দ্বিতীয় পর্ব
অন্ধকার রুদ্ধগৃহে একেলা বসিয়া
পড়িতেছি মেঘদূত; গৃহত্যাগী মন
মুক্তগতি মেঘপৃষ্ঠে লয়েছে আসন,
উড়িয়াছে দেশদেশান্তরে। কোথা আছে
সানুমান আম্রকূট; কোথা বহিয়াছে
বিমল বিশীর্ণ রেবা বিন্ধ্যপদমূলে
উপলব্যথিতগতি; বেত্রবতীকূলে
পরিণতফলশ্যাম জম্বুবনচ্ছায়ে
কোথায় দশার্ণ গ্রাম রয়েছে লুকায়ে
প্রস্ফুটিত কেতকীর বেড়া দিয়ে ঘেরা;
১২০৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত শ্রীধর দাসের সদুক্তি কর্ণামৃত নামক কোশকাব্যে জয়দেবের নামে একত্রিশটি শ্লোক সঙ্কলিত, তার মধ্যে পাঁচটি শ্লোক গীতগোবিন্দে পাওয়া যায়। জয়দেব মূলত বিবিধ বিষয়গুলি নিয়ে শ্লোক রচনা করেছেন যেমন কল্কি অবতার শ্রুতি, বীররসের উৎসাহ ও উদ্দীপনা, আদি-রসের কবিতা, রাজকীর্তি ও স্তুতি প্রভৃতি। রাজার স্তুতি কবিতাটি সম্ভবত মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের বন্দনা বলে মনে হয় —
“লক্ষ্মীকেলিভুজঙ্গ জঙ্গমহরে সঙ্কল্পকল্পদ্রুম
শ্রেয়ঃ সাধকসঙ্গ সঙ্গরকলাগাঙ্গেয় বঙ্গপ্রিয়।
গৌড়েন্দ্র প্রতিরাজনায়ক সভালঙ্কার-কর্ণার্পিত
প্রত্যর্থিক্ষতিপাল পালক সতাং দৃষ্টো’সি তুষ্টা বয়ম্ ”।
একটা সময় পর্যন্ত রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভারত্ন ছিলেন জয়দেব গোস্বামী। মোটা চোখে হয়তো গীতগোবিন্দ সভ্যমানুষের কাছে একসময় গ্রহণ যোগ্য ছিল না। কিন্তু শ্রী চৈতন্যদেব প্রাণ ভরে সেই কাব্যের রসাস্বাদন করতেন। গীতগোবিন্দকে প্রেমরস ধরলে প্রেমরস, আদি রস ধরলে আদিরস আর ঈশ্বরের প্রতি আরাধিকার ভক্তিরস ধরলে ভক্তিরস। গীতগোবিন্দ এই জন্যই তো সাধারণ হয়ে উঠেছে।
ডক্টর হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় হতে বহু গবেষক প্রমাণ করেছেন জয়দেব বীরভূমের কেঁদুলিতেই জন্মগ্রহণ করেন। এখানেই ছিল তাঁর পর্ণকুটির। সেখানেই তিনি পূজা করতেন রাধামাধবের। প্রতিদিন পায়ে হেঁটে কাটোয়া গিয়ে গঙ্গা স্নান করতেন। সুন্দরী পদ্মাবতীর সঙ্গে এখানেই তিনি ঘর বাঁধেন। এই স্থানেই বসে তিনি লেখেন গীতগোবিন্দ। মন্দির সংলগ্ন স্থানই ছিল তাঁর জন্মভিটে। কেঁদুলির পূর্ব নাম ছিল কেন্দুবিল্ব।
গ্রন্থে নিজ সম্পর্কে কবি —“পদ্মাবতী চরণ চারণ চক্রবর্তী”, “কেন্দুবিল্ব—সমুদ্র সম্ভব—রোহিণীরমণ”, “পদ্মাবতী রমণ —জয়দেব কবি” (গীতগোবিন্দ ১/২, ৩/১০, ১০/১০, ১২/১১) ইত্যাদি কথাগুলো বলেছেন। তাঁর পিতামাতা হলেন ভোজদেব ও বামাদেবী অথবা রামাদেবী বা রাধাদেবী। যদিও এক্ষেত্রে সঠিক কোনও ঐতিহাসিক বিবরণী পাওয়া যায় নি, কিন্তু তবুও নানা জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করে জয়দেবের জীবনী ও সমসাময়িক ইতিহাস সম্পর্কে নানা তথ্য আমরা জানতে পারি।
