মহাত্মা হরিদাস – হিন্দু সমাজের প্রেরণা স্রোত

শ্রীল শ্রী হরিদাস যে সময়ে ধরাধামে লীলা প্রকট করেছেন তার প্রায় দুই কি তিন শতাব্দী পূর্বে বাঙ্গলায় মুসলিম শাসন প্রবর্তিত হয়েছে। বহু মানুষকে জোর করে মুসলিম করা হয়েছে। যাঁরা কোনক্রমে সনাতন পরম্পরা বজায় রেখেছেন তাঁরাও নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে গোপনেই পালন করে থাকেন। তথাকথিত পণ্ডিতদের অধিকাংশই সেই সময়ে শাস্ত্র নিয়ে বিবাদ বিসম্বাদ আদি করতে ব্যস্ত থাকতেন। সমাজে শাস্ত্র ও শাস্ত্রোক্ত ধর্মের প্রচার করার উপায় ছিল না

এই সময়ে বঙ্গদেশে ধর্ম রক্ষার জন্য সপারিষদ শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব। তাঁরই এক বিশিষ্ট পার্ষদ শ্রী হরিদাস ঠাকুর। তিনি যবন কুলে জন্মেছিলেন বলেই মনে করা হয়। সেই কারণে তিনি যবন হরিদাস নামে সুপরিচিত। কিন্তু, তাঁর জন্ম কোথায়, কবে, কার ঘরে হয়েছিল সেই বিষয়ে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে কেউ কেউ মনে করেন যে, দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ লীলায় গোরু, বাছুর ও গোপদের লুকিয়ে রাখার অপরাধে ব্রহ্মাই সংস্কার ও ধর্ম রহিত যবন কুলে হরিদাস রূপে জন্মান এবং তাঁর গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলায় সহযোগ করা।

সম্ভবতঃ, অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলায় বূঢ়ন নামক গ্রামে আনুমানিক ১৩৭০ বা ১৩৭১ শকাব্দে তাঁর জন্ম। আজন্ম বৈরাগী শ্রী হরিদাস শ্রীচৈতন্যের থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ। নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মের সময়ে হরিদাস ঠাকুর শান্তিপুরে শ্রী অদ্বৈতাচার্যের গৃহে বসবাস করছিলেন। বাল্যে বা কৈশোরে কোন মহাত্মার নিকট তিনি মন্ত্র বা উপদেশ লাভ করেছিলেন সেই কথা জানা যায় না। কিন্তু, তিনি যৌবনের প্রাক্কালেই নিজের গ্রাম ও সমাজ ত্যাগ করে বর্তমান বনগ্রামের বেণাপোলে একটি নির্জন জঙ্গলে এসে একটি কুটীর নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। দিনান্তে নিকটবর্তী এক ব্রাহ্মণের গৃহে ভিক্ষা গ্রহণ করতেন এবং সারাদিন নাম জপে নিরত থাকতেন। প্রতিদিন ৩লক্ষ নাম জপ করা ছিল তাঁর ব্রত। এই ব্রত তিনি আমৃত্যু পালন করেছেন।

