প্রথম পর্ব
যা শ্ৰীঃ স্বয়ং সুকৃতিনাং ভবনেষ্বলক্ষ্মীঃ
পাপাত্মনাং কৃতধিয়াং হৃদয়েসু বুদ্ধিঃ।।
শ্রদ্ধা সতাং কুলজনপ্রভবস্য লজ্জাতাং ত্বাং নতাঃ স্ম পরিপালয় দেবি! বিশ্বম্।।
যে দেবী পুণ্যবান্ ব্যক্তিগণের গৃহে লক্ষ্মী স্বরূপিণী এবং পাপীগণের গৃহের অলক্ষ্মী রূপিণী , যাঁদের মন নির্মল সেই ব্যক্তিদের বুদ্ধি , বিদ্যা স্বরূপিণী , যাঁরা সৎ তাঁদের হৃদয়ে দৃঢ় বিশ্বাস স্বরূপিণী , যাঁরা ভালো তাঁদের অন্তরে লজ্জা স্বরূপিণী , সেই তোমাকে নমস্কার করি । হে মহাদেবী তুমি বিশ্ব পরিপালন করো।
প্রকৃতিত্বঞ্চ সৰ্বস্ত গুণত্রয়বিভাবিনী।
কালরাত্ৰিৰ্মহারাত্রিৰ্ম্মোহরাত্রিশ্চ দারুণ ।
ত্বং শ্রীস্ত্বমীশ্বরী ত্বং হ্রীস্ত্বং বুদ্ধির্ব্বোধলক্ষণা ॥
লজ্জা পুষ্টিস্তথা তুষ্টিং শান্তিঃ ক্ষান্তিরেব চ।
তুমি গুণত্রয়স্বরূপিণী, অতএব সকল পদার্থের কারণরূপা।তুমি প্রলয়রাত্রিস্বরূপা এবং মরণরাত্রি ও মােহরাত্রিরূপা,তুমি ভয়ঙ্করী। তুমি লক্ষ্মী, তুমি ঈশ্বরী, তুমি লজ্জারূপা, তুমি বােধলক্ষণ।তুমিই লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, ক্ষমা এবং শান্তি।
তিনি কখনো উমা , কখনো গৌরী, পার্বতী হয়ে শিবানী, তিনি বিনম্রা মাতৃস্বরূপা। তিনিই মহামায়া, স্বাহা , স্বধা , তিনিই যুদ্ধংদেহী অশুভনাশিনী কৌশিকী, কালিকা, চন্ডিকা, বারাহী। তিনিই মহাবিদ্যা , মহামেধা , মহালক্ষ্মী। তিনি কখনো দ্বিভুজা , অষ্টভুজা , দশভুজা, অষ্টাদশভূজা, বিংশভূজা রূপে পূজিতা। তিনিই এক এবং তিনিই অদ্বিতীয়া।
যিনি ব্রহ্ম, তিনি আদ্যাশক্তি। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন তাকে ব্রহ্ম বলি। পুরুষ বলি। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় এসব করেন তাকে শক্তি বলি। প্রকৃতি বলি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যিনি পুরুষ তিনি প্রকৃতি। আনন্দময় আর আনন্দময়ী। পিতা আর জননী। যিনি জগৎরূপে আছেন- সর্বব্যাপী হয়ে তিনি মা।
তিনি তাই কোথাও নদী রূপে, কোথাও বৃক্ষরূপে, কোথাও দূর্বা রূপে, কোথাও ভুমিরূপে ,কোথাও অগ্নিরূপে, কোথাও শিলারূপে পূজিতা।
সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা …
দেবী কখনো শুভ্র বর্ণা , কখনো স্বর্ণ বর্ণা, কখনো অতসীপুষ্প বর্ণা, কখনো নীল বর্ণা , কখনো তিনি শ্যামা , ক্ষেত্র বিশেষে তিনি রক্ত বর্ণা।
খড়িগনী শূলিনী ঘােরা গদিনী চক্রিণী তথা।
শঙ্খিনী চাপিনী বাণ-ভুশুণ্ডীপরিঘায়ুধা
:সৌম্য সােমতরাশেষসৌম্যেভ্যস্থতিসুন্দরী।
পরাপরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী।।