পথতরুশাখে কোথা গ্রামবিহঙ্গেরা
বর্ষায় বাঁধিছে নীড়, কলরবে ঘিরে
বনস্পতি; না জানি সে কোন্ নদীতীরে
যূথীবনবিহারিণী বনাঙ্গনা ফিরে,
তপ্ত কপোলের তাপে ক্লান্ত কর্ণোৎপল
মেঘের ছায়ার লাগি হতেছে বিকল;
বীরভূমের অজয় নদীর তীরে কেঁদুলি গ্রামে জয়দেবের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আজও মেলা বসে এবং বৈষ্ণব – ভক্ত – বাউলগণ সেখানে উপস্থিত হন। কেঁদুলিই কী কেন্দুবিল্ব ? আসলে মেলাস্থান থেকে সাতক্রোশ দূরে কেঁদুলিই হল কেন্দুবিল্ব। গীতগোবিন্দের নানা টীকায় কবিকে মিথিলা, গুজরাট কিম্বা উড়িষ্যার অধিবাসী বলে দাবী করা হয়েছে। সেই অনুসারে পুরীর কেন্দুলি অথবা মিথিলার কেন্দোলি গ্রাম তাঁর জন্মস্থান রূপে চিহ্নিত। তবে বর্তমানে প্রাপ্ত নানা সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে জন্মস্থান হিসেবে বীরভূমকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
চন্দ্রদত্তের ভক্তমালা গ্রন্থ এবং প্রসিদ্ধ টীকাকারদের টীকায় জয়দেব ও তাঁর পত্নী পদ্মাবতী সম্পর্কে নানা কিংবদন্তী প্রচলিত। হলায়ুধ মিশ্রের “সেকশুভোদয়ার” কাহিনী অনুসারে জয়দেব ও তাঁর পদ্মাবতী উভয়েই মার্গসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। এক দক্ষিণী ব্রাহ্মণ দম্পতি তাঁদের কন্যা পদ্মাবতীকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে মানত করে প্রাপ্ত হন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিতামাতা সুন্দরী কিশোরীকে জগন্নাথ দেবের কাছে দেবদাসী রূপে উৎসর্গ করেন, পুনরায় স্বপ্নাদেশ পেয়ে তাঁরা পদ্মাবতীকে কেন্দুবিল্ব নিবাসী জয়দেব গোস্বামীর সঙ্গে বিবাহ দেন। কথিত আছে, জয়দেব গীতগোবিন্দের পদ গাইতেন এবং পদ্মাবতী নাচতেন। বঙ্গে প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী ভক্তকবি জয়দেবের অনুপস্থিতিতে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণই তাঁর রূপ ধারণ করে বহু শ্লোকের রচনা করেছেন। কোথায় যেন তাই অপূর্ব অমৃতময় জয়দেব শ্লোক অতিন্দ্রীয় তন্ময়তার স্পর্শে অনাবিল রূপে ভাস্বর হয়ে ওঠে।
গীতগোবিন্দে জয়দেব তাঁর সমসাময়িক উমাপতিধর, শরণ, আচার্য গোবর্ধন এবং কবিরাজের বিশেষ প্রশংসা করেছেনঃ-
গোবর্ধনশ্চ শরণো / জয়দেব উমাপতিঃ ।
কবিরাজশ্চ রত্নানি / পঞ্চৈতে লক্ষ্মণস্য চ ।।
এই কবিরা সকলেই সম্ভবত লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ছিলেন। টীকাকার রাণাকুম্ভের মতে, “ষট পণ্ডিতা রাজ্ঞো লক্ষ্মণসেনস্য প্রসিদ্ধা ইতি”। নরনারায়ণের সভাকবি শুক্লধ্বজ বলেছেন — “লক্ষ্মণসেনসভাসদাং স্বরূপকথনেন নিজোৎকর্ষপ্রতিপাদনেন” জীব গোস্বামী ভাগবতের বৈষ্ণবতোষিণী টীকায় লিখেছেন —“শ্রীজয়দেবসহচরেণ মহারাজ-লক্ষ্মণসেন-মন্ত্রিবরেণ উমাপতিধরেণ।”