নির্জনবাসের জন্য বেণাপোলের জঙ্গলে এসে বসবাস শুরু করলেও সেই যবন কবলিত বাংলায় ভগবৎকথা শ্রবণে উৎসুক মানুষ তাঁকে খুঁজে বের করেছিল ঠিকই। যারাই তাঁর নিকট আসতেন তাদেরকেই তিনি ভগবানের নাম শ্রবণ করাতেন। হরিদাসের বিশেষ প্রচেষ্টায় সেই অঞ্চলের প্রতি গৃহে হরিনাম সংকীর্তন শুরু হল। কিন্তু, হিন্দু সমাজে রাবণ, কংসের মত পাষণ্ড চিরকালই বর্তমান। তেমনই এক পাষণ্ড রামচন্দ্র খান হরিদাসের এই খ্যাতি সহ্য করতে না পেরে তার চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করার জন্য এক বেশ্যাকে নিযুক্ত করলেন। সেই বেশ্যা হরিদাসের কুটীরে গিয়ে হরিদাসের সঙ্গে সঙ্গম কামনা করল। হরিদাস তাকে বললেন যে, তাঁর সঙ্কল্পিত নামজপের সংখ্যা পূরণ হলেই তিনি বেশ্যার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হবেন। বেশ্যা আশায় বুক বেঁধে সমস্ত রাত্রি হরিদাসের কুটীরে বসে থাকল। কিন্তু ভোর পর্যন্ত হরিদাস নাম জপে ব্যস্ত রইলেন। দ্বিতীয় রাত্রিও এমন কাটল। তৃতীয় রাত্রিতে হরিদাস সেই বেশ্যাকে বললেন যে, তিনি এক মাসে এক কোটি নাম জপ করার সঙ্কল্প নিয়েছেন। সেই সঙ্কল্প পূরণের আজই শেষ রাত্রি। বেশ্যা আরাত্রি হরিদাসের কুটীরে বসে হরিদাসকে দেখতে লাগল। নিরন্তর নাম জপ করে চলেছেন, দুই চোখ দিয়ে অবিরল প্রেমাশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। সমস্ত শরীর থেকে যেন দিব্য জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। রাত্রি শেষে বেশ্যার হৃদয় বিগলিত হয়ে গেল। পূর্বাকাশে অরুণের প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বেশ্যার হৃদয়ের মোহপাশ অপাবৃত হল। সে হরিদাসের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করাতে হরিদাস বললেন, “রামচন্দ্র খান ও তোমার ষড়যন্ত্র আমি আগেই জানতাম। রামচন্দ্র আমাকে একবার বললেই আমি এই স্থান ত্যাগ করতাম। কিন্তু, আমি এখানে ছিলাম কেবল তোমাকে উদ্ধার করার জন্য।” এর পরে হরিদাস বেণাপোল ত্যাগ করলেন। এদিকে সেই মহিলা পরম ভক্তিমতী বৈষ্ণব রূপে চতুর্দিকে প্রসিদ্ধি লাভ করলেন। তার জীবনের গতিপথ পাল্টে গেল

এদিকে ভগবানের নামগান করতে করতে হরিদাস পৌঁছলেন শান্তিপুরে। শান্তিপুরে অদ্বৈতশাস্ত্রের দিগ্বিজয়ী বিদ্বান এবং শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র পুরীর শিষ্য কৃষ্ণভক্তির মূর্ত বিগ্রহ শ্রী অদ্বৈত আচার্য দৈব আবেশে চৈতন্যদেবের লীলাসহচরদের একত্র করার ঐশ্বরিক কাজে নিরত ছিলেন। তিনি নামপ্রেমোন্মত্ত হরিদাসকে দেখে শান্তিপুরে গঙ্গার ধারে একটি কুটিয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। নির্জন সাধনকুটীরে হরিদাস জপযজ্ঞে ব্রতী হলেন। কিন্তু তিনি কেবল নির্জন কুটীরেই নাম জপ করতেন না। লোকালয়ে প্রবেশ করে মধুর কণ্ঠে শান্তিপুরের সমস্ত নরনারীকে মধুর হরিনাম শোনাতে লাগলেন। সকাল থেকে নগর কীর্তন করে তিনি মধ্যাহ্নে অদ্বৈত আচার্যের গৃহে ভোজন করে কিছুক্ষণ কৃষ্ণকথা আলোচনা করে নিজের কুটিয়াতে ফিরে যেতেন

