পর্ব ৫

উত্তরবঙ্গের এক বৃহৎ অংশ জুড়ে গোরক্ষনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সে ব্যাখ্যা পূর্বেই করেছি। তিনি সেখানে উর্বরতার প্রতীক রূপেও উপাসিত হন। আসলে প্রাচীনকাল থেকে দেবাদিদেব সেখানে উপাসিত হতেন।

আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের বক্তব্য থেকে একটুকু প্রকাশিত হয় যে , পুরাকালে পূর্ব্বভারতের রাজারা অধিকাংশই শৈব ছিলেন। কিরাত, মেচ, কুকি, চাকমা, হাজাং, খস্ প্রভৃতিরা তাঁদের প্রজা ছিলেন। হিমালয়ের নানাভাগে এবং হিমালয়ের নিকটবর্তী স্থানে তাঁদের বাস ছিল। তাঁরা নিজেদের শিবেরগণ বলে মনে করতেন প্রাচীন শৈবমার্গ এসব অঞ্চলে বদ্ধমূল ছিল। উত্তর এবং উত্তর পূর্ব এবং পূর্ব ভারতের রাজা মহারাজাগণ শিবের সঙ্গে নিজের শিষ্যত্বাদির কথা বা মহারুদ্রের ভক্ত হবার কথা গৌরবের সঙ্গে প্রচার করতেন। উক্ত সকল অঞ্চলে এককালে স্বয়ম্ভুই সম্রাট্ ছিলেন। ত্রিপুররাজ্যের ত্রিলোচনা এবং কোচবিহারের রাজা বিশ্বসিংহ শিবের বরপুুত্র বলে কথিত হয়ে থাকেন। হরিবংশে লিখিত আছে বাণ বা বাণাসুর মহাদেবের এক নিষ্ঠাবান ভক্ত ছিলেন। তাঁর মতো শ্রেষ্ঠ শিব ভক্ত ইতিহাসে খুব কমই আছেন। বাণ-প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ– সর্ব্বপ্রকার শিবলিঙ্গ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং বাণলিঙ্গ নামে অভিহিত। কোনদের সঙ্গে নানারূপ শিবলীলা উপকথার বিষয়ীভূত হয়ে আছে। প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে এ সম্বন্ধে নানা কাহিনী বর্ণিত আছে। জরাসন্ধ, বাণ, ভগদত্ত, নরক ও মুর প্রভৃতিরা শ্রেষ্ঠ শিবভক্ত এবং তন্ত্রধারক ছিলেন।

Mahakal Mandir, Darjeeling

সুতরাং , উত্তরবঙ্গে তথা সমগ্র বঙ্গ এবং অখন্ড ভারতের জন-সমাজের মধ্যে এক সুপ্রাচীন কাল হতে শৈব মার্গ প্রচারিত স্থানীয় রূপ লাভ করেছিল। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী শিব একজন কৃষক। বলা বাহুল্য যে, উত্তরবঙ্গের সাধারণ কৃষক সমাজেই শিবের এই অভিনব পরিকল্পনা সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গের কৃষকগণ কৃষিকার্য দেব-বৃত্তি বলে নির্দেশ করে এর উপর এক অপরূপ গৌরব দান করেছিল। পরে শিব জেলে , বেতের ঝুড়ি বোনার কারিগর ইত্যাদি সব রূপেই এই বঙ্গ সমাজে পূজিত হয়েছেন।

চাষ করিতে যায় ভোলানাথ বল্লুকা কুলে গো।
কোথায় আছো গৌরী দেবী দাওনা শঙ্খের ধ্বনি গো।।
আগে চলে দেব ভোলানাথ শেষে নারদ গো।
বল্লুকা কুলে আসি তারা উপনীত হলো গো ।

হাল জোড়ে হাল জোড়ে দেব ভোলানাথ গো ।
সিংগা বাজায় দেব ভোলা বাঁশের উপর বসে গো।।
এক চাষ , দুই চাষ, তিন চাষ দিল গো।।।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লৌকিক দেবদেবীর কেন্দ্রীক লোকায়ত পালা গান গুলির মধ্যে বিশিষ্ট পালা গান হল চাষী মহাদেব। উক্ত পংক্তিগুলি এই দেবপালার অন্তর্গত। বঙ্গে তথা ভারতের লৌকিক সমাজে মহাদেব কৃষি সহায়ক দেবতা হিসেবে পরিচিত যুগ থেকে যুগান্তরে।

