দ্বিতীয় পর্ব

কুলীন গ্রামী সত্যরাজ আর রামানন্দ।
যদুনাথ , পুরুষোত্তম, শঙ্কর বিদ্যানন্দ।।
বাণীনাথ বসু আদি যত গ্রামিজন।
সবে চৈতন্য ভৃত্য চৈতন্য প্রাণধন।।

চৈতন্য যুগ ও প্রাক্ চৈতন্য যুগ বৈষ্ণব মার্গ ও সংস্কৃতি প্রসারে বর্দ্ধমানের কুলীন গ্রাম অধুনালুপ্ত কংস নদীর তীরে একটি প্রসিদ্ধ জনপদ। এখানের অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংখ্যা গরিষ্ঠ । উচ্চ ও নিম্ন উভয় বিত্তের মানুষের বাস। দীঘি , গাছ গাছালি ছায়া ঘেরা শান্ত শ্ৰী মন্ডিত দূষণমুক্ত পরিবেশ।

চৈতন্য আবির্ভাবের ছয় বৎসর পূর্বে কায়স্থকুল শিরোমণি ভগীরথ ও ইন্দুমতির সুসন্তান মালাধর বসু চৈতন্য পূর্ব যুগে তুর্কি শাসনে হতোদ্যম হিন্দু বাঙ্গালীর হৃদয়ে বৈষ্ণবভাবনার সঞ্চার করতে সনাতনী ঐতিহ্যের পৌরাণিক কৃষ্ণকাহিনী ভাগবতের ১০ ও ১১ স্কন্ধের আখ্যান অনুসারে সরল বাঙ্গালায় রচনা করলেন শ্ৰীকৃষ্ণবিজয় কাব্য।

ভাগবত অর্থ ভৃত পয়ারে বাঁধিয়া
লোক নিস্তারিতে করি পাঁচালি রচিয়া।।
সুন হে পন্ডিত লোক একচিন্ত মনে।
কলি ঘোর তিমির জাতে বিমোচনে।।
ভাগবত শুনি আমি পন্ডিতের মুখে
লৌকিক কহিল লোক সুন মহাসুখে।।

চৈতন্য সমসাময়িককালে বঙ্গে বৈষ্ণব মার্গ ও বৈষ্ণবীয় সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্ররূপে কুলীনগ্রামের বিশেষ পসার ঘটেছিল। বৈষ্ণবক্ষেত্র রূপে কুলীনগ্রাম ও শ্রীখন্ড নবদ্বীপ অপেক্ষা কিছু প্রাচীন , তাই চৈতন্যদেব এই দুই স্থানের গ্রামবাসীদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন।

পূর্ব পর্বেই কিছু কিছু এসব উল্লেখ করেছি। উল্লেখ করেছি বসু পরিবারের দুই কৃতি পুরুষের নাম। আজ আরো কিছু কথা বলি কুলীনগ্রাম নিয়ে। কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে এই দুই বৈষ্ণব প্রধানের নাম উজ্জ্বল। বস্তুত পক্ষে কুলীনগ্রামে বৈষ্ণব সংস্কৃতির পরিচয়বহ যা কিছু আজও বর্তমান তার মূলে রয়েছেন মালাধর বসু , লক্ষ্মীকান্ত বসু, রামানন্দ বসু এবং তাঁদের খ্যাতি ও উপাধি। লক্ষ্মীকান্ত বসু ( সত্যরাজ ) রামানন্দের ন্যায় কবিত্বশক্তির অধিকারী ছিলেন না।কিন্তু কুলীনগ্রামে মন্দির ও মূর্তি নির্মাণে , নীলাচলের সঙ্গে কুলীনগ্রামের তথা গৌড়ের যোগসাধনে তাঁর কৃতিত্ব অসীম। সেই কারণেই সম্ভবত কুলীনগ্রামের গোপালমন্দির গাত্রে তাঁর নাম খোদিত আছে ” সর্বাধিকারী শ্রীল সত্যরাজ খাঁ ” । লক্ষ্মীকান্ত বা সত্যরাজ ছিলেন কর্মী , রামানন্দ ছিলেন কবি। সত্যরাজ এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, রামানন্দ বিনম্রভক্ত । দুজনেই বৈষ্ণব। একজন গৃহী , অন্যজন সন্ন্যাসী। রামানন্দ সত্যরাজ পুত্র ও মালাধরের পৌত্র। বসু রামানন্দ চৈতন্যভক্ত , চৈতন্য সখা, চৈতন্য প্রাণ। তিনি ছিলেন একজন সদর্থক পদকর্তাও। বসু রামানন্দের পদ শুধু কবিত্বে উজ্জ্বল নয়, তাঁর অনেক পদে চৈতন্যচরিতামৃতের উপাদান ছড়িয়ে আছে।

শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনার পর মালাধর বসু বড় জোর সতেরো বা আঠারো বৎসর জীবিত ছিলেন। এ কথার প্রমাণ মেলে কুলীনগ্রামে প্রাপ্ত একটি শ্লোক থেকে। কুলীনগ্রামে গোপেশ্বর শিব মন্দির নামে একটি মন্দির আছে। সেই মন্দির চত্বরের সামনের দিকে একটি কালো পাথরের বৃষমূর্তি আছে। সেই মূর্তির গলায় হারের ন্যায় একটি শ্লোক লেখা আছে। বাঙ্গালা লিপি এবং সংস্কৃত শ্লোক ; এই শ্লোকের উল্লেখ অনেকেই করেছেন কিন্তু কেউই শ্লোকটির প্রকৃত পাঠোদ্ধার করতে পারেননি ।ফলে সাল তারিখ ইত্যাদির বিভ্রান্তি ঘটেছে। তবে পরে অবশ্য শ্রদ্ধেয় রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় লিপিটির নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করে প্রথম যথার্থ পাঠ উদ্ধার করেন।

শ্লোকটি হল :

শাকে বিংশতি বেদৈকে মুক্ত্যর্থং শিব সন্নিধৌ ।
খাঁ শ্ৰী সত্যরাজেন স্থাপিতোয়ং শিলা বৃষঃ।।

এই শ্লোক অনুসারে বোঝা যায় যে এই শিলাবৃষটি স্থাপিত হয়েছিল ১৪২০ শকাব্দে অর্থাৎ ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে । স্থাপন করেছিলেন মালাধরের পুত্র লক্ষ্মীকান্ত বসু ( সত্যরাজ) । তখন মালাধর বসু জীবিত ছিলেন না। থাকলে হয়ত তাঁর নামই থাকত। কুলীনগ্রামের ওই শিবমন্দিরের অভ্যন্তরে একটি পাথরের মূর্তি বসানো আছে। মূর্তিটির দুপাশে বঙ্গাক্ষরে একটি সংস্কৃত শ্লোক লেখা আছে । পন্ডিতেরা শ্লোকটির পাঠ করেছেন –

শ্ৰীসত্যরাজখানো হস্যাং প্রতিমায়া মাধিষ্ঠি( তঃ)।
শবপাদোদকাকাংক্ষী খাঁ শ্ৰীগুণিরাজজঃ।।

প্রসঙ্গত , শ্লোকটির শুরু হয়েছে ওঁ দিয়ে এবং বিস্ময়ের ব্যাপার হল শেষ শব্দটি হল , ” শ্ৰীগুণিরাজজঃ “। গুণিরাজ শব্দটি ব্যাকরণগত ভাবে ঠিক।মালাধর বসুর উপাধি ছিল গুণরাজ খাঁ। খোদিত শ্লোকে কেন তাঁকে গুনিরাজ বলা হল তা নিয়ে অন্য একদিন আলোচনা করব।

যা হোক, কুলীনগ্রাম বললেই মানুষ কেবল মালাধর, সত্যরাজ বা রামানন্দের কথা ভাবেন। কিন্তু কুলীনগ্রাম যে মালাধরোত্তর বৈষ্ণব সংস্কৃতির রূপে উজ্জ্বল ছিল , তা সম্পর্কে অনেকেই স্বল্পজ্ঞাত বা অজ্ঞাত। ঊনবিংশ শতাব্দীতেও কুলীনগ্রামে বৈষ্ণব সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডল ম্লান হয়ে যায়নি। যিনি ঐতিহ্য ধারণ করে রেখেছিলেন তিনি মালাধর বসুর বংশধর হরিদাসবসু। হরিদাস বসু নিষ্ঠাবান ও সুলেখক ছিলেন । তিনি স্বয়ং বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য ছিলেন । গুরুর সান্নিধ্য লাভ তাঁর জীবনে গভীর পরিবর্তন এনেছিল। তবে সমসাময়িককাল ও ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অবাধ ।

