১। চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা
২। হিমশৈলের চূড়া
৩। কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন
৪. ধর্ম যখন উপলক্ষ্য
৫। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা
৬। ইতিহাসবিদ বনাম ইতিহাস
৭। নভেম্বর-৯ ইতিহাস পরিবর্তন করবে
৮। শিল্যান্যাস থেকে “বার্লিনের পাঁচিল” পর্যন্ত
৯। রাম-জন্মভূমি মন্দির সংক্রান্ত মুসলিম বিবৃতি
১০। বোবা সাক্ষী কথা বলুক
উপসংহার
১৯৯০ সালে ভয়েস অফ ইণ্ডিয়া এই বইটি প্রকাশ করে। হিন্দুত্ববুক্সের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই বইটি পাঠকদের সামনে নিয়ে আসল বঙ্গদেশ। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা সরকার।
আগের পর্ব [১] – [২]- [৩] – [৪]
পঞ্চম অধ্যায় : সত্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা
রাম স্বরূপ
চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা নিবন্ধটি (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯-তে প্রকাশিত) লক্ষ্যণীয়ভাবেই কিছুটা আলাদা। এটি এমন একটি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছে যা নিয়ে আলোচনা কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। এই নিবন্ধটিতে এমন কিছু খোলামেলা কথা বলা হয়েছে যা ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিরল। তেমনিভাবে, তাঁর “হিমশৈলের চূড়া” এবং “ধর্ম যখন উপলক্ষ” (ফেব্রুয়ারি ৯ ও মে ২১) প্রবন্ধগুলিতে সীতারাম গোয়েল এক বিস্তারিত গবেষণালব্ধ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপিত করেছেন এবং এটিকে বৃহত্তর ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণে আলোচনা করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে, প্রতিমাবিধ্বংসী মনোভাব (আইকনোক্ল্যাজম) এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের মন্দিরগুলিকে ধ্বংস করা “উদ্যোগী কিন্তু বিভ্রান্ত শাসকে”র বিচ্যুতি বা ভ্রষ্ট আচরণ নয়—এগুলি ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্রীয় অঙ্গ। তারা তাদের ন্যায্যতা এবং বৈধতা কুরআন এবং নবীর সুন্নাহ বা অনুশীলন থেকে পেয়ে থাকে। যদিও অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এইগুলির সর্বদা প্রয়োগ করা যায় না, তবে এগুলি সম্পাদনের অত্যাবশ্যকতা ইসলামী ধর্মতত্ত্ব দ্বারাই নির্ধারিত।
আদি ইসলাম
নবীর সময়েই এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁর ইশারাতেই ‘অন্যান্য বিশ্বাসের’ মন্দির ও মূর্তিগুলি ধ্বংস করা শুরু হয়। নবীর প্রথম ধার্মিক জীবনী সীরাত-উন-নবী বর্ণনা করেছে : কীভাবে ইসলামের প্রথম দিকের যুগে, মদিনার যুবকরা, ইসলামী শিক্ষার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, প্রতি রাতে একটি বাড়িতে বারবার প্রবেশ করত এবং সেখানে রাখা প্রতিমা বহন করে প্রতিদিন আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিতো। তবে