মহাদেব সমগ্র লৌকিক জীবন ও জীবিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বারব্রত প্রিয় মহিলাগণ থেকে শুরু করে ধনী দরিদ্র সব শ্রেনীর কৃষক, জেলে, কুমার , কামার অর্থাৎ সমাজের কর্মঠ ও শ্রমজীবী মানুষেরা জীবনের নানা সংস্কারের সাথে তাঁকে গ্রহণ করে নিয়েছেন।

যেমন – রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মহাদেবের পূজা, কৃষি ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য মহাদেবের পূজা, শিশুর রক্ষাকর্তা হিসেবে মহাদেবের কাছে মানত, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য মহাদেবের পূজা। মহাদেবের মতো স্বামী পেতে যুগ থেকে যুগান্তরে মেয়েরা মহাদেবের বারব্রত করেন।

শিবকে নিয়ে লোক কথার অন্ত নেই। দেবতা মহাদেব লৌকিক হয়ে মানুষের নিকট আপন হয়েছেন। তাঁর নিকট উচ্চ নিচ নেই। তিনি সবার। তিনি আদি , অন্তত , স্বয়ম্ভু । মহাদেব কে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানান পৃথক গান।

লোক সংস্কৃতির বিজ্ঞানীগণ মনে করেন মহাদেব, শিব শম্ভু, আদি অন্ত দেবতা পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম পর্যায় থেকে মানুষ দ্বারা পূজিত হয়ে এসেছেন । অর্থাৎ যদি আমরা দেখি ,তাহলে ইতিহাস সাক্ষী মহেঞ্জোদারো হরপ্পা যুগ থেকে মানুষের কাছে তিনি পূজিত। সিন্ধু সভ্যতার সীলমোহরে তাঁকে পশুপতি হিসাবে আমরা দেখতে পাই । বঙ্গের লোক বিশ্বাসের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার উৎখনন প্রাপ্ত পশুপতির মূর্তির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় ।

তাছাড়া মহাদেব শিব বঙ্গের আঞ্চলিক দেবতা নন। তিনি সারা পৃথিবীর সনাতন ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের কাছে বহু রূপে দেবতা হিসেবে পূজিত হয়ে আসছেন। ভারতবর্ষের বহু মানুষের জীবন সম্পৃক্ত নানা আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে বহুকাল আগে তিনি ঠাঁই পেয়েছেন । মহাদেবকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা ব্রত কথা, ধাঁধাঁ, গান, কতকথা পালাগান।

বিশেষত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারায় ও শাক্ত পদাবলীর কবিগণ নানাভাবে শিবকে চিত্রিত করেছেন। লোকায়ত পালাগানে শিব নিতান্ত নিজের গৃহবাসী রূপে বর্ণিত হয়েছেন।

কৃষিজীবী সমাজের আরও বিবিধ চিত্র পাই সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের কাব্য ‘#শিবায়ণে’। সেখানে বলা হয়েছে- চাষাবাদেও নানা ঝামেলা আছে। নানা উদ্বেগ আছে। তাই শিব বলেছেন, চাষ না করে ব্যবসা করাই ভাল। কিন্তু স্ত্রী পার্বতী বুঝিয়েছেন যে ‘পুঁজি আর প্রবঞ্চনা বাণিজ্যের মূল।’ তাই শিব চাষই করলেন। ইন্দ্রের কাছে জমির পাট্টা নিলেন। কুবেরের কাছে বীজধান নিলেন। শূল ভেঙে হাল তৈরির হলো। বাঘ ও বৃষ জুড়ে লাঙ্গল চলল। মাঘের বৃষ্টিতে ধান রোপণ করা হলো। বৈশাখে জেগে উঠল কচি ধান। সেই ধান দেখে শিবের আনন্দের সীমা রইল না :

হর্ষ হৈয়া হর ধান্য দেখে অবিরাম॥
ধান দেখে তিনি ক্ষেতেই পড়ে রইলেন। সংসারের কথা ভুলেই গেল ….
ধান্য দেখ্যা রহিল পাসর‌্যা পরিজন॥

