১.৭ মিশ্র সংস্কৃতি : একটি কিংবদন্তি
‘মিশ্র ভারতীয় সংস্কৃতি‘-র সম্মিলিত চিন্তাধারাও সমভাবে কাল্পনিক। বস্তুত আসল কথা হল, ভারতের জাতীয় সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু সংস্কৃতিই। এর পাশাপাশি অন্যান্য সংস্কৃতির কিছু অবশিষ্টাংশ বিদেশী শত্রু ও শাসকের মাধ্যমে আমাদের দেশে রয়ে গেছে। একই ভাবে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশেই আগ্রাসী শক্তি তাদের সংস্কৃতির ছাপ রেখে গেছে। তার মানে এই নয় যে কোনো জাতীয় সংস্কৃতির বিনাশ ঘটেছে অথবা কোনো ‘মিশ্র’ সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে। অপরপক্ষে, আগ্রাসী সংস্কৃতি সর্বদাই শত্রুর সংস্কৃতি অথবা পরজীবী সংস্কৃতির আখ্যা পেয়েছে। এই সংস্কৃতির সমূলে বিনাশ ঘটিয়ে নিজ সংস্কৃতিকে যথাসম্ভব দূষণ মুক্ত করতে সমস্ত রাষ্ট্র সর্বদাই সচেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বুলগেরিয়ায় অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনকালে তুর্কিরা দীর্ঘ চার শতক ধরে নিজেদের সংস্কৃতি বুলগেরিয়ার উপর আরোপ করে এবং বলপূর্বক বহু বুলগেরিয়ান জনসাধারণকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। কিন্তু বুলগেরিয়ানরা কখনোই নিজেদের সংস্কৃতিকে ‘মিশ্র‘ হিসেবে গণ্য করেনি বরং স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী কালে জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে ইসলামীয় সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে এমনকি তারা মানুষদের ইসলামীয় নাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকার আদেশ জারি করে। ৫০০ বছর ধরে মুসলিমরা স্পেনে নিজেদের শাসন বজায় রাখে এবং সেখানে ইসলামীয় সংস্কৃতি আরোপ করে। কিন্তু স্পেনীয়রা যখন রিকনকোয়েস্তার শিবির চলাকালীন তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, তখন তারা অত্যন্ত যত্ন সহকারে মুরিশ ( অথবা ইসলামীয়) সংস্কৃতির শেষ চিহ্নটুকুও তাদের দেশ থেকে মুছে দিয়েছিল। তারা নিজেদের সংস্কৃতিকে ‘মিশ্র‘ সংস্কৃতি বলে মনে করেনি এমন কি তারা তাদের নিজস্ব ভূমিতে ইসলাম ধর্মের পালনও নিষিদ্ধ করে দেয়।
ভারতবর্ষে মিশ্র সংস্কৃতির ধারণা প্রচারের প্রধান উদ্দেশ্য খুবই সহজ – আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হিসেবে, নিজস্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ইসলামীয় সংস্কৃতিকে (এবং কিছু ক্ষেত্রে খ্রিস্টান ধর্মকে) গ্রহণ করা উচিত। বাস্তবের চিত্রটা একেবারেই বিপরীত। সহস্র বছরের সহাবস্থানের পরেও, হিন্দু এবং ইসলামীয় সংস্কৃতি যে কেবল সমান্তরাল সংস্কৃতি, তা নয়, উপরন্তু প্রত্যেক সম্ভাব্য বিষয়ে তারা দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়েছে। গঠনগত কিংবা আধ্যাত্মিক বিষয়ে হোক, নীতি অথবা চর্চার ক্ষেত্রে বা শ্রেষ্ঠত্ব অথবা নগণ্যতার প্রশ্নে হোক – প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই দুই সংস্কৃতি তেল ও জলের ন্যায় অবিমিশ্রিত থেকে গেছে। বর্বর আক্রমণকারীদের মাধ্যমে এদেশে ইসলামের আনয়ন ঘটে এবং সহস্র বছর ধরে তারা নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় হিন্দু সংস্কৃতির বিলোপ সাধনের চেষ্টা করে চলেছিল। অতঃপর, এটি আমাদের জন্য শত্রুর সংস্কৃতি বা পরজীবী সংস্কৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
এটাও একটা অপ্রিয় সত্য যে, এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান; তাদের ভিত্তি ও তত্ত্বগুলি পরস্পরের এতই বিরোধী, যে অদূর ভবিষ্যতেও এরা কখনোই ‘মিশ্র সংস্কৃতি’–র আখ্যা লাভ করবে না।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে, বিশ্বে এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যারা অপর কোনো দেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেনি এবং যেখানে বিদেশী সংস্কৃতির নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু এটি কখনোই জাতীয় সংস্কৃতির চরিত্র ও উপাদানকে ধ্বংস করে না। ভারতবর্ষে, বহু মুসলিম হিন্দু সঙ্গীতকে সাদরে গ্রহণ করেছে অথবা মুসলিম শাসকেরা এদেশে চিহ্নস্বরূপ বহু সৌধ রেখে গেছেন এবং সহজাত ধার্মিক উদারতা বহু হিন্দুকে মুসলমান ফকিরদের সমাধিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে অনুপ্রাণিত করে তুলেছে – এই সমস্ত বিষয় আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে একেবারেই মিশ্র সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করতে পারে না। তবুও আমরা এর নামেই আজও আমাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ চালিয়ে যাচ্ছি।
১.৮ মিশ্র সংস্কৃতি : ইসলামীয় চিন্তাধারা
এই চিন্তাধারাতেও কোনো প্রকার নতুনত্ব নেই। অষ্টাদশ শতকের পর থেকে ভারতীয় মুসলমান ধর্মজ্ঞানীদের মতামতের দিকে একবার দৃকপাত করুন। অষ্টাদশ শতকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ, উনবিংশ শতকে শরীয়তুল্লাহ, সৈয়দ আহমেদ বারেলভী, আব্দুল আজিজ, তিতুমীর প্রমুখ এবং বিশ শতকে মহম্মদ ইকবাল, মৌলানা মৌদুদী এবং অন্যান্যরা তাই বলেছেন যা আজ আমি বলছি। এই সকল প্রণম্য ব্যক্তিরা কখনোই স্বীকার করেননি যে ভারতের হিন্দু এবং মুসলিমরা একত্রে এক মিশ্র সংস্কৃতির সৃষ্টি করতে পারে অথবা আমাদের সংস্কৃতি একটি মিশ্র সংস্কৃতি। তাঁরা সকলেই এ বিষয়টিতে জোর দিয়েছিলেন যে ভারতবর্ষের মুসলমানদের একটি পৃথক জাতিসত্তা (qaum, awām) ও সংস্কৃতি আছে। খোলাখুলিভাবে আপনাদের জানিয়ে রাখি, আমি যদি মুসলমান হতাম, তাহলে আমিও কখনোই মানতাম না যে আমার জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি আপনার জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি অভিন্ন। কারণ, কোরান স্বয়ং এই চিন্তাধারাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। কোরান অনুসারে, মুসলমানরা নিজেরাই একটি আলাদা জাতি গঠন করেছে, যা