ভক্তারাই চৈত্রমাস জুড়ে কঠোর সংযম করে, সারাদিন নিরম্বু উপবাস করে, ‘দেল’ বা ‘পাট’ নিয়ে ‘শোলোক’ গান গাইবার অধিকারী ছিলেন। যাদের কষ্টসাধ্য আচার পালন করা সম্ভব ছিল না, তাদের জন্যই রচিত হয়েছিল অষ্টক গান। অর্থাৎ অষ্টক গানের আদিরূপ হচ্ছে ‘শোলোক’। শৈব গানেরই একটি শাখা-সংস্কৃতি হচ্ছে অষ্টক। তাই এই গান কখনওই ধর্ম বিচ্যুত সংস্কৃতি নয়। লোকসংস্কৃতি গবেষক সুজিত বিশ্বাস (২০০৪)-এর মতে, তুর্কী আক্রমণের পরবর্তীকালে অষ্টক গানের আদিরূপ ও রীতিটি আনুমানিক ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লোকসমাজে আত্মপ্রকাশ করে। তখনই হয়তো হিন্দুদের মধ্যে থাকা নানান সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার লোকায়তিক প্রচেষ্টা শুরু করে। শিব-সংস্কৃতি ছাপিয়ে যায়।

হাবড়া নিবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক অষ্টক গান শোনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন বর্তমান লেখকের কাছে, “ছোটবেলায় আমাদের পাড়াতেই অষ্টকের দল ছিল। শিব-গৌরী, রাধা-কৃষ্ণ, দাতা কর্ণ, নৌকা বিলাস ইত্যাদি পৌরাণিক পালা নির্ভর গান বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাচ, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হত। একজন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করত, বাকিরা সমবেত কন্ঠে দোঁহার। সাথে বাজত সারিন্দা, বাঁশি এবং ঢোল । থাকত হ্যাজাগ লাইট। সন্ধ্যে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আমিও ঐ দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। বাড়ি ফিরলে জুটত ঠ্যাঙানি কিম্বা বকুনি। এখন আর ওরা কেউ বেঁচে নেই। প্রাত্যহিক জীবনে ওরা কেউ ছিলেন রাজমিস্ত্রি, কেউ মাঠের জনমজুর, কেউবা মাছ কিম্বা সব্জির দোকানদার। এখন আর দেখিনা সেই হারিয়ে যাওয়া লোকশিল্প অষ্টকের দল, গাজন-গীতি অথবা নীলের নাচ। আমাদের এই এলাকায় বছর কুড়ি আগেও গাজন ও নীলের নাচ দেখেছি। কিছু বয়স্ক বাসিন্দা ত্রিনাথের মেলার গান করতেন। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকত, থাকত গাঁজায় দম দেবার আয়োজন (আমিও দু’একবার টেনেছি)…এরাই চৈত্র মাসে গাজনে সন্ন্যাস নিত। শিব ঠাকুরের প্রতীক হিসাবে সিঁদুর মাখানো লাল শালুতে মোড়া কাঠের পাটা মাথায় করে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যেত। সঙ্গে থাকত ঢাক ও কাঁসর। বাড়িতে ঢুকে তুলসী তলায় জল ঢেলে দিত, সেই জলে ধোওয়া উঠোনে পাটা রাখত। তেল, সিঁদুর, বাতাসা, ধূপকাঠি জ্বেলে সন্ন্যাসীরা ঢাকের তালে কিছুক্ষণ নাচ করতো। চাল, দক্ষিণা নিয়ে অন্য বাড়ি চলে যেত। করোনার আগেও আমাদের বাড়ি এসেছিল ওরা। এখন সবই অতীত।”

অষ্টক গানের রচয়িতারা পূর্ব পাকিস্তানে দুর্বিষহ জীবন যাপন করার পরও তাদের গানে উঠে এসেছে পাকিস্তান বন্দনা। এটা কেন? দেশভাগ, হিন্দু নারী ধর্ষণ, নির্যাতন, মন্দির লুঠপাট, গণহত্যা সব কিছুই ভুলে যায় হিন্দু লোকসংস্কৃতির টেক্সট। এটা কি মুসলমান-ভীতি, নাকি সম্প্রীতির বার্তা? পূর্ব পাকিস্তানের ভিটেমাটিতে টিকে থাকার প্রাণপণ লড়াইয়ের চেষ্টা নির্যাতিত হিন্দুদের?