এইভাবে কিছুদিন শান্তিপুরে কাটিয়ে তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন ফুলিয়াতে। শান্তিপুরের মত ফুলিয়াতেও তিনি সমস্ত লোকালয় কৃষ্ণনামে পরিপূর্ণ করে তুললেন। ফুলিয়াতে এক মহা অসহিষ্ণু মুসলমান কাজী বাস করত। প্রতিদিন ফুলিয়াবাসীর এই রকম উচ্চৈঃস্বরে কৃষ্ণনাম উচ্চারণে সে ক্রোধে আত্মহারা হয়ে এই সমস্ত কিছুর পাণ্ডা হরিদাসের বিরুদ্ধে মুলুকপতি নামে পরিচিত স্থানীয় মুসলমান শাসকের নিকট অভিযোগ জানালেন। কাজীর অভিযোগ ছিল গুরুতর। হরিদাস জন্মসূত্রে মুসলমান হয়েও মুশরিকের ধর্ম আচরণ করে। এতে অন্য মোমিনরাও কুমন্ত্রণা পাবে। কাজীর অভিযোগের ভিত্তিতে হরিদাসকে দণ্ড দেওয়া হল। পাইকরা তাকে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছিল। তিনি পথে যেতে যেতে হরিনাম করতে লাগলেন। কয়েকদিন বিনা বিচারে কারাগারে রাখার পরে তাকে দরবারে আনা হল। দরবারে অগণিত ‘ধর্মপ্রাণ’ মোমেন ও কাজীর উপস্থিতিতে হরিদাসকে কলমা পড়ে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করতে বলা হল। হরিদাস স্পষ্ট শব্দে বললেন, “আপনার রাজ্যে তো বহু হিন্দু সন্তান মুসলমান সম্প্রদায়ে মতান্তরিত হচ্ছে। তাতে যদি অপরাধ না থাকে, তবে, আমার কৃষ্ণ নাম জপে কী অপরাধ?” মূর্খ, বিপ্রলিপ্সু, প্রবঞ্চক পণ্ডিতম্মন্য বুদ্ধিজীবীকুল যে সম্প্রদায়কে ‘শান্তির সম্প্রদায়’ নামে প্রচারে সর্বদা নিরত, সেই সম্প্রদায়ের অনুসারী ‘অতি সহিষ্ণু’ ও ‘ধর্মপ্রাণ’ মোমেন জনতা ও কাজীকুল কৃষ্ণ নাম জপের অপরাধে হরিদাসকে দণ্ড দেওয়ার জন্য মুলুকপতিকে পীড়াপীড়ি করতে শুরু করলেন। তাদের মধ্যে গোরাই কাজী পরামর্শ দিল যে, পাইকরা কৃষ্ণনাম জপকারী এই নরাধমকে বাইশটি বাজারে নিয়ে গিয়ে নিদারুণ চাবুক প্রহার করুক। এতে এই নরাধমের সঙ্গে সঙ্গে অন্য মুশরিকদেরও যথেষ্ট শিক্ষা হবে।

বিচার অনুসারে হরিদাসকে বাইশটি বাজারে ভ্রমণ করিয়ে চাবুক পেটা করা শুরু হল। হরিদাসের তপঃক্লিষ্ট ক্ষীণ দেহ রক্তস্রোতে ভেসে গেল। কিন্তু তাঁর মুখ থেকে মৃদু হাস্য এবং হরিনাম মুহূর্তের জন্যও অপসৃত হল না। সেই ‘ধর্মপ্রাণ মোমেন’ পাইকদের হৃদয়ে ক্রোধের আগুন জোরদার হল। হরিদাসকে তারা আরও প্রবল প্রহার শুরু করল। এদিকে বাইশটি বাজারে ঘুরিয়ে এত বেদম প্রহারের পরেও হরিদাসের প্রাণ যায় না দেখে পরিশ্রান্ত পাইকরা বলল, ‘এত প্রহারেও যখন তুমি মরছ না, তখন তুমি বোধহয় মরবে না। কিন্তু তাতে আমাদের সর্বনাশ হবে।’ এই কথা শুনে হরিদাস মৃদু হেসে বললেন, ‘তবে আমি মরে গেলাম’। এই বলে তিনি সমাধিতে নিস্পন্দ হলেন। সেই নিস্পন্দ শরীর দেখে পাইকরা তাঁকে মৃত মনে করে কাজীর দরবারে নিয়ে গেল। কাজী বলল যে, তাঁকে মাটিতে কবর দিলে তাঁর সদ্গতির সম্ভাবনা আছে। সুতরাং এর শরীর জলে ভাসিয়ে দাও। সমাধিস্থ হরিদাসকে পূতসলিলা জাহ্নবীর স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হল। ভাসতে ভাসতে কিছু দূর গিয়ে তাঁর সমাধি ভগ্ন হলে তিনি তীরে উঠে এলেন। এদিকে মুলুকপতির কাছে খবর গেল যে, মৃত হরিদাস পুনরায় বেঁচে উঠেছে। মুলুকপতি এই অলৌকিক ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হরিদাসের পায়ে পড়ে ক্ষমা চেয়ে নিল। আদেশ জারি হল যে, হরিদাস ফুলিয়াতে স্বেচ্ছানুসারে বাস করবেন এবং হরিনাম করবেন।

ফুলিয়ার হিন্দুরা তাঁর নিকট এসে তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “নিজের কানে বহুধা কৃষ্ণনিন্দা শ্রবণ করার পাপেই আমাকে এই দণ্ড ভোগ করতে হল।” তিনি পুনরায় ফুলিয়াকে কৃষ্ণনামে মাতিয়ে তুললেন। এই সময়ে তিনি মাঝে মাঝে শান্তিপুর এবং সময়ে সময়ে নবদ্বীপেও যেতেন এবং হরিনাম প্রচার করতেন।