পূর্বেই বলেছি কুলীনগ্রাম একটি প্রসিদ্ধ জনপদ ছিল যার উপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল লুপ্ত হয়ে যাওয়া কংস নদী। কুলীনগ্রামে এই নদীর চিহ্ন এখনো স্থানে স্থানে বর্তমান। কুলীনগ্রাম থেকে শিয়াপুর পর্যন্ত পায়ে হাঁটলে এই অবলুপ্ত নদীর চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। কুলীনগ্রামে অনেক মন্দির আছে, যেমন – শিবানী দেবীর মন্দির ,কাশীনাথ মন্দির, শ্যামসুন্দর মন্দির। এই সকল মন্দির লুপ্ত কংস নদীর তীরে স্থাপিত হয়েছিল। অসংখ্য ভক্তবৃন্দ এই নদীর জলে স্নান করে উক্ত মন্দিরগুলিতে দেবদেবীকে দর্শন করতেন , পূজার্চনা করতেন , অন্তরের ভক্তিঅর্ঘ্য প্রদান করতেন।

কুলীনগ্রামে ব্রাহ্মণ , কায়স্থ, উগ্রক্ষত্রিয় , তাঁতী, যুগী, ডোম, দুলে, জেলে ইত্যাদি সকল জাতি চিরকাল একত্রে বাস করেছেন , এখনো করেন ,আশা করি ভবিষ্যতেও করবেন। কারণ মালাধর বসু একজন প্রভাবশালী , পন্ডিত ও ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি শাস্ত্রে উল্লিখিত কর্মের ভিত্তিতে বর্ণের বিভাগে বিশ্বাস করতেন। তাই উচ্চ নীচ ভেদ ইত্যাদি গ্রামে ঢুকতে পারে নি। হরিদাস বসুর রচিত #মহাপাতকীরজীবনেসদগুরুর_লীলা গ্রন্থে সেই সব বিবরণ প্রাপ্ত হয়।

কুলীনগ্রামে রয়েছে গোপাল দীঘি , খাঁ দীঘি, গোপীনাথ দীঘি । এছাড়া কুলীনগ্রামের গড় ও খাতের উল্লেখ অনেক গ্রন্থে দেখা যায়। গ্রামে অনুসন্ধান করলে দুইটি চিহ্ন প্রকট হয়ে ওঠে। একটি কুলীনগ্রামের অন্তর্ভুক্ত চৈতন্যপুরে । ওই গড়ের #বসুরামানন্দেরগড়বাটী। আরেকটি হরিদাসের আখড়া যাওয়ার পথে পড়ে ।কুলীনগ্রামের প্রাচীন বৃক্ষাদির মধ্যে পাকুড়, তমাল, অর্জুন, অশ্বথ, বট, পলাশ, অশোক, বকুল, কলিকদম্ব উল্লেখযোগ্য।

মহাপ্রভুর দেখানো পথেই কুলীন গ্রামের কীর্তনীয়া সমাজ গড়ে উঠেছিল। হরিনামের বন্যায় কুলীনগ্রাম ভেসে গিয়েছিল । যার প্রমাণ মেলে চৈতন্যচরিতামৃতে – কুলীনগ্রামের এক কীর্তনীয়া সমাজ।
তাঁহা নৃত্য করে রামানন্দ সত্যরাজ ।।

কুলীন গ্রামের এই কীর্তনীয়া সমাজ গড়ার পিছনে ভক্ত হরিদাস এর অবদান ছিল অসামান্য । ভক্ত হরিদাস সম্পর্কে চৈতন্যদেব ভক্তমণ্ডলীকে বলেছিলেন, ” হরিদাস আছিল পৃথিবীর শিরোমণি”। যিনি প্রতিদিন তিনলক্ষ নামজপ করতেন । তাই তিনি নামাচার্য বলেও বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর সান্নিধ্যে কুলীনগ্রামবাসী হরি নামে মেতে উঠবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই । মহাপ্রভুর ভাষায় “শ্ৰীকৃষ্ণ পরম করুণ । তাঁর লোক নিস্তারিব। ” এই স্বভাব কেবলমাত্র অবিদ্যা স্বরূপ মায়ায় মুগ্ধ জীবের উদ্ধার করে বিদ্যা স্বরূপ মায়ায় নিয়ে যাবার জন্য । তাই মালাধরের লোকনিস্তারনের জন্য রচিত শ্রীকৃষ্ণবিজয় মহাপ্রভুকে আকৃষ্ট করেছিল। কলিহত জীবনকে মালাধর বসু আশ্বাস দিয়ে গ্রন্থ শেষে বলেছিলেন:

বদন ভরিয়া হরি বল সর্ব্বজন।।
ধর্ম অর্থ দুই হবে ইহাকে শুনিলে।
ইহা বৈ ধন আর নাহি কলিকালে।

সমাপ্ত

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১)শ্ৰীপাট কুলীনগ্রাম ও নামাচার্য শ্রীল হরিদাস ঠাকুর

২) শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত

৩) বর্ধমান : ইতিহাস ও সংস্কৃতি

৪) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.