তুমি খড়গ, শূল, গদা, চক্র, শঙ্খ, ধনু, বাণ, ভুলুণ্ডী এবং পরীঘ অস্ত্রধারিণী। তুমি সুন্দরী, সুন্দরীতরা এবং নিখিল সুন্দর বস্তু হইতে সুন্দরী, ব্ৰহ্মা, ইন্দ্র প্রভৃতির কর্ত্রী তুমিই “”পরমেশ্বরী”” ।
স্ত্ত্ব , রজঃ এবং তমঃ – এই তিনটি গুণের তারতম্য অনুসারে মানুষের স্বভাবের পার্থক্য হয়ে থাকে। স্ত্ত্বগুণের প্রাধান্য যাঁর মধ্যে থাকে তিনি শান্ত হন। তাঁর চিত্ত থাকে স্থির আর ভক্তি, প্রীতি, শ্রদ্ধায় অন্তর থাকে অবিচল। রজোগুণ যাঁর মধ্যে প্রবল, তিনি হন কর্মঠ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী , প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাভূত করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার দুনির্বার আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়াস । তৃতীয় গুণ তমোগুণ – ষড়রিপুর যা যা দোষ সব লক্ষণ তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে।
হেতুঃ সমস্তজগতাং ত্রিগুণাপি দোষৈ-
র্ন জ্ঞায়সে হরিহরাদিভিরপ্যপারা।
সর্ব্বাশ্রয়াখিলমিদং জগদংশভূত-
মব্যাকৃতা হি পরমা প্রকৃতিসত্ব মাদ্যা।।
দেবী ভগবতী হতে সমগ্র বিশ্বের জন্ম । স্ত্ত্ব , রজঃ এবং তমঃ এই তিনটি গুণও দেবী হতে পৃথক নয়। এই ত্রিগুণের দ্বারাই সৃষ্টি – স্থিতি – প্রলয় সম্পন্ন হয়, জগতের সকল ভাঙা গড়ার খেলা চলে। এদের পরিমাণের কমবেশিতে ভালোমন্দ বস্তু সকল হয়। জীবের মনে অনুরাগ, বিদ্বেষ ইত্যাদি হয় । কিন্তু সেই ত্রিগুণময়ী হয়েও মহামায়া ভগবতীর এই গুণগুলি র যে কাজ বা প্রভাব সে সকলের অধীন নহে। দেব, দৈত্য, দানব , মানব কেউই তাঁকে সঠিক রূপে জেনে উঠতে পারেন নি।কাজেই বলা যায় , ত্রিগুণের দ্বারা তিনি বিশ্বে ভাঙাগড়ার কর্ম সম্পাদন করছেন ,কিন্তু নিজে তার মধ্যে জড়িয়ে পড়ছেন না। অর্থাৎ , গুণগুলি তাঁর বশ। দেবী ব্রহ্মময়ী , সর্বব্যপী , তিনি এক ও অদ্বিতীয়া। তাঁর এক এক রূপ যে এক এক সময় দেখা যায় শুভ ও ন্যায় কার্য সাধনের জন্য তাঁর অলৌকিক মায়া মাত্র। তিনিই পরমা প্রকৃতি।
” কৌমারী রূপ সংস্থানে নারায়ণী নমস্তুতে”।
মহামায়ার অনেক স্বরূপ। যদিও পুরাণকাররা চণ্ডীকে শিবের ঘরণী বানিয়ে দিয়েছেন; বাস্তবে শিবের সাথে দুর্গার প্রায় কোন সম্পর্ক নেই। চণ্ডীতে তিনি ‘নারায়ণী’, ‘বিষ্ণুমায়া’ , বিষ্ণুশক্তি। তিনিই দেবরাজ ইন্দ্র- ” বৃত্রপ্রাণ হরে চ ঐন্দ্রি”। তিনি অগ্নিরূপিনী, সূর্যস্বরূপা। তিনি দশপ্রহরণধারিনী, দশভূজা। বলাবাহুল্য দুর্গার দশভুজ দশটি দিকের প্রতীক। তিনি উমা। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় বা দ্রাবিড় ভাষায় উমা শব্দের অর্থ মাতা। দুর্গা বা চন্ডী স্বরূপে পরমাত্মা সূর্যেরই নাম , যিনি পর্বতবাসিনী(পর্বত শব্দের অর্থ মেঘ এবং অবশ্যই চণ্ডীতে তাঁকে পর্বতকন্যা বলা হয়নি) , যিনি মহাবৃষভবাহিনী( এটিও সূর্যের স্বরূপ) ।