উম্মা নামে পরিচিত। কোনো ব্যক্তি যিনি কুফরে বিশ্বাসী, তিনি কখনো উম্মার অংশ নন। ইসলামের চোখে কাফির, যারা কুফর এর অনুগামী, তারা দুইভাগে বিভক্ত – জিম্মি এবং মুর্শিক। ইহুদি এবং খ্রীষ্টানরা হলেন যারা কিতাবী (অর্থাৎ যাদের প্রকাশিত বই আছে ), তারা জিম্মি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ইসলামিক রাষ্ট্রে এরা পোল–ট্যাক্স (জিজিয়া কর) প্রদান করে এবং সামাজিক জীবন পরিত্যাগ করে বসবাস করতে পারেন। বেঁচে থাকতে দেওয়ার দাক্ষিণ্যের পরিবর্তে তাদের ওপর কুড়িটি অপমানজনক শর্ত বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই শর্তের মাধ্যমে তারা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু অন্তত জিম্মিদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু কেড়ে নেয়া হয়নি। কিন্তু মুশরিকরা অর্থাৎ যাঁরা মূর্তিপূজা করতেন, তাঁদের ইসলাম ধর্মগ্রহণ অথবা মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না।
কোরানের মতে, আমরা হিন্দুরা এই মুশরিকের অন্তর্ভুক্ত, যাদের এই পবিত্র বই বাঁচার অধিকার দেয় না। কোরান তার অনুগামীদের এই কাফেরদের সঙ্গে নাগরিকের সমানাধিকার নিয়ে কোনো দেশেই শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার অধিকার প্রদান করেনা। মুশরিকদের জন্য কোরানে কেবলমাত্র দুটি উপায় ছিল – হয় তারা ইসলামে ধর্মান্তরিত হবে, নয়তো তাদের পুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা হবে এবং নারী, শিশু ও সমস্ত সম্পত্তি অধিকার বলে লুন্ঠিত হবে। কোরানানুসারে, আমাদের ভূমি হল জাহিল্লিয়াহ অর্থাৎ অন্ধকারের দেশ। যতদিন না ইসলাম পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততদিন এটি জাহিল্লিয়াহ হিসেবেই গণ্য হবে। মুসলমানরা বিশ্বাস করে কোরান মূলত আল্লারই কথা, এবং কোরানের অনুগামী হিসেবে তাদের বিশ্বাসের কোনোরূপ স্বাধীনতা নেই যে ইতিহাসের বর্তমান পর্যায়ে যখন ভারতবর্ষ প্রধানত হিন্দু দ্বারা অধ্যুষিত, তখনও তারা ভারত রাষ্ট্রেরই অংশ।
হাদিস আরো স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে যে যদি মুসলমানরা জাহিল্লিয়ায় বসবাস করতে বাধ্য হয়, তবে তাদের প্রধান কর্তব্য হবে যুদ্ধ ঘোষণা করা এবং কাফেরদের হত্যা করে দেশ জয়ের মাধ্যমে সেই স্থানে ইসলামের প্রতিষ্ঠা করা। যদি বর্তমান সময়ে জয় করা অসম্ভব হয়, তাহলে মুসলমানদের উচিত সেই সময়কে কাজে লাগিয়ে তাদের শক্তিবর্ধন করা। যদি কোনোভাবে এটিও অর্জন করা অসম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে মুসলিমদের সেই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া উচিত। এই দেশান্তরণ হিজরা নামে পরিচিত। সুতরাং হাদিস মুসলমানদের বলে, “যদি প্রয়োজন পড়ে হিজরা পালন কর, কিন্তু কখনোই মুশরিক রাষ্ট্রের অংশ হয়ে উঠো না“। যদি কোনো মুসলিম নিজেকে আপনার এবং আমার সঙ্গে সাম্যের ভিত্তিতে এই রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে তার এরূপ করার কারণ সে কোরান ও হাদিসকে অন্তর থেকে প্রত্যাখ্যান করেছে, ইসলাম এর সারবত্তাকে চূর্ণ–বিচূর্ণ করেছে এবং একজন প্রকৃত মুসলিমের জন্য প্রণীত মূল নীতি থেকে পথভ্রষ্ট হয়েছে।
সুতরাং হিন্দু ও মুসলমানের সমন্বয়ে এক মিশ্র রাষ্ট্রের ধারণা অত্যন্ত অন্তঃসারশূন্য ও মিথ্যা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ১৯৪৭ সাল থেকে এই মিথ্যা জাতীয়তাবাদের চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে চলে আসছে। এই প্রাথমিক মিথ্যাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এখানকার আধিকারিককে অন্যান্য প্রায় সমস্ত বিষয়েই মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছে। বহুসংখ্যক বাংলাদেশী মুসলমানেরা আসাম, বাংলা, বিহার এবং দেশের অন্যান্য স্থানে অনুপ্রবেশ করছে কিন্তু আপনি কিছুতেই বলতে পারবেন না যে এই অনুপ্রবেশকারীরা মুসলমান। কাশ্মীরে মুসলিমরা প্রকাশ্যে সরাসরিভাবে জেহাদ শুরু করে এবং উপত্যকাজুড়ে সমস্ত হিন্দুদের ওপর নিষ্ঠুর স্বৈরাচার চালাতে থাকে কিন্তু আপনি কাশ্মীরের এই দ্বন্দ্বকে কিছুতেই সাম্প্রদায়িক বলতে পারবেন না – আপনাকে বলতে হবে এটা কাশ্মীরীয়ত লাভের জন্য যুদ্ধ ! মুসলিমরা কলকাতা ও বম্বেতে ধ্বংসাত্মক বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়, কিন্তু আপনাকে বলতে হবে যে এটি পাকিস্তানিদের অথবা অন্ধকার জগতের হস্তশিল্প। মুসলমানরা প্রায়ই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাতে থাকে। আপনাকে বলতে হবে ” দুটি গোষ্ঠীর লোকের মধ্যে “সংঘর্ষ” ঘটেছে এবং কে এই হত্যাকাণ্ডের সূচনা করছে, তা আপনাকে এড়িয়ে যেতে হবে। মুসলমানরা মন্দির জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু আপনাকে বলতে হবে “কোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠীর প্রার্থনাস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে “। অন্যান্যদের তুলনায় মুসলমানদের প্রজনন হার অপেক্ষাকৃত বেশি। কিন্তু আপনাকে এই সহজ স্বীকারোক্তি উপেক্ষা করতে হবে।
আমার মনে হয়, বর্তমানে আমাদের জাতীয় দুর্বলতা এবং সমস্যা মূলত এই দুষ্কর্মের ফলেই উদ্ভুত। জাতীয়তাবাদের যে কৃত্রিম দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে আমাদের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত তা প্রকৃত জাতীয়তাবাদের থেকে অনেকাংশে আলাদা। এই বৈপরীত্যের অন্তিম পরিণতিস্বরূপ দেশে জাতীয় অনুপ্রেরণার বিলোপ ঘটে। ১৯৪৭ এর পরবর্তীকালীন সময়ের ভারতের কোনো হিন্দুর পক্ষে নিজেকে এই কাল্পনিক রাষ্ট্র যার জন্য এই সমগ্র শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, তার অংশ হিসেবে ভাবা অত্যন্ত দুরূহ।