তারপর থেকে শিব মেতে গেলেন চাষে। এবিষয়ে তার যোগ্য অনুচর হলো ভীম। ভীম সারাবছর চাষে খাটতে লাগল। কখনও সে হাল বাইছে, কখনও ধান রুইছে, কখনও ধান কাটছে, কখনও ধান ঝাড়ছে, কখনও সে ধান বেঁধে রাখছে পুড়ায়।

শূন্যপুরাণে #অথচাস অংশে শিবের কৃষিকার্যের বিস্তারিত উল্লেখ আছে। সেখানে বস্ত্রের অভাব মেটানোর জন্য গৌরী শিবকে কার্পাস চাষ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। সেখানে তৈল বীজের মধ্যে তিল, সরিষা সহ নানা ধরনের ডালচাষের কথাও আছে , যেমন – মুগডাল, বুটের কলাই, আখচাষ এমন কি কলাগাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন পার্বতী। সেখানে কামোদ নামক ধানের উল্লেখ হয়ে। উল্লেখ হয়েছে যে কামোদ ধান থেকে অন্যান্য ধানের সৃষ্টি। শ্রাবণ মাসের ধানের নাম গছা , ভাদ্রের ধানের নাম মনুহর।

অগণিত নদী খাল-বিলে সত্ত্বেও এদেশের লোকগানে, ব্রতকথা , মঙ্গল কাব্য, চর্যাপদে, নানা পূজাঅনুষ্ঠানে মেঘ ও আকাশের কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা ও পৃথিবীর নিকট পুষ্টিযুক্ত ভূমি প্রার্থনার বিরাম নেই যুগ থেকে যুগান্তরে।

সেই কোন প্রাচীন কালে বৈদিক ঋষি মুনিরা তাই উচ্চারণ করেছিলেন মহামৃত্যুঞ্জয় মৃৎসঞ্জীবনি মন্ত্র –

ওঁ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম। উর্বারুকমিববন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাৎl

তারপর বাঙ্গালীর জীবনে বারো মাসের তেরো পার্বন সেখানে পূজা, ব্রত , মঙ্গলকাব্য সবই প্রকৃতি বিষয়ক। সর্বত্রই মানুষ চান ধরিত্রী যেন হয় সুজলা সুফলা। সেই জন্যই তো শিবের আরাধনা। বৈদিক হতে লৌকিক, সেই মহাকালই সৃষ্টি স্থিতি লয়ের চক্রের অধিকর্তা। উক্ত কারণগুলির জন্যই তিনি বঙ্গীয় কোচ রাজবংশী সমাজের অধিপতি এবং কৃষিদেবতা রূপে সুপ্রাচীন কাল থেকে তিনি পূজিত হয়ে আসছেন।

Jatileswar Temple

বঙ্গের অন্যতম শিব উপাসনা পদ্ধতি হল গাজন উৎসব। তবে কেবল শিবকেই কেন্দ্র করে গাজন হয় এমন নয়। ধর্মঠাকুর, মহামায়া আদ্যাশক্তির নানা লোকরূপ , মনসা , শীতলা ( যদিও ইনিও মহামায়ার এক রূপ) ইত্যাদি পূজায় বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে গাজন পালিত হয়। এটি একটি সংযম পালনের ব্রত। মহাদেবের নীলেরব্রত বা চৈত্র সংক্রান্তিরদিন বা নীলপূজোর দিন শিবের কৃষিকর্ম নাটকীয় আকারে প্রদর্শিত হয় গান এবং ছড়ার মাধ্যমে। মূলত এই অনুষ্ঠানটি গাজনের প্রধান সন্ন‍্যাসীর সঙ্গে অন্যান্য গাজনের ভক্তরা করে থাকেন। একজন ক্ষেত প্রস্তুত করেন । আরেকজন কর্ষিত ক্ষেত্রে বীজ ছড়িয়ে দেন। নদীয়ার অনেক জায়গায় শিব পুজোর দিন আউশ ধান ছড়িয়ে দেওয়া হয় জমিতে । কেউ আবার জিজ্ঞাসা করেন- এবার কত ধান হলো ? কেউ একজন মনের মত জবাব দেন। এরপর সেই ধানের বীজ সংগ্রহ করে কৃষকরা বীজধানের মধ্যে জমা রেখে দেন। বোশেখে বীজপাড়ার সময় সেই বীজ ছড়িয়ে দেন ক্ষেতে।