ততোহখিলং লোকমাত্মদেহ সমুদ্ভবৈঃ
ভবিষ্যামি সুরাঃ শাকৈরা বৃষ্টৈ প্রাণ ধারকৈ।
শাকম্ভরী বিখ্যাতং তদা যাস্যমহং ভূষি।।
ভারতবর্ষে বৃক্ষলতা উর্বরতা বর্ধনে সহায়ক এবং তা কেবল শস্যাদি , খাদ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। অক্সিজেন, ওষধি , জ্বালানী , বাসগৃহ, বস্ত্র, বিদ্যা লাভের জন্য উপযোগী বস্তু সমূহ, সকল কিছু একটি বৃক্ষ প্রদান করতে পারে। তাই ধনজনসন্তান কামনা, রোগশোকপাপ দূরীকরণ ইত্যাদি পার্থিব ও পার্থিব আকাঙ্খা পূরণের জন্যও বটে। তাই নিরাকার পরম ব্রহ্ম রূপে বৃক্ষকে সেই প্রাচীন কাল হতে পূজা করে আসছে সনাতনী মানব। তাই দারুব্রহ্ম রূপে জগন্নাথ পুরীতে অবস্থান করেন । তাই ব্রহ্ম স্বরূপ নিরাকার প্রকৃতি মহামায়া মা দুর্গা বোধন হয় নবপত্রিকায়। ওই নবপত্রিকা এবং ঘটই পূজা মুখ্য বিষয়। আজও তাই বহু স্থানে নবপত্রিকার সম্মুখে ঘটেপটে পূজা হয়। নবপত্রিকার নয়টি বৃক্ষ হল কদলী, কচ্চি, হরিদ্রা , জয়ন্তী, শ্রীফল, দাড়িম্ব, অশোক, মান্য ও ধান্য। পূজা মন্ত্রগুলোতে দেখা যায় একটি বৃক্ষ বা পত্রিকাকে দেবতা বা তাঁর প্রতীক বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুসারে যথোচিত প্রার্থনা জানানো হয়েছে।
ঠিক একই ভাবে লক্ষ্মী পূজায়ও মহাদেবীকে শ্ৰী হিসাবে এবং ভূমাতা হিসাবে, ধনদায়ীনি হিসাবে পূজার সময় ধান, আখ, সরিষা, নানা প্রকার শাক , কলার ভেলা ইত্যাদি পূজার উপকরণ হিসাবে প্রদান করা হয়। সনাতনী সমাজে মহাবিষ্ণু সংক্রান্তিতে #ফলদান_সংক্রান্তি ব্রত পালন করা হয়। উক্ত দিনে সবস্ত্র , সপাত্র নারিকেল ফল বিষ্ণুকে দান করলে নিখিল পাতক দূর হয়। পুরোহিত দর্পন, ক্রিয়াকান্ড বারিধি ইত্যাদি নানা গ্রন্থে সে কথা উল্লেখ আছে। এই রূপে একেকটি মাসের সংক্রান্তির দিন বিশেষ বিশেষ ফল দান করলে মোক্ষলাভ হয়। সুতরাং, জনধনউৎপাদন , পাপ দূরীকরণ , মোক্ষ প্রাপ্তি প্রভৃতি জাতীয় কামনা বাসনা বৃক্ষ উপাসনার নেপথ্যলোকে বিরাজিত থাকে। এই সকল কারনে বৃক্ষরোপণ সনাতনী প্রথায় একটি পবিত্র কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়।