১৯২৩ -৩০ খ্রিস্টাব্দের ভূমি মানচিত্রে জয়দেব কেঁদুলির নাম এসেছে। এখন তো কেঁদুলি বাদ দিয়ে লোকমুখে কেবল জয়দেবই প্রচলিত হয়েছে।
দ্বাদশ শতাব্দীর সেনপাহাড়ি এলাকায় রাজা লক্ষ্মণ সেন কিছুকাল অবস্থান করেন। সে বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্য প্রাপ্ত হয়েছে। অজয়ের ওপারে গড়জঙ্গল। সেখানে মা শ্যামরূপার অবস্থান। দেবী ভবানী জয়দেবের প্রভাবে হয়েছেন শ্যামরূপা কালী। শ্যাম ও শ্যামার কি অপূর্ব মিলন।
যা কালী সৈব কৃষ্ণঃসাৎ , যঃ কৃষ্ণ স শিবঃ স্মৃতঃ।
এষং ভেদো না কর্তব্যো যদীচ্ছেদাত্মনো হিতং।।
গড়জঙ্গলেই দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেব গোস্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় রাজা লক্ষ্মণ সেনের। পরে রাজা তাঁকে সভারত্ন করে কৃষ্ণনগর নদীয়ায় নিয়ে যান আমন্ত্রণ করে। অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও বীরভূমের কেঁদুলিকেই জয়দেবের ভিটা বলে মান্যতা দিয়েছিলেন ।
শিখদের গ্রন্থসাহেবে (১৬ শতাব্দী) জয়দেবের যে দুটি শ্লোক বিকৃতভাবে উদ্ধৃত হয়েছে আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর শুদ্ধ পাঠোদ্ধার করেছেন (সাহিত্য একাদেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ জয়দেব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়)। নাভাজী দাসের ভক্তমাল গ্রন্থে (১৬০০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দ) জয়দেবের বাক্য ও কবিত্ব প্রশংসিত হয়েছে এমনি ভাবে —
প্রচুর ভয়ো তিহুঁ লোক গীতগোবিন্দ উজাগর ।
কোক কাব্য নবরস-সরস-শৃঙ্গার কো আগার ।।
— সন্ত–সরোরুহ-খণ্ড কৌ পদুমাবতি-সুখজনক — রবি ।
জয়দেব কবি নৃপচক্কবৈ খণ্ড–মণ্ডলেশ্বর আনি কবি ।
রূপ গোস্বামীর লেখনীতেও লক্ষ্মণ সেনের নামে সংকলিত দুটি শ্লোকের অনুকরণ লক্ষণীয় — “রাধা মাধববয়োর্জয়ন্তি মধুরস্মেরালসসদৃষ্টয়ঃ”(১/১)। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায় জয়দেব রাজা লক্ষ্মণ সেনের শুধু সভাকবি নন, প্রিয় পাত্রও ছিলেন। অবশ্য তিনি কখন এবং কীভাবে রাজসভায় স্থানলাভ করেন তার কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না।
রসময় দাস বলেছেন –
বৃন্দাবনে যমুনার কূলে নিত্য লীলা।
জয়দেব নিজগ্রন্থে সব প্রকাশিলা।।
রাধিকা মাধব কেলি যমুনার কূলে।
জয়যুক্ত বর্ত্তমান কাল শাস্ত্রে বলে।।