মক্কা বিজয়ের পরে এই ধ্বংসলীলা ব্যাপক আকার ধারণ করে। কাবার মূর্তিগুলি ধ্বংসের জন্য আলীকে বেছে নেওয়া হয়, কথিত আছে তিনি এই কাজটি নবীর কাঁধে চেপে করেছিলেন। দেয়ালের ছবি নষ্ট করার জন্য ওমরকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তারিখ-ই-তাবারি থেকে জানা যায়, অভিযানকারী দলগুলিকে সমস্ত জায়গায় পাঠানো হতো – আল-মানাত, আল-লাত এবং আল-উজ্জার চিত্রসহ বিভিন্ন উপজাতির দ্বারা বিশেষ উপাসনা করা দেব-দেবীদের চিত্র ধ্বংস করার জন্য। তারা তথাকথিত শয়তানী ধর্মতত্ত্বগুলিকে (“স্যাটানিক ভার্সেস”) নষ্ট করে দিত।
সাদ-কে আউস ও খাজরাজ উপজাতির দেবতা আল-মানাতের ধর্মস্থান ধ্বংস করতে প্রেরণ করা হয়েছিল।
আল-লাত ধর্মস্থানে আক্রমণ করা হলে এর ভক্তরা প্রতিরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা নিজেদের অতিশয় দুর্বল উপলব্ধি করায় আত্মসমর্পণ করে মুসলমান হয়ে যান। মহিলা-উপাসকরা কেঁদেছিলেন, যখন তাঁরা দেখলেন যে লোকেরা কীভাবে তাদের দেবতাকে ধ্বংস করেছে; কেউ তাঁকে রক্ষা করতে যথেষ্ট আগ্রহ দেখায়নি। অনুরূপভাবে, নবী খালিদকে নাখলাতে আল-উজ্জার মূর্তিটি ধ্বংস করতে পাঠিয়েছিলেন, যা কিনান ও নাদের উপজাতির দ্বারা উপাসিত হত। ভীত বিশ্বাসীগণ মূর্তিটিকেই এটির আত্মরক্ষার জন্য রেখে পালিয়ে যায়। তারা প্রার্থনা করে:
হে উজ্জা! খালিদের উপর ধ্বংসাত্মক আক্রমণ করুন,
হে উজ্জা! আপনি যদি খালিদকে হত্যা না করেন
তবে দ্রুত শাস্তি সহ্য করুন বা খ্রিস্টান হন।
খ্রিস্টান কেন? শব্দটি “মুসলিম” হওয়া উচিত ছিল। দেখে মনে হয় যে, ইসলামের প্রথম দিকের যুগে মানুষ খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের একে অপরের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতো। উভয়েরই একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, উভয়ই জোর করে ধর্মান্তরিত করতো এবং উভয়ই অন্যের উপাসনাগৃহ ধ্বংস করতো।
সেমেটিক প্রকাশ
(সেমিটিক ভাষাগুলি হল হিব্রু এবং আরবী)
আসল বিষয়টি হল আত্ম-আবিষ্কারের ব্যাপারটি শুধুমাত্র ইসলামের সঙ্গে যুক্ত নয়। এটির উল্লেখ প্রাচীন ‘ইহুদি আত্ম-আবিষ্কারের’ মধ্যেও পাওয়া যায় যা থেকে খ্রিস্টধর্ম উদ্ভূত। দুটি উদ্ঘাটন কিছু বিবরণে পৃথক হলেও তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মিল রয়েছে। উভয়ের ঈশ্বর একচেটিয়া আনুগত্য দাবি করেন এবং আনুগত্যের বিভাজন বিষয়ে একেবারেই সহনশীল নন। তিনি আদেশ দেন যে তাঁর অনুসারীরা যেন অন্য কোনও ঈশ্বরের উপাসনা না করে। তিনি লোকদের কাছ থেকে এইরূপ কঠিন উপাসনা দাবি করলেও তিনি সরাসরি তাদের কাছে নিজেকে পরিচিত করেন না। বিপরীতে, তিনি পছন্দসই একজন মানুষের বা একটি বিশেষ অবতারের মাধ্যমে অপ্রত্যক্ষভাবে তাদের কাছে তাঁর ইচ্ছাটি জানান।
