প্রথম পর্ব

পৌষের সংক্রান্তি কাল তীব্র শীত রাত!

অসুস্থ শরীর নিয়ে পড়ে আছে ঘরের কোনায়- 

সাধক কবির চোখে নেমে আসে

আকুতির জল..

এবার তার মন্দভাগ্যে গঙ্গা স্নান নেই।

ভক্ত প্রাণ কেঁদে ওঠে , অন্ধকার শুক্লপক্ষ চাঁদ…

পরদিন ভোরবেলা অবাক বিস্ময়ে দেখে

কেন্দুবিল্ব গ্রামের মানুষ

অজয়ের কানায় কানায় 

সাদা জলে মিশে আছে ভাগীরথীর গেরওয়ার রং!

সেদিন কবির ডাকে পূর্বমুখী স্রোত পশ্চিম দিগন্ত ছুঁয়ে ছিল, সূর্যনারায়ণ ডুব দিয়েছিল অজয়ের বুকে, সে এক পুন্য শাহী স্নান হয়েছিল। কদমখন্ডির ঘাটে পূণ্য মকর গঙ্গার ধারা স্নিগধ করেছিল সব। হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু সেকি অপার মহিমা ছিল ! 

সেই জয়দেব গোস্বামীর স্মৃতিকে স্মরণে রেখে কেঁদুলিতে বসে মেলা, প্রতি পৌষ মাসে। গ্রাম ভারতের সর্ববৃহৎ মেলা ” জয়দেব – কেঁদুলি মেলা”, কেউ কেউ একে “বাউলমেলা “ও বলে থাকেন। বাউল এ মেলার প্রধানতম অঙ্গ হলেও মেলাটি কিন্তু পৌষ সংক্রান্তির , মকরলগ্নের মেলা। এই লগ্নেই অসুস্থ কবি জয়দেবের আকুল প্রার্থনায় মকর স্নানের পুণ্য দানের জন্য ভাগীরথী – গঙ্গা নিজেই অজয়ের উজানে ভেসে এসেছিলেন , কেঁদুলির ঘাটে।  সেই মকর লগ্নে অজয় স্নানে ভক্তজনের গঙ্গা স্নানের সমান পুণ্যফল লাভ হয়। লক্ষ পুণ্যার্থীরা সমাগমে শেষ পৌষের ভোরে বীরভূম – বর্ধমান একবারে মিলেমিশে এক হয়ে যায়। শীতের অজয় নদ একদিন বুকের মাঝে ভাগীরথীর উজান বইয়ে অপরূপ আলোয় মাখা এক শীর্ণ রজত রেখায় আঁকা স্বপ্নের নদী হয়ে যায়। 

সুবিশাল ভারতের সর্বত্র থেকে আসনে কত শত বাউল, কীর্তনীয়া , গাইয়ে রা। আসেন কত পন্থা ,কত মার্গের সাধু সন্ন্যাসীরা। গানে , ধর্ম , ঐশ্বরিক আলোচনায় মুখরিত হয়ে ওঠে অজয়ের তীর, আকাশ , বাতাস আর অজয় নদের পাড়ের মানুষজন। 

দেখবি যদি চলরেহ মন 

জয়দেব ধাম – গুপ্ত বৃন্দাবন ।

সেথা ভক্তিরসের বইছে জোয়ার

তাতে ভাসেন কত মহাজন।।

রাত পোহালে রোজ সকালে

ডুব দে রে মন গঙ্গা বলে অজয় সলিলে।

ক্ষ্যাপা , মুছে যাবে মনে কালি

করবি যুগল দরশন।।

বাউলেরা সকলে নিজেদের কবি জয়দেবের উত্তরসূরী মনে করেন। তাই তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত মেলায় তাঁদের কোনো নিমন্ত্রণের দরকার লাগে না, এমনি দূরদূরান্ত থেকে তাঁরা এসে ভিড় করেন। 

বাউল – কলা – হোলা 

এই তিনে জয়দেবের মেলা।

হ্যাঁ , বাউলের সঙ্গে সঙ্গে আসে চন্দন নগর থেকে প্রচুর কলা। বসে অনেক কলার দোকান। আগে এখানে উই – এর ঢিপির মতো মাটি দিয়ে ঢিপি বানিয়ে কলা পাকানো হতো। স্থানীয় মানুষজন কাঁদি কাঁদি কলা কিনে নিয়ে যেতেন। এলাকায় অতিথি – আত্মীয় সেই কলা দিয়ে আপ্যায়ন জানাত। তাছাড়া প্রচুর কাঠের জিনিস , মাটির হাঁড়ি, কলসী, হোলা , মাছ ধরার জাল এসব বিক্রি হত। 