ভারত রাষ্ট্র যে ‘মিশ্র’ জাতীয় সত্তা সকলের সম্মুখে উপস্থাপন করে, সেই ব্যক্তি এই কাল্পনিক কৃত্রিম রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেকে আবেগগত দিক থেকে সংযুক্ত করতে পারে না। এরূপে জাতি ও রাষ্ট্র, এবং জাতীয় সমাজ ও শাসক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায় এক মহাসমুদ্র দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই ব্যবধানই জাতীয় সমাজের অনৈক্য, গণসচেতনতা ও সংবেদনশীলতার অভাব ও সমাজের বিবেকের যাবতীয় অবক্ষয়ের কারণ। এই শূন্যস্থানের ফলে স্বার্থপরতা, দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয় খুব শীঘ্রই বৃদ্ধিলাভ করেছে। জাতীয় সমাজ রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে এবং আমাদের জাতি বেশ কিছু অদৃশ্য সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকে।
১.৯ মিথ্যা চিন্তাধারার প্রচলন
দুৰ্ভাগ্যবশত, এই নেহরুবাদী মিথ্যা চিন্তাধারা আজ সমগ্র শাসক শ্রেণীর মনে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এই ভৌগোলিক রাষ্ট্রের ধারণা আমাদের শিক্ষিত সমাজ, আমাদের রাজনীতিবিদ, সংবাদপত্রের সম্পাদকদের মনে বদ্ধমূল ভাবে গেঁথে আছে। ৫০ বছর ধরে এর ভয়ঙ্কর
প্রচারের ফলে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যেখানে বর্তমান শিক্ষিত সম্প্রদায় মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে হিন্দুরা কেবলই এক ধার্মিক সম্প্রদায় এবং যাঁরা হিন্দুদের হয়ে কথা বলে তাঁরা একটিমাত্র সম্প্রদায়ের কথাই বলে, অতঃপর তাঁরা সাম্প্রদায়িক। যা আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে জাতীয়তাবাদ, তা তাঁদের কাছে সাম্প্রদায়িকতা। তাঁরা নেহরুবাদী বিষাক্ত চিন্তাধারায় এতই নিমগ্ন যে জাতীয়তাবাদের বিকল্প ধারণাটি তাঁদের মনে গভীরভাবে গেঁথে গেছে এবং সত্যি বলতে কি তাঁরা আমার মতো মানুষজনকে ‘সাম্প্রদায়িক‘ হিসেবে গণ্য করে।
বর্তমান পরিস্থিতি এমনই শোচনীয় যে স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারাকেও বর্তমানে নেহরুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়। স্বামীজির বার্তার এক বিকৃত রূপ এমন ভাবে উপস্থাপিত করা হয় যাতে মনে হয় রাষ্ট্র সম্পর্কে স্বামীজি ও পরবর্তীকালে আগত নেহরুর চিন্তাধারা প্রায় একই। স্বামীজির বক্তব্য এমনভাবে প্রচারিত হয় যে, যে কেউ ভাবতে পারেন, স্বামীজি সেই সেই কথাই বলেছেন যা পরর্তীকালে নেহরু বলেছেন। বাস্তবে নেহরুর বক্তব্যকেই স্বামীজির বক্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
বাস্তবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্বামী বিবেকানন্দের সমস্ত লেখনীতে হিন্দুধর্ম, হিন্দুরাষ্ট্র, হিন্দুবর্ণ এবং ভারত – এই চারটি শব্দ সমার্থক এবং পরস্পর আন্তঃ–বিনিময়যোগ্য। বহু জায়গায় স্বামীজি ‘হিন্দু‘ ও ‘ভারত‘ এই দুটি শব্দকে একই অর্থে একই বাক্যে ব্যবহার করেছেন। এই বিষয়ের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি কি স্বামীজী রচিত ‘বর্তমান ভারত‘ এর একটি বিখ্যাত অনুচ্ছেদ পেশ করতে পারি? এতে স্বামীজি লিখেছেন :
“ হে ভারত! ভুলো না তোমার নারীত্বের আদর্শ হলেন সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী; ভুলোনা তোমার উপাস্য সর্বত্যাগী উমানাথ শঙ্কর; ভুলোনা, তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের—নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নয়; ভুলো না—তুমি জন্ম থেকেই ‘মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত; ভুলো না—তোমার সমাজ সে বিরাট মহামায়ার ছায়ামাত্র; ভুলো না— নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই! হে বীর, সাহস অবলম্বন কর; সদৰ্পে বল—
আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল—মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই; তুমিও কটিমাত্ৰ–বস্ত্রাবৃত হয়ে, সদৰ্পে বল —ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই—ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বৰ্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ; আর বল দিন–রাত, ‘হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর। ’
এই বার্তায় স্বামীজী ‘ভারত‘ শব্দের অবতারণা করেছেন পাঁচবার এবং ‘ভারতবাসী‘ শব্দের অবতারণা করেছেন আটবার; কিন্তু দয়া করে লক্ষ্য করুন কাদের উদ্দেশ্যে তিনি এই কথাগুলি বলছেন। “তোমার নারীত্বের আদর্শ হল সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী “, কিন্তু সেই নারীরা কারা যারা সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী কে নিজের আদর্শ হিসেবে মনে করে? কোন সে ভারতবর্ষ? তারা নেহরুবাদী অলীক চিন্তাধারার ভারতবাসী নয়, কেবলমাত্র হিন্দু নারী। যখন স্বামীজি বলেন “তোমার উপাস্য ঈশ্বর উমানাথ শঙ্কর “তিনি কেবল হিন্দুদের কথাই বলছেন। যখন তিনি বলেন ” তুমি জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত ” – তখন তিনি কি কোনো মুসলমান বা খ্রিস্টানের কথা বলছেন যারা মায়ের জন্য বলিপ্রদানের বিষয়টির সম্পূর্ণরূপে বিরোধী ? তিনি বলেন নীচ, অজ্ঞ, দরিদ্র, মুচি, মেথর তোমার ভাই; তিনি বলেননি হিন্দু এবং মুসলমান, তিনি বলছেন মুচি ও মেথর। তিনি স্পষ্টতই কেবল হিন্দু সমাজের দুটি দুর্বল ও অসহায় অংশের কথা বলেছেন। “ব্রাহ্মণ ভারতবাসী ও নীচ ভারতবাসী “- এই বক্তব্যে তিনি, হিন্দু সমাজের দুই প্রান্তে থাকা ব্রাহ্মণ ও অন্তঃজ শ্রেণীর মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন। কোন জাতি ভারতের দেবদেবী কে নিজের ঈশ্বর হিসেবে গ্রহণ করবে? ভারতের সমাজকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন যে তা ” আমার পবিত্র স্বর্গ, আমার বার্ধক্যের বারাণসী “। কিন্তু প্রশ্ন হল সেই ব্যক্তিরা কারা যাদের কাছে বারাণসী পবিত্রতম স্থান ? সেই ব্যক্তিরা কারা যারা মনে করে “ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ” এবং জাহিল্ল্যাহ বা দার–উল–হারব নয়? সেই ভারতীয়রা কারা যারা গৌরীনাথ ও জগদম্বার উদ্দেশ্যে নিজের প্রার্থনা জানায়?
