পর্ব ১

“গৃহ কোন্”? গোর্খ নাথ বলে – “নিজ দেহ”।

এই তত্ত্ব বুঝে মাত্র ভাগ্যবান্ কেহ ।। 

যুদ্ধ কর ,যুদ্ধ কর ঘোর বনে , বীর।

তত্ত্ব তরবারি কর, তত্ত্ব তীক্ষ্ণ তীর।।

ইন্দ্রিয়কে করে বশ সাধিয়া আসন।

সর্ব্ব জিনিয়াছে সেই – পায় নিরঞ্জন।।

সেই জন্যই বলা হয় গোরখ বিজয়। উপনিষদও একই কথা বলে – 

তৎ হ তদ্ বনং নাম – তদ্ বনম্ ইতি উপাসিতব্যম্। (কোনোপনিষদ্)

প্রণবো ধনুঃ, শরো হি আত্মা, ব্রহ্ম তৎলক্ষ্যমুচ্যতে। (মুন্ডকোপনিষদ্)

পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে অর্থাৎ যাকে সোজা কথায় লোকে বলে উত্তরবঙ্গ , সেই স্থানে বহু প্রাচীনকাল হতে সেই গোরক্ষনাথের গান প্রচলিত  হয়ে আছে। 


Marvellous night View of Maha Mrityunjay temple in kalajugi, Assam.
The 126-feet Shiva Linga looks phenomenal at night

পূর্বে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে গোরক্ষনাথের পূজা এবং ব্রত ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে বড় একটা দেখা যায় না। বিশেষ করে রাখাল বালকরা বড় শ্রদ্ধার সঙ্গে এই পূজা এবং ব্রত পালন করত। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান, চাল, টাকাপয়সা সংগ্রহ করত।এই সব ধান, চাল ইত্যাদি সংগ্রহের সময় যে গান গাওয়া হত সেটাই ছিল গোরক্ষনাথের গান।স্থানীয় উচ্চারণে বলা হয় গোরখনাথ বা গোর্খানাথ। অনেকেই এই পূজা ও ব্রতকে আখোয়ালী বা রাখোয়ালী বলে। এই পূজা ও ব্রতকথার সময় কাল ফাগ – বোশেখ মাসে। 

গোরখ পূজা ও ব্রত কৃষি ও গো – পূজার গান। ধর্মনারায়ণ সরকার তাঁর গ্রন্থে বলেছেন কার্তীকি শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই পূজা ও ব্রত হয়। কদলী বা কিম্পুরুষের দেশ তিনি জয় করেছিলেন। সেই অঞ্চল তাই #গোর্খাভূমি বা #গোরক্ষভূমি নামে পরিচিত হয়। গোরখনাথের গানগুলি থেকে বেশ ভালোকরে উপলব্ধি হয়ে যে গোরক্ষনাথের জন্মস্থান জল্পেশ এবং গোয়ালপাড়া জেলার মেচপাড়ার নিকটবর্তী বলে জানা যায়। সমগ্র উত্তরবঙ্গ এবং পশ্চিম কামরূপ জুড়ে গোরক্ষনাথের অজস্র স্মৃতিচিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। গারো পাহাড়, বগুড়ার গোরক্ষনাথের মন্দির, রংপুরের গোরক্ষমণ্ডপ , গোয়ালপাড়ার যোগীঘোপা এবং দিনাজপুরের রাণী শঙ্কলের নিকট গোরক্ষনাথের মন্দির এবং নেকমর্দ্দানের গোরক্ষকূই ইত্যাদি স্থানে গোরক্ষনাথ পূজিত হন। 

Jalpesh shiva temple Jalpaiguri Westbengal

ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যাল তাঁর “রাজবংশীজ অব নর্থ বেঙ্গল ” গ্রন্থে গোরখনাথের পূজা এবং শিব উপাসনা একই বলে উল্লেখ করেছেন। এবার এই বিতর্কের অবসান হওয়ার জন্য যোগী সম্প্রদায় নিয়ে যেমন আলোচনার দরকার ,তেমনি বঙ্গের লোকমানসে দেবদেবীর অবস্থান নিয়েও এরূপ আলোচনা আবশ্যক। নাথরা হলেন শৈব সম্প্রদায়। সে অনেকে নানা বিতর্ক সৃষ্টি করলেও নাথরা শৈব মার্গীয় একটি অংশ বা পন্থা। কারণ আমি নিজে নাথ বংশের পুত্রবধূ এবং আমার স্বামীর বংশের গোত্র – শিব। 