এই ঈশ্বর অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্যের ঈশ্বর থেকে অনেকটাই আলাদা। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু রীতিতে ঈশ্বর একচেটিয়া নন। তিনি অন্যান্য ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধুত্বের জীবনযাপন করেন। “অন্যান্য ঈশ্বর তাঁরই বিভিন্ন প্রকাশ“ এই নীতিতে তার কোনও অনমনীয় রূপ নেই এবং এটিকে বিভিন্নভাবে ধারণা করা যায় : বহু, এক, একাকী ইত্যাদি। তিনি কোনও একক প্রিয় মধ্যস্থতাকেও স্বীকৃতি দেননি। যারা তাঁকে ভক্তি ও প্রজ্ঞা দিয়ে ডাকেন তিনি তাঁদের কাছে যান, তাঁদের সকলের কাছেই নিজেকে প্রকাশ করেন। এখানে কোনও “সেমেটিক প্রোটোকল” পাওয়া যায়নি। হিন্দু ঐতিহ্যও পূজার সম্পূর্ণ স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়। প্রত্যেকেরই নিজস্ব উপায়ে তাঁর ঈশ্বরের উপাসনা করার অধিকার আছে এবং প্রত্যেক ঈশ্বর তাঁর নিজস্ব ভক্তদের উপাসনারও অধিকারী। এই স্বাধীনতা মানুষের এবং ঈশ্বরের উভয়ে পক্ষেই। এই নীতির ভিত্তিতেই প্রাথমিক খ্রিস্টানরা তাদের উপাসনার স্বাধীনতা উপভোগ করেছিল।
নির্বাচিত মানুষ
কোনও ‘ঈর্ষাপূর্ণ ঈশ্বরে’র মুদ্রার অন্য দিকটি হল ‘বেছে নেওয়া মানুষ’ বা বেছে নেওয়া একটি বিশেষ ধর্মস্থান। নির্বাচিত ঈশ্বরের একটি নির্বাচিত মানুষ রয়েছে (এমনকি তাঁর নির্বাচিত শত্রুও রয়েছে)। তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, দুজনেই একে অপরের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়তা করে।
তাদের ঈশ্বর যেমন তাদেরকে প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করে, তেমনি বিশ্বাসীরা তাদের ঈশ্বরকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী-ঈশ্বরের সঙ্গে লড়াইয়ে সহায়তা করে।
বিশ্বাসী মানুষেরা ছোট-বড় বিভিন্ন কাজে ঈশ্বরের সাহায্য প্রার্থনা করে। সেরকম ঈশ্বর তাঁর বৃহত্তর গৌরব অর্জনের জন্য, তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং পৃথিবীতে তাঁর আধিপত্য বিস্তার করতে তাঁর বিশ্বাসী-মানুষদের উপর নির্ভরশীল। সংক্ষেপে, এভাবে বিশ্বাসী মানুষেরা ঈশ্ববের যোদ্ধা, বিক্রয়কর্মী, সাক্ষী এবং তাঁর জন্য প্রাণ দিতে সক্ষম (শহীদ) হয়ে ওঠে। তাদের শুধুমাত্র তাদের অবিশ্বাসী প্রতিবেশীদের সঙ্গেই নয়, প্রতিবেশীদের দেবতাদের সঙ্গেও লড়াই করতে হয়। কারণ এই ঈশ্বরগুলি কেবল তাদের “শত্রুদের ঈশ্বর”ই নয়, তারা তাদের “ঈশ্বরের শত্রু”ও বটে – যা ততোধিক খারাপ। বিশ্বাসী মানুষগণ তাদের এই ঈশ্বরদত্ত কাজটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। মুসলিম রীতিনীতি বিষয়ক একটি শ্রেষ্ঠ বই, হেডায়া (গাইডেন্স), নবীকে উদ্ধৃত করে লিখেছে: “আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আজ্ঞাপ্রাপ্ত যতক্ষণ না তারা (অবিশ্বাসীরা) স্বীকার করবে যে: “আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই।”’
পার্থিব পুরস্কার