মনসামঙ্গল গাওয়ার সময়ও পটুয়া বা গায়েনরা শিবের কৃষি কাজের কথা উল্লেখ করে গান –

শুন শুন মর্ত্যবাসী শুন দিয়া মন,
ধান্য সৃজন করিলাম অন্নের কারণ।
এই ধান্য তোমাদের আহার জুটিবে,
কৃষি দেবতা রূপে তোমরা আমায় পুজিবে।

শিবই ত্রম্ব্যক্, তাঁর মধ্যেই পঞ্চভূত সমাহিত হয়, তাঁর মানস কন্যা নর্মদা , তাঁর জটায় বাঁধা পড়ে নির্গত সুশীতল গঙ্গা আমাদের ধরিত্রীকে পুষ্ট করছে। নদী বিধৌত অঞ্চল হল পশ্চিমবঙ্গের উত্তরভাগ, মানে যাকে আমরা উত্তরবঙ্গ বলে থাকি। ভৌগলিক দিক থেকে দেখতে গেলে উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী গুলি হল তিস্তা,তোর্সা ,গালান্ডি, ডুডুয়া, মেচী, জোড়াই ,সংকোষ ইত্যাদি। এই তিস্তা – তোর্সা নদীর অববাহিকা অঞ্চলেই বিভিন্ন জাতি – জনজাতির সহাবস্থান এবং সমন্বয় সৃষ্টি করেছে এক স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বলয়। উক্ত নদীগুলি কোনো না কোনোভাবে মহাদেবের সঙ্গে লোকবিশ্বাসে সম্পর্ক যুক্ত হয়েছে।

Jalpesh Temple

তিস্তা – তোর্সা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা লোকসংস্কৃতির বা বলা যায় তিস্তা সভ্যতার প্রধান অধিবাসী হলেন মালপাহাড়ি, কোচ, রাজবংশী , রাভা, খ্যান , গারো, মুন্ডা, সাঁওতাল, হো , নাগেসিয়া, বোরো বা মেত, টোটো ,ওঁরাও প্রভৃতি। তবে রাজবংশীরাই সংখ্যায় অধিক। এখানকার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। ফলে কৃষিকেন্দ্রীক লোকসংস্কৃতিগত লোকাচার, লৌকিক সংস্কার , কৃষিগত জাদু বিশ্বাস , লোকবিশ্বাস এই অঞ্চলের সনাতনী জীবনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।

যেহেতু আমি লৌকিক বিষয় গুলি নিয়ে পড়াশোনা এবং লেখালিখি করি তাই আমি এর পূর্বেও বহু লেখায় বলেছি যে বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবী , ব্রত নানা লোকসংস্কার ,বিশ্বাস তথা লোকচারের মধ্যে দিয়ে সৃষ্ট হয়। উত্তরবঙ্গের ভূ- সংস্কৃতি এবং নৃ- সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবী , বুড়োবুড়ি, মদনকাম, চড়ক, হুদুমদেও , মাশান , মহাকাল, তিস্তাবুড়ি , সন্ন্যাসী, ভাণ্ডানী , বিষহরি, যখাযখী, থানসিরি, সোনারায়, গারামঠাকুর, ডাংধরা প্রভৃতি। আর এই সব লৌকিক দেবদেবীকে কেন্দ্র করে তিস্তা তোর্সা অববাহিকায় গড়ে ওঠা বহু গ্রামের নাম নির্ধারিত হয়েছে। গ্রামনাম স্থানামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

আশুতোষ ভট্টাচার্য মহাশয়ের রচনা থেকে জানা যায় :