অজং শাশ্বতং কারণং কারণানাং

শিবং কেবলং ভাসকং ভাসকানাম্।

তুরীয়ং তমঃপারমাদ্যন্তহীনং

প্রপদ্যে পরং পাবনং দ্বৈতহীনম্।

অর্থাৎ, তিনিই আদিম , তিনিই ব্রহ্ম , তিনিই সকলকে প্রথম জ্ঞানের আলোক প্রদান করেন। তাই তিনিই আদি গুরু। বেদের শিরোভাগ এবং বেদান্তে বলছেন – শিব এব কেবলঃ । 

বেদান্তে বলা হয়েছেঃ

তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং ত্বং দেবতানাম পরমঞ্চ দৈবতম্ ।

পতিং পতিনাং পরমং পরস্তাদ বিদাম্ দেবম্ ভুবনেশমীড্যম্ ।।

 তুমি ঈশ্বরদেরও ঈশ্বর মহেশ্বর। দেবতাদেরও পরম দেবতা। তুমি অধিপতিদেরও অধিপতি মহাধিপতি। তুমি পরমেরও পরম। তুমিই ভূবনের পূজনীয় ইশ্বর।

জ্ঞানসংহিতা বলছেন – অহং ভবানয়ঞ্চৈব রুদ্রোহয়ং যো ভবিষ্যতি।

একং রূপং ন ভেদোহস্তি ভেদে চ বন্ধনং ভবেৎ।।

তথাপীহ মদীয়ং শিবরূপং সনাতনম্।

মূলভূতং সদা প্রোক্তং সত্যং জ্ঞানমনন্তকম্।। 

তাই , নাথপন্থীগণের  আদিগুরু হলেন শিব , তিনিই আদিনাথ। তিনিই অলোকনাথ। তিনিই সেই বীর মন্ত্রের অলখ্ নিরঞ্জন। তিনি যখন সয়ম্ভূ , অনাদি তখন সেই ব্রহ্মান্ডে শক্তি ব্রহ্মময়ীর সঙ্গে ওঙ্কার বা ওঁ ধ্বনিতে সৃষ্টি করলেন, সেই মুহূর্তে তিনি হলেন আদি। দত্তাত্রেয় আদিনাথ ও মহাদেবকে অভিন্ন বলেছেন। মহেশখালীতে যে আদিনাথ পূজিত হয় তাও শিবমূর্তি। অনুমান এই মহেশখালীই প্রাচীন কেজাপূবীন দ্বীপ, যেস্থলে আদিনাথ দ্বারা মৎস্যেন্দ্রনাথ দীক্ষিত হন। 

MAHAKALESHWAR

আকুলেনাদি নাথেন কেজাপূবীন বাসিনা।

কৃপয়েব পরং তত্ত্বং মীন নাথোপি বোধতঃ ।।

 সেই পরম ব্রহ্ম একইভাবে জৈন এবং বৌদ্ধ মার্গীয়দের মধ্যে সর্ব প্রাচীন বা আদি হিসাবেই উপাসিত হন।

অধ্যাপক বারিদবরণ ঘোষের মতে,–

‘নাথধর্ম সনাতন ভারতীয় ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ধর্ম নয়– যদিও আচার-আচরণে প্রচলিত ‘হিন্দুধর্ম’ থেকে এদের বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়ার মতো। আর এই আচার-আচরণই নাথধর্মের উৎসে শিবদেবতার উপস্থিতিকে অনিবার্য করে তুলেছে। এই ‘নাথ’ শব্দটির বিশিষ্ট প্রয়োগই এই ধর্মের আচার-পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। সমগ্র মানবসমাজ কতকগুলি ইন্দ্রিয়ের কর্মপদ্ধতি দ্বারা পরিচালিত। এই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের (পঞ্চেন্দ্রিয় দু প্রকারের– এক জ্ঞানেন্দ্রিয়, দুই কর্মেন্দ্রিয়। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক– এগুলি জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু এবং উপস্থ– এগুলি কর্মেন্দ্রিয়) উপর নাথ (প্রভুত্ব) হওয়াই এই ধর্মের মূল কথা। এই নাথ হতে গেলে প্রথমে সিদ্ধতনু, পরে দিব্যতনু বা প্রণবতনু লাভ করতে হয়। প্রণবতনু লাভ করলে তবেই প্রকৃত নাথ হতে পারা যায়। এই তত্ত্ব শিবজাত তত্ত্ব। নাথযোগীদের আদিগুরু স্বয়ং মহাদেব।’