ইতিমধ্যে শ্রীচৈতন্যদেব আবির্ভূত হয়েছেন। কিছুদিন পরে হরিদাস সপ্তগ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করলেন। সপ্তগ্রামে হিরণ্য ও গোবর্ধন নামক দুই ভাই ছিলেন জমিদার। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। তাঁদের পুরোহিত বলরাম আচার্যের গৃহে হরিদাস ভিক্ষা গ্রহণ করতেন এবং হরিকথা আলোচনা করতেন। গোবর্ধন মজুমদারের একটি অল্পবয়সী পুত্র ছিল। সে বলরাম আচার্যের গৃহে হরিদাস ঠাকুরের সান্নিধ্যে হরিকথা শ্রবণ করে ধীরে ধীরে হরিপ্রেমে মাতোয়ারা হল। এই পুত্রই শ্রীচৈতন্যের ভাব প্রচার কারী ষড়্ গোস্বামীর অন্যতম দাস রঘুনাথ। একদিন হিরণ্য ও গোবর্ধনের সভায় হরিদাসকে নিয়ে গেলেন বলরাম আচার্য। হরিদাস প্রতিদিন তিন লক্ষ হরিনাম জপ করেন শুনে সভায় হরিনাম বিষয়ক আলোচনা প্রবৃত্ত হল। কেউ বললেন, হরিনামে পাপক্ষয় হয়। কেউ বললেন, হরিনামে মোক্ষলাভ হয়। কিন্তু, হরিদাস বললেন, হরিনামে হরিপদে প্রেমানুরাগ লাভ হয়। এর পরে সভায় যে শাস্ত্রচর্চা হল তাতে সকলেই হরিদাসের অগাধ শাস্ত্রজ্ঞানে বিস্মিত হলেন। কিন্তু, হরিদাস কখনও শাস্ত্রাধ্যয়ন করেছিলেন বলে জানা যায় না

এর পরে কিছুদিন তিনি কুলীনগ্রামে বসবাস করেছিলেন বলে জানা যায়। সেখানে এখনও হরিদাস ঠাকুরের পাট ও আখড়া গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের তীর্থ রূপে পরিচিত। ইতিমধ্যে গয়া থেকে প্রত্যাগত নিমাই পণ্ডিতকে ঘিরে নবদ্বীপে নাম আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে। হরিদাস উপস্থিত হলেন সেখানে। সেই সময়ে তাঁর বয়স প্রায় ষাট বৎসর। কিন্তু আজানুলম্বিত বাহু, ঋজু শরীরের শোভায় তাঁর বয়স ধরা যায় না। হরিদাসকে দেখা মাত্রই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁকে আলিঙ্গন করে তাঁর শরীরে চন্দন লেপন করে দিলেন এবং নিজের গলার মালা খুলে হরিদাসের কণ্ঠে পরিয়ে দিলেন।

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য পুরীতে গমন করলে কিছুদিন পরে হরিদাস এক ভক্তদলের সঙ্গে পুরীতে উপস্থিত হলেন। কিন্তু, তিনি পুরীধামে প্রবেশ করলেন না। কারণ জিজ্ঞাসা করলে জানালেন যে, তিনি যবন কুলে উৎপন্ন বলে তিনি নিজেকে পুরীতে প্রবেশের অনুপযুক্ত মনে করছেন। যদি কোন নির্জন স্থানে কোন ছোট কুটীরের ব্যবস্থা হয় তবে তিনি বসবাস করবেন। পুরীতে কাশী মিশ্রের গৃহের নিকট ফুলের বাগানে একটি ছোট ঘর মহাপ্রভু হরিদাসের জন্য চেয়ে নিলেন। হরিদাস সেখানে বসবাস করে প্রতিনিয়ত নাম জপ ও নাম প্রচারে রত হলেন। এর পরে সম্ভবতঃ তিনি আজীবন পুরীধামেই কাটিয়েছেন। ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে তিনি মর শরীর ত্যাগ করেন।