বাউলেরা এক আখড়া থেকে অন্য আখড়ায় গিয়ে গান করতেন। লোকে গান শুনে খুশি হয়ে তাঁদের গায়ের গৈরিক কাপড়ে বা গুদুরিতে যা পাঁচ , দশ টাকা গেঁথে দিতেন বা ঝোলায় যা দুচার টাকা দিতেন ,তাতেই তাঁরা খুশি হতেন। বাউল তো…সর্ব ত্যাগী, বলা যায় একপ্রকার সন্ন্যাসী। তাই তাঁদের তেমন কোনো দাবি দাওয়া থাকতে নেই। গানই তাঁদের সাধনা, মুক্তির পথ। গান বেঁধে শোনাতে পারলেই যেন আনন্দ। সর্বত্রই তাঁরা নেচে গেয়ে বেড়াতেন।  ছাউনি ভিতর রাত জাগা মানুষ জন বসে থাকত , মাঝে এক টুকরো জায়গা। খড়ের বিচালি পাতা। সেখানেই গান গাইত বাউল , শ্রোতা দর্শক সম্মুখে এবং সমতলে দাঁড়িয়ে। 

আজি প্রেমানন্দের হাট বসেছে

আজি প্রেমানন্দের হাট বসেছে

প্রেমিকের হৃদয়ে,

প্রেমানন্দে ভাসছে প্রেমিক

আত্মহারা হয়ে।

প্রেমে পূর্ণ প্রেমেই পাগল

ও তার ঘুচে গেছে সব গণ্ডগোল,

ও মুখেতে বলে হরিবোল

প্রেমে বিভোর হয়ে।

 পাশে ধুনি জ্বলত। সেখানে সাধু গুরু , আশ্রম পিতা কথা বলতেন সকলের সঙ্গে । সাধ্য মতো আপ্যায়ন করতেন। দুপুরে সেখানেই পাত পড়ত , খিচুড়ি, লাবড়া বা বাঁধাকপির তরকারি , ডাল ,টক। মহাতৃপ্তি লাগত সে সব রান্নায় , খাওয়ায়। বিনে পয়সায় খিচুড়ি জনসেবা হত। এই নরনারায়ণ সেবার জন্য পুরো পৌষমাস জুড়ে ভিক্ষা বা মাধুকরী করে সেসব সঞ্চিত হত। কোথাও কোথাও হত লুচি, সাদা ভাত ,ঘি ভাত।

কিন্তু একটা সময়ের পর এখানে বাউলদের সমাগম কমে বৃদ্ধি পেল কীর্তনীয়াদের সমাগম । কিন্তু কেন এমন হল ? আগে তো অনেক আশ্রমে গুণীজনদের সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকত। সাহিত্য, কবিতা , সনাতনী আলোচনা হত। সে সময় তো আর সরকারী খাতায় হেরিটেজ মেলা হয়ে যায় নি। তাই মেলা চলত নিজের মতো। সেই টিকরবেতা থেকে একেবারে নদীর ঘাট পর্যন্ত। সাধক- বাউলেরা তখন তাঁদের সব আখড়া গুলি তখন খোলা মাঠের জমিতে পড়ত।  অর্থাৎ , নদীতে মেলা নামেনি তখনো। তখন বাউলরা বৈষয়িক হয়ে পড়েন নি। কেবল পরমার্থের সন্ধানী ছিলেন। মনের সুখে আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে ঘুরে নেচে গেয়ে তাঁদের মনের খিদে মিটে যেত। তেমনি অজয়ের কানায় কানায় যেমন ভাগীরথী পূর্ণ হওয়ার মতো মনের আনন্দে বাউল নাচ , গান দেখেশুনে  মেলা থেকে ফিরে আসত বাউল প্রেমী মানুষজন। আবার অপেক্ষা একটি বৎসরের। বাউলরা কারুর নিকট চাল ডাল, একটা দুটো টাকা যাহোক কিছু পেলেই মহানন্দে গ্রহণ করতেন।না পেলেও মহানন্দেই অন্য দিকে পা বাড়াতেন। কিন্তু নানা রকম ভাবে ধীরে ধীরে বাউল পথের অধঃপতন হল। ফলে কেঁদুলির জয়দেবের মেলায় কীর্তনীয়াদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেল। কীর্তনীয়াদের সারাবছরে যোগাযোগ কেন্দ্র এই মেলা। এখান থেকেই তাদের এখন বায়নাপত্র হয়। 

কত কাল ধরে

কত সঙ্গীহীন জন, প্রিয়াহীন ঘরে,

বৃষ্টিক্লান্ত বহুদীর্ঘ লুপ্ততারাশশী

আষাঢ়সন্ধ্যায়, ক্ষীণ দীপালোকে বসি

ওই ছন্দ মন্দ মন্দ করি উচ্চারণ

নিমগ্ন করেছে নিজ বিজনবেদন!

