আজ ১লা জানুয়ারি, ১৮৮৬, শুক্রবার। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আজ কাশীপুরের বাগানবাড়িতে তাঁর বসবাসের ঘরটি থেকে নেমে এসেছেন নীচের বাগানে। তাঁর পরনে লালপেড়ে ধুতি, একটি পিরান, লালপাড়ের একটি মোটা চাদর, কানঢাকা টুপি ও চটি জুতো। সঙ্গে রয়েছেন ভ্রাতুষ্পুত্র রামলাল চট্টোপাধ্যায়। এখন বিকেল। ঠাকুর এসেছেন আমগাছটির কাছে। সেখানে কতিপয় ভক্তের জটলা। ঠাকুরকে দেখে সর্বাগ্রে এগিয়ে এলেন গৃহিভক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তিনি ভক্তির আতিশয্যে জুতো খুলে রেখে শ্রীরামকৃষ্ণকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন। কৃপাসিন্ধু ভগবানের কৃপাবারি উথলে উঠল। তিনি গিরিশকে জিজ্ঞাসা করলেন — তুমি যে সকলকে এত কথা (আমার অবতারত্ব সম্বন্ধে) বলে বেড়াও, তুমি (আমার সম্বন্ধে) কি দেখেছ, কি বুঝেছ? গিরিশ গদগদ স্বরে উত্তর দিলেন — ব্যাস বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি , আমি তাঁর সম্বন্ধে অধিক কি আর বলতে পারি ! গিরিশের এই ভাবপূর্ণ স্তব শুনে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট ও সমাধিস্থ হলেন। খানিক পরে ভাবের গাঢ়তা তরল হলে তিনি সমবেত ভক্তমন্ডলীর উদ্দেশে বলতে লাগলেন — তোমাদের আর কি বলব। আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হোক। শ্রীরামকৃষ্ণের এই কৃপা-বিতরণের মহার্ঘ্য-ক্ষণে ভক্তেরা উদ্বেলিত হয়ে উঠল, সকলে তাঁর কৃপাপ্রাপ্তির অভিলাষে সমবেত হল তাঁর চারপাশে, শ্রীরামকৃষ্ণ একে একে সকলকে স্পর্শ করতে লাগলেন। তাঁর কৃপা-পরশে কেউ হাসতে লাগল, কেউ কাঁদতে লাগল, কেউ ধ্যানে নিমগ্ন হলো, কেউ প্রার্থনা করতে আরম্ভ করল, কেউ জ্যোতি দেখতে পেল, কেউবা নিজের ইষ্টের দর্শন পেল, আবার কেউবা নিজের শরীরে আধ্যাত্মিক-তরঙ্গের ঢেউ অনুভব করতে লাগল।
শ্রীরামকৃষ্ণের নরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি অন্তরঙ্গ ত্যাগী সন্তানরা অধিকাংশই তখন ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁরা রাতভোর জপধ্যান করতেন। সেই কারণেই মধ্যাহ্নের পর ঘুমিয়ে নিতেন। গৃহিভক্তরাই আজ বিশেষভাবে ঠাকুরের কৃপাভিলাষে জড়ো হয়েছেন। অক্ষয় সেনকে কাছে ডেকে বক্ষ স্পর্শ করলেন ঠাকুর , কানে দিলেন ‘মহামন্ত্র’। অক্ষয় সেনের চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরতে লাগল, তাঁর জীবন কৃতার্থ হলো। নবগোপাল ঘোষকে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন একটু ধ্যানজপ করলেই তাঁর হবে। কিন্তু নবগোপাল সাধারণ গৃহস্থ, তাঁর এসবের অবসর কোথায়? ঠাকুর তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন — আমার নাম একটু একটু করতে পারবে তো? নবগোপাল বললেন — তা খুব পারব। এই উত্তর শুনে ঠাকুর বললেন — তা হলেই হবে — তোমাকে আর কিছু করতে হবে না।
‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এর প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অর্থকষ্টে ভুগছেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে অর্থ প্রার্থনা করলেন। ঠাকুর তাঁকে বললেন — তোর অর্থ হবে। পরবর্তীকালে তিনি প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হন এবং নানাভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের সেবায় জীবন অতিবাহিত করেন। রামলাল দাদা পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন। মনে মনে ভাবছিলেন — সকলের তো একরকম হলো , আমার কি গাড়ু গামছা বয়া সার হবে? অন্তর্যামী ঠাকুর তাঁর মনের ভাব বুঝে তাঁকে ডেকে বললেন – এত ভাবছিস কেন? আয় আয়। এরপর শ্রীরামকৃষ্ণ রামলাল চট্টোপাধ্যায়ের বুকে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন — দেখ্ দিকিনি এইবার। রামলাল দাদা দেখলেন – সে যে কি রূপ , কি আলো , কি জ্যোতি! পরে তিনি স্বামী সারদানন্দকে বলেছিলেন যে — ঠাকুর স্পর্শ করা মাত্র সর্বাঙ্গসুন্দর ইষ্টমূর্তি তাঁর হৃদয়পদ্মে যেন নিমেষের মধ্যেই নড়েচড়ে ঝলমল করে উঠেছিল। এমন সময় বৈকুন্ঠনাথ স্যান্যাল এগিয়ে এলেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করে বললেন — আমায় কৃপা করুন। ঠাকুর বললেন — তোমার তো সব হয়ে গেছে। বৈকুন্ঠনাথ বললেন যে ঠাকুর যখন বলছেন, তখন সেকথা নিশ্চয়ই ঠিক, তবে তিনি যাতে সেই অনুভূতি অল্পবিস্তর বুঝতে পারেন, ঠাকুর যেন তা করে দেন। একথা শুনে শ্রীরামকৃষ্ণ ক্ষণিকের জন্য বৈকুন্ঠনাথের হৃদয় স্পর্শ করলেন। অমনি বৈকুন্ঠনাথ সর্বত্র শ্রীরামকৃষ্ণ রূপ দেখতে লাগলেন। ক্রমাগত তিনদিন তিনি এই অবস্থায় রইলেন। যেদিকে তাকান, সেদিকেই শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে পান। ইতিমধ্যে বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা আগতপ্রায়। শ্রীরামকৃষ্ণ রামলালদাদার সঙ্গে ফিরে চললেন নিজের ঘরে। রামলালদাদাকে তিনি বললেন , সকলের পাপ গ্রহণ করে তাঁর অঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। ঠাকুরের কথামত রামলালদাদা গঙ্গাজল নিয়ে এলেন। ঠাকুর গায়ে মাখলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন যে যাবার আগে তিনি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে যাবেন , অর্থাৎ নিজের স্বরূপ ভক্তদের মাঝে প্রকাশ করে দিয়ে যাবেন। তাই করলেন তিনি আজ, ১৮৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি। কৃপাসিন্ধু ভগবান কল্পতরু হলেন ভক্তদের কাছে।