 আদিনাথকে অবলম্বন করে নানা গাথা , কথাবার্তা প্রচলিত ছিল – 

আদিনাথের আদিনাথ। আদিনাথে দিলা বর।

এই ঘর সুবন্নি (সুবর্ণ) ঘর। 

সুবন্নি ঘরে তুলেছে মাটি।

এই ঘর হইছে কুমারহাটি।।

কুমারহাটির কুমার ভাই।

তোমার লাগাল ( নাগাল) কেমনে পাই।।

গাঙ্গেরেই (নদী) পার পারে। ইত্যাদি।।

অর্থাৎ, আদিনাথের বরে গৃহস্থ শ্রীসম্পন্ন হল। এধরনের গান গেয়েই কাছাড় ও সন্নিহিত অঞ্চলে সন্ন্যাসী , যোগীরা ভিক্ষাদি প্রার্থনা করে তাই দিয়ে আদিনাথকে ভোগ দিতেন। 

শুক্ল যজুর্বেদীয় রুদ্রীপাঠ রুদ্রাষ্টাধ্যায়ী মহারুদ্রের আরাধনার কথা উল্লেখ আছে ।  শিবলিঙ্গের উপর দুধ, দই, ঘি, মধু, শর্করা, গঙ্গাজল প্রদান করা হয়ে থাকে । শ্রীঙ্গীর দ্বারা শিবলিঙ্গের উপরে অভিষেক হতে থাকে এবং  এই বেদমন্ত্র পাঠ চলতে থাকে। এইটিই রুদ্রাভিষেক শিব পূজা। এই রুদ্র শিব পূজা করাতে পারলে মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হয়ে থাকে সফলতা, রোগমুক্ত, দীর্ঘাযু, অকাল মৃত্যুবরণের হাত থেকে রক্ষা করেন মহারুদ্র মৃত্যুঞ্জয় মহাদেব।

মনঃ শিব-সঙ্কল্পমস্তু।

                         (শুক্ল যজুর্বেদ, ৩৪)

         আমার মন শুভ কল্যাণকর সঙ্কল্পযুক্ত হোক।

এই শুক্ল যজুর্বেদীয় রুদ্রাধ্যায়ী সম্পর্কে একটি ধারণা বেদের মধ্যে ভগবান শিব কে আমরা রুদ্র নামে জানি। পূর্বকালে হইতে শ্রদ্ধালু বেদধ্যায়ী মানুষ গন অাত্মকল্যাণের শুক্লযজুর্বেদ থেকে আট উপযোগী অধ্যায় কে চরণ করে “রুদ্রাষ্টাধ্যায়ী” নামক গ্রন্থ হয়।

এই রুদ্র শিব হল অন্যতম  তাৎপর্যবাহী মন্ত্র। নমঃ শিবায়-এর অর্থ হল “ভগবান শিবকে নমস্কার” বা “সেই মঙ্গলময়কে প্রণাম!” 

এই মহারুদ্র শিবকে পঞ্চাক্ষর মন্ত্রও বলা হয় যার মানে “পাঁচ-অক্ষরযুক্ত” মন্ত্র (ওঁ ব্যতীত)। এটি ভগবান মহারুদ্র শিবের প্রতি সমর্পিত হওয়া। এই মন্ত্রে শ্রী রুদ্রম্ চমকম্ ও রুদ্রাষ্টাধ্যায়ীতে “ন”, “মঃ”, “শি”, “বা” এবং “য়” রূপে প্রকাশিত। শ্রী রুদ্রম্ চমকম্, কৃষ্ণ যজুর্বেদের অংশ এবং রুদ্রাষ্টাধ্যায়ী, শুক্ল যজুর্বেদ-এর অংশ।

নমস্কার সবাইকে শিবরাত্রির অগ্রিম শুভেচ্ছা শিবরাত্রি তাই যজুর্বেদ এর রুদ্র স্তুতি—

ওঁ নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ।

বাহুভ্যামুত তে নমঃ।।

                  (শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/১)

ওঁ যা হে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহপাপকাশিনী।

তয়া নস্তন্বা শম্তময়া গিরিশম্তাভি চাকশীহি।।

                  (শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/২)

ওঁ নমো ভবায় চ রুদ্রায় চ নমঃ শর্বায় চ পশুপতয়ে

চ নমো নীলগ্রীবায় চ শিতিকন্ঠায় চ।।

                  (শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/২৮)