বীরভূমে কেঁদুলির সংলগ্ন মন্দিরা বা মুন্দিরা মৌজায় ছিল জয়দেবের পর্ণ কুটির আর রাধামাধবের প্রাচীন মন্দির। সে সব আজ আর কিছুই নেই। সবই চলে গেছে নদীর গর্ভে। মুন্দিরা নামে কোনো গ্রামও নেই। কেবলমাত্র আছে মুন্দিরা নামের মৌজা। বতর্মানে যে অপূর্ব সুন্দর টেরাকোটার মন্দিরটি মন্দিরটিকে আমরা জয়দেবের মন্দির বলি, তা জয়েদেবের মন্দির নয় বা জয়দেব আরাধিত রাধামাধবেরও মন্দির নয়। এটি পরবর্তীকালে নির্মিত রাধাবিনোদের মন্দির। বৃন্দাবন চলে যাবার সময় কবি জয়দেব গোস্বামী তাঁর আরাধ্য রাধামাধব শিলাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই জয়দেব পূজিত রাধামাধব বর্তমানে রাজস্থানের জয়পুরে ঘাঁটি নামক স্থানে পূজা পাচ্ছেন। এর সত্যতা প্রমাণ দেওয়া ভার। আসলে ভারতীয় ইতিহাস , বাঙ্গালীর ইতিহাস খুঁড়ে তার প্রকৃত সত্য বের করার চেষ্টা তো কেউ করে নি, তাই সব নিয়েই বিতর্ক থেকে যায় বার বার। আর আমরা ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাই রোজ একপা করে।
যাক সেসব বিতর্ক বাদ দিয়ে তাই আমরা অমৃতের সন্ধান করি। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যে রহস্য গুপ্ত ছিল , শ্রীগীতগোবিন্দে তা প্রকাশিত এবং বিকশিত হয়েছে।
ইতস্ততস্তামনুসৃত্য রাধিকা মনঙ্গবাণ ব্রণখিন্নমানসঃ।
কৃতানুতাপঃ স কলিন্দনন্দিনী – তটান্তকুঞ্জে বিষসাদ মাধবঃ।।
কংসারিরপি সংসারবাসনাবদ্ধশৃঙ্খলাম্ ।
রাধামাধায় হৃদয়ে তত্যাজ্য ব্রজসুন্দরীঃ ।।
রামানন্দ রায় বলেছেন –
এই দুই শ্লোকের অর্থ বিচারিলে জানি।
বিচারিলে উঠে যেন অমৃতের খনি।।
রামানন্দ রায় বলেছেন –
কৃষ্ণকে আহ্লাদে তাতে নাম আহ্লাদিনী।
সেই শক্তি দ্বারে সুখ আস্বাদে আপনি।।
সুখরূপ কৃষ্ণ করে সুখ আস্বাদন।
ভক্তগণে সুখ দিতে সেই হ্লাদিনী কারণ।।
পৌষ সংক্রান্তির মকর লগ্নের উপলক্ষে বীরভূমের কেঁদুলির বুকে বিরাট এই গ্রামীণ মেলাকে চরম শহুরেপনা , কর্পোরেট সংস্থা এখনও গ্রাস করতে পারেনি। রাতভোর কীর্তন আর বাউলগানের মুখর এ মেলা। লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীর আবেগে রাঙা মকর লগ্নের এই পুণ্যস্নান এক বৃহৎ মিলনমেলা , যা কিনা এতদ্ ভারতে এক বিরল মেলারই নাম।
কবি জয়দেব অজয় নদের তীরে তাঁর নব পরিণীতা পদ্মাবতীকে নিয়ে এক অপরূপ প্রেম সাধনা শুরু করেন, দিনের সারাক্ষণই চলে রাধাশ্যামের অর্চনা, সঙ্গে পদ্মাবতী রাধাশ্যামের আরতি করেন সংগীত নৃত্য করে। কবি জয়দেব সারাক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন কৃষ্ণ-চিন্তা, কৃষ্ণ কথাতে।