সোনার থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ ওঠেন পুবের আকাশে। মাঠে মাঠে শালি ধান মুঠো মুঠো হয়ে হাঁসি ছড়ায়। ধান বিশেষ করে #শালি ধান এবং ইক্ষু সম্পর্কে কবির কল্পনা নানাভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছে। শ্রীধর দাসের সদুক্তিকর্ণামৃত নামক সংকলন গ্রন্থে বিভিন্ন বাঙালি কবির জলবায়ু প্রসঙ্গে দুজন বাঙালি কবি রচিত দুটি শ্লোকে বর্ষায় ধানক্ষেত, হেমন্তের শালি ধানের স্তুপ, আখ মাড়াই কল ইত্যাদি নিয়ে যে কবির কল্পনা বিস্তারিত হয়েছে তা অনবদ্য। এঁদের একজন হলেন কবি জয়দেবের শ্যালক যোগেশ্বর ,অন্য জন অজ্ঞাত নামা। সেই অজ্ঞাত নামা কবির মধুর বাস্তব চিত্রের কবিতাটি উল্লেখ করলাম।
শালিচ্ছেদ- সমৃদ্ধ হালিকাগৃহাঃ সংসৃষ্ট নীলোৎপল-স্নিগ্ধ শ্যাম যব প্ররোহ নিবিড়ব্যাদীর্ঘ সীমোদেরাঃ।মোদন্তে পরিবৃত্ত ধেন্বনডুহচ্চাগহাঃ পলালৈরনবৈঃসনসক্ত ধ্বনদিক্ষুযন্ত্রমুখরা গ্রাম্য গুড়ামোদিনঃ।।
কোজাগরি লক্ষ্মীপূজা , কোজাগরী শব্দটি এসেছে ‘কো জাগর্তি’ থেকে, যার অর্থ ‘কে জেগে আছো?’।
সনাতনী বিশ্বাস মতে,এ রাতে মা লক্ষ্মী ধন-সম্পদ দিতে যে কোনো সময় ঘরের দ্বারে এসে ‘কো জাগর্তি’ বলে ডাক দেন। জেগে থাকা মানুষেরাই এ ধন লাভের অধিকারী হয় বলে ব্রতকারীরা এজন্য সারা রাত জেগে থাকেন মায়ের ডাকের প্রতীক্ষায়। যে জেগে অক্ষক্রীড়া করে , লক্ষ্মী তাঁকে ধন সম্পদ দান করেন।
নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী ।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ ।।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন-
যা নিশা সর্বভূতানাং সা নিশা জাগরতি সংযমী ।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশাতো মুনেঃ ।।
অর্থাৎ সর্ব ভূতের যা রাত্রি, সংযমীর পক্ষে তা দিন। তাঁদের যা দিন, তাঁর তা রাত্রি। সকল প্রানী পরমার্থ বিষয়ে নিদ্রিত কিন্তু বিষয়ভোগে জাগ্রত। কিন্তু সংযমী সাধু যোগী পরমার্থ বিষয়ে জাগ্রত, বিষয়ভোগে নিদ্রিত। দেখা যায় দিবাকালে অন্য প্রাণীরা যখন জাগ্রত পেচক তখন নিদ্রিত। পেচক নিশাচর। নিশীথের নিস্তব্ধ পরিবেশ সাধুদের সাধনার অনুকূল। তাই পেচক আমেদের পরমার্থ চিন্তার আদর্শ সেখায়, যার মাধ্যমে আমরা দেবীর কৃপা পেতে পারি।
…প্রদীপ জ্বালিয়ে মহালক্ষ্মীর অপেক্ষায় রাতভর জাগরণ। যে ঘুমিয়ে যাবে এই রাত্রে , তার ভাগ্যও ঘুমিয়ে যাবে। প্রহর জাগো রে …. মহামায়া মহাদেবী সম্পদ , সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি রূপে মহালক্ষ্মী শ্ৰী হয়ে আসবেন। গৃহে আলোকের সঙ্গে থাকবে শান্তি – সেখানেই পড়বে দেবীর পদচিহ্ন। ঘরদুয়ার উঠবে হেঁসে। দেবী লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আর লতাপাতার আল্পনা পাবে প্রাণ। ছায়া ঘেরা বৃক্ষরাজির মধ্যে দিয়ে নিকানো উঠানে জোৎস্না চন্দন ঝরে পড়বে।