ইনি ( শিব ) লৌকিকরূপে সম্পূর্ণ ভাবেই কোচজাতীয় কৃষকদের দেবতা ছিলেন। সুপ্রাচীন কাল হতে পশু ,কৃষি এবং ভূমির দেবতা হিসাবে মহেশ্বর শিবের অস্তিত্ব ছিল। তিনি স্বয়ংভূ পশুপতি। তাই প্রাচীনকাল হতে বিভিন্ন প্রাচীন জনজাতির এক ও অন্তিম আরাধ্য দেবতা হবেন সে বিষয় দ্বিমত থাকে না। তিনিই বৈদিক রূপে রুদ্র। তাই তিনিই প্রাচীন কাল হতে কোচ জাতির দেবতা তা অনুমান করা যেতেই পারে। তাই হয়ত , পরবর্তীকালে শিবের সঙ্গে পুরান বহির্ভূত কোচদিগের সংশ্রবের কাহিনী জড়িত থাকতে দেখা যায়।

তাই বৈদিক হোক বা লৌকিক সকল দেবতাদের আদিদেব হলেন শিব। শিব রূপে ত্রিশূল পূজা, লিঙ্গ পূজা, শিবের বাহন ( বৃষভ, সর্প) , শিবের ভৈরব প্রভৃতি মূলত কৃষিমূলক । বর্ষণ ও বৃষের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ট। সর্প প্রজননের প্রতীক। শিব তাই একধারে সর্বশক্তিমান আবার কৃষির দেবতা। তাই তিনি প্রাচীন কোচ জাতির নিকট কৃষিদেবতা, যুগ থেকে যুগান্তরে তাই হিমালয় সন্নিকস্থ তথা ভারতীয় লোক জীবনে শিবই হলেন প্রধান উপাস্য দেবতা।

Ambotia Shiva Temple, Darjeeling

দেবতাদের আদিদেব হলেন শিব। শিব রূপে ত্রিশূল পূজা, লিঙ্গ পূজা, শিবের বাহন ( বৃষভ, সর্প) , শিবের ভৈরব প্রভৃতি মূলত কৃষিমূলক । বর্ষণ ও বৃষের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ট। সর্প প্রজননের প্রতীক। শিব তাই একধারে সর্বশক্তিমান আবার কৃষির দেবতা। তাই তিনি প্রাচীন কোচ জাতির নিকট কৃষিদেবতা, যুগ থেকে যুগান্তরে তাই হিমালয় সন্নিকস্থ তথা ভারতীয় লোক জীবনে শিবই হলেন প্রধান উপাস্য দেবতা।

উত্তরবঙ্গের ধর্মীয় জীবনের সমস্ত লোকবিশ্বাস , লোকসংস্কার , লোকাচার শিবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। পরবর্তী কালে , বৌদ্ধ ,জৈন এবং বৈষ্ণব মার্গ মিলেমিশে একটি মিশ্র সাধনার ক্ষেত্র হিসাবে প্রসার লাভ করেছে।

উত্তরবঙ্গের সমাজ এবং সাংস্কৃতিক জীবনে সপরিবারে শিবের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীপক কুমার রায় বলেছেন –

লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্যেই শিবই হলেন প্রধান দেবতা । অন্যান্য দেবদেবী শৈব পরিবারেরই অন্তর্ভুক্ত। যেমন – মনসা, গোসান মারী, চন্ডী, ভাণ্ডানী, মাশান, বুড়ি ঠাকুর ইত্যাদি। উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর জনসমাজ রাজবংশীরাও মূলত শৈব। বোরো বা মেচ, ধিমাল, রাভা, গারো, জলদা ইত্যাদি জাতি- জনজাতি সমাজেও প্রধান দেবতা শিব। ধিমাল সমাজে তিনিই দান্তা বেরাং, বোরো সমাজে শিব্রাই বা বাথৌব্রাই নামে পরিচিত।

আদি কৃষিভিত্তিক লোকাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিব এই অঞ্চলে নানা রূপে ও নামে পরিচিতি। লৌকিক রূপের মহাকাল বুড়াঠাকুর, সন্ন্যাসী , ধূমবাবা, যখা ঠাকুর, মাশান ,মদনকাম , গমীরা, চড়ক প্রভৃতির পাশাপাশি শিবের আদিম পৌরাণিক রূপ জল্পেশ্বর , বাণেশ্বর , জটেশ্বর, সর্বেশ্বর, ভদ্রেশ্বর , বটেশ্বর , নীলাশ্বর প্রভৃতি শিব পূজিত হন। শিব উপাসনা দুই রূপে ঘটে :