স্বামীজির বার্তার প্রত্যেকটি শব্দ হিন্দু ব্যতীত আর কারোর উদ্দেশ্যে ছিল না। কিন্তু তিনি “ভারত” ও ” ভারতবাসী ” এই দুটি শব্দের ব্যবহার করেছেন কারণ তাঁর মতে হিন্দু, ভারত ও ভারতবাসী এই শব্দগুলি সমার্থক। বর্তমান সময়ে আপনি বিভিন্ন বড় বড় হোর্ডিং–এর বিজ্ঞাপনগুলিতে লক্ষ্য করবেন, “সদৰ্পে বল—‘আমি ভারতবাসী আর সকল ভারতবাসী আমার ভাই’– স্বামী বিবেকানন্দ”
যে প্রসঙ্গে তাঁর কথাগুলি এরকম খণ্ডিতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, স্বামীজি যে অর্থে “ভারতবাসী” কথাটি ব্যবহার করেছেন, ঠিক সেই একই অর্থে পরবর্তীতে নেহরুও ব্যবহার করেছেন – এই ভ্রান্ত ধারণাটি প্রচারে উদ্দেশ্যেই এই কাজ করা। আর এই ভ্রান্ত ধারণাটিকে অর্থাৎ সামান্য ভৌগোলিকগত ভাবে ভারতীয় – এই ধারণাটিকে দেশীয় গণমাধ্যম ১৯৪৭ সাল থেকে একনাগাড়ে প্রচার করে আসছে। রামকৃষ্ণ মিশনকে এই বিষয়ে আমি অনেক চিঠি লিখেছি যে কেন তাঁরা স্বামীজির বার্তাকে বিকৃত করে তাঁর মুখে নেহরুর কথা বসিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু আমি কোনো সদুত্তর পাইনি। নেহেরুর জাতীয়তাবাদী চিন্তা বর্তমানে স্বামীজির নামে প্রচারিত হচ্ছে, যেখানে স্বামীজির রাষ্ট্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে আমাদের মতো লোকেরা যারা হিন্দু জাতির কথা বলে তারাও দেখা যায় গোপনে অন্তত আংশিক ভাবে হলেও ধর্মনিরপেক্ষ ধারণা পোষণ করে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা আজকের মতই বিভিন্ন সভা সম্মেলনে হিন্দু রাষ্ট্র সম্পর্কে কথা বলে থাকি, কিন্তু যখন বহির্জগতে আমরা নিজেদের হিন্দু হিসেবে পরিচয় দান করিনা। যখনই আমাদের নিজেদের জাতীয়তাবাদ চিহ্নিত করার প্রশ্ন আসে তখনই আমরা নিজেদেরকে ভারতীয় হিসেবে উপস্থাপিত করি। আপনাদের মধ্যে বহু ব্যক্তিই বহু সময়ে হোটেলে রাত্রিবাস করেছেন। সেখানে অতিথি পরিচায়ক বিবরণীতে আপনাদের নাম, ঠিকানা এবং জাতিগত পরিচয় উল্লেখ করতে হয়। এক্ষেত্রে যদি আমার ধারণা যদি সঠিক হয়, তাহলে আপনারা প্রত্যেকেই ‘ জাতি ‘ নামাঙ্কিত স্তম্ভে নিজেদের ‘ ভারতীয় ‘ হিসেবেই উল্লেখ করেন, হিন্দু হিসেবে নয়। অনুগ্রহপূর্বক বলুন, এখানে এমন কি কেউ আছেন যিনি নিজেকে জাতিগতভাবে হিন্দু হিসেবে উল্লেখ করেন? তাই এক্ষেত্রে বলা যায় ‘ ভারতীয়‘ শব্দটির যে চিরাচরিত অর্থটি নেহরু তৈরি করেছিলেন, তা এখনো একই আছে – যদিও সেটি নিতান্তই একটি কাল্পনিক জাতীয়তাবাদের ধারণা মাত্র। যখন আমরা নিজেদের ভারতীয় বলে ঘোষণা করি, তখন স্বভাবতই আমাদেরও ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাতেই ব্যাখ্যা করা হবে।
সম্প্রতি আমার একটি নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার প্রয়োজন হয়েছিল । তাই এর উপযুক্ত আবেদনপত্রে আমি জাতি–র স্তম্ভে ‘হিন্দু‘ লিখেছিলাম । ব্যাংকের মুখ্য আধিকারিক সে বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেন যে উক্ত স্থানে ‘ জাতি ‘ উল্লেখ করতে বলা হয়েছে, ধর্ম নয়। আমি তাঁকে বলি যে আমার জাতিগত পরিচয়ই হিন্দু। তখন তিনি বলেন যে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক (RBI) এর নিয়মানুসারে তিনি আমার আবেদন পত্রটি গ্রহণ করতে পারবেন না। আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, “ এটি খুবই খারাপ। আমার জানা নেই যে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক এর নিয়মাবলীতে ঠিক কী উল্লেখ করা আছে। কিন্তু আমি একজন হিন্দু এবং আমার জাতিগত পরিচয় হিসেবে আমি হিন্দু ছাড়া আর কোনো কিছুই বলতে পারব না। আমি কোনোভাবেই রিজার্ভ ব্যাংক এর বাধ্যতামূলক নিয়মাবলীর জন্য আমার পরিচয় পরিবর্তন করতে পারব না। যদি আপনি এই কারণে আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না খুলতে পারেন তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমি অ্যাকাউন্ট খুলব না। কিন্তু আমি আমার জাতিগত পরিচয় হিসেবে হিন্দুকেই গণ্য করি এবং এ বিষয়ে আমি কোনোভাবেই আপোষ করতে রাজি নই”। যাই হোক, মুখ্য আধিকারিক সবকিছুর পরেও আমার অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
যদি প্রকৃত অর্থেই আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা হিন্দুরা একটি জাতি, তাহলে নেহরুর মিশ্র জাতির এই অলীক কল্পনার প্রতি আনুগত্যকে আমাদের অবিলম্বে অস্বীকার করা উচিত। আপনাকে বিমানের অবতরণ কার্ডে ক্ষেত্রে নিজের জাতিগত পরিচয় লিখতে হয়। কিন্তু সম্ভবত আপনি সেখানেও ‘হিন্দু’ হিসেবে নিজের পরিচয় দেন, ‘ভারতীয়’ পরিচয় দেন না। আর কিছু যদি না করা যায়, তবে অন্ততপক্ষে কি আমরা অবিলম্বে হোটেল, আন্তর্জাতিক উড়ান, ছাত্রদের স্কুল–কলেজে ভর্তির আবেদনপত্র, চাকরির বিভিন্ন আবেদনপত্র ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এবং আরো অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজেদের জাতীয়তাবাদ হিসেবে হিন্দুকে ঘোষণা করতে পারি না?
