রানী পদ্মাবতী বা পদ্মিনী ভারতীয় ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য নাম। মেওয়ার রাজ রতন সিং এর ধর্মপত্নী এবং সিংহল রাজ গন্ধর্বসেনের কন্যা রানী পদ্মিনী শুধু রূপবতীই ছিলেন না, ছিলেন তলোয়ার যুদ্ধেও পারদর্শিনী। দিল্লীর তৎকালীন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি রানী পদ্মাবতীর সৌন্দর্য সম্পর্কে অবগত হয়ে তাকে পাওয়ার জন্য ১৩০৩ সালে চিতোর দুর্গ আক্রমণ করে। যুদ্ধে আসন্ন পরাজয় বুঝতে পেরে নিজ সম্ভ্রম রক্ষার্থে রানী পদ্মাবতী সহ দুর্গের ১৬০০ রমণী রানীর সাথে ‘জহর’ পালন করেন।
এই ‘জহর’ কে যদিও সতী প্রথার সাথে তুলনা করা হয়েছে, তবুও এখানে বলা জরুরি আপাতদৃষ্টিতে এক মনে হলেও এই দুটি প্রথা আদতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মহাভারতে উল্লিখিত আছে যে হস্তিনাপুর রাজ পাণ্ডুর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে উনার পত্নী মাদ্রি উনার সাথে সহমরণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অর্থাৎ উনি সতী হন। কিন্তুু মহাভারত বা প্রাচীন ভারতীয় কোনও গ্রন্থেই ‘জহর’ পালনের কোনরকম প্রমাণ আমরা পাইনা। জহর’ পালন মানে হল বহু রমণীর নিজ সম্ভ্রম রক্ষার্থে একসাথে অগ্নি কুণ্ডে ঝাঁপ দেওয়া। এই ভাবে আত্মহত্যার পথ রমণীগণ তখনই বেছে নিতেন যখন তাদের স্বামী, পুত্র, বাবা বা ভ্রাতা যুদ্ধে পরাস্ত হত।
মুলত রাজপুতানা রাজ্যের রমণী সহ উত্তর ও মধ্য ভারতে এই প্রথা পালনের নজির আমরা পাই যখন এই সব রাজ্যের রাজাগণ মুসলমান শাসকদের হাতে পরাস্ত হন। হিন্দু রাজার সাথে অপর হিন্দু রাজার যুদ্ধের পর এই ধরণের প্রথা পালনের কোনরকম দৃষ্টান্ত ইতিহাসে পাওয়া যায়না। এমনকি প্রাচীন ভারতে হিন্দু রাজার সাথে বুদ্ধ বা জৈন রাজা দের যুদ্ধের পরও জহর’ পালনের কোনরকম নজির ইতিহাসে নেই। কিন্তু মুসলমান আক্রমণের ক্ষেত্রেই নারীদের এই পথ অবলম্বন করতে হত কারণ পরাজিত রাজ্যের রমণীদের উপর এই মুসলমান যোদ্ধাগণ নারকীয় অত্যাচার করত। এবং রমণীগণ অন্য কোন উপায়ে আত্মহত্যা না করে আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার কারণ স্বরূপ বলা যেতে পারে মুসলমান যোদ্ধাদের কারো কারো মধ্যে necrophilic আচরণ। ৭১২ থেকে ১৬৩৪ সন পর্যন্ত হিন্দু রমণীদের বহু বার ‘জহর’ পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘জহর’ পালনের পূর্বে দুর্গের রমণী এবং শিশুরা দুর্গের দেওয়ালে নিজেদের হাতের ছাপ দিয়ে যেতেন। আজও দুর্গ গুলোতে গেলে সেই হাতের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। এক দু বার নয়, সু দীর্ঘ মুসলমান শাসনে এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে বহু বার।
৭১২ সালে মহম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু প্রদেশ আক্রমণ করেন এবং ওখানের হিন্দু রাজা দাহিরকে হত্যা করেন। তারপর রানীর নেতৃত্বে বহুদিন দুর্গ রক্ষা করলেও পরবর্তীতে দুর্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তখন রানীর নেতৃত্বে দুর্গের মহিলারা জহর’ পালনের পথ বেছে নেয় এবং পুরুষ গণ আমৃত্যু যুদ্ধ (সাকা) চালিয়ে যায়।
