সাহেব পাড়া থেকে একে একে মুছে গেছে কতকিছুই। ব্লু ফক্স, ফিরপো থেকে শুরু করে মিউজিক ওয়ার্ল্ড হয়ে প্রায় শতাব্দী প্রাচীন নিলাম ঘর ভিক্টর ব্রাদার্সও। পাততারি গুটিয়ে ক্লোজিং ডাউন সেলের বিজ্ঞাপন বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে তারাও। সেরকমই ভারতের সবথেকে পুরোনো হবি সেন্টার বা ছোটো বড়ো সকলের প্রায় সব পেয়েছির দেশ ইন্ডিয়া’স হবি সেন্টার (India’s Hobby Centre)-ও কার্যত ভ্যানিশ চোখের নিমেষেই। বিদেশের হোয়াট নট বিপণিগুলোর মতোনই, কলকাতার বুকে সেই ১৯৫৪ সাল থেকে পথ চলা শুরু এই হবি সেন্টার বা শখের সাম্রাজ্যের। আজ্ঞে হ্যাঁ, সাম্রাজ্যই বটে! সেই যে কথায় আছে ‘শখের রাজা বা রাজার শখ’ — যা ছিল আদতেই শখ পূরণের ম্যাজিক বাক্স। যার ভেতরে ঠাসা থাকতো হাজারো দেশি বিদেশি খেলনার পসরা, থরে থরে সাজানো নতুন ডাক টিকিট, স্ট্যাম্প, বিদেশি মুদ্রা, ফার্স্ট ডে কপির মণি মাণিক্য।
কলকাতা বাদেও হবি সেন্টারের অন্যান্য বিপণিগুলি ছিল মুম্বাই, দিল্লি, চেন্নাই এমনকি হায়দরাবাদেও। যদিও সেগুলির সবকটিই ঝাঁপ গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে বহু আগেই। প্রায় সত্তর বছরেরও বেশি বয়স পর্যন্ত টিকে ছিল কেবল এই একটিই। যা শিবরাত্রির সলতের মতোন টিমটিম করে জ্বলে থাকলেও মায়াবী ক্যালাইডিস্কোপিক রোশনাই জুগিয়ে চলছিল আমার আপনার মতো অনেকেরই ছোটোবেলার স্মৃতিতে।
সখের রাজা – রাজার সখ
হবি সেন্টার – আগে
কলকাতা বাদেও হবি সেন্টারের অন্যান্য বিপণিগুলি ছিল মুম্বাই, দিল্লি, চেন্নাই এমনকি হায়দরাবাদেও। যদিও সেগুলির সবকটিই ঝাঁপ গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে বহু আগেই। প্রায় সত্তর বছরেরও বেশি বয়স পর্যন্ত টিকে ছিল কেবল এই একটিই।
পার্কস্ট্রিট বা অধুনা মাদার টেরেসা সরণির বিখ্যাত কুইন্স ম্যানশন আর শতাব্দী প্রাচীন পানশালার গা ঘেঁষে উল্টোদিকে যে রাস্তা সোজা চলে গেছে আকাশচুম্বী দ্য ৪২ অবধি, সেটাই রাসেল স্ট্রিট। যে রাস্তার শুরুতেই ছিল ১-এ রাসেল স্ট্রিট, লাল পাটাতনের কাঠের বিজ্ঞাপনের হাতছানিতে বড়ো বড়ো করে কাঠ খোদাই ব্লকে লেখা ‘ইন্ডিয়া’স হবি সেন্টার’; কলকাতা তথা ভারতের সবচেয়ে পুরোনো খেলনার পসরা সাজানো ওয়ান্ডারল্যান্ড! পিক আপ স্টিক্স, বাগাডুলি, চাইনিজ চেকার, স্বচ্ছ রঙিন কাচের দাবা, পাজল গেম, পোস্টার, পোস্টকার্ড কী নেই সেখানে? শোকেস ঠাসা খেলনা। যেন এক খেলনাবাড়ি। যার অমোঘ আকর্ষণে বুঁদ ছোটো বড়ো সব্বাই। অবশ্য শুধুই খেলনা বললে ভুল বলা হবে। এই বিপণি যেন কার্যতই তামাম দুনিয়ার সঙ্গে তিলোত্তমা কলকাতার এক অদ্ভুত দোয়েল সাঁকো।
হবি সেন্টার – আগে
খাস বিলেত থেকে আমদানি করা মেকানো, হর্নবি কোম্পানির খেলনা গাড়ি, ডাই কাস্ট মডেলের ভক্সহলস, রোলস ডাইসমেলারস, ক্যাডিলাক্স, মরিস গ্যারেজ মিনিয়েচার গাড়ি শোভা পেত এই বিপণিতে। পরীক্ষা শেষে অন্তত একবার ঢুঁ মারবার নাছোড় বায়নায় হাজির হয়েছে কত ছোটোদের দল বাড়ির বড়োদের হাত ধরে। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের হাতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা আর চিনতে শেখা প্যাডেল গাড়ি, বিলেতি বালসা কাঠের এয়ারক্রাফট, তার মেশিনারি, কলকব্জার খুঁটিনাটি। হাতে পাওয়া প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা, তার সব কিছুরই সাক্ষী এই হবি সেন্টার। দেখলেই যে নিতে হবে, তেমন বাধ্যবাধকতা কোনো কালেই ছিল না এই সব পেয়েছির দেশে।