তাঁর অন্তরের নিবিড় আকুতি, অনুভূতি হয়ে ফুটে ওঠে তাঁর লেখনীতে। সন্ধ্যারতির সময় পদ্মাবতীর বিভোর হয়ে নৃত্য নিবেদন রাধাশ্যামের বিগ্রহের কাছে যেন মনে হয় স্বয়ং শ্রীরাধিকা নৃত্য করছেন কৃষ্ণপ্রেমে। আবেশে কবি জয়দেবের অজয় নদকে মনে হয় যমুনা, অজয় নদের তীরে কদম্ববৃক্ষকে দেখে তাঁর মনে হয় কেলিকদম্ব। আস্তে আস্তে জয়দেব তাঁর নিজের মনে রচনা করে নেন নববৃন্দাবন।
রাধাবদন বিলোকন বিকশিত বিবিধ বিকার বিভঙ্গম্।
জলনিধিমিব বিধুমণ্ডল দর্শন তরলিত তুঙ্গ তরঙ্গম্।।
কবি পত্নী পদ্মাবতীর প্রেমের মধ্যেই তিনি নতুন করে খুঁজে নেন রাধা কৃষ্ণের অনন্ত প্রেমলীলা। জয়দেব রচনা করতে বসেন ‘গীতগোবিন্দ’ এখানে শ্রীকৃষ্ণ বিলাসরসে রসিক কিশোর নায়ক, সেই কিশোর নায়কের অপূর্ব মোহন মূর্তি। চন্দ্রাবলীর কুটিরে লীলা সমাপ্ত করে কৃষ্ণ এসেছেন শ্রীমতির কুঞ্জে। নিদারুন অভিমানে কৃষ্ণ অভিমানিনী শ্রীরাধিকা, স্বয়ং রাধামাধব তাঁর মানভঞ্জনের জন্য সংকল্প করেন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে শ্রীমতীর চরণে আত্মসমর্পণ করার।
একদিন তিনি গীতগোবিন্দ লিখছেন । লিখতে লিখতে প্রায় দশম সর্গে চলে এসেছেন। রাধিকার বড় মান হয়েছে। মান ভঞ্জন করছেন কৃষ্ণ। তিনি লিখলেন –
স্থল – কমলগঞ্জনং মম হৃদয়রঞ্জনম্
জনিত – রতি – রঙ্গ পরভাগম্ !
ভণ মসৃণ – বাণি করবাণি চরণদ্বয়ম্
সরস – লসদলক্ত রাগম্।।
স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং ….
কিন্তু হায় কি লিখছেন ? জগৎ যাঁর পায়ের নিচে তিনি কিনা ?….ছি ছি কি করে শেষ করবেন এই শ্লোক। কি লেখেন কি লেখেন …নাঃ স্নান করে এলে কিছু সুবিধা হয়। স্নানে গেলেন কবি। পদ্মাবতী তখন দ্বিপ্রহরের রন্ধনে ব্যস্ত। এমন সময় হঠাৎই পদ্মাবতী শুনতে পেলেন স্বামীর আগমন পদধ্বনি। তারপর গলা শুনলেন, ” কই খেতে দাও, আজ বড় ক্ষুধার্ত অনুভব করছি। ” বলে বিদ্যা আরাধনার কক্ষে গিয়ে বসলেন তালপত্রের পুঁথির সম্মুখে , কলম তুলে আঁচড় দিলে অসমাপ্ত শ্লোকের পাশে। লিখলেন , “দেহি পদপল্লবমুদারম”। এদিকে পদ্মাবতী আহারের আয়োজন করে স্বামীকে ডাকলেন। মহাতৃপ্ত মনে স্বামী আসনে বসে সেবা নিলেন। তারপর বললেন , “বাঃ এবার একটু বিশ্রাম করি। ” শয়ন কক্ষে গিয়ে দ্বার দিলেন। পদ্মাবতী স্বামীর আহারান্তে সবেমাত্র অন্নগ্রহণে বসেছেন। এমন সময় আবার স্বামীর গলা শুনলেন। ” নাঃ আজ স্নান না করে ফিরলাম। শ্লোক সমাপ্ত না করে আজ অন্নগ্রহণ করব না। ” তারপর দেখলেন স্ত্রী আহারে বসেছেন। একটু অবাক হলেন। পদ্মাবতীও তো বিস্ময় হতবাক হয়ে স্বামীকে দেখছে। পদ্মাবতী বললেন , ” তুমি ? তুমি এখানে কেন ? এই তো তুমি স্নান করে , শ্লোক সমাপ্ত করে , আহার গ্রহণ করলে। তারপর শয়ন কক্ষের দ্বার দিলে। ” কবি ছুটে গেলেন বিদ্যা কক্ষে। সেখানে দেখলেন অসমাপ্ত শ্লোকের পাশে লেখা আছে দেহি পদপল্লবমুদারম।