১.১০ ‘হিন্দু’ শব্দের ভৌগোলিক ধারণা
কিছু কিছু ব্যক্তি হিন্দুস্তান এ বসবাসকারী সকল ব্যক্তিকেই হিন্দু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন। এই ধারণার সূত্রপাত হয়েছিল মূলত ১৮৮৪ সালে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান এর হাত ধরে এবং এটি সর্ব্বৈব ভুল ও বিভ্রান্তিকর। এটি হিন্দুদের একটি সাংস্কৃতিক–জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর পরিবর্তে কেবল একটি ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখার অপচেষ্টামাত্র। এই ধারণা অনুযায়ী ‘ হিন্দু ‘ কথাটির তাৎপর্য ও নেহরুর ‘ভারতীয়‘ ধারণাটির তাৎপর্য একই। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, আবদুল্লাহ বুখারী, সৈয়দ শাহাবুদ্দিন এবং ইব্রাহিম মেনন এর ন্যায় ব্যক্তিবর্গও ‘হিন্দু‘ হিসেবে পরিচিত হবেন। কিন্তু এমন ধারণা শুধুমাত্র অদ্ভুত নয় বরং তা হিন্দুত্বের ক্ষেত্রেও চরম অবমাননাকর। আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে হিন্দুত্বের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল সনাতন ধর্ম। শুধুমাত্র এই মহান ও গৌরবময় আধ্যাত্মিক প্রথাকে যাঁরা অনুসরণ করতে পারে, তা তাঁরা এর অগণিত শাখার মধ্যে কেউ যাকেই অনুসরণ করুন না কেন, তাঁরাই প্রকৃত হিন্দু, অন্য কেউ নয়। খুব সম্ভবত প্রাচীনকালে কিছু বিদেশী আমাদের দেশকে ‘হিন্দ‘ এবং আমাদেরকে ‘হিন্দু‘ বলে উল্লেখ করেছিলেন কিন্তু তৎকালীন সময়ে এই নামটিও সনাতন ধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছিল। পরবরতীকালে যখন আমরা নিজেদের এই নাম গ্রহণ করলাম আমাদের জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির পরিচায়ক হিসেবে, তখন থেকেই আমরা নিজেদের ‘হিন্দু‘ হিসেবে গর্ববোধ করতে শুরু করি। বহু শতাব্দী ধরে আমরা আমাদের হিন্দুত্বকে রক্ষণ ও সংরক্ষণের জন্য বহু যুদ্ধ করেছি, একাধিক বৃহৎ স্বার্থত্যাগ করেছি এবং হিন্দু হিসেবে পরিচিতি ধরে রাখার জন্য অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছি। সুতরাং আমাদের নিজেদেরই হিন্দু শব্দটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দিয়ে তাকে শুধুমাত্র ভৌগোলিক অর্থ দান করার ছলনা থেকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
১.১১ সংখ্যালঘুর ধারণা
এই বিষয়ে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিভাবেই আপনারর মনে আসবে যে যদি হিন্দুরা নিজেদের একটি জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে, তাহলে এই দেশে বসবাসকারী মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের স্থান কী হবে ? তারা কি রাষ্ট্রের অংশ নয়? কিছু ব্যক্তি এমনও প্রশ্ন ও উত্থাপন করেন যে তাহলে আমরা কি তাদের কে দেশ থেকে দূর করে দেবো ? এখানে এই প্রশ্নের খুব সহজ উত্তর হলো, একটি রাষ্ট্রের অংশ ও একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার মধ্যে একটি সহজ পার্থক্য আছে। একজন ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে সেই রাষ্ট্রের অংশ নাও হতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিটি যথাযথ ভাবে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত হন। এটিই মূলত সংখ্যালঘুর সঠিক ধারণা। ভারতবর্ষ হিন্দু জাতির মাতৃভূমি। তাই এখানে বসবাসকারী যাঁরা নিজেদের সনাতন ধর্ম থেকে পৃথক করে নিয়েছেন, তাঁরা কোনোভাবেই আর এই রাষ্ট্রের অংশ নন, তাঁরা সংখ্যালঘু। তাঁরা হয়ত এই দেশের নাগরিকত্ব পান ও নাগরিক অধিকার ভোগ করেন, কিন্তু তাঁরা এদেশের জাতীয় জনতার মর্যাদা পাবেন না, তাঁরা সংখ্যালঘু হিসেবেই থেকে যাবেন।
সমগ্র বিশ্বে যে কোনো একটি দেশের বসবাসকারী জনগণকে এই দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে – জাতীয় জনতা ও সংখ্যালঘু। ভারতেই একমাত্র একটি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে দুটি শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে – একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অপরটি সংখ্যালঘু। আসলে যখন ঐতিহাসিক বা ভৌগোলিক কারণে একটি রাষ্ট্রের বেঁচে থাকার জন্য বিভাজন এর প্রয়োজনীয়তা আসে অথবা যখন নিজের মাতৃভূমি অন্য রাষ্ট্রের দ্বারা অধিকৃত হয়ে থাকে, তখন সেই অংশের জনগণকে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত করা হয়ে থাকে। কয়েকটি উদাহরণ এই ধারণাকে আরো ভালো ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। চীন দেশে যে সমস্ত তিব্বতীরা আছেন যারা ভাষাগত, ধর্মীয় ও জাতিগত দিক থেকে চাইনিজদের থেকে পৃথক এবং যারা হান সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত – তারা মূলত সংখ্যালঘু হিসেবেই পরিচিত। বাংলাদেশেও হিন্দুদের যাদের কেবল ধর্মীয় দিক থেকে পৃথক হিসেবে ধরা যায়, তারাও সংখ্যালঘু। কানাডায়ও কিউবেকের ফরাসিভাষী ব্যক্তিবর্গও সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য করা হয়। বুলগেরিয়া প্রদেশ মুসলিম–তুর্কি সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি যারা ধর্ম, জাতি ও ভাষাগত দিক দিয়ে বুলগেরিয়ানদের থেকে ভিন্ন, তাদের সংখ্যালঘু আখ্যা দিয়েছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেও কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের বর্ণবৈষম্যের কারণে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রকৃত অর্থে এই সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রধান মাপকাঠি হিসেবে একদিকে যেমন ধর্মকে নেওয়া হয়, তেমনি ভাষা, বর্ণ এবং কোনো ক্ষেত্রে এই দুটির সম্মিলিত কারণ বা অন্য কোনো কারণও বিবেচিত হয়। এটা এমন কেন হবে? এর মূল কারণ হলো একটা নির্দিষ্ট অংশের জনগণের রাষ্ট্রের অংশ হয়ে উঠতে না পারা, যার কারণে একটি স্বাতন্ত্র্য সূচিত হয়েছে এবং এটি তাদের মূল জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় বাধা দিচ্ছে, আবার কোনো ক্ষেত্রে এটি তাদের জাতীয় মনোভাব ব্যক্ত করতেও বাধাদান করছে – আর তাদের এই পৃথকীকরণের বিষয়টি সেই দেশে তাদের সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিতকরণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