“ধন্য মোদের পাকিস্তান,
আমি গাইব তারই গান।
হিন্দু মুসলিম দুই ভাই বলি মিলে,
ত্যাজি মোরা অভিমান।।

মোদের মোহম্মদ জিন্না,
মোরা তারে ভুলি না
পাকিস্তানের জনক তিনি,
করি আমি বন্দনা।।

এ যে নদী ঘেরা দেশ,
মাঝি ভোলে হিংসা দ্বেষ।
কত নৌকা পাল তুলে যায়,
ভাসে জলে গানের রেশ।”

অষ্টকগানের শুরুতে বন্দনাংশে গায়ক সব মানুষকে বন্দনা করতে ভোলে না শান্তিতে আপন লোকসংস্কৃতি নিয়ে টিকে থাকার জন্য —
“আমি বন্দি করজোরে, সবার ভিতরে,
হিন্দু মুসলমান যত জনে।”

অষ্টক গানের মধ্যে শৈব ও বৈষ্ণব মতের সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের তাগিদে হয়তো প্রাচীন গানের টেক্সটে কৃষ্ণ ও অষ্টসখীর সংলাপ ও গান সন্নিবেশিত হয়েছিল। ‘অষ্টক’ কথাটা সেই অষ্টসখীর সঙ্গীত ও নৃত্য থেকেই হয়তো এসেছে। মূল চারিত্রিক উপস্থাপন কৃষ্ণ, রাধা এবং আট সখী। ‘অষ্ট-রস’-এর এ গান কিনা এবং তার জন্যই এমন নাম কিনা, এ বিষয়েও মতামত দিয়েছেন লোকসংস্কৃতিবিদেরা৷ নিত্যানন্দ বিশ্বাসের একটি গানের টেক্সটে পাওয়া যায়, “অষ্টরসে অষ্টক গান/রামায়ণে কে বা যায়।” তবে অষ্টক নামক লোকনাট্যে নানান সাঙ্গীতিক ধারার প্রভাব পড়েছে। যেমন সুরের প্রভাব রয়েছে কীর্তনের এবং ভাটিয়ালির।

অষ্টক গানের বিষয়বস্তুতে রামায়ণের কথাও থাকে। ‘তরণীসেন বধ’ পালায় ভাই লক্ষ্মণের সংজ্ঞাহীনতায় রাম দিশেহারা হয়ে বলেন, “কোথায় আছ হনুমান,/আমার প্রাণের লক্ষ্মণ হয় অচেতন,/বাঁচাও তাহার প্রাণ।/ভ্রাতৃঘাতী রে দুরমতি/ও তোর নাইরে পরিত্রাণ।।” ‘সীতা উদ্ধার’ পর্যায়ে রাবণের মৃত্যু ঘনিয়ে আসে, “রণস্থলে পড়ে রাবণ করে হায় হায়,/রামের সীতা হরণ করে পড়েছি আজ বিষম ফেরে।/বুঝি আজকার রণে হারাইলাম প্রাণ।” তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর, গোয়ালন্দ, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, যশোহর, নাড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ, খুলনা, ঢাকা, বরিশাল, মেহেদিগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নোয়াখালির হিন্দু বাঙালি তাদের প্রিয় রঘুবীরের কথাও অষ্টক গানে শুনতে চেয়েছে বলেই রামায়ণের কাহিনী উপস্থাপিত হয়েছে সেখানে। সেখানকার ভূমিপুত্রেরাই তাদের সাধের লোকায়তিক ধারা সঙ্গে করে চলে এসেছেন হিন্দুদের পক্ষে নিরাপদ বসবাসস্থল ভারতবর্ষে।

তথ্যসূত্র
সুজিত বিশ্বাস (২০০৪), অষ্টক, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৭-৮.

কল্যাণ গৌতম

ছবি – কমল ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.