পর্ব ৬
প্রথম পর্বেই বলেছি যে গোরক্ষনাথের পূজাব্রতর এক মূল কর্ম বা নিয়ম হল , রাজবংশী সমাজের বালকগণ গান গেয়ে গৃহস্থ বাড়ি থেকে চাল, ডাল, পয়সা সংগ্রহ করে। ওই সব মাধুকরী দ্রব্য দিয়েই হয় গোরক্ষনাথের ব্রত উপাসনা। আমন ধানের মরসুমেই গান করে দক্ষিণ বা দান সংগ্রহ করা হয়ে থাকে । এই যে গীত গাওয়া হয় তাকে #হাইচাও বলে। মুখ প্রসারিত করে এই গানের শব্দ উচ্চারণ বা হাই করা হয় বলে বোধহয় গানের নাম হয়েছে হাইচাও। এর স্বপক্ষে গোরক্ষনাথের একটি গানও আছে –
হাচাইল হাচাইল হাচাওরে এনাবেনা হাচাওরে ফুল চরণে।
হাচাওরে ধউলি গাই তোর আশুরবাদে দুধভাত খাই।।
হাচাইল হাচাইল হাচাওরে এনাবেনা হাচাওরে ফুল চরণে।
হাচাওরে পাকরা বলদ তোর আশুরবাদে ধান ঘরতি।।
দ্বিতীয় গানটি হল –
হন্না হন্নি তাম্বুল বন্নি
ধান খায় গোদ গোদায় ।
আইলতে বসি গড়াগড়ি যায়,
আইলের বাঘে ধরিয়া খায়।।
এক বাঘের নাম হইচই
গাওলাক মারিয়া আনলেক দই ।
এক বাঘের নাম হামেলা
বাছিয়া মারে কামেলা।
এক বাঘের নাম মাথার চান্দি
পাত্ ফালাইতে নিয়া গেইল বান্দি
এক বাঘের নাম খুক, কাসে
ঝোলকমারি তামাক আইসে….
হ্যাঁ , গোরক্ষনাথের ব্রত উপাসনার এক অন্যতম ভাগ হল গাভীসিজ্জন অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান পালন করা হয় গোয়াল ঘরে। কিংবদন্তি আছে ,একবার এক গোয়ালা দুধ থাকতেও বিক্রেতার কাছে দুধ নেই বলে মিথ্যাচার করেছিল। এই মিথ্যাচারের জন্য তার গাভীগুলো গোয়াল ঘরে মারা যায়। পরে গোয়াল ঘরে গোরক্ষনাথের ব্রত ও গাভীসিজ্জন অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে প্রার্থনা জানালে গাই বাছুরগুলি পুনরুজ্জীবিত হয়। নানা উপাচারের মাধ্যমে ফুল, তুলসী, দূর্বা , বিল্বপত্র প্রভৃতি দিয়ে পূজা দেওয়া হয় গোয়ালঘরে। এই পূজার পর গোয়ালঘরের অমঙ্গল দুষ্টভাব কেটে যায় বলে মনে করা হয় । পূজা সম্পন্ন হলে নিচের গানটি গাওয়া হয়-
হাসেরে গোয়ালনী হাতে নিয়ে মাটা
তারপর জিয়া উঠে গোয়ালিনীর ব্যাটা।
হাসেরে গোয়ালনীর মাও
হাতে নিয়া দাও।
এরপর মনে করা হয় যে, গাভী বাছুর জিয়া ওঠে বা সুস্থ হয়ে ওঠে-
হাসেরে গোয়ালনী হাতে নিয়া মাটা
সাত শোয়া গাভী বাঁচিল নয়শোয়া বাছা।
এরপর গৃহস্থ আয়োজিত পূজার প্রসাদ গাভী, বাছুর এবং বলদদের দেওয়া হয় আনন্দে মন ভরে ওঠে তখন গান গাওয়া হয়-
হাচাইল হাচাইল হাচাওরে এনাবেনা চাওরে ফুল চরণে।। হাচাওরে ধউলি গাই তোর আশুরবাদে দুধ ভাত খাই।। হাচাইল হাচাইল হাচাওরে এনাবেনা চাওরে ফুল চরণে।।