কোনও রাষ্ট্রের সকল বাসিন্দাদের সর্বদা তাদের নিজস্ব জন্মভূমিতে বাস করা অপরিহার্য নয়। সনাতন ধর্মের ভারতীয় অনুগামীরা হিন্দু রাষ্ট্রের অঙ্গ। তাঁদের অনেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন, গ্রিন কার্ড পেয়েছেন এবং সেই দেশের নাগরিক হয়েছেন, তবে তাঁরা এখনও হিন্দু রাষ্ট্রের সদস্য এবং যতদিন না তাঁরা সনাতন ধর্ম এবং ভারতবর্ষের মাটির সাথে তাঁদের টান হারিয়ে ফেলেন ততদিন তাঁরা থাকবেনও। অনেক তিব্বতী ভারতে বসবাস করছেন তবে তাঁরা তিব্বতের নাগরিক হিসাবে রয়ে গেছেন। ইহুদিরা ভারতে বা আর্জেন্টিনায় বসতি স্থাপন করতে পারেন, তবে তাঁরা এখনও ইহুদি রাষ্ট্রের অংশ হয়েই আছেন।
১.১২ মুসলিম এবং খ্রিস্টান: সংখ্যালঘু না নাগরিক
এই পটভূমিটি মাথায় রেখে ভারতের মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মনে রাখা দরকার যে তারা আমাদের নিজের লোক। কয়েক বছর আগেও তারা আমাদের জাতির অংশ ছিল। কিন্তু বিদেশী শাসকদের অত্যাচার ও প্ররোচনা তাদেরকে একটি বিদেশী সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল এবং সময়ের সাথে সাথে তারা নিজের পৈতৃক সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতার মনোভাব গড়ে তুলতে থাকে। তাদের ও আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র প্রাচীর হল এই এলিয়েন সংস্কৃতি। ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের এই বাধাটি ধ্বংস করা হলে ভারতীয় মুসলমান এবং ভারতীয় খ্রিস্টানদের আমাদের থেকে আলাদা করার মতো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
আমাদের দেশের সংখ্যালঘু এবং তাদের গৃহীত বিদেশী সংস্কৃতির মধ্যে সম্পর্কটি হল রোগের সাথে রোগীর সম্পর্ক। আমরা আমাদের পরিবারের কোনো অসুস্থ সদস্যকে আমাদের শত্রু হিসাবে বিবেচনা করি না বরং আমরা তার রোগ নিরাময় করার চেষ্টা করি যাতে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আগের মতো সুখে–স্বাচ্ছন্দ্যে ও মিলেমিশে জীবনযাপন করতে পারেন। ড্রাগ ও মাদকাসক্ত ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্কের দ্বারা এই সম্পর্কের আরও যথোপযুক্ত তুলনা টানা যায়। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার প্রিয় ড্রাগের সাথে এমন তীব্র টান তৈরী করেন যে এটি তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় জিনিস হয়ে যায়। এটি ছাড়া তিনি তার জীবন কল্পনাও করতে পারেন না। তবে আমরা জানি এই ড্রাগ কতটা মারাত্মক বিষ। তাই এই মাদকাসক্তির ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে আমাদের আত্মীয়–স্বজনদের রক্ষা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
সুতরাং, ভারতীয় কোনো মুসলমান ও খ্রিস্টানদের প্রতি আমাদের কোনো শত্রুতা রাখা উচিত নয়। আমাদের শত্রুতা, আমাদের লড়াই সেই বিষাক্ত মতাদর্শ–র বিরুদ্ধে, অর্থাৎ ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে – যা আমাদের নিজেদের কিছু লোকের মনে তাদের আদি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধ মনোভাব তৈরী করেছে, নিজের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং বিদেশী সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য তৈরী করেছে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো আমাদের জাতির এই বিপথগামী সদস্যদের বহিরাগত মতার্শের নেশা থেকে তাদের উদ্ধার করা এবং তাদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দেওয়া। মুসলমানদের নয়, এ দেশ থেকে আমাদের ইসলামকে শেষ করতে হবে।
তবে এটি একেবারেই আবশ্যিক নয় যে প্রতিটি ভারতীয় মুসলিম বা ভারতীয় খ্রিস্টানকে হিন্দু রাষ্ট্রের বাইরে থাকতে হবে। তাদের প্রত্যেকের নাগরিকতা তার ব্যক্তিগত মনোভাবের উপর নির্ভর করবে। শুধুমাত্র বিদেশী সংস্কৃতি উপাসনা করার জন্য কোনও ব্যক্তিকে হিন্দু রাষ্ট্র থেকে বাদ দেওয়া যায় না, কারণ সনাতন ধর্ম পূজার পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দেয়। আসল সত্য হলো যে কেউ সাকার বা মূর্তিপূজার পরিবর্তে নিরাকার ঈশ্বরের সাধনা করতে চায়, অথবা পশ্চিমে মুখ করে নামাজ পড়তে চায় অথবা শুক্রবার বা রবিবার কোনো বিশেষ দিনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে যায় অথবা দিনের বেলা একমাস রোজা রাখতে চায় অথবা যীশুখ্রিস্টকে তার ইষ্টদেবতা মানতে চায় – সেই সকল ব্যক্তিকে আমরা আমাদের রাষ্ট্রের বাইরে রাখব না। সনাতন ধর্ম অবশ্যই এই অবাধ স্বাধীনতা আমাদের দেয়। এমনকি একজন নাস্তিককেও আমাদের শাস্ত্রমতে হিন্দু হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তবে কেন আল্লাহ বা যীশুর একজন উপাসক হিন্দু হয়ে থাকতে পারেন না?