১ : লৌকিকরূপে
২: লৌকিক রূপের পরিশীলিত পৌরাণিক রূপে

তিস্তা – তোর্সা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে সমাজ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত লৌকিক এবং আদিম রূপী শিবের নামে গ্রাম নাম একার্থে এই অঞ্চলের সমাজ সংস্কৃতিগত লোক ঐতিহ্যকে গভীর ভাবে দ্যোতিত করে।

Durgeshwar Shiva Temple, Nimtalla

সুতরাং , শৈবমার্গীয় রাজবংশী সমাজে অন্যতম শৈব আচার্য গোরক্ষনাথ কৃষি ও উর্বরতার প্রতীকরূপে পূজিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। গোরক্ষনাথের ব্রতগানে রাজা জল্পেশশ্বরের নাম উল্লেখ হয়েছে। কিংবদন্তি তাঁর রাজত্ব তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। তিনিই জল্পেশশ্বর শিব প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকেই মনে করেন এই রাজা জল্পেশ স্বয়ং গোরক্ষনাথ ছিলেন। কোচবিহারে জেলায় এঁর অপর নাম গোন্নানাথ হিসাবে বিখ্যাত।

উত্তরবঙ্গের জাগ্রত শিব মন্দির জল্পেশ মন্দির। সেই মন্দিরে অধিষ্ঠিত মহাদেব জল্পেশ্বর।পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে দেবী সতীর বাম চরণ ত্রিস্রোতায় পতিত হয়েছিল । দেবীর নাম ভ্রামরী, ভৈরবের নাম ঈশ্বর । পীঠনির্ণয়তন্ত্র বলে-

ত্রিস্রোতায়াং বামপাদে ভ্রামরী ভৈরবেশ্বরঃ ।

শিবচরিত গ্রন্থ অনুসারে এখানে দেবীর জানু পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম চণ্ডীকা আর ভৈরবের নাম সদানন্দ । ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন-

তিরোতায় পড়ে বামপাদ মনোহর ।
অমরীদেবতা তাহে ভৈরব অমর ।।

তিরোতা ও ত্রিস্রোতা কে এক ধরা হয় । জ্ঞানার্ণবতন্ত্র শাস্ত্র ও শাক্তানন্দ তরঙ্গিণী শাস্ত্রে ত্রিস্রোতায় শক্তিপীঠের উল্লেখ পাওয়া যায় । ত্রিস্রোতা বলতে উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদীকে বোঝায় । তিস্তা নদী ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা । পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে জলপাইগুড়ি জেলার বোদাগঞ্জ গ্রামে ফরেস্টের ভেতরে এই মন্দির। অনতিদূরে ভীষন গর্জন ও তীব্র স্রোত নিয়ে বয়ে চলছে তিস্তা । ভিন্ন মতে জলপাইগুড়ি জেলার জল্পেশ শিব মন্দির কেই শক্তিপীঠ ধরা হয়। সেজন্য কিছু পণ্ডিত দের মতে ভ্রামরী দেবীর ভৈরব হলেন জল্পেশ বা জল্পেশেশ্বর ।

চারুচন্দ্র স্যানাল তাঁর The Rajbansis of North Bengal গ্রন্থে বলেছেন :

Jalpeswar is mentioned in Skanda Purana as being installed by one Raja Jalpa. The deity is also mentioned in the Kalima purana Yogini Tantra . The Lingam is enshrined in a big temple which said to have been built at first by arama named Jalpeswar in the 19th year of Saka….. Probably one his descendants , Prithibi Raja , rebuilt the temple in the second Century . The Prannarayan and Modhnarayan the Fourth and fifth rajas of Coochbehar rebuilt the temple about 150 years ago.