হাচাওরে পাকরা বলদ তোর আশুরবাদে ধান ভরতি।।
তুই হাচাইলে ফুল না তেল নাই , মুঠে মুঠে খই ছিলাই।।
হইলরে গোরক্ষনাথের পূজা আলয়া আতপ গেইল সুজা।।
হইলরে গোরক্ষনাথের পূজা কলা কদলী গেইল সুজা।।
হইলরে গোরক্ষনাথের পূজা গুড় চিনি গেইল সুজা।।
হইলরে গোরক্ষনাথের পূজা ধূপ সিন্দুর গেইল সুজা।।
হইলরে গোরক্ষনাথের পূজা দই চিঁড়া গেইল সুজা।।
হইলরে গোরক্ষনাথের পূজা জল পানি গেইল সুজা।।
হইলরে গোরক্ষনাথের পূজা পাতখোলা গেইল সুজা।।
হইলরে গোরক্ষনাথের পূজা গুয়াপান গেইল সুজ।।
রাখাল বালকেরা যখন হাইচাও গেয়ে দক্ষিণা সংগ্রহ করে তখন মাঝে মাঝে গৃহস্থরা মজা করে কিছু ধাঁধা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় এবং সেইসঙ্গে উত্তরের আশায় গৃহস্থ অপেক্ষা করে থাকে। এই যে ধাঁধাঁ গুলি জিজ্ঞাসা করা হয় এগুলিকেই ” গোরক্ষধান্ধা” বা “গোরক্ষনাথের ধান্দা” উচ্চারান্তে “গোলকধাঁধা ” সুপরিচিত। এর ভিতর দিয়ে গানের কলির মতো প্রশ্ন ও উত্তর ভাসতে থাকে। এই ভাবেই একটি গানের আসর জমে ওঠে ও পূর্ণতা লাভ করে।
প্রথম ধাঁধা –
ছাওয়া হাইগছে তিনটে
হাইচাও গাইবেন কোন্টে?
উত্তর – ছাওয়ার মাও বোছাগুড়ি
গু ফেলে দে হাইচাও জুড়ি।।
দ্বিতীয় ধাঁধা- ঘরের পাছোত গাই খুড়িয়া
হাইচাও কৈলে কোন্ কুড়িয়া
উত্তর – ঘরের পাছোত নাপা শাক
হাইচাও কৈলে তোর বাপ।।
তৃতীয় ধাঁধা – শুভে করা হৈলেন খাড়া
তোমার টিকাত্ হোলগোছ গাড়া।
উত্তর – হোলগোছ উকড়ি মান্নুং পাক
হামরা হৈনোং তোমার বুড়া বাপ।।
এইভাবেই হাইচাও বা সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে রাখালবালকরা দান সংগ্রহ করে।
কোন গাভীর বাচ্চা হবার পর সেই দুধ কোন দেবতার কাজে লাগানোর পূর্বে গোরক্ষনাথের পূজা করে শুদ্ধ করে নেওয়া হয়ে থাকে । শুদ্ধি না করলেই এই গাইয়ের দুধ কোন দেবতার অনুষ্ঠানে কাজে লাগে না । দুধ দিয়ে ঘোঁটা তৈরি করে এই পূজার আয়োজন করা হয় এবং গান গাওয়া হয়। এই গানই পূজার অন্যতম প্রধান উপকরণ। একটি গানের উল্লেখ এক্ষেত্রে করতেই হচ্ছে –
এই গাই কপিলি পেটি হয়রে হয়,
আঠারে ঘটিত হয় রে হয়।
সে দুই কি হৈল হয়রে হয়,
সে দুই বিলাই খাইলে হয়রে হয়,
সে নেপরা কি হইল হয়রে হয়,
সে নেপরা বাড়িয়া খাইলে হয়রে হয়,
কেনরে বাড়িয়া নেপরা খালু হয়রে হয়,
আখালে কেন ঘাস না খাওয়ায় হয়রে হয়,
কেনরে আখাল ঘাস না খাওয়াইস হয়রে হয়,
গিরতানি কেন ভাত না দেয় হয়রে হয়
গিরতানি কেন ভাত না দেয় হয়রে হয়
আখালে কেন পাত না কাটে হয়রে হয়……