ওঁ নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।।

বেদে ত্রয়স্তিমাশতি কোটি বা তেত্রিশ কোটি অর্থে তেত্রিশ উচ্চকোটি দেবতার কথা বলা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য গ্রন্থে এটি পরিষ্কার ভাবে ব্যখ্যা করা হয়েছে। অথর্ব বেদের দশম অধ্যায় সপ্তম সুক্তের ত্রয়োদশ শ্লোকে বলা হয়েছে-

যস্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা অঙ্গে সর্বে সমাহিতাঃ।

স্কম্মং তং ব্রুহি কতমঃ স্বিদেব সঃ।।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে – 

অষ্টৌ বসব একাদশ রুদ্রা দ্বাদশদিত্যাস্ত। একত্রিংশদিন্দ্রশ্চৈব প্রজাপতিশ্চ ত্রয়ত্রিংশা চিতি।।

এই তেত্রিশ কোটি দেবতার এগারো জন পৃথিবীতে, এগারো জন বায়ুতে এবং বাকি এগারো জন মহাকাশ বা অন্তরিক্ষে অবস্থান করছেন। এঁরা হলেন – দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র, অষ্টবসু এবং দুই অশ্বিন।

একাদশ রুদ্র হলেন মহাদেব শিবের বিভিন্ন রূপ

মন্যু

মনু

মহিনস

হর

শম্ভু

ঋতুধ্বজ

উগ্ররেতা

ভব

কাল

বামদেব

ধুতব্রত

অনেক গ্রন্থ অনুসারে একাদশ রুদ্র হলেন মানব শরীরের দশ চালিকা শক্তি এবং এক আত্মা। বৃহদারন্যক উপনিষদে একাদশ রুদ্র হলেন

প্রাণ(নিঃশ্বাস)

অপান(প্রশ্বাস)

ব্যন

সমান

উদাম

নাগ

কুর্ম্ম

কৃকল

দেবদত্ত

ধনঞ্জয়

আত্মা

এইজন্য একাদশ রুদ্র একাদশ তনু হিসাবেও পরিচিত।

ঋগ্বেদে বলা হয়েছে – 

পিতর্মরুতাম্

অর্থাৎ , যিনি মরুদগণের পিতা।

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছেঃ‘আদিত্যমণ্ডল মধ্যবর্তী হিরণ্যশ্মশ্রু, হিরণ্যকেশ নখ হইতে কেশাগ্র পর্যন্ত যে হিরন্ময় পুরুষ দৃষ্ট হন, তিনিই ভক্তকল্যানকারী সাক্ষাৎ শিব।”

বেদে রুদ্রের বিশেষণরূপে‘শিব’শব্দটির উল্লেখ আছে। আসলে পৌরাণিক শিব আর বৈদিক রুদ্র অভিন্ন। রুদ্রের অনেক ভাবই শিবচরিত্রে পাওয়া যায়। যেমন, যজুর্বেদে রুদ্র‘নীলগ্রীব’বা‘শিতিকণ্ঠ’; ঋগ্বেদে (৭/৫৯/১২) তাকে বলা হয়েছে‘ত্রম্বক’; তিনি‘কপর্দ্দী’বা জটাজুটধারী, তিনি বজ্রধারী। রুদ্রের বজ্রই  অপরাজেয় পাশুপাত।

 বেদে রুদ্র বদান্য, কল্যাণপ্রদ ও সহজেই সন্তুষ্ট; পৌরাণিক শিবও নিত্য মঙ্গলময়, তিনি আশুতোষ। বেদের রুদ্র ভয়ানক ও ধ্বংসকারী, পক্ষান্তরে পৌরাণিক শিবও সংহারের দেবতা ও প্রলয়ের প্রতিভূ। বেদের রুদ্র শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, অনেক ভাল ভাল ঔষধী তিনি জানেন, তাই তিনিই  বৈদ্যনাথ, তিনি আয়ুর্বেদের রসবিজ্ঞান শাখার উপদেষ্টা। ঋগ্বেদের একাধিক মন্ত্রে (২/৩৩/৪,৬,৭) রুদ্রকে বলা হয়েছে‘বৃষভ’,  তাই মহাদেবের এক নাম বৃষভধ্বজও বটে। বেদের রুদ্র ধনুর্বাণধারী,  তাই দেবাদিদেব কিরাতরূপ ধারণে তদীয় শ্রীকরে ধনুর্বাণ পরিশোভিত।