১২৩২ সালে সামস উদ্দিন ইলতুৎমিস গোয়ালিয়র (তৎকালীন রাজপুতানা অধীনস্ত) রাজ্য আক্রমণ করলে সেইখানের মহিলারা জহর’ পালনের পথ বেছে নেয়। আজও গোয়ালিয়র দুর্গে সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে জহর কুণ্ড।
১২৯৪ সালে আলাউদ্দিন খিলজি জয়সালমির দুর্গ আক্রমণ করলে পরাজয় নিশ্চিত বুঝে ২৪০০০ মহিলা জহর পালন করেন।
১৩০১ সালে আলাউদ্দিন খিলজি রাজপুতানার রণথাম্বর দুর্গ জয় করলে সেখানেও মহিলারা একই ভাবে আত্মাহুতি দেয়।
১৩০৩ সালে আলাউদ্দিন খিলজি চিতোর দুর্গ আক্রমণ করলে পদ্মাবতী সহ দুর্গের ১৬০০ রমণী রানী পদ্মাবতীর সাথে ‘জহর’ পালন করেন।
১৩২৭ সালে মহম্মদ বিন তুঘলক উত্তর কর্ণাটকের কাম্পি রাজ্য আক্রমণ করলে সেখানেও মহিলাদের একই ভাবে আগুনে ঝাঁপ দিতে হয়ে সম্ভ্রম রক্ষার্থে।
১৪শ শতকের শেষভাগে ফিরোজ শাহ তুঘলক জয়সালমির দুর্গ আক্রমণ ১৬০০০ মহিলা জহর পালন করেন এবং ১৭০০ রাজপুত যোদ্ধা পালন করেন সাকা।
১৪২৩ সালে মাণ্ডুর সুলতান হসেন শাহ রাজপুতানার গাগরাও দুর্গ আক্রমণ করলে হাজারের উপর মহিলা পালন করেন জহর।
১৫শ শতকে আমীর আলি জয়সালমির দুর্গ আক্রমণ করে। সময়াভাবে জহর কুণ্ডের ব্যবস্থা না করতে পারায় ওই দুর্গের মহিলারা স্বেছায় রাজা রাওয়াল লুনাকরনের হাতে মৃত্যু বরণ করেন।
১৫২৮ সালে মধ্যপ্রদেশের রাইসিনা রাজ্য মুঘল বাদশাহ বাবর আক্রমণ করে এবং যুদ্ধের ফলস্বরুপ রাণী চান্দেরির নেতৃত্বে মহিলারা আত্মাহুতি দেন।মধ্যপ্রদেশের রাইসিনা মুঘল বাদশাহ বাবরের বশ্যতা স্বীকার না করায় বার বার আক্রান্ত হয়। ১৫৩২ সালে সেখানে রাণী দুর্গাবতীর নেতৃত্বে ৭০০ মহিলা জহর পালন করেন এবং ১৫৪৩ সালে রাণী রত্নাবলীর নেতৃত্বে সেখানে তৃতীয় বারের মত জহর পালিত হয়।
১৫৩৫ সালে গুজরাটের বাহাদুর শাহ চিতোর দুর্গ আক্রমণ করে। তখন চিতোর এবং মেওয়ার ছিল রাণী কর্নাবতীর শাসনে। রাণী কর্নাবতী তৎকালীন মুঘল বাদশাহ হুমায়ূনকে রাখী পাঠিয়ে ভ্রাতৃত্বের আহবান জানান এবং ভাই এর কাছে সাহায্য প্রাথনা করেন। হুমায়ূনের বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য রাণী পরাস্ত হন এবং রানীর নেতৃত্বে মহিলারা দুর্গের মহিলারা জহর পালন করেন এবং পুরুষরা পালন করে সাকা।
১৫৬৭ সালে মুঘল বাদশাহ আকবর চিতোর দুর্গ আক্রমণ করে এবং ১৫৬৮ সালে সেই দুর্গ জয় করে। দুর্গ জয়ের পর আকবর দুর্গে প্রবেশ করে দেখে সেই দুর্গ পরিণত হয়েছে এক শ্মশান ভুমিতে।
১৬৩৪ সালে মুঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেব বুন্দেলখণ্ড দুর্গে আক্রমণ চালায়। দুর্গের রমণীগণ পরাজয়ের খবর পেয়েই আত্মাহুতি দেওয়া শুরু করেন। দুর্গ দখলের পর মুঘল সেনারা দুর্গে প্রবেশ করে যেই সকল মহিলাদের জীবিত অবস্থায় পায় তাদের জোরপূর্বক মুঘল হারেমে নিয়ে যাওয়া হয়। জীবিত সকল পুরুষকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। কেউ ধর্ম পরিবর্তনে অসম্মত হলে তাকে হত্যা করা হয়।
কিন্তু উল্টোদিকে আমরা যখন দেখি মারাঠা সাম্রাজ্য দ্বারা যখন মুঘলরা পরাস্ত হয়, এই রকম কোন পথ তাদের রমণীদের বেছে নিতে হয় না।
Satabdi Bhattacharya