জয়দেব “মণ্ডনং” পৰ্য্যন্ত লিখে, এই ভাবিয়া, “দেহি পদপল্লবমুদারম” এই অংশ সাহস করে লিখতে পারছিলেন না যে, প্রভুর মস্তকে পদার্পণের কথা কিরূপে লিখব। পরিশেষে, ঐ অংশ লিখিতে কোন ক্রমেই সাহস হয় নি। কিন্তু কৃষ্ণ অত্যন্ত রসিক, সামান্ত নায়কের হ্যায় বর্ণিত হলে, অপরাধ গ্রহণ করেন এরূপ নন ; বরং তাঁর প্রণয়িনীর পদপল্লব তদীয় মস্তকে অপিত বর্ণন করলে, প্রসন্নই হন । তাই ভক্তের আকুতি ,মনের ইচ্ছা তিনিই পূরণ করলেন। আহা , কি ভাগ্য, রাধামাধবের এ কি লীলা , তিনিই ছদ্মবেশে এসে সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে গেছেন। পদ্মাবতী ধন্য। স্বচক্ষে তিনি রাধামাধব দর্শন করেছেন। এমন ভক্তিরসেই তো গীতগোবিন্দ হয়ে উঠেছে অমূল্য , অক্ষয়, অব্যয়।
ভ্রূবিলাস শেখে নাই কারা সেই নারী
জনপদবধূজন, গগনে নেহারি
ঘনঘটা, ঊর্ধ্বনেত্রে চাহে মেঘপানে,
ঘননীল ছায়া পড়ে সুনীল নয়ানে;
কোন্ মেঘশ্যামশৈলে মুগ্ধ সিদ্ধাঙ্গনা
স্নিগ্ধ নবঘন হেরি আছিল উন্মনা
শিলাতলে, সহসা আসিতে মহা ঝড়
চকিত চকিত হয়ে ভয়ে জড়সড়
সম্বরি বসন ফিরে গুহাশ্রয় খুঁজি,
বলে, “মা গো, গিরিশৃঙ্গ উড়াইল বুঝি!”
ইতিহাস , পুরান, লোককথা , গল্পগাথা, ভক্তিরসের মিশ্রনে অপার মহিমা ধারণ করে জয়দেবের কেঁদুলির মেলা। ওপারের গড়জঙ্গল। সেথায় মা শ্যামরূপার সঙ্গে আছেন রাঢ়ের কুলদেবতা ধর্মঠাকুর। আছে ইছাই ঘোষ, লাউসেন, কালু ডোমের ইতিহাস। কুর্ম রূপে স্বরূপনারায়ণ ধর্মের পূজা হয় সেথায়।
একে শনিবার তায় ঠিক দুপুরবেলা।
সম্মুখে দন্ডাইল ধর্ম্ম গলে চন্দ্রমালা।।
গলায় চাঁপার মালা আসাবাড়ি হাথে।
ব্রাহ্মণ রূপে ধর্ম্ম দন্ডাইল পথে।।
রাঢ় বঙ্গের অন্ত্যজ দরিদ্র শ্রেণীর সাধারণ মানুষের ঠাকুর হলেন নারায়নের লৌকিক রূপ স্বরূপনারায়ণ অর্থাৎ ধর্ম্মঠাকুর। তিনি রাঢ় বঙ্গের সাধারণ মানুষের ত্রাণ কর্তা। তাঁর নিকট লাউসেনও যা কালু ডোমও তাই। ধর্মমঙ্গল তাই হয়ত রাঢ় বঙ্গের মহাকাব্য।ধর্মমঙ্গল থেকে জানা যায় তৎকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় পরিস্থিতির কথা। এসব কারণেই রাঢ় বঙ্গের গাঁয়ে গাঁয়ে ধর্ম ঠাকুর নানা নামে স্বয়ং অবস্থান করেন।
উর ধর্ম্ম আমার আসরে।।
কাতর কিঙ্কর ডরে আসরে স্মরণ করে।
তেজ ধর্ম্ম বৈকুণ্ঠ নগর ।।
বিড়ম্বনা দন্ড কত দেখ নাট শুন গীত।
আপনি আসরে কর ভর।।
লাউসেনের সঙ্গে ইছাই ঘোষের যুদ্ধ, বর্ধমান রাজপরিবারের সঙ্গে তার দূরাগত পদধ্বনি সবই এই অঞ্চল ঘিরে আছে। সব কিছুর সাক্ষী হয়ে বয়ে চলেছে সুপ্রাচীন অজয় নদ।
ক্রমশঃ
© দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. জয়দেব কেঁদুলির মেলা
২. গীতগোবিন্দম্