পর্ব ৪
একদিন গোরক্ষনাথ দেখলেন তাঁর গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ কোনও একজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য কদলী বা কিম্পুরুষ দেশে গেলেন। কিন্তু তারপর তিনি আর ফিরলেন না। এদিকে গোরক্ষনাথ তখন বিজয়নগর ত্যাগ করে এক বকুলগাছের নিচে সাধনা করছেন। তাঁর অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা দেখলেন তাঁর গুরু নিষিদ্ধ ভোগে মগ্ন। অন্যমতে ধ্যানে কানুপা এসে গোরখনাথকে বললেন , ” তোর গুরু পড়িয়াছে কদলীর ভোলে…”। তাঁর শরীর জীর্ণ এবং যমের বাড়িতে গিয়ে দেখেছেন মাত্র তিনদিন আয়ু। এদিকে হাড়িফার অবস্থাও ভালো নয়। মেহেরকুলের রাজমহিষীর পুত্রের কোপে পড়েছেন। সে হাড়িফাকে বেঁধে মাটির নিচে রেখে দিয়েছে। এই কানুপা, হাড়িফা এঁদের উল্লেখ আমরা গোর্খবিজয় পুঁথি, গোপীচন্দ্রে গানে পাই।
যা হোক, এসব দেখে শুনে গোরক্ষ নাথ আতঙ্কিত হয়ে পরলেন-“কি করে আমার গুরুর এই অবস্থা হতে পারে? তো সিদ্ধ যোগী!” দত্তাত্রেয় সংহিতায় বলা হয়েছে –
যদি সঙ্গং করোত্যেব বিন্দুস্তস্য বিনশ্যতি।
আয়ুক্ষয়োবিন্দুহীনাদসমার্থঞ্চ জায়তে।।
অর্থাৎ, ব্রহ্মচর্য মাঝে যদি কাম ,ক্রোধ, লালসার স্বীকার হয় , তবে যোগীর বিন্দু ক্ষয় এবং তা থেকে আয়ুক্ষয় হয়।
তাছাড়া , এও বলা হয়েছে –
দিনে দিনে সুসংমৃষ্টং সম্মার্জন্যাপাতন্দ্রিতঃ
বাসিতঞ্চ সুগন্ধেন ধূপিতং গুগ্গুলাদিভিঃ।।
আলস্য পরিত্যাগ করে প্রতিদিন মঠ মার্জনা বা সাধনস্থল মার্জনা এবং ধূপ ধুন ইত্যাদি দিয়ে সুবাসিত করা কর্তব্য।
যোগীদের আহারের ব্যাপারেও নিষ্ঠা ও নিয়ম মানা কর্তব্য –
কটূম্লতিক্তলদণোষ্ণহরীত শাক –
সৌবীরতৈলতিলসর্ষপমতসামদ্যম্।।
অজাদিমাংসদধিতক্তকুলন্থকোল-
পিন্যাকহিঙ্গুলসুনাদ্যমপথ্যমাহুঃ।।
কটু ,অম্ল, তিক্ত, লবণ , উষ্ণ দ্রব্য, হরীত শাক, বদরী ফল, তৈল ,তিল, সর্ষপ, মৎস্য, মদ্য , নানাপ্রকার মাংস, তক্র, কুলন্থ, কলায়, পিন্যাক, হিঙ্গু, লসুন দ্রব্য একজন যোগীর জন্য অপথ্য।
গোধূমশালিয়বযষ্টিশভৌনান্নং
ক্ষীরাদ্যখণ্ডনবনীতসিতামধুনি।
শুঠোকপোলকফলাদিকপঞ্চাশাকং
মুদ্গাদিদিব্যমুদকঞ্চ যমীন্দ্রপথ্য।।
গোধূম, শালিধান্য, যব, যষ্টিক ধান্যরূপ সুচারু অন্ন, ক্ষীর, অখণ্ড নবনীত , চিনি, মধু ,শুন্ঠী,কপোলক ফল, পঞ্চশাক, মুগ ইত্যাদি এবং উত্তম জল যোগীর পথ্য।
গোরক্ষনাথ দেখলেন তাঁর গুরু এসব তো করছেনই না। বরং যা কিছু নিষিদ্ধ তাই তাই করছেন। ফলে , তিনহাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে গুরুর সম্ভ্রম রক্ষার উদ্দেশ্যে গোরক্ষনাথ সেই কদলী রাজ্য বা কিম্পুরুষ দেশ ,অর্থাৎ নেপাল পৌঁছান। তিনি সমস্ত পথ পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছে দেখলেন তাঁর গুরু সেই সব কাজ করছেন যা কেবল একজন যোগীর নয় এক সামাজিক মানুষের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয়। তাঁর গুরু অপ্সমারের স্বীকার হয়েছেন। গোরক্ষনাথ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি ভাবলেন “মৎস্যেন্দ্রনাথের সাথে এমনটা কিভাবে হতে পারে? তিনি তো প্রায় শিব”। গোরক্ষনাথ মৎস্যেন্দ্রনাথকে কত বিভিন্ন শক্তিশালী রূপে অনুভব করেছেন, আর এখানে ….?