মূল সমস্যার বিষয়টি এই ধর্মগুলির আদর্শ বিশ্বাস করা বা না করার ওপর নির্ভর করে। একজন মুসলমান ব্যক্তি যে আসলে ইসলাম ধর্মের মতবাদে বিশ্বাস করে সে কখনোই হিন্দু রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারে না। এই ধর্মতত্ত্ব অনুসারে, যাঁরা বিশ্বাস করে সনাতন ধর্ম আপত্তিকর, আমাদের পূর্বপুরুষরা বিপথগামী ছিলেন, আমাদের ঋষি, মুনিরা শয়তানের শিষ্য ছিলেন, নরকে আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য স্থান সংরক্ষণ করা আছে, কিয়ামত এর দিন অর্থাৎ বিচারের শেষ দিনে আমরাও নরকের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাব এবং আর কখনোই স্বর্গের প্রবেশপথ দেখতে পাব না, যারা বিশ্বাস করে যে আমাদের সমস্ত দেবদেবী ও তাঁদের অবতার কদর্য মিথ্যা এবং আমরা তাঁদের উপাসনা করে প্রধানত পাপ করে চলেছি, যাঁরা মনে করেন, তাঁদের গৃহীত বিদেশী তত্ত্বই একমাত্র সঠিক পথ ও সত্যকারের ধর্ম আর ভারতবর্ষ হলো জাহিল্লিয়া, যে নিজের মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে, যাঁরা বলেন যে আল্লাহ নিজেই হিন্দুদের বধ, লুণ্ঠন ও নির্যাতন করাকে পুণ্যের কাজ বলে নির্ধারণ করেছেন – এই জাতীয় মানুষেরা কোনোভাবেই হিন্দুরাষ্ট্রের অংশ হতে পারে না।
খ্রিস্টান ধর্মের মূল তত্ত্বগুলি ইসলামের থেকে খুব বেশি আলাদা নয়, তবে যথেষ্ট উদারতা এখন বিশ্বের খ্রিস্টান সমাজগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই খ্রিস্টানদের পক্ষে এখন তাদের ধর্মতত্ত্বকে সত্যিই বিশ্বাস করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। সুতরাং আমরা খ্রিস্টানদের মধ্যে এরূপ বিপুল সংখ্যক ব্যক্তির সন্ধান পেতে পারি এবং সেই শ্রেণীর কয়েকজন মুসলমানকেও খুঁজে পেতে পারি যাঁরা বহিরাগত কোনো ধর্মের উপাসক, কিন্তু সনাতন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখেছেন, যাঁরা তাদের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি, হিন্দুজাতি ও তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনের মধ্যে চেতনা ও আন্তরিক বন্ধন স্থাপন করেছেন। এই জাতীয় ব্যক্তিরা খ্রিস্ট বা ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করেও হিন্দু জাতির অংশ হিসাবে রয়ে গেছে। তবে যারা সত্যিই খ্রিস্ট বা ইসলাম ধর্মতত্ত্বকে বিশ্বাস করে তারা আমাদের মাতৃভূমিতে কেবল সংখ্যালঘু হিসাবে গ্রাহ্য হতে পারে, নাগরিক নয়। সেহেতু ইহা অনস্বীকার্য যে, বর্তমানকালের বেশিরভাগ মুসলিমরা সংখ্যালঘু, জাতীয় নাগরিক নয়।
যেমনটা আমি আগে বলেছি, বিশ্বের সমস্ত দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে মানুষকে শ্রেণীবদ্ধ করার সর্বাপেক্ষা স্বীকৃত রীতি হল তাদের রাষ্ট্র ও তার সংখ্যালঘু হিসাবে দেখা। এজন্য সংখ্যালঘুদের উপজাতীয় বা আঞ্চলিক সংখ্যালঘু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত আপনি সর্বত্র দুই প্রকার শ্রেণীবিভাগ দেখতে পাবেন – রাষ্ট্র এবং যারা সেই মাটিতে বাস করার পরেও এর সাথে সাম্য বজায় রাখতে অক্ষম অর্থাৎ সংখ্যালঘু। তবে ভারতে ভ্রান্ত ও কৃত্রিম জাতির উপলব্ধি সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা তৈরি করেছে যথা – যদিও প্রতিটি ভারতবাসী এই রাষ্ট্রের অংশ, তবে তার কিছু অংশ সংখ্যালঘুও। একই রাষ্ট্রের মধ্যে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ ও ‘সংখ্যালঘু’ হিসাবে বিভাজন হওয়া উচিত – এই বিভাজনটি সম্পূর্ণ ভুল।
ইজরায়েল হলো ইহুদি জাতির দেশ। আরবের সাত শতাংশ মানুষ এখানে রয়েছে যারা মুসলিম। ভারতে মুসলমানরা জনসংখ্যার এগার শতাংশ, ইজরায়েলের চেয়ে খুব বেশি নয়। ইজরায়েলে এই আরবীয়দের নাগরিকত্বের সম্পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয় এবং তাদের ধর্ম অনুসরণ করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। তবে তারা ইহুদি হিসাবে নয় বরং সংখ্যালঘু হিসাবে বিবেচিত। ইহুদি রাষ্ট্রের বিষয়গুলি কীভাবে পরিচালিত হবে সে সম্পর্কে এই আরবীয়দের সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন বলে মনে করা হয় না। হিন্দু রাষ্ট্রের আওতায় নেই এমন মানুষের রাজনৈতিক ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে আমাদেরও কিছুটা পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। তাদের মর্যাদা কেবল সংখ্যালঘু পর্যন্তই, তারা নাগরিক নয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির একটি বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন করা দরকার, বাস্তবতার ভিত্তিতে তাদের মনোভাব এবং আকাঙ্ক্ষাগুলিকে আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে।
১.১৩ হিন্দুরাষ্ট্র: এখনও পরাধীন
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় যার প্রতি আমাদের সর্বাপেক্ষা বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত তা হল আমরা হিন্দুরা একটি রাষ্ট্র হলেও আমরা এখনো স্বাধীন রাষ্ট্র নই। আমরা এখনো একটি পরাধীন জাতি। আপনি যদি কিছুটা গুরুত্বের সাথে ভাবেন তবে আপনি বুঝবেন যে ১৯৪৭ সালের ১৫ ই অগাস্ট হিন্দু রাষ্ট্র আসলে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। হয়েছিল কেবলমাত্র প্রভুর পরিবর্তন, শাসকের পরিবর্তন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পরে, মুসলমানদের পরিবর্তে ব্রিটিশদের পরিবর্তে মুসলমানরা আমাদের শাসক হয়। তার মানে কি আমরা তখন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছি? একইভাবে ১৯৪৭ সালে, যদিও ব্রিটিশদের এই দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছিল। হিন্দু জাতি নিজের হাতে ক্ষমতা পায়নি কারণ যে নতুন শাসকবৃন্দ ক্ষমতায় এসেছিলেন তাঁরা নিজেদের হিন্দু বলে মানতেন না এবং নিজেদের হিন্দু জাতির অংশ হিসাবেও মনে করতেন না।
খুব সহজ তবে কঠিন সত্যটি হল ১৯৪৭ সালের অগাস্টে অবিভক্ত ভারতের মুসলিম জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তবে হিন্দুরা নয়। মুসলমানরা একটি পৃথক জাতি হিসাবে স্বীকৃতি পেল এবং একটি পৃথক ভূখণ্ড তাদের জাতীয় জন্মভূমি হিসাবে পরিচিত হল। তারা সেই ভূখণ্ডে তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং সেই রাষ্ট্র ভারতবর্ষের মুসলমানদের সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষা, সম্মান এবং স্বার্থকে নিজস্ব দায়িত্ব জ্ঞান করে পালন করে চলেছে। তবে হিন্দুরা না কোনও জাতি হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করেছিল, না নিজস্ব রাষ্ট্র হিসেবে, না তাদের স্বদেশের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল।
আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে যখন ভারতবর্ষে তার নিজের লোকেরাই শাসন করছিল তখন আমরা কীভাবে স্বাধীন নই? দেশের নাগরিক দ্বারা যে কোনো নিয়মে দেশ শাসন করলেই দেশ স্বাধীন হয় না। ইদি আমিন উগান্ডার নাগরিক ছিলেন, তবে তাঁর আমলে কি উগান্ডা স্বাধীন ছিল? ইউ এস এস আর–এর অধীনে স্টালিন এবং সিউসেস্কোর অধীনে রুমানিয়া – এই দেশগুলি তাদের নিজস্ব দেশের বংশোদ্ভূত শাসকদের অধীনে ছিল, কিন্তু এই দেশগুলি কি স্বাধীন ছিল?