প্রদোষকালে ঘটে পটে প্রতিমায় শুরু লক্ষ্মী পূজন। কোথাও বা লক্ষ্মী রূপে কলাবউ পূজা হয়। আটনের নীচে কলার পেটো দিয়ে বানানো ময়ূরপঙ্খী নাও। পাশে সাতটি বাকারি গোলা ।তাতে বাঙ্গালী তথা ভারত থেকে প্রায় লুপ্ত নানা শস্য – যেমন কালো মুগ, শালি ধান, আখের টুকরো, কালো তিল , সর্ষে , গোটা শুকনো হলুদ ইত্যাদি রাখা হয় । থাকে ফলমূল এবং সোনারূপা ,তামা। এছাড়াও লাগে গোটা পাট, গোটা হিংচে , কলমী, মটর , গোটা হলুদ গাছ। পূর্বে বাঙ্গালীর জানতেন বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। উক্ত শস্যাদি বা ফসল বাণিজ্যে মূল উপাদান ছিল।
পূর্বেই যে শ্লোক উচ্চারণ করলাম, সেখানে অক্ষ শব্দটি আছে। অক্ষ’ শব্দটির অনেক রকম মানে হয়। অক্ষ শব্দটির দ্বিতীয় অর্থ – ক্রয় বিক্রয় চিন্তা। যারা বৈশ্য তাঁরা এইদিন দেবীর আরাধনা করে ব্যবসা বাণিজ্যের চিন্তন করেন। দেবীর কৃপা পেলেই ত ব্যবসায় সফলতা আসবে। ‘অক্ষ’ শব্দটির আরেক ভাবে রুদ্রাক্ষ, জপমালা কেউ বোঝায়। যারা ভক্ত মানুষ – তাঁরা এই রাত্রে দেবীর কৃপা পাবার আশায় তাঁর নাম জপ করেন। ধন সম্পদ বলতে শুধু কি অর্থ, সোনা দানা ? ঈশ্বরের পাদপদ্ম পরম ধন।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যে এবার এসব তথ্য নিমিত্ত সমর্থন খোঁজা যাক । মূলত মঙ্গলকাব্য গুলিতে বাণিজ্যের প্রসঙ্গ বেশি পেয়েছি। চাঁদ সদাগর , ধনপতি , শ্রীমন্ত প্রভৃতি চরিত্রের মাধ্যমে আমরা প্রতি তৎকালীন ব্যবসার কথা জানতে পারি। কবির কাব্যে সে সব কিছু ছুঁয়ে যায় বাস্তবের মাটি। প্রথমেই উল্লেখ করি ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে দ্বিজমাধব রচিত #মঙ্গলচন্ডীর_গীত এ শ্রীমন্তের বাণিজ্য যাত্রার কথা জানতে পারি। কবি রপ্তানি দ্রব্যের নাম উল্লেখ করেছেন ।সেখানে কাপড় বা বস্ত্র আর পাট কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
সোনা রূপা লোহা সীসা রাঙ্গা কাপড়
তামা পিতল তোলে চামড় গঙ্গার জল।
দ্বিজ মাধব বাণিজ্যের কথা বলতে গিয়ে আরো বললেন :
লোহা সীসা লঅ সাধু যথ বাস মন।
এহার বদলে পাইবা নির্মল কাঞ্চন।।
গুয়াফল লঅরে সাধু কি কহিমু আর।
এহার বদলে পাইবা গজমতির হার।।
ঘৃণা তেজি লঅ সাধু পাটের পাছরা।
এহার বদলে পাইবা মুকুতার ছরা।।
অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রীমন্ত সওদাগর সোনা,রূপো, তামা, পিতল প্রভৃতি ধাতুর সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভাবে রাঙা কাপড় কেও বাণিজ্যের দ্রব্য হিসেবে রাখছেন ।অপরদিকে আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পাটের পাছড়ার বদলে বণিক লাভ করছে মুক্তার ছড়া।
কবিকঙ্কন মুকুন্দ রচিত চন্ডীমঙ্গল কাব্যে ধনপতির উপাখ্যানে আমরা পাই এক দারুণ বাণিজ্যের চিত্র। সেখানে আমরা সুতো , পাট ইত্যাদির গুরুত্ব যে কত সে কথা জানতে পারি।
কুরঙ্গ বদলে মাতঙ্গ পাব নারিকেল বদলে সঙ্গ।
বিড়ঙ্গ বদলে লবঙ্গ পাব সুঁঠের বদলে টঙ্ক।।
আবার দেখতে পাচ্ছি , ধনপতি বলছেন যে,
চিনির বদলে কর্পূর পাইব আলতার বদলে নাটী।
সকলাত কম্বল পামরি পাব বদল করিয়া পাটি।
এস্থলে সুঁঠ বলতে সুতো বা সুতির বস্ত্র এবং পাটি বলতে পাট কে বোঝানো হয়েছে এবং সেই সুতি বিক্রি করে তিনি অনেক টাকা পাবেন এই কথা বলছেন । আবার পাট বিক্রি করে তিনি দামি কম্বল পাবেন সেই কথা কবি উল্লেখ করেছেন।
কাব্য গত এই সমস্ত বাণিজ্যিক দ্রব্যের উল্লেখ থেকে যে বাস্তব চিত্রটি ফুটে ওঠে তা হল কারিগরি ,ফল , ধাতুদ্রব্য, রোগের ঔষধ, সোরা ইত্যাদির দিক থেকে বাংলা কিছুটা হলেও অন্য প্রদেশের উপর নির্ভর করলেও, ভালো সুতিবস্ত্র, মসলিন,খাদ্যশস্য ইত্যাদির জন্য বাংলা ছিল পুরোপুরি স্বনির্ভর। ধান, ইক্ষু, ইক্ষু জাত চিনি, গুড় , লবণ , রবি শস্য,পাট ও পাটজাত দ্রব্য , সর্বোপরি বস্ত্র রপ্তানিতে বঙ্গ ভারতে সেই সময় সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্ছ্বসিত প্রশংসিত ছিল।
মা লক্ষ্মীর পাশে থাকে চূড়ো করা নৈবেদ্য। চিঁড়ে, মুড়ি, খই, তিল আর নারকোল দিয়ে পাকানো সুবাসিত নাড়ু। আধাপাকা নোয়ানো ধানের শীষ গুচ্ছ। পিদিমের নরম আলো। সেখানে কাঁসর ঝাঁজ, ঢাক, ঢোল , মৃদঙ্গ ,করতালের আরতি নয়। শঙ্খ বাজিয়ে হয় পূজা।
দেবী লক্ষ্মী কে চঞ্চলা বলা হয়। কারণ লক্ষ্মী দেবী নাকি এক জায়গায় থাকেন না। ধন হস্তান্তর হয়। কুপাত্রের হাতে বিপুল ধন আসলে সে ধনের অসৎ প্রয়োগ করে লক্ষ্মী কে হারায়। রাবণ লক্ষ্মী সীতা দেবীকে অসৎ উপায়ে ভোগ করতে চেয়েছিলেন, এই কারনে গোটা লঙ্কা ধ্বংস হয়েছিল। রাবন নিহত হয়েছিলেন। এই থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করি লক্ষ্মীর কৃপা সব সময় এ শুভ কাজেই ব্যবহার করা উচিৎ। এবং কখনো অসৎ উপায় অবলম্বন করে লক্ষ্মী প্রাপ্তির আশা করা উচিত নয়। না হলে রাবনের মতো আমাদেরও বিনাশ নিশ্চিত।