“Mahadev is Everything & Everywhere”
Virupaksha Temple, Hemakuta Hill, Hampi, Karnataka

রুদ্র , পূষা ও সোম জটাজুটধারী। পূষা গোরক্ষক বা পশুরক্ষক দেবতা,  তাই মহাকাল পশুপতিও বটে। পূষার এক নাম‘অনষ্টপশু’। পূষার আয়ুধ তীক্ষ্নাগ্র লৌহদণ্ড বা শূল,  ত্রিশূল। শিবই সোম। তিনি সোমচিহ্ন ললাটে ধারনপূর্বক শিব হয়েছেন সোমার্দ্ধমৌলি বা চন্দ্রমৌলি। সোম বা চন্দ্রের স্নিগ্ধোজ্জ্বল কিরণসুধা শ্রীঅঙ্গে লেপন করে নিয়েই যেন তিনি হয়েছেন‘রজতগিরিনিভ’। কোন কোন পণ্ডিত বলেন–এই‘সোম’কথাটার মধ্যেই পৌরাণিক শিব-পার্বতী বা তান্ত্রিক শিব-শক্তির তত্ত্বজীব নিহিত। উমার অর্থাৎ আদ্যাশক্তি মহামায়ার সহিত যিনি বর্তমান, (স+উম) তিনিই সোম। 

সুতরাং সেই আদিদেব , সেই আদিনাথ হতে জাত, তাঁর উপাসক ও শিষ্যই হলেন নাথযোগী।  এই সূত্রে চৌরাশি সিদ্ধার কথা যখন উঠে আসে , তেমনি আমাদের পৌঁছে যেতে হয় একাদশ রুদ্র তত্ত্বে। কারণ , যোগীগণ এই একাদশ রুদ্রের প্রধানতম মহারুদ্র হতে জাত। অর্থাৎ, রুদ্রদেবই নাথ যোগীদের আদি উৎস, সেইজন্যই তাঁরা নিজেদের রুদ্রের সন্তান বলে দাবি করে থাকেন। পূর্বেই আমি একাদশ রুদ্রের নাম উল্লেখ করেছি। এই একাদশ রুদ্রকে আবার একাদশ তনুও বলা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে বলে রাখি , মহাদেব ১. অজ ২. একপাদ ৩. অহিরত্ন ৪. পিনাকী ৫. অপরাজিত ৬. ত্র‍্যম্বক ৭. মহেশ্বর ৮. বৃষাকপি ৯. শম্ভু  ১০. হর ১১.ঈশ্বর – এই একাদশ মূর্তি ধারণ করেছিলেন। 

Lingas excavated from the Harappan sites.

অন্যমতে এই একাদশ রুদ্র হলেন – অজৈকপাদ, অর্হিবুধ্ম‍্য , বিরূপাক্ষ, সুরেশ্বর , জয়ন্ত, বহুরূপ, ত্র‍্যম্বক, অপরাজিত ,বৈবস্বত এবং হর।

তৃতীয় একটি মতে ব্রহ্ম শিব এবং শক্তি জাত এগারটি সন্তান হলেন একাদশ রুদ্র। এঁরা হলেন – মহান্ , মহাত্মা, মতিমান্, ভীষণ, ভয়ঙ্কর, ঋতু , ঊর্ধ্বকেশ, পিঙ্গলাক্ষ, রুচি, শুচি এবং কালাগ্নি। এঁদের শক্তির নাম হল – কলা ,কলাবতী, কাষ্ঠা, কালিকা, কলহপ্রিয়া, কন্দলী , ভীষণা , রাস্না, প্রাম্লচা , ভূষণা এবং শুক্লী। এই তালিকা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে। এনাদের থেকে মহাদেবের উপাসক সন্তানের জন্ম হয় । এনারাই যোগী এবং যোগীগণের আদি। এই যোগীগণ কনফট্ , অওঘোর, মচ্ছেন্দ্র, শারঙ্গীহার , কানিপা, ডুরিহার, অঘোরপন্থী, সংযোগী এবং ভর্তৃহরি – নয় শ্রেণীতে বিভক্ত। বল্লাল চরিত এবং অক্ষয়কুমার দত্তের ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় গ্রন্থে এব্যাপারে বিস্তারিত লেখা আছে। 

#ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস

২. উত্তরবঙ্গে গোরক্ষনাথের গান

৩. শ্রী শিবগোপাল দেবশর্মা 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.