হনুমান জয়ন্তী পরম রামভক্ত , রুদ্রের আংশিক অবতার বীর হনুমানের জন্ম তিথি উপলক্ষে ভারতবর্ষের অধিকাংশ জায়গায় চৈত্র মাসের পূর্ণিমার সময় পালিত হয়। কর্ণাটক , তামিলনাড়ু, কেরল, মহারাষ্ট্রে হনুমান জয়ন্তী একটি জনপ্রিয় উৎসব। তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে হনুমান জয়ন্তী ৪১ দিন ব্যাপী পালিত হয়।
হনুমানের মাতা অঞ্জনা আর পিতা কেশরী। কেশরী বর্তমান কর্ণাটক রাজ্যের বিজয়নগরের পাশে সুমেরু নামক অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন।
পৌরাণিক কথা অনুযায়ী হনুমান , সীতাকে মাথায় সিঁদুর লাগানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে মাতা সীতা উত্তর দেন শ্রী রামচন্দ্রের দীর্ঘায়ুর জন্য তিনি সিঁদুর লাগান। প্রভুভক্ত হনুমান তারপর নিজের সারা শরীরকে সিঁদুর লাগিয়ে দেন। শ্রী হনুমানের পূজার পর তাঁর বেদী থেকে সিঁদুর মাথায় লাগিয়ে পতিব্রতা নারী ও ভক্তরা হনুমানের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।
ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে বৈদেশিক অপসংস্কৃতি তথা পরাধীনতার মাঝেও সন্তকবি তুলসীদাসের ভক্তি ভারতবর্ষ কে বাঁচিয়ে রেখেছিল। ভক্তির চরমতম উদাহরণ শ্রী হনুমান। তাই ভক্তির পথকে চেনাতে ‘হনুমান চালিশা’র মাধ্যমে জাগরণ ঘটিয়েছিলেন তুলসীদাস। দেশের ধর্ম-সংস্কৃতি বাঁচাতে ও ভগ্ন মন্দির পুনরুদ্ধারের শপথ নেওয়া যুবক ও সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের বজরং বলীর নামে সংগঠন গড়ে তোলার উদাহরণ প্রচুর পাওয়া যায়। আজো ভারতবর্ষের সমস্ত হনুমান মন্দিরে প্রতি মঙ্গল ও শনিবার হনুমান চালিশা ভারতবর্ষ কে রামভক্তি ও রামদূতের ভক্তিতে নিমজ্জিত করে। ভারতবর্ষে আধাত্ম্যের দুই ধারা ভক্তি ও শক্তির সংযোজক রামভক্ত মহাবলী। ভারতবর্ষে ভক্তি আন্দোলনের মাঝে হনুমান ভক্তির যেনো এক স্বতন্ত্র আন্দোলন আছে যার স্রোত মহাবলীর মতোই কালজয়ী।
সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক দুই দিকেই উৎকর্ষতা প্রাপ্ত হলেই জীবনকে সফল বলা যায়। কিন্তু বর্তমানে আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজনীয়তা ভুলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে পার্থিব উন্নতিকেই একমাত্র লক্ষ্য মনে করার কারণে জীবনে অত্যধিক শারীরিক , মানসিক চাপের প্রভাবে সমাজের অঙ্গস্বরূপ মানুষের জীবন দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে।এই কারণেই সঠিক দিশা পেতে আমাদের শ্রী হনুমানের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। রাষ্ট্রজীবনের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের সাযুজ্য তথা রাষ্ট্রীয় হিতে যোগদানকারী সুনাগরিক হতে শিশু বয়স থেকেই পবনপুত্রের জীবন থেকে প্রেরণা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। শ্রী হনুমানের জীবন থেকে আমরা লক্ষ্যের প্রতি নিষ্ঠা, ধৈর্য্য,নিয়মানুবর্তিতা , সঙ্কটের সময় নেতৃত্বের গুণ, সুসম্পর্ক তৈরির দক্ষতা, নিজের ও সর্বশক্তিমানের ওপর বিশ্বাস এমনকি প্রয়োজনের সময় হাস্যরসের সঠিক ব্যবহারের শিক্ষা পায়।
প্রভু মুদ্রিকা মেলি মুখ মাহী ।
জলধি লংঘি গয়ে আচার্য নাহী ॥১৯॥
মা সীতার খোঁজে সমুদ্র পার করার সময় বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হলেও শ্রী হনুমানকে টলানো যায় নি এমনকি লক্ষ্য অর্জনের আগে তিনি মৈনাক পর্বতের অনুরোধ সত্ত্বেও বিশ্রাম নিতে অস্বীকার করেন। সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার সময় যে হনুমানের ক্ষিপ্রতা দেখা গিয়েছিল অশোক কাননে মা সীতার সঙ্গে দেখা করার সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ধৈর্য্যশীল হনুমান কে আমরা পায়।
তুম্হরো মন্ত্র বিভীষণ মানা ।
লংকেশ্বর ভয়ে সব জগ জানা ॥১৭॥
হনুমানের সুসম্পর্ক তৈরি করার গুণের কারণেই বিভীষণ রাবণের সঙ্গ ত্যাগ করে শ্রী রামের কাজে সহযোগিতা করেছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দের বিভিন্ন চিঠিপত্র ও বক্তৃতায় শ্রী হনুমানের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার প্রসঙ্গ আসে। ভক্তি যোগ বোঝাতে তিনি যেমন শ্রী হনুমানের উদাহরণ টেনেছেন আবার জ্ঞান যোগ বোঝাতেও অঞ্জনীপুত্রই তাঁর প্রিয় আর কর্মের ফলকামনা থেকে মুক্ত কেশরীনন্দন আদর্শ কর্মযোগী।জ্ঞান, ভক্তি বা কর্ম পথ যাই হোক না কেনো অমিতবিক্রম আমাদের পথপ্রদর্শক।প্রত্যেক রামকৃষ্ণ মঠের মূল মন্দিরের প্রবেশদ্বারে শ্রী হনুমানের ছোটো মূর্তি থাকে–জীবসেবার মাধ্যমে শিবসেবা করতে হলে নিষ্কাম সেবকের জীবন থেকে প্রেরণা নেওয়ার উপদেশ এইভাবেই দেওয়া হয়।
হনুমান শব্দের অর্থ যার মান অর্থাৎ অহঙ্কার হত হয়েছে — অহঙ্কার শূন্য মন নিয়ে সেবার মাধ্যমেই নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হয়। ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া প্রত্যেক উপাসনা পদ্ধতি ও তার সাহিত্যে শ্রী রাম ও হনুমানের প্রভাব বিভিন্নভাবে দেখা যায়।
উপাসনার পথ বদলালেও ধর্মের প্রতীক শ্রী হনুমানের প্রভাব থেকে ভারতবর্ষের কোনো প্রান্ত মুক্ত হতে চাই নি কারণ স্বরাজ ও সুরাজ্যের প্রতীক রামরাজ্য হলে তা অর্জনের উপায় শ্রী হনুমানের জীবন দর্শন।
সন্তকবি তুলসীদাস যথার্থই লিখেছেন—
তুম্হরে ভজন রামকো পাবৈ ।
জনম জনম কে দুখ বিসরাবৈ ॥৩৩॥
পিন্টু সান্যাল