দেবী লক্ষ্মী যেখানে শীল ও সদাচার থাকে দেবী সেখানেই বাস করেন । ব্রহ্ম বৈবরত পুরানে দেবী নিজ পরিচয় দিয়েছেন“ যে সকল গৃহে গুরু, ঈশ্বর, পিতামাতা, আত্মীয়, অতিথি, পিতৃলোক রুষ্ট হন, সে সকল গৃহে আমি কদাপি প্রবেশ করি না। আমি সে সকল গৃহে যেতে ঘৃনা বোধ করি, যে সকল ব্যাক্তি স্বভাবতঃ মিথ্যাবাদী, সর্বদা কেবল ‘নাই’, ‘নাই’ করে, যারা দুর্বলচেতা এবং দুঃশীল। যারা সত্য হীন, মিথ্যা সাক্ষ্য দান করে, বিশ্বাসঘাতক, কৃতঘ্ন, যে সকল ব্যাক্তি সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ভয়গ্রস্ত, শত্রু গ্রস্ত, ঋণ গ্রস্ত, অতি কৃপণ, দীক্ষা হীন, শোকার্ত, মন্দঘ্নী, স্ত্রী বশীভূত, কুলটার পতি, দুর্বাক, কলহ পরায়ণ, যারা ভগবানের পূজো ও তাঁর নাম গুন কীর্তনে বিমুখ, যারা শয়নের পূর্বে পাদপ্রক্ষালন করে না, নগ্ন হয়ে শয়ন করে, বেশী ঘুমায়, প্রভাতে সন্ধ্যায় দিবসে নিদ্রা যায়, যাদের দন্ত অপরিচ্ছন্ন, বসন মলিন, মস্তক রুক্ষ, হাস্য বিকৃত, তাদের গৃহে আমি কদাপি গমন করি না।
লক্ষ্মী আমি সে সকল গৃহে বসতি করি, যে সকল গৃহ শ্বেত পারাবত অধুষ্যিত, যেখানে গৃহিণী উজ্জ্বল সুশ্রী, যেখানে কলহ নাই, ধান্য সকল সুবর্ণ সদৃশ, তণ্ডুল রজতোপম এবং অন্ন তুষহীন। যে গৃহস্থ পরিজনের মধ্যে ধন ভোগ্য বস্তুর সমান বিভাগ পূর্বক বিতরণ করেন, যিনি মিষ্টভাষী, বৃদ্ধপোসেবী, প্রিয়দর্শন, স্বল্পভাষী, অ দীর্ঘ সূত্রী, ধার্মিক, জিতেন্দ্রিয়, বিদ্যা বিনয়ী, অ গর্বিত, জনানুরাগী, পরপীড়ন বিমুখ, যিনি ধীরে স্নান করেন, চয়িত পুস্প আঘ্রাণ করেন না, সংযত এমন ব্যাক্তি আমার কৃপা পেয়ে থাকেন।”
শুধু অর্থ নয়, উন্নত চরিত্রও মানুষের অমূল্য সম্পদ। লক্ষ্মী দেবীর কৃপা তাঁরাই লাভ করেন যারা নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। লক্ষ্মী র কৃপা সব সময় সৎ কাজেই ব্যাবহার করা উচিত। মানুষ যদি লক্ষ্মী র অপপ্রয়োগ করেন ত অলক্ষ্মীর শাপে সে ধ্বংস হবেই। যে শুদ্ধ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী তাঁর গৃহে লক্ষ্মী অচলা হয়ে অবস্থান করেন। আর যারা ঠিক এর উল্টো তারা কর্মদোষে অলক্ষ্মীর আহ্বান করে ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়। লক্ষ্মী হল ‘শ্রী’। সকলের মধ্যে যে শীল ও সদাচার আছে তার মাধ্যমেই তিনি প্রকাশিতা। তাই যেখানে ভালোমানুষদের প্রতি অবমাননা হয়, বা যারা ওপর নির্যাতন করেন – সেই সব জায়গায় কখনই দেবী লক্ষ্মীর কৃপা বর্ষণ হয় না।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ .শ্ৰী শ্ৰী চণ্ডী
২. মেয়েদের ব্রত কথা
৩. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
8.বাংলার মুখ