তখন গোরখনাথ দুন্দুভি ,মাদল বাজিয়ে তাঁকে কায় সাধনার কথা মনে করিয়ে দিলেন। ” মাদলের গানে কহে গুরুরে বুঝাই “। মাদলের ঘা , ” কায়া সাধ , কায়া সাধ মাদলেতে বোলে ” গুরুকে বললেন,”আপনাকে আসতেই হবে , বিন্দুধারণ করাই মূল।” গোরখনাথের প্রচণ্ড মূর্তি দেখে অপ্সমারগণ ভয়ে চলে গেল। গোরখ তাঁর গুরুকে সেখান থেকে বার করে আনলেন এবং নিজের সঙ্গে নিয়ে গেলেন।
পথে মৎস্যেন্দ্রনাথ স্নান করতে গেলেন। তাঁর হাতের ঝুলিটা গোরখনাথ কে দিয়ে বললেন, “এটা সামলে রেখো। এরমধ্যে অতি মূল্যবান জিনিস আছে।” এরপর তিনি নদীতে স্নান করতে নামলেন। ঝুলিটা ছিল খুব ভারী, তাই গোরক্ষনাথ সেটা খুলে দেখলেন ভিতরে দুটো বড় বড় সোনার বাট । দেখে তার মন ভেঙ্গে গেল,”আমার গুরুর একি হল? প্রথমে নিষিদ্ধ সঙ্গ , আর এখন সোনা সংগ্রহ করছেন! তিনি চাইলে গোটা পাথরকে সোনায়ে পরিণত করে দিতে পারেন; তাঁর মধ্যে সেই মাত্রার অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু এই মানুষটির দুটো স্বর্ণ বাটের প্রতি এত আসক্তি। কিন্তু কেন?” আর তিনি সোনার বাট দুটো নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তারপর তাঁরা দুজনে ফিরে এলেন।
গোরক্ষনাথ নিজের গুরুকে, এভাবে পথভ্রষ্ট হতে দেখে চরম মনোকষ্টে ছিলেন, আর এখন তিনি গর্বিত অনুভব করছিলেন এইজন্যে যে, তিনি গুরুকে পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য তিন হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটেছেন।
যখন তাঁর মধ্যে এই গর্ব বোধ এল, মৎস্যেন্দ্রনাথ গোরক্ষনাথের মাথায় হাত রাখলেন, আর গোরক্ষনাথ হঠাতই উপলব্ধি করলেন তিনি যেখানে ছিলেন সেখানেই বসে আছেন। না তিনি কদলী গেছেন হেঁটে, না দেখেছেন অপ্সমারদের রূপ, না দেখেছেন কোন সোনা – কিছুই না। এসবই ঘটছিল তাঁর মনের মধ্যে। কিন্তু তাঁর কাছে এসবই সত্যি ছিল-তিনি প্রকৃতপক্ষেই হেঁটেছিলেন, সেখানে গিয়েছিলেন এবং সেসব দেখেছিলেন। এসবই ঘটেছিল তাঁর গুরুর অলৌকিক ক্ষমতার বলে। মৎস্যেন্দ্রনাথ যোগবলে এই সবকিছু তাঁর চারপাশে তৈরি করেছিলেন।
এবার গোরক্ষনাথ একেবারে ভেঙে পড়লেন। মৎস্যেন্দ্রনাথ বললেন,”আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে রক্ষা করার জন্য তুমি তিন হাজার কিলোমিটার হাঁটতে তো প্রস্তুত। তোমার জন্য এটাই অসাধারণ; নিজের মধ্যে এটাই বজায় রেখো। তুমি কাম ,লোভ , মায়া , মোহ, জয় করেছ। শিবের কাছে এসে এই সকল কিছু মিশে এক হয়ে যায়। সেই কর্ম তুমি সম্পাদন করেছ। তুমি শ্রেষ্ঠ যোগী এবং তুমি শিবের সঙ্গে পূজিত হবে ।”