এটি সব সময় ঈশ্বর এবং তাঁর গৌরবসংক্রান্ত বিষয় নয়। এই উদ্যোগের একটি ব্যবহারিক দিকও রয়েছে। ক্রুসেডাররা তাঁদের পার্থিব পুরষ্কারও লাভ করেন। তাঁরা তাঁদের ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব স্থাপনের প্রক্রিয়াটিকে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রসারিত করার জন্যও ব্যবহার করে। একটি ধার্মিক ঐতিহ্য ঘোষণা করে যে: “পৃথিবী আল্লাহ্ এবং তাঁর নবীর অন্তর্গত”। অতএব, অনিবার্য উপসংহারটি হল যে কাফেররা (অবিশ্বাসী অর্থাৎ অন্য-মতে বিশ্বাসীরা) কেবল বিচ্ছিন্নতাবাদী। এগুলির নিষ্পত্তি করা উচিত এবং ভূমি তার সত্যিকার মালিকদের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।
বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের একটি হুজুগ হল সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলিতে জোর দেওয়া এবং এর ধর্মতাত্ত্বিক উপাদানটিকে অবহেলা করা। তবে ইতিহাস দেখায় যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যবাদী অভিপ্রায়গুলির মধ্যে ধর্মতাত্ত্বিক উদ্দেশ্যটি সবচেয়ে শক্তিশালী। এ জাতীয় সাম্রাজ্যবাদ বিবেক ছাড়াই টিকে থাকতে পারে, অথবা বলা যায় তারা তাদের সক্রিয় বিবেকবুদ্ধির সাহায্যেই এই সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে সমর্থন করে। বিশ্বাসের শক্তি সমস্ত সম্ভাব্য সন্দেহ এবং আত্ম-সমালোচনাকে সহজেই হত্যা করতে পারে।
‘চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি মৌলনা আবুল-হাসান আলী নদভীর একটি কাজের বিস্তারিত বিবরণ প্রস্তুত করেছে। মৌলনা আবুল-হাসান “হিন্দুস্থান আন্ডার ইসলামিক রুল” শীর্ষক বইটির একটি সম্পূর্ণ মুখবন্ধ রচনা করেন। তাতে তাঁর মতামতগুলি বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে “সাদা-মানুষদের স্বঘোষিত সভ্য পৃথিবী সৃষ্টির দায়িত্বের বোঝাটিও” অযৌক্তিকতার মানদণ্ডে “ইসলামের সারা পৃথিবীকে এক ঈশ্বর (আল্লাহ) এবং তার নবীদের রাজ্য বানানোর এই দাবির” ধারেকাছেও আসে না।
প্রতিমাবিধ্বংসী মনোভাব
একেশ্বরবাদ হিসাবে বর্ণিত সেমেটিক “নিজ ঈশ্বরবাদে”র (মাই-গডিজম) আরও একটি মাত্রা রয়েছে: প্রতিমাবিধ্বংসী মনোভাব। আসলে, দুটি একই মুদ্রার দুটি দিক মাত্র। সেমেটিক ঈশ্বরের উপাসকরা যখন প্রথমে তাঁদের প্রতিবেশীদের সংস্পর্শে আসেন, তখন তাঁরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেননি যে তাঁরা কোনটিকে বেশি ঘৃণা করেন, প্রতিবেশীদের ঈশ্বরকে নাকি সেই ঈশ্বরের মূর্তিকে। বাস্তবে তাঁরা এই দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনো প্রভেদও করেনি এবং দুটি বিষয়ের বিরুদ্ধে সমানভাবে বৈরিতা ঘোষণা করেছিলেন।
ইহুদিদের ঈশ্বর তাঁর উপাসকদের আদেশ দিয়েছেন যে: তারা যখন তাদের শত্রুদের দেশে প্রবেশ করবে, তখন তারা “তাদের বেদীগুলি ধ্বংস করবে, তাদের মূর্তিগুলি ভেঙে ফেলবে, তাদের উপাসনা-উদ্যানগুলো কেটে ফেলবে এবং তাদের সমাধির চিত্রগুলি আগুনে পোড়াবে” (বাইবেল, দেউ ৭.