মহাত্মা যবন হরিদাস শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য লীলার এক বিশিষ্ট অধ্যায়। তিনি মুসলমান ঘরে জন্মেও হিন্দু সংস্কৃতি অনুসরণ করে সমগ্র হিন্দু সমাজে পূজিত হয়েছেন। অদ্বৈত আচার্যের ন্যায় পণ্ডিত প্রবর তাঁকে ‘উচ্চকুলোদ্ভব মহাজ্ঞানী’ ব্রাহ্মণের উপযুক্ত ‘শ্রাদ্ধপাত্র’ দান করেছেন। পবিত্র জীবন এবং শাস্ত্রোক্ত সৎ কর্মই যে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে উন্নীত করে সেটি প্রভু অদ্বৈত আচার্য ভক্ত হরিদাসের জীবনকে আশ্রয় করে দেখিয়েছেন। তাঁর জীবনে প্রমাণিত যে, সাধনার মাধ্যমেই শাস্ত্র প্রতিপাদিত সমস্ত সার তত্ত্ব উপলব্ধি করা যায়। এর দ্বারা তিনি এটিও দেখিয়েছেন যে, হিন্দু শাস্ত্র ঋষিদের তপোলব্ধ সত্য ব্যতীত কিছুই নয়। পরবর্তীতে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেও আমরা এই সত্য উপলব্ধি করি।

জন্মসূত্রে মুসলমান হয়ে তিনি হরিনাম উচ্চারণের জন্য শাস্তি স্বীকার করে হিন্দু সংস্কৃতির মহিমা এবং যবন বিকৃতির অসহিষ্ণুতার বিষয়ে সমাজের চোখ খুলে দিয়েছেন। অন্যদিকে রামচন্দ্র খানের মত হিন্দু নাম ধারী পাষণ্ডদের চরিত্রও তিনি লোকসমক্ষে তুলে ধরেছেন। পতিতার চরিত্র নির্মল করে তাকে পবিত্র জীবনের পথের পথিক করেছেন। শ্রী হরিদাস ঠাকুর হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিতে একজন চিরস্মরণীয় সাধক। অবতার পুরুষ শ্রীচৈতন্যদেবের ব্যাপক সমাজ আন্দোলনে হরিদাস ঠাকুর ছিলেন অগ্রগণ্য সেনাপতি। হিন্দু সমাজের ব্যাধিস্বরূপ অস্পৃশ্যতা, নানাবিধ বৈষম্য, ক্রিয়াহীন সদাচারহীন ভক্তিহীন শাস্ত্রচর্চা, ভণ্ডামি প্রভৃতির বিরুদ্ধে তাঁর বীরত্বব্যঞ্জক সংগ্রাম আমাদের নিকট প্রেরণার স্রোত। অন্যদিকে অবিরাম নাম জপ, সকলের মধ্যে হরিনাম ও নিজ সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ জাগানো, হরিনামের জন্য দণ্ড ভোগের মাধ্যমে সমাজে সংগ্রামী মানসিকতা জাগানোর ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অপরিসীম। কৃষ্ণনিন্দা শ্রবণই তাঁর দণ্ডভোগের কারণ এই কথা বলে তিনি সমাজের নপুংসকতাকে কশাঘাত করেছেন। নিজ আরাধ্য ও সংস্কৃতির নিন্দা শ্রবণ করে নীরব থাকাই সমাজের অধঃপাতের কারণ বলে তিনি স্পষ্ট দিশানির্দেশ করেছেন।

শ্রীচৈতন্য বলতেন যে, তিনি হরিদাসকে স্পর্শ করে নিজেকে পবিত্র করেন। এহেন মহাপুরুষ সম্পর্কে আর কী বলা চলে। তাঁর সম্বন্ধে শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন করেছেন শ্রী সনাতন গোস্বামী। তিনি বলেছেন, “কেউ আচার করে, কেউ বা প্রচার করে। আপনি আচার ও প্রচার দুইই করেন।” অর্থাৎ, তিনি একই সঙ্গে প্রতিদিন ৩ লক্ষ নাম জপ এবং সকলের মধ্যে নামের প্রচার এই দুই কাজের মাধ্যমে ধর্মকে সুচারুরূপে ধারণ করেছিলেন। আজ ১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ভাদ্র শুক্লা চতুর্দশীতে তাঁর প্রয়াণ তিথিতে আমরা তাঁর জীবন থেকে প্রেরণা নিয়ে ধর্মের পালনে ব্রতী হতে পারি এই প্রার্থনা প্রভু শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণে। শ্রীহরিদাস ঠাকুরের চরণে বিনম্র প্রণতি–

নমামি হরিদাসং তং চৈতন্যং তং চ তৎপ্রভুম্

সংস্থিতাম্ অপি যন্মূর্তিং স্বাঙ্কে কৃত্বা ননর্ত যঃ

লেখক – রাকেশ দাশ (Rakesh Das)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.