হবি সেন্টার – আগে
অধুনা আর্টিকুলেটেড খেলনা যা মূলত অ্যাকশন ফিগারিন নামে জনপ্রিয়, কলকাতাবাসীকে চিনতে শিখিয়েছে এই আশ্চর্য দোকানটিই। মাইকেল জ্যাকসন থেকে ব্রুসলি, আন্ডারটেকার থেকে ব্যাটম্যান, টিনটিন, কুট্টুস সব্বাই এক শোকেসের মধ্যে পাশাপাশি। এয়ার মডেলিং খেলনা এরোপ্লেন থেকে শুরু করে যা কার্যত রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে উড়াল দেওয়া যেত, বেহালা ফ্লাইং ক্লাউবের বার্ষিক আকাশ অভিযানেও যা অংশগ্রহণ করত হামেশাই এবং এর যাবতীয় কলকব্জা সারানোর একমাত্র ওয়ান স্টপ সল্যুশন এই হবি সেন্টারই। বালসা কাঠের তৈরি প্রমাণ সাইজের এরোপ্লেনের দেখা মিলতো এই কিছু মাস আগে অবধি। কিন্তু সব ভালো কিছুরই শেষের মতোন এই আশ্চর্য দুনিয়াও পিছিয়ে পড়তে শুরু করে বাজারে সস্তা চাইনিজ খেলনার দেদার রমরমার সময় থেকেই। সঙ্গে দোসর হয় ভারত সরকারের বলবৎ করা বৈদেশিক খেলনা আমদানির ওপর নির্ধারিত চড়া শুল্কের ব্যয়ভার।
এখনের ছোটোদের মোবাইল আসক্তিতে বুঁদ হয়ে থাকাও যেন অভিমানী করে তুলছিল প্যান্ডোরার ম্যাজিক বাক্সসম এই খেলনা বাড়িটিকে। এক সময়ের ম্যাজিক দুনিয়ার এই বিপণিতেও পুরু ধুলোর আস্তরন জমতে শুরু করে ডাইক্যাস্ট এম্বেসেডর মডেল, আর সি গাড়ির মডেল, এমনকি হাফ শতক পুরোনো অস্টিন যে ফোর্টির মতো ভিনটেজ এবং দুষ্প্রাপ্য খেলনা গাড়ির মডেলগুলোয়।
অধুনা আর্টিকুলেটেড খেলনা যা মূলত অ্যাকশন ফিগারিন নামে জনপ্রিয়, কলকাতাবাসীকে চিনতে শিখিয়েছে এই আশ্চর্য দোকানটিই। মাইকেল জ্যাকসন থেকে ব্রুসলি, আন্ডারটেকার থেকে ব্যাটম্যান, টিনটিন, কুট্টুস সব্বাই এক শোকেসের মধ্যে পাশাপাশি।
সাইনবোর্ড থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে হবি সেন্টারের নাম
অধুনা মালিকানার অংশীদারের সঙ্গে কথা বলে অভিমানী গলায় ঝরে পড়া ক্ষোভ জানান দিল, “এতো বড়ো জায়গা কতদিন আর এভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া যেত, বিক্রি তলানিতে ঠেকেছিল অনেকদিন, তাই বাধ্য হয়েই… তবে তিন তলায় কিছুদিন আমরা রয়েছি দেখা যাক…”
অস্থায়ী আস্তানায় বর্তমান হবি সেন্টার
বর্তমান পার্কিং স্পেস
রাসেল স্ট্রিটের যে সরু গলির মধ্যে দিয়ে ঢুকলে পৌঁছে যাওয়া যেত এক নতুন সব পেয়েছির দেশে, যার কাচের শোকেসে আলো করে থাকত টিনটিন, এস্টেরিক্স, ফিগারিন সেই গলির কার্যত হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া, যেন পেরেক ঠুকে জানান দেয় নস্টালজিয়াও হারায় বৈকি! কোথায় সেই পেল্লায় সব পেয়েছির দেশ আর তার মণিমাণিক্যের কিছুই নেই আর এক চিলতে লিজের ঘরে। এমনকি প্রায় ফি বছর ভিন্টেজ কার র্যালির অন্যতম আকর্ষণ মাইক্রো প্যাডেল কার, ১৯৩৫ সালের রাইট ক্র্যাফট স্কুটার ছাড়াও ডব্লু বি এম ৪৬২৮ এই ভিন্টেজ মোটর বাইকের কিছুই নেই (স্মলেস্ট ভিনটেজ কারের তকমা পাওয়া গাড়িগুলিও আর নেই) এক আধটা খেলনা এয়ার ক্রাফটের সঙ্গে পড়ে রয়েছে কিছু অবিক্রিত চেনা খেলনার কঙ্কাল। অভিমানী সুরেই হ্যামিলিনের বাঁশিতে হয়তো মিলিয়ে গেল সেই জাদুবাড়ি — ইন্ডিয়াস হবি সেন্টার।
©অরিজিৎ ভট্টাচার্য – বঙ্গদর্শন