৫)। সম্ভবত ইহুদী প্রকাশিত বাক্যটি কেবল প্রতিশ্রুতিপ্রাপ্ত ভূখণ্ডের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার জন্য; কিন্তু যখন খ্রিস্টান এবং যথাযথভাবে ইসলাম সেই একই নিয়মকে সগর্বে নিজেদের ধর্মতত্ত্বে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, তখন তা স্বাভাবিকভাবেই একটি বিশ্বজনীন রূপ নেয়। যেখানেই এই দুই ধর্মের লোকেরা গিয়েছিল, সেখানেই ধর্মস্থান-ধ্বংস করা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্ম নিজের একটি ভিন্ন চেহারা উপস্থাপন করেছে বলে মনে হয়; তবে এই ধর্ম যখন প্রসারের শিখরে ছিল তখন এটি ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতে, উত্তর ইউরোপে, এশিয়া এবং দুটি আমেরিকাতে অদম্য পুঙ্খানুপুঙ্খতা এবং নিখুঁত আত্মতৃপ্তির সঙ্গে পৌত্তলিকদের মন্দির ধ্বংস করেছিল। আমেরিকা আবিষ্কারের সময়, কলম্বাসের সঙ্গে আসা বেনেডিক্টীয় সন্ন্যাসীরা একাই হাইতিতে একক হাতে ১৭০,০০০ চিত্র ধ্বংস করার কথা সগর্বে ব্যক্ত করেছিলেন। মেক্সিকোর প্রথম বিশপ জুয়ান ডি জুম্মারেজ, ১৫৩১ সালের প্রথম দিকে লেখেন, যে তিনি বিধর্মীদের ৫০০টা মন্দির এবং ২০,০০০ মূর্তি ধ্বংস করেছিলেন। আমাদের নিজের দেশে, গোয়ায় জেসুইট ফাদাররা বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন।
ইসলামও তাই করেছিল। এটি যেখানেই গেছে, আগুন ও তরোয়াল বহন করেছে এবং বিজিত মানুষের মন্দিরগুলি ধ্বংস করেছে। গোয়েল এর মধ্যে কয়েকটি নথিভুক্ত করেছেন তবে তিনি নিজেই যেমন বলেছেন যে এগুলি কেবল একটি হিমশৈলের চূড়ামাত্র।
ইসলামের ধর্মীয় নীতি
‘একেশ্বরবাদে’র মতো সেমীয় প্রতিমাবিধ্বংসী মনোভাবও মূলত একটি প্রভুত্বস্থাপনকারী ধারণা। কোনও সাম্রাজ্যবাদ ততক্ষণ পর্যন্ত সুরক্ষিত নয় যতক্ষণ না এটি ‘বিজিত মানুষের’ গর্ব, সংস্কৃতি এবং বীরত্বকে ধ্বংস করতে পারছে। যে লোকেরা তাদের ধর্মকে, তাদের ঈশ্বর এবং তাদের পুরোহিতদের উচ্চ মর্যাদায় ধরে রাখে, তাদের থেকে একটা বিদ্রোহের ভয় থেকেই যায়।
ইসলাম এটি জানত এবং এজন্যই এটি ধর্মীয় আধিপত্যের একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব তৈরি করেছিল। মন্দিরগুলি তাদের সঞ্চিত সম্পদের জন্য ধ্বংস করা হয়নি, যেমনটা মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকরা প্রচার করে থাকেন। হিন্দুরা কেনই বা তাদের ব্যক্তিগত ধন-সম্পদ মন্দিরের মধ্যে জমিয়ে রাখতে যাবে, এইরকম আচরণের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ ও যুক্তিসঙ্গত কারণ কোনোটাই খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং যুদ্ধ জয়ের পরে বিজয়ীদের অতি উৎসাহের কারণে মন্দিরগুলি আক্রমণ বা ধ্বংস করা হয়নি। আসলে মুসলিম আমলের শান্তিপূর্ণ সময়েও এই কাজগুলি খুব সাধারণ ও বহুল প্রচলিত ছিল। এটি নিপীড়নের নীতির একটি উদ্দেশ্য ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে দমিয়ে রাখা এবং তাদেরকে সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে নিরস্ত্র করা, তাদের আত্মমর্যাদাকে ধ্বংস করা এবং তাদের মনে করিয়ে দেওয়া যে তারা ‘জিম্মি’ (একটি নিকৃষ্ট জাত)। এই নীতি অনুসারে, জিম্মিদের নাগরিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা স্বীকার করতে বাধ্য করা হত। তারা (জিম্মিরা) শুধুমাত্র গোপনে তাদের নিজস্ব ধর্মচারণ করতে পারতো এবং তাদের অ-মুসলমান থাকবার জন্য ‘জিজিয়া’ নামক একটি অবমাননাজনক কর দিতে হত। বিশেষত নগরগুলিতে অনেক বিধিনিষেধ ছিল। মুসলিম আইনে (হিদায়া) এ কথা পাওয়া যায় যে: নগরগুলিতে ইসলামের ধর্মাচরণের উপাদানগুলি (যেমন সর্বসাধারণের প্রার্থনা, উৎসব ইত্যাদি) প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই জিম্মিদের সেখানে “বিধর্মীয় রীতিনীতি” উদ্যাপন করার অনুমতি দেওয়া হত না। এর মধ্যে কয়েকটি বিধিনিষেধ যেমন গোষ্ঠীগত প্রার্থনা, হিন্দু মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা মুসলিম আমলের দীর্ঘদিন পরেও অব্যাহত ছিল। আসলে সেগুলি মুসলিম আমলের একটি দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্য হিসাবে জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে গিয়েছিলো। একইভাবে আরেকটি আইন ছিল যে কাফেররা পুরানো মন্দিরগুলি মেরামত করতে পারবে, কিন্তু নতুন মন্দির তৈরি করার অনুমতি পাবে না। সম্ভবত এই কারণেই দিল্লিতে ১১৯২ সালের পর থেকে নির্মিত কোনও উপযুক্ত হিন্দু মন্দিরের নিদর্শন নেই। মহাত্মা গান্ধী দ্বারা ১৯৩৮ সালে উদ্বোধিত “লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরটি” হল প্রায় সাত শতাধিক বছর পরে নির্মিত প্রথম হিন্দু মন্দির!
কোনো সহজ সমাধান নেই
পূর্বোক্ত আলোচনাটি থেকে দেখা যায় যে সমস্যাটি অযোধ্যার রাম জন্মভূমি মন্দির বা মথুরার কৃষ্ণ মন্দির বা বারাণসীর বিশ্বেশ্বর মন্দিরের নয়। আরো গভীরে, সমস্যাটি আগ্রাসী ধর্মতত্ত্ব এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা ইতিহাসের আগ্রাসী ঐতিহ্য তৈরি করেছিল। এমন বিশাল মাত্রায় সমস্যাটির যে কোনো সহজ সমাধান নেই তা বলাই বাহুল্য। একটি সাধারণ পরিস্থিতিতে, একজন মানুষ যখন তার আবেগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে কোনো কাজ করে তখন তার যুক্তি এবং বিবেকের কাছে আবেদন করা যায়। তবে এই ক্ষেত্রে, যখন ইসলামী ধর্মতত্ত্ব এবং তার ঐতিহাসিক অনুশীলন আগ্রাসী লক্ষ্যগুলি অনুমোদন করে, তখন এই বিকল্পটি খুঁজে পাওয়া যায় না। তবুও আমাদের অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে, আগ্রাসনের উত্তর হিসাবে আগ্রাসন কখনওই ফলপ্রসূ হতে পারে না। আমাদের বুঝতে হবে যে সমস্যাটা মুসলিমদের নিয়ে নয়, এর জন্য ইসলামিক ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতএব, এই ধর্মতত্ত্বটির আরও সমালোচনামূলক অধ্যয়ন প্রয়োজন, এখন পর্যন্ত যা করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশী। “দৈববাণী থেকে সৃষ্টি হওয়া ধর্ম” তার ঈশ্বর, তার নবী ও তাদের শিক্ষা, ধর্মের অনুগ্রহপ্রাপ্ত প্রচারক, ধর্মের একেশ্বরবাদ ও তার ভিত্তিতে মানুষের দুটি দলে বিভাজন (বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী), তাদের নবীবাদ, তাদের ধর্মান্তকরণ ও ধর্মযুদ্ধ সংক্রান্ত ঐশ্বরিক আবেদন, এই বিষয়গুলিতে আমাদের অবশ্যই আরো বেশি করে আলোকপাত করতে হবে।