আপনি উল্লেখ করতে পারেন যে এই শাসকেরা সকলেই স্বৈরশাসক ছিলেন কিন্তু ভারতে গণতন্ত্র আছে, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করার অধিকার আমাদের এখানে রয়েছে। তবে যতক্ষণ নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্বজাতির জাতীয়তাবোধকে অস্বীকার করে শাসন করতে চাওয়ার মত উপাদানে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, ততক্ষণ সেই নির্বাচন দেশের স্বাধীনতার কোনো পরিচয় দেয় না। সোভিয়েত ইউনিয়নেও নির্বাচন হতো, তবে প্রতিযোগিতাটি কমিউনিস্ট পার্টির একাধিক প্রার্থীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। একইভাবে, ভারতে, নেহরুবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষতা এখন এতই পবিত্র হয়ে গেছে যে যাঁরাই এ মতবাদের কোনোরূপ বিরোধিতা করবেন না, তাঁরাই সাফল্যের সহিত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
যেমনটি আগেই স্পষ্ট করা হয়েছে যে এই ধর্মনিরপেক্ষতার মূলমন্ত্রটি হল হিন্দু বিরোধিতা এবং আজ যদি কোনও প্রার্থী প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে তিনি হিন্দুদের একটি জাতি হিসাবে বিবেচনা করেন এবং তিনি হিন্দুদের বাঁচাতে চান এবং তাদের স্বার্থের জন্য লড়াই করতে চান এবং তিনি হিন্দুদের স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্থির থাকেন এবং হিন্দুদের সমর্থন প্রার্থনা করেন, তবে তার নির্বাচিত হওয়ার অধিকারটি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। এমনকি তিনি নির্বাচনে সাফল্য পেলে আদালত তাঁর নির্বাচনকে ‘সাম্প্রদায়িক প্রচার‘- এর ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করবে। বোম্বাইয়ের ভিলে পারলের মতো নির্বাচনী এলাকায় এর উদাহরণ ইতিমধ্যে রয়েছে। অতএব বর্তমান ভারতে প্রার্থীদের মধ্যে থেকে আমাদের প্রতিনিধিদের বেছে নেওয়ার অধিকারটি সীমাবদ্ধ আছে একমাত্র যারা নেহরুবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষতা বা হিন্দু–বিরোধী আদর্শের পক্ষে সওয়াল করেন। এটিই সেই আদর্শ যা ভারতের সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলিকে দিঙনির্দেশ করে – অবশ্য এই দলগুলির এদিকে সেদিকে নানা রূপ আছে।
তবে ধর্মনিরপেক্ষতা বা নেহরুবাদ–এর মূল নীতি হ‘ল হিন্দু বিরোধিতা এবং হিন্দু জাতিসত্তার অস্বীকৃতি, এবং সেই আদর্শের অনুসারী হিসাবে স্বেচ্ছায় হিন্দু জাতি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা। তাই হিন্দুদের পক্ষে এই ধরণের মানুষকে হিন্দু বলে গণ্য করা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাদের হাতে তুলে দেওয়ার পরে তাদেরকে স্বাধীন ও স্ব–শাসিত বলে বিবেচনা করা স্পষ্টতই বোকামির পরিচয়।
একজন ব্যক্তি যখন সম্পূর্ণ বিপরীত কোনো আদর্শ গ্রহণ করেন তখন তিনি তাঁর পরিচয় হারিয়ে ফেলেন। উদাহরণস্বরূপ, জনাব এম. জে. আকবরের পিতামহ শ্রী প্রয়াগ রাম একজন হিন্দু ছিলেন, তবে তিনি ইসলামের প্রতি তাঁর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন; তাই তিনি হিন্দু হতে পারেননি। রেভারেন্ড কৃষ্ণ মোহন ব্যানার্জী ছিলেন একজন হিন্দু। কিন্তু তিনি খ্রিস্ট ধর্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর হিন্দু হয়ে ওঠার রাস্তাটি বন্ধ হয়ে যায়। লেনিন এবং স্ট্যালিন উভয়েই খ্রিস্টান পরিবারগুলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং যথাযথভাবে ব্যাপটিস্টও হয়েছিলেন, তবে তাঁরা একবার মার্কসবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন, তাঁদের আর খ্রিস্টান হিসাবে বিবেচনা করা যায়নি। একইভাবে, যে ব্যক্তি নেহরুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতা বা মার্ক্সিজমকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন – যা আদতে হিন্দু জাতিসত্তার বিরোধিতার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাকে যৌক্তিকভাবে হিন্দু বা আমাদের জাতির অংশ হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। ইউরোপের খ্রিস্টানদের কাছে মার্কসবাদ যা ছিল তা হিন্দু সমাজের কাছে তাই হচ্ছে নেহরুবাদ।
আমরা ভুল করে ধর্মনিরপেক্ষ বা নেহরুবাদীদেরও হিন্দু বলেও ভাবি। সম্ভবত বিভ্রান্তি এই কারণে হয়েছিল যে ধর্মনিরপেক্ষরাও হিন্দু জাতির কয়েকটি ঐতিহ্য, আচার–অনুষ্ঠান এবং দানধর্ম গ্রহণ করেছে –যেমন, সমাধি ও প্রতিকৃতিতে মালা অর্পণ করা, সংবেদনশীলতার সহিত শ্রদ্ধা নিবেদন, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন এবং মাঝে মাঝে কোনো সাধু–সন্তের দর্শনলাভ অথবা মন্দির–দর্শন ইত্যাদি। এই প্রতারণামূলক চালাকি দ্বারা তাঁরা আমাদের বোকা বানায়। এজন্যই ১৯৪৭ সাল থেকে যাঁরা এই দেশে শাসন করে আসছে তাঁরা কায়মনোবাক্যে হিন্দু বিরোধী এবং হিন্দু জাতির শত্রু – যদিও তারা বাহ্যিকভাবে কয়েকটি হিন্দু রীতি–নীতি গ্রহণ করেছে। তাই তাঁদের হিন্দু হিসাবে বিবেচনা করা বা তাঁদের শাসনকে হিন্দুদের স্বশাসন হিসাবে বিবেচনা করা ভুল হবে।