অর্থাৎ , দেখা যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষি ও উর্বরতা মূল শক্তি হিসাবে শিবই কেবল নন,. শিবের উপাসক , শৈব আচার্যও পূজিত হন। তিনি অশুভ শক্তি বিনাশ করে গো রক্ষা করেন। শোনা যায় , কোনো এক পীরের কুদৃষ্টিতে নাকি গোয়ালার গাই মরে ছিল, কিন্তু গোরখনাথের পূজায় তারা জীবিত হয়ে ওঠে। সুতরাং, এই পূজাব্র্ত কেবলমাত্র অশুভকে নাশ করার ব্রত নয়, এটি সনাতনী অস্তিত্বকে পুনরুজ্জীবিত করার এক রূপক ব্রতও বটে। একসময় ঝড়ে কাক মরলেও ফকিরের কেরামতি হতো, কেরামতি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ধর্মকে প্রসারিত করা হতো। সেই জায়গায় আঘাত হেনেছিলেন গোরক্ষনাথ। উচ্চ নিচ নির্বিশেষে সকল সনাতনী সমাজকে একত্রিত করতে সক্ষম হন। এখানেই জয়ী যায় গোরখনাথের ব্রত।
ধনুঃ শতং পরী হারো গ্রামস্য স্যাৎ সমন্ততঃ।
শম্যাপাতাস্ত্রয়ো বাপি ত্রিগুণো নগরস্য তু।।
সুবিশাল অখণ্ড ভারতের বৈদিক হতে লৌকিক সমাজে সেই সুপ্রাচীন কাল হতে গাই-গোরু ভগবতী জ্ঞানে পূজিতা হয়ে আসছেন। পূর্ব কালে বিবাহ থেকে যজ্ঞানুষ্ঠান সকল ক্রিয়া কর্মে গোধন দান পুণ্য কর্ম বলে বিবেচিত হতো। গরু বা গো হলেন দুঃখ বিনাশিনী মাতা।
গো এবং শস্যধনই তো সকল ধনের শ্রেষ্ঠ ধন। বিখ্যাত পন্ডিত ও বিদেশি ভারততত্ত্ববিদেরা আমাদের সনাতন শাস্ত্রে যেখানেই গো শব্দ পেয়েছেন তার অর্থ করেছেন গরু! কিন্তু হলায়ুধ সংস্কৃত কোষে পাওয়া যায় ‘গো’ শব্দের দশটি অর্থ যার সবকটিই সংস্কৃত সাহিত্যে ও কথ্য সংস্কৃতে প্রয়োগ হয়েছে! ‘গো’ শব্দের দশটি অর্থ হল- (১) দিশা,(২) দৃষ্টি,(৩) কিরণ,(৪) স্বর্গ,(৫)বজ্র,(৬)বাণী বা বেদান্তবাক্য,(৭) বাণ,(৮)বারি,(৯)ভূমি ও (১০) গরু নামক পশু। সকলের নিকটই আমরা কোনো না কোনোভাবে কৃতজ্ঞ।
বেদে বলা হয়েছে – অঘাসু হন্যতে গাবঃ কথাটার লৌকিক সরল অর্থ হল, সুপ্রাচীন যুগ হতে গরুই ছিল প্রধান সম্পদ, বিবাহাদিতে যৌতুক হিসাবে গরুই দান করা হত। মঘা নক্ষত্রে সূর্যের কিরণ মন্দীভূত হয়, কাজেই কন্যার পিতৃপ্রদত্ত গবাদি পশু ঐ সময়েই পতি গৃহে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হত আর অর্জুন্যো পর্য্যুহ্যতে মানে ফাল্গুনী নক্ষত্রে কন্যা স্বামী গৃহে যাত্রা করতেন।
মাতা রুদ্রাণাং বসূনাং স্বমাদিত্যনামমৃ তস্য নাভিঃ
প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায়,মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট।( ঋ ৮/১০১/১৫)
এর অর্থ হল গরু হল বসু, রুদ্র আদিত্যদের কন্যা, মা ও ভগিনীর সমান।গরু দুধ অমৃত দান করে।সকলে জেনে রাখ গরু,,যার অদিতি,তাকে বধ করো না।
ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়াগ্নে মা হিংসী পর মে ব্যোমন্।১৩/৪৬
মানে মানুষকে যে ঘৃতদান করে তার নাম অদিতি, কাজেই তাকে হিংসা কোরো না।
বঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের পশ্চিমে এবং মানভূম এলাকায় এই গো বা ভগবতী পূজার থেকে জন্ম হয়েছিল কপিলা মঙ্গলগানের।
গোরু সেই ঐতিহাসিক কাল হতে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান জীব। তাই, প্রাচীন কাল হতে গো বিনিময় প্রথার মাধ্যমে দ্রব্য কেনাবেচা হতো। মূল্যবান অত্যন্ত , তাই গো সম্পদ এবং কৃষি সম্পদকেই প্রকৃত সম্পদ বলে মনে করা হতো। গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতি এবং গো ও অশ্ব সম্পদ বেদে গুরুত্বময় রূপে স্বীকৃত।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে …
সেই সুপ্রাচীন কালে , সেই অতি প্রাচীন ত্রিকালজ্ঞ বৈদিক ঋষিগণ তাই কৃষিবল , বৃক বা সীর এবং গো কে প্রকৃত শক্তি এবং সম্পদ বলে উল্লেখ করে উক্ত সকল কিছুর জন্য মঙ্গল কামনা করেছেন কৃষির অধিষ্ঠাত্র দেব ক্ষেত্রপতির নিকট। ধেনুর পুষ্টিকর দুগ্ধের ন্যায় পুষ্টিকর জলের জন্য প্রার্থনা করেছেন।
ক্ষেত্রস্য পতিনা বয়ং হিতেনে জয়ামসি।
গামশ্বং পোষয়িত্ব স নো মৃলতীদৃশে।।
ক্ষেত্রস্য পতে মধুমন্তমূমিং ধেনুরিব পয়ো অস্মাসু ধুক্ষব।
মধুশ্চুতং ঘৃতমিব সুপূতমৃতস্য নঃ পতয়ো মৃলয়ন্তু।।
ঋগ্বেদে গো হল রয়ি বা সম্পদ। গোমৎ শব্দটি ধনী ব্যক্তির সমার্থক ,অর্থাৎ যিনি গোসম্পদের অধিকারী।দুহিতৃ অর্থ কেবলমাত্র কন্যাকেই বোঝাত না। দুহিতৃ ,অর্থাৎ যিনি গাভী দোহন করেন। তাই উক্ত শব্দটিও গোসম্পদ ব্যঞ্জনা মূলক।
শ্রী কৃষ্ণ গোপাল , যাদব বংশের প্রধান সম্পদ গোরু ছিল। মূল্যবান সম্পদ হিসাবে তাই দুর্যোধন বিরাট রাজার গাভী অপহরণ করেছিল। কেবলমাত্র কামধেনুকে কেন্দ্র করে মহর্ষি বশিষ্ঠ এবং ক্ষত্রিয় বিশ্বামিত্রের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হয়েছিল। কোনো কিছুর বিনিময় স্বর্গীয় গাভী কামধেনুকে ঋষি বশিষ্ঠ ত্যাগ করতে চাননি।
বহুনা কিং প্রলাপেন ন দাস্যে কামদোহিনীম।
সেই যুদ্ধে হেরেই বিশ্বামিত্র সাধন পথে এগিয়েছিলেন। তিনি হয়েছিলেন ব্রহ্মর্ষি।
ঋষি জমদগ্নির হোমধেনু অপহরণ করার নিমিত্ত পরশুরাম হৈহয়রাজ কার্তবীর্যকে হত্যা করেন। এরপর কার্তবীর্যের পুত্ররা জমদগ্নির আশ্রম আক্রমণ করে , ঋষিকে হত্যা করলে , রুষ্ট ,ক্রুদ্ধ পরশুরাম তাঁদের হত্যা করেন। এরপর পরশুরাম একুশবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেন।