এটি এমন একটি সত্যানুসন্ধানকারী কাজ যাতে সৃজনশীল পরিশ্রমের প্রয়োজন। আবদ্ধ ধর্মগুলি গভীর আধ্যাত্মিকতা এবং গভীর মানবতা উভয়ের জন্যই ভয়ের এবং তাদের কিছু ‘গ্লাসনস্ট’ বা “মুক্ততা এবং স্বাধীনতা” প্রয়োজন। একটি বিস্তৃত আলোচনা তাদের উন্মোচিত হতে সহায়তা করবে। এই কার্যক্রমে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, এবং এটি তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত। এটি মুসলমানদের মধ্যে তাদের মৌলিক বিষয় পুনর্বিবেচনা করার একটি নতুন প্রক্রিয়াও শুরু করতে পারে, যেটি আজ অবধি পরিচিত মৌলবাদ থেকে সরে গিয়ে অন্য একটি সত্য মৌলিকত্বের রূপ নিতে পারে।
এটি হিন্দু-বৌদ্ধ চিন্তাবিদদের উপর তাদের ‘যোগ’ সংক্রান্ত ঐতিহ্যের বিষয়টিকে আরো বেশি করে তুলে ধরার একটা দায়িত্ব আরোপ করে। এই বিষয়টিতে ভারতীয় ‘যোগ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। আমাদের বলা হয় যে “দৈববাণীগুলি ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে”। কিন্তু অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে, উদ্ঘাটন এবং ঈশ্বর এই দুই মানুষের নিজস্ব মন বা আত্মা থেকে জন্ম নেয়, যোগ এমনটাই শেখায়।
এর বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নরকম বিশুদ্ধতা রয়েছে, প্রতিটি স্তর একেকটি ঈশ্বর-মূর্তির মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়। সমস্ত ভগবান ও সমস্ত প্রকাশ একই রকম পবিত্র নয়। এমনকি কিছু ঈশ্বর-মূর্তির মধ্যে দিয়ে যে ভাবধারা সমর্থিত হয় যেগুলি যথেষ্ট বিতর্কিত। এই উপসংহারটি অনেক হিন্দু পণ্ডিতদের হতাশ করতে পারে যাঁরা “সমস্ত ধর্ম একই” এবং “সমস্ত নবী একই কথা প্রচার করেন” বলে থাকেন। তবে তাঁদের অবশ্যই সমস্যাগুলির মুখোমুখি হতে হবে। ঐক্যের সমন্বয় করার সময়, তাদের অবশ্যই পার্থক্যগুলি সনাক্ত করতে শিখতে হবে যেখানে পার্থক্যগুলি বাস্তব।
সবশেষে, আমরা আবারও চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা নিবন্ধে ফিরে যাই যা আমাদের “ফাঁকি দেওয়া এবং আড়াল করা” এবং “সত্যের মুখোমুখি হওয়ার” প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। তবে দুঃখজনক সত্যটি হল: সত্যের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য, এবং ফাঁকি দেওয়ার জন্য আমরা একটি বিস্তৃত ‘গোপনীয়’ ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছি যা কেবল “গোপনীয় সাম্প্রদায়িকতাকেই” রক্ষা করে না, তা “গোপনীয় সাম্রাজ্যবাদে”র আরও দুষ্ট শক্তি যেমন “গোপনীয় ধর্মতত্ত্ব”কেও রক্ষা করে যা মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্ককে বিকৃত করে। এটিকে গভীরতর স্তরে বোঝা এবং এর অতীত এবং পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৮ জুন, ১৯৮৯