৯ই নভেম্বর ২০১৯ সমগ্র সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক উজ্জ্বল দিন। দীর্ঘ কয়েক শতকের লড়াই এর পর আমরা অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ করার অনুমতি পেয়েছি। মহামান্য আদালতের এই রায়ের পেছনে সবথেকে বড় ভুমিকা যেই সংস্থা পালন করেছে সেটি হল Archeological Survey of India (ASI)। ১৭৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা এত গুলো বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে, তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে এবং হারিয়ে যাওয়া বহু ঐতিহাসিক স্থানকে আমাদের সামনে তুলে ধরতে।
ASI এর প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার কানিংঘাম অযোধ্যায় প্রথমবারের মত জরিপ করেন। এবং উনি ফা হিয়েন দ্বারা বর্ণিত সা-চি, হুয়েনসাঙ্গ দ্বারা বর্ণিত বিশাখ এবং হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের লিপিতে নথিভুক্ত সাকেত শহরকেই অযোধ্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন।
পরবর্তীতে অধ্যাপক বি.বি.লাল তার প্রত্নতাত্তিক গবেষকদের দল নিয়ে এই রাম মন্দির এবং রামায়ণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অনেক গবেষণা করেন। উনার এই দলে ছিল পাঁচজন প্রত্নতাত্তিক ডঃ কে.পি.নটিয়াল, এস.কে.শ্রীবাস্তব, আর.কে.চতুর্বেদী এবং কে.এস.আস্থানা। ASI এর পক্ষ থেকে মহাদেব এন কাট্টি, এল এম ওয়াহাল এবং এম এস মানি। উত্তরপ্রদেশ সরকার প্রত্নতাত্তিক বিভাগের পক্ষ থেকে ছিলেন হেমরাজ। আরও ছিলেন ASI-এর পক্ষ থেকে ১২ জন ছাত্র। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কে.কে.মহম্মদ, যিনি পরবর্তীকালে ASI-এর বিভাগীয় প্রধান পদে উন্নীত হন । অধ্যাপক বি.বি.লাল তার এই সুদীর্ঘ গবেষণা চালিয়েছেন নিম্নলিখিত স্থান গুলোতেও,
১. অযোধ্যা
২. শ্রীঙ্গাভেরপু- শ্রীরামচন্দ্র যেখান থেকে গঙ্গা পার হয়ে দক্ষিণ ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
৩. ভরদ্বাজ ঋষির আশ্রম
৪. চিত্রকুট- যাত্রাপথে যেখানে শ্রীরামচন্দ্র বিশ্রাম নিয়েছিলেন
৫ . বিথুর- যেখানে বাল্মীকি মুনি থাকতেন
৬ . পারিহার- যেখান থেকে রাবণ সীতা কে হরণ করে
গবেষণার মাধ্যমে অনেক রকম প্রমাণ পাওয়া যায়, যা অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের স্থানে আসলে এক পুরনো মন্দিরের অস্তিত্ব কেই প্রমাণ করে বলে সর্বপ্রথম বি.বি.লাল একটি প্রবন্ধে জানান। পরবর্তীতে কে.কে.মহম্মদ নিজেও এই প্রমানের সত্যতা প্রকাশ করেন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তনী কে.কে.মহম্মদ ২০১৮ সালে একটি আত্মজীবনী মুলক বই প্রকাশ করেন মালায়ালম ভাষায়। যার ইংরাজি অনুবাদের নাম হল “I am Indian” এবং এই বইতে তিনি নিজের প্রত্নতাত্তিক গবেষণা এবং কিছু বাস্তব পরিস্থিতির কথা লেখেন।
জন্মসূত্রে কেরালার বাসিন্দা কে.কে.মহম্মদ ১৯৭৫ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর হন এবং ১৯৭৬ সালে ASI তে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা পড়াকালীন এই রাম মন্দির সংক্রান্ত কাজটির সাথে যুক্ত হন। সেই সময় উনিই ছিলেন ওই কাজের এক মাত্র মুসলমান সদস্য। মূলত কয়েকটি অকাট্য প্রত্নতাত্তিক প্রমাণের ভিত্তি তেই কে.কে.মহম্মদ অযোধ্যায় রাম মন্দিরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল,
১. স্তম্ভ- বাবরী মসজিদটি পূর্বতন রাম মন্দিরের ১২টি স্তম্ভের উপরেই নির্মিত। খননকালে আরও পাওয়া যায় মন্দির গর্ভে রাখা পূর্ণ কলস এবং মন্দিরে অষ্ট মঙ্গলা চিহ্ন।
KODANDA RAMA HIREMAGALUR-KARNATAKA – This is the only temple depicting Lord Rama carrying the Kodanda bow (Shiva’s bow).
২. টেরাকোটার স্থাপত্য- বাবরী মসজিদে বহু টেরাকোটার স্থাপত্য পাওয়া যায়, যাতে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর অবয়ব চিত্রিত আছে। কে.কে.মহম্মদ দাবী করেন “মসজিদে কক্ষনোই এই ধরণের স্থাপত্য থাকা সম্ভব নয়, কারণ এগুলো ইসলাম বিরোধী।”
৩. পরবর্তী খননে আরও ৫০ টি স্তম্ভ পাওয়া যায় যেগুলো ১২শ শতকের মন্দিরের কারুকার্যের অনুরুপ।
৪. মন্দিরের ভেতরে গঙ্গা স্নানের চিহ্ন কুমীরের উপস্থিতি, খনন কালে উদ্ধার হওয়া দ্বিখন্দিত বিষ্ণু হরি শিলা ফলক ইত্যাদি ওখানে রাম মন্দিরের অস্তিত্ব কেই প্রমাণ করে।
এই বইতে কে.কে.মহম্মদ লিখেছেন এই গবেষণায় অংশ নেয়ায় এবং রাম মন্দিরের অস্তিত্ব কে স্বীকার করার জন্য উনাকে চূড়ান্ত হেনস্থার বলি হতে হয়েছে। কে.কে.মহম্মদ মনে করেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে মক্কা-মদিনার গুরুত্ব যতখানি একজন ধর্মপ্রাণ সনাতনীর কাছেও ঠিক ততটাই গুরুত্ব রাখে অযোধ্যার রাম জন্মভুমি। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিজে থেকেই উচিত এই মসজিদের দাবী ছেড়ে দেওয়া। কে.কে.মহম্মদ মূলত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কসবাদী দের কাছে উনার সত্য কথার জন্য অপছন্দের পাত্র হয়ে ওঠেন। এরা উনার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপর মহলে চাপ দিতেও পিছপা হয়না।
এমনকি ডঃ ইরফান হাবিব নামের এক অধ্যাপক এমনও দাবী করেন যে কে.কে.মহম্মদ নাকি অযোধ্যার গবেষণা কাজে যুক্তই ছিলেন না। ২০১৯ সালে কোর্টে যখন রাম মন্দির সংক্রান্ত শুনানি চলছিল তখন এই মার্কসবাদীরাই এই ঘটনাকে কেন্দ করে ধর্মীয় রাজনীতির চেষ্টা করে বলে জানান কে.কে.মহম্মদ। ২০১৯ সালে ভারত সরকার এই গুণী প্রত্নতাত্তিককে পদ্মশ্রী পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানায়।
শতাব্দী ভট্টাচার্য্য