ময়নাগুড়ির গ্রাম হসুলডাঙ্গা থেকে দক্ষিণ দিকে জটিলেশ্বর শিব মন্দিরের অবস্থান। তাঁর নামেই স্থানটির নাম জটিলেশ্বর।

জল্পেশ এবং জটিলেশ্বর দু’টিই বিখ্যাত শৈবক্ষেত্র। জল্পেশে প্রতি বছর অন্তত সাড়ে তিন লক্ষ পুণ্যার্থী আসেন। তার মধ্যে নেপাল থেকেও আসেন অনেকে। বৈশাখ, শ্রাবণ ও ফাল্গুনে বিশেষ উৎসবে মন্দিরে জনসমুদ্র তৈরি হয়। জটিলেশ্বরেও শ্রাবণ ও ফাল্গুনে বেশ ভিড় হয়। এই দু’টি মন্দিরই বেশ প্রাচীন। এর মধ্যে জল্পেশ দু’হাজারের বছরের পুরনো সিল্ক রোডের উপরেই ছিল বলে গবেষকদের অনেকের ধারণা। জটিলেশ্বরের মন্দিরটি নবম শতকের বলে মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা।

জলপাইগুড়ি হল তিন ‘ঈশ্বরের দেশ’—জল্পেশ্বর, জটিলেশ্বর, জটেশ্বর। স্থানিক বাসীদের অনক্ষর অংশ এই ভূখণ্ডকে ‘মহাকালের দেশ’ বলে জানেন। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’ গল্পে এই মহাকালের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখিত হয়েছে। তবে স্থানীয় তন্ত্র সাহিত্যে এই অঞ্চলকে ‘রত্নপীঠ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মহাকাব্য ও পুরাণে সামগ্রিক ভাবে এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে ‘কিরাত দেশ’ বলে চিহ্ণিত করা হয়েছে। এই কিরাত দেশের অধিপতি রূপে মহাকাল শিব মধ্যম পাণ্ডবকে দর্শন দিয়েছিলেন , নিয়েছিলেন পরীক্ষা সামর্থের।

বন পর্বের মূল অংশ ছিল কিরতা-অর্জুন। এই গল্পটি সংস্কৃত সাহিত্যের পাঁচটি মহাকাব্যের অন্যতম। ভারভী’র লেখা “কীরতার্জুনীয়ম্” সংস্কৃত সাহিত্যের সম্পদ।

মহাদেবের কাছ থেকে পশুপতাস্ত্র না পাওয়া পর্যন্ত ইন্দ্র তাঁর পুত্রকে স্বর্গের​ থেকে অন‍্যান‍্য অস্ত্র সংগ্রহের অনুমতি দেননি। ইন্দ্র পরিষ্কারভাবে অর্জুনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে আদি ধনুর্দ্ধর শিবই হলেন সকল অস্ত্রের উৎস। আর তাই তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া অস্ত্র লাভ করা অসম্ভব।

শিব অর্জুনকে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র প্রদানের আগে তাঁর দক্ষতা এবং ক্ষমতা পরীক্ষা করেছিলেন। তারপরে তিনি অর্জুনকে স্বর্গে গিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণের অনুমতি দিয়েছিলেন। শিবের কৃপায় কেবলমাত্র অর্জুন সমস্ত প্রকার অস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তিস্তা-করলা-কালজানি-জলঢাকা স্নেহাশ্রিতা হিমালয় দুহিতা জলপাইগুড়ি একশো পঞ্চাশ বছরে পদাপর্ণ করেছে। এই জনপদের ইতিহাস স্মরণ শুধু স্মৃতি তর্পণ নয়, এই স্মরণের মাধ্যমে নিজেদেরও জানার একটা সুযোগ পাওয়া যায়। অর্থাৎ শিকড়ের দিকে ফিরে তাকানো যায়।

মহাকাল শিবের পরিশীলিত রূপই হল এই জটেশ্বর শিব। কোনো এক জটাধারী সাধুর শিলামূর্তি স্থাপন করে শিব জ্ঞানে পূজা করার অনুসঙ্গ ভীষণ ভাবে এক সনাতনী লৌকিক ইতিহাসকে বহন করে।

চারুচন্দ্র স্যন্যাল গোরক্ষনাথের জন্মস্থান জল্পেশ হবার কারণে , সম্পূর্ণ জল্পেশকে গোরক্ষময় এবং গোরক্ষকে জল্পেশময় হিসাবে দেখিয়েছেন। পশ্চিমকামরূপের চূর্ণ এবং শঙ্খ ব্যবসাইরাও নাথ হিসাবে পরিচিতি।

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস

২. উত্তরবঙ্গে গোরক্ষনাথের গান

৩. শ্রী শিবগোপাল দেবশর্মা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.