অর্থাৎ , রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি ...এমন রোম্যান্টিসিজম যেমন কেবল গাভীকে কেন্দ্র করে ছিল , গাভীকে কেন্দ্র করে ছিল অর্থনীতি , তেমন গাভীর জন্য অনেক ইতিহাস বদলে ছিল।
ঋগ্বেদে তাই বলা হয়েছে –
গোমাঁঁ অগ্নেহ বিমাঁঁ অশ্বী যজ্ঞো নৃবৎসখা সদমিদপ্রমৃষ্যঃ।
ইল.বাঁ এষো অসুর প্রজাবান্ দীর্ঘ রয়ি পৃথবুধ্ন সভাবান্।।
হে অগ্নি , হে ভয়াল , আমাদের এ যজ্ঞ গো ,মেষ ও অশ্ব বিশিষ্ট হোক। যে যজ্ঞে যজমানেরা অধ্বুর্য প্রভৃতি ঋত্বিক বিশিষ্ট , সে যজ্ঞ সর্বদা অপ্রধৃষ্য হব্যবিশিষ্ট প্রজাবান হোক এবং অবিচ্ছিন্ন ধনসম্পদ , বিস্তীর্ণ মূলবিশিষ্ট এবং সভাযুক্ত হোক।
গোচারনের জন্য সুপ্রাচীন কাল হতে পৃথক ভূমি সংরক্ষিত হতো। ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে –
প্র বাহবা সিসৃতং জীবসে ন আ নো গব্যূতিমুক্ষতং ঘৃতেন।
আ নো জনে শ্রবয়তং যুবানা শ্রুতং মে মিত্রাবরুণা হবেমা।
হে মিত্র বরুণ ,বাহু প্রসারিত করো। আমাদের জীবনার্থে আমাদের গোচারণস্থান জলসিঞ্চিত করো। মনুষ্যসমূহের মধ্যে আমাদের বিখ্যাত কর। তোমরা নিত্য তরুণ ! আমাদের এই আবাহন শোনো।
অথর্ব বেদে বসুন্ধরার নিকট প্রার্থনা করে বলা হয়েছে –
যস্যাং পূর্বে পূর্বজনা বিচক্রিরে সম্যাং দেব অসুরানভ্যবর্তয়ন্।
গবামশ্বানাং বয়সশ্চ বিষ্ঠা ভগং বর্চ পৃথিবী নো দধাতু।।
আমাদের পূর্বজনেরা , যাঁরা আমাদের উৎপীড়িত করত সেই অত্যাচারী অমঙ্গল শক্তি দমন করে অসীম শৌর্য দেখিয়েছিলেন। গো, অশ্বের মতো গৃহপালিত পশুরা এবং আমাদের উপকারী বিহঙ্গকুল এই ধরিত্রীতে আশ্রিত । হে ধরিত্রী , হে বসুন্ধরা আমাদের সকলকে শক্তি ও সমৃদ্ধি দাও।
খনার বচনে আছে –
ন – ঘর ছ – ঘর ভাগ্যে পাই।
সাতুল দেখে দূরে পালাই।।
গোরু চিন বা না চিন।
ধলা খুঁচি দেখে কিন।।
সাতুল – সাত , খুঁচি – পালান
উত্তম গোরুর লক্ষণ এখানে বর্ণিত হয়েছে।
গো সেবা তাই সনাতনী জীবনে ছিল এক অত্যন্ত পবিত্র কর্ম। গাভীমাতা সন্তুষ্ট ও সুখী হলে দেবী ভগবতী ব্রহ্মময়ী মা দুর্গা গৃহলক্ষ্মী মা অন্নপূর্ণা গৃহস্থের প্রতি সদয় থাকেন। গো সেবা জীব সেবা। সকল জীবের মধ্যেই তো ব্রহ্ম বতর্মান। সুতরাং , পটুয়া চিত্রকরদের গো মঙ্গল বা কপিলামঙ্গল গানও সেই পবিত্র কর্মের অঙ্গ। তাতেও গৃহস্থের মঙ্গল হয়।
যে শিব স্বয়ং গো রক্ষক , তাঁর উপাসক সিদ্ধ পুরুষ কিংবদন্তিতে শিবের দেহ বা গোবর থেকে আবির্ভুত গোরক্ষনাথ স্বাভাবিক ভাবেই গো রক্ষা করবেন , এই তো বিশ্বাস। সেই গোরক্ষার ব্রত কোথাও বা গরুচুমা , কোথাও বা গো বান্না বা বাঁদনা পরব , কোথাও গোবৎস দ্বাদর্শী হিসাবে পালিত হয়।
হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে।
গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে ।।
ওঁ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ ।।
স্বভাবগতভাবেই সব লোক সাধারণত ধর্ম প্রবণ হয়ে থাকে। পল্লী সমাজের বুকে আজও অতীত স্মৃতি সত্তা লুকিয়ে আছে অনুসন্ধান, প্রকাশের অপেক্ষায় । যার যথাযথ অনুসন্ধান ও প্রকাশের ফলে যা ইতিহাসের নতুন অধ্যায় উন্মোচন করে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে শ্রী রাধাগোবিন্দ বসাক মহাশয় এর মন্তব্য , তিনি বলেন যে , ” যে পর্যন্ত না কেউ এই দেশের লৌকিক দেবতা বিষয়ে লিখেছেন সে পর্যন্ত বঙ্গের সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অলিখিত থেকে যাবে। “
এই লোকাচারকে কেন্দ্র করে রাঢ় বঙ্গে যেমন পটুয়া বা গায়েনরা গায় গোমঙ্গল বা কপিলামঙ্গল গান , তেমন উত্তরে রাখালবালকরা গান করে গোরক্ষনাথের ব্রতগান। রাখালই তো গোধনের প্রকৃত রক্ষাকর্তা। রাঢ়অঞ্চলে একসময় রাখাল বালকদের বিপদের হাত থেকে রক্ষার জন্য ব্রত অনুষ্ঠান পালন করা হতো। এইসব পটুয়া , রাখাল – এরা গান বেঁধে সমাজকে শিক্ষা দিত। শিক্ষা দিত গোপালনের ….তারাই তো সনাতনী সমাজের মূল ধারক ও বাহক।
শ্রদ্ধেয় গুরুসদয় দত্ত মহাশয় বহু অজানা তথ্য আবিষ্কার করেছেন । বর্তমানেও বহু তথ্য সন্ধানী লোকসংস্কৃতি গবেষক এই কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তুলে ধরেছেন জেলাগুলির সুমহান ঐতিহ্য । আমার বর্তমান আলোচনা সেই বহমান লোকসংস্কৃতির একটি ক্ষুদ্র অংশ। গাভীকে কেন্দ্র করে নানা লোকাচারের মাধ্যমে সনাতনী বঙ্গ তথা ভারত এক হয়ে যায়।শ্রদ্ধেয় গুরুসদয় দত্ত মহাশয় বহু অজানা তথ্য আবিষ্কার করেছেন । বর্তমানেও বহু তথ্য সন্ধানী লোকসংস্কৃতি গবেষক এই কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তুলে ধরেছেন জেলাগুলির সুমহান ঐতিহ্য । আমার বর্তমান আলোচনা সেই বহমান লোকসংস্কৃতির একটি ক্ষুদ্র অংশ। নাথ যেমন শিবময়, শিবও নাথময়। তাঁকে এবং তাঁর রক্ষিত কৃষি , গাভী ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে নানা লোকাচারের মাধ্যমে সনাতনী বঙ্গ তথা ভারত এক হয়ে যায়।
সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস
২. উত্তরবঙ্গে গোরক্ষনাথের গান
৩. শ্রী শিবগোপাল দেবশর্মা
বিঃদ্রঃ ছবি-
বর্ধমান জেলার পাড়ুই আর কুড়মুন এর গাজন এবং বোলান।