সে সবার কন্ঠস্বর কর্ণে আসে মম

সমুদ্রের তরঙ্গের কলধ্বনি-সম

তব কাব্য হতে।

কবি জয়দেবকে নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। যে কেঁদুলিকে আমরা কবির জন্মগ্রাম বলে জানি তা নিয়েও বেশ কিছু কথা আছে। অনেক কথা আছে কবি জয়দেব পূজিত রাধামাধবকে নিয়েও।

আমাদের দেশে সংস্কৃত কাব্যের যে ধারা সাধারণত প্রবাহিত হচ্ছিল কালক্রমে তা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। সংস্কৃতে রচিত বৈষ্ণব সাহিত্যের কথা ছেড়ে দিলে ভট্টনারায়ণের বেনীসংহারেই বাংলার উল্লেযোগ্য নাটক, গোবর্ধনাচার্যের আর্যাসপ্তশতী, অভিনন্দের রামচরিত একমাত্র ঐতিহাসিক কাব্য।  বঙ্গের কাব্যসাহিত্যের ধারা অন্যপথে প্রবাহিত হল মূলত সঙ্গীতের আমন্ত্রণ ও ধর্মশিক্ষার প্রয়োজনে। সংস্কৃত ভাষাকে অবলম্বন করে জয়দেবের গীতগোবিন্দ একাধারে ধর্ম, সঙ্গীত ও কাব্য সাহিত্যকে যুগপৎ যুগোচিত পুষ্টিপ্রদান করেছে। 

মেঘৈর্মেদুরমম্বরং বনভুবঃ শ্যামাস্তমালদ্রুমৈ-

র্নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়।

ইথথং নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্ব কুঞ্জদ্রুমং

রাধামাধবয়োর্জয়ন্তি যমুনাকুলে রহঃ কেলয়ঃ।।

জয়দেবই পদকর্তাদের গুরু, তিনি যে ধারার প্রবর্তন করলেন তাই পদাবলীর ধারা। তাঁর পদাবলীর ছন্দ, বিষয়বস্তু, গঠনভঙ্গী, পদবিন্যাস, আলঙ্কারিতা ও ভাবভঙ্গীরই অনুসরণ করেছেন পরবর্তী পদকর্তারা। জয়দেবের এই মধুর কোমলকান্ত পদাবলী শ্রীকৃষ্ণের উজ্জ্বল মধুর রসের বৃন্দাবনলীলা অবলম্বনে রচিত এবং রাগ, তাল সংযোগে গেয়। গীতগোবিন্দের রাধা প্রধানত খণ্ডিতা ও মানিনী। ভনিতায় জয়দেব বলেছেন হরিস্মরণে যাদের মন সরস, বিলাসকলায় যারা কুতূহলী, তাদের হর্ষবৃ্দ্ধি ও ভক্তি সঞ্চারের জন্যই তাঁর কাব্য। গীতগোবিন্দ সহজবোধ্য সংস্কৃতে রচিত হওয়ায় আর্যাবর্তের সর্বত্রই — এমনকি দক্ষিণাপথের বহু স্থলে তার প্রচার ও সমাদর হয়েছিল। 

ভারতের পূর্বশেষে

আমি বসে আজি; যে শ্যামল বঙ্গদেশে

জয়দেব কবি, আর এক বর্ষাদিনে

দেখেছিলা দিগন্তের তমালবিপিনে

শ্যামচ্ছায়া, পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর।

আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর্‌,

দুরন্ত পবন অতি, আক্রমণে তার

অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার।

বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘভার

খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া।

কিন্তু বঙ্গের  মত অন্য প্রদেশের গীতিকাব্যে তা এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বঙ্গবাসী যোদ্ধা জাতি, বীর জাতি আবার প্রেমিক জাতিও বটে, প্রেমের কবিতার বড়ই অনুরাগী। বাঙ্গালীরা গীতগোবিন্দে প্রেমগীতির একটা চূড়ান্ত আদর্শ পেয়ে গেল এবং শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবে ও তাঁর প্রেম ধর্ম-প্রচারের ফলে গীতগোবিন্দ বৈষ্ণব জগতে এক অনন্য মর্যাদা লাভ করল, চৈতন্য দেব গীতগোবিন্দে লোকাতীত ব্যঞ্জনা সঞ্চার করলেন। বঙ্গবাসীর নিজস্ব-কীর্তন সঙ্গীতের অভাবনীয় সমুন্নতির ফলে গীতগোবিন্দের পদ কীর্তনের অঙ্গীভূত হয়ে অভিনব সুর তালে ধ্বনিত হতে শুরু করল। একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে এই অখণ্ড সঙ্গীত হিল্লোল একমাত্র জয়দেবের, অন্য কারো নয়।

ক্রমশঃ

© দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১. জয়দেব কেঁদুলির মেলা

২. গীতগোবিন্দম্

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.