হ্যাঁ , উক্ত কাহিনীটি নানা রূপক প্রতিপন্ন করে। নানা পুঁথিতে উক্ত কাহিনী নানা মোড়কে আবদ্ধ হয়ে রচিত হয়েছে। কিছু শব্দ সেসব ক্ষেত্রে রূপক হিসাবে ব্যবহার হয়েছে। আসলে , শিবই তো পরম ব্রহ্ম। তাঁর নিকট এসে কাম, ক্রিয়া সব এসে সমাহিত হয়। তাই তিনি কামদেবকে ভস্ম করেছিলেন। তিনিই কামেশ্বররূপ ধারণ করে অবস্থান করেন ব্রহ্মময়ী ত্রিপুরাসুন্দরীর সঙ্গে। তাঁকে গুরু মেনে যিনি সাধন করেন তিনিও শিবেরই গণ হন। তাই তো, নন্দীর কানে মনে কথা দিলে শিব সব জানতে পারেন। গোরক্ষনাথ সব কিছুকে জয় করেছিলেন বলেই তিনি আচার্য এবং পূজনীয় হয়েছিলেন। তিনি সেই মায়াময় কদলী দেশে কাম , লালসাকে জয় করেছিলেন বলেই, বলা হয় তিনি কদলী জয় করেন , তাই গোরক্ষবিজয়। সেখান হতে এক সুবিশাল অংশে গোরখনাথের সেই সংযমের কথা, গুরুভক্তির কথা প্রচারিত হয়েছিল, সেই অংশকেই গোর্খভূমি বা গোর্খাভূমি বা গোর্খাদেশ বলা হয়। তাঁর নামেই তাই গোর্খাভূমির মানুষদের গোর্খা বলা হয়।
ইদং তীর্থ মিদং তীর্থ ভ্রমন্তি তামসা: জনা:
আত্মতীর্থং ন জানন্তি কথং মোক্ষ বরাননে৷।
গোরক্ষনাথ কদলীতে কাম, লালসাকে জয় করেছিলেন, তাই গোরক্ষবিজয়। পশ্চিম নেপালে এই গোরক্ষনাথের সন্ধান প্রাপ্ত হয়। তিনি ছিলেন যোগী ঋষি। এই গোর্খা অঞ্চলের অধিবাসী রাজা পৃথ্বীনারায়ণ নেপাল, সিকিমাদি অঞ্চল জয় করেন।
অনেকে মনে করেন কদলী বঙ্গেরই কোনো স্থান । অনেকে বলেন এটি আসাম। হারানচন্দ্র চাকলাদারের মতে এটি উত্তর পশ্চিম সীমান্তের কোনো প্ৰদেশের অন্তর্গত। লামা তারানাথের পাগসাম্ জোনজ্ঝান্ গ্রন্থে কদলীরাজ্যের যে উল্লেখ আছে, তা বঙ্গদেশের কোনো স্থান বলেই অনুমান হয়। গোরক্ষবিজয় কাহিনী অনুসারে গোরক্ষনাথ বিজয়নগর হয়ে বকুল এবং বকুল থেকে কদলী যান।
তন্ত্রে , বিশেষ করে বৌদ্ধমার্গীয় তন্ত্রে এক গুহ্য এবং প্রধান কেন্দ্র হল ওড্ডিয়ান। ওড্ডিয়ান ঠিক কোন জায়গায় সেটা নিয়ে আজও বিতর্ক আছে। ওড্ডিয়ানের দুটি প্রদেশ শাম্ভব ও লঙ্কাপুরী। Waddel এর মতে এটি বর্তমান সোবাট ও চিত্রলের কাছে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে উড়িষ্যায়। তবে “লঙ্কা” গৌহাটি থেকে ৯৫ মাইল দূরে নওগাঁ জেলার একটি মৌজা ও রেলস্টেশন। এই নওগাঁ থেকে ২৪ মাইল দূরে ভবকা। ভবকার ২১ মাইল দক্ষিণপূর্বে এবং লঙ্কা স্টেশন থেকে সমদূরত্বে বকুলিয়া গ্রাম। গোরক্ষনাথ বিজনগর থেকেই এই বকুলে এসেছিলেন। ভবকার কাছে নওগাঁ শহরের ১১ মাইল দক্ষিণ পূর্বে একটি মৌজার নাম কন্দলী। এখানে প্রাচীন মন্দিরে হরপার্বতী , শিবলিঙ্গ প্রাপ্ত হয়েছে। কন্দলী চা বাগানের তিন মাইল ঈশান কোণে পাহাড়ের উপরে একটি গুহার নাম বাদুলী কুরুং । কন্দলী পাহাড়ের একটি অংশের নাম বামুনী পর্বত। কন্দলী ও বামুনী পর্বতের কাছাকাছি মিকির পাহাড়ে প্রচুর চন্দন গাছ – রপ্তানিও হতো। এই জন্যই হয়তো “চারি কড়া”য় এক তোলা চন্দন এই কথা বলা হয়েছে পুঁথিতে।
কন্দলীর নিকটেই রয়েছে কয়েকটি গ্রাম – ননই , দীঘরদরি , পেটভরা ইত্যাদি। এখানে বহুসংখ্যক নাথ যোগীর বাস। নওগাঁ বাসী বদুলাকে বন্দুলা বলেন, বাদুলীকে বলেন বান্দুলি। সম্ভবত কদলীও এইভাবে অনুনাসিক উচ্চারণে কন্দলী হয়েছে , ডবকা হয়েছে ডাহুক। এছাড়া গোয়ালপাড়া জেলায় যোগিগুম্ফা এবং গোরক্ষপাহাড় আছে। তাছাড়া নওগাঁ থেকে নেপাল ইত্যাদি অঞ্চলের দূরত্বও অধিক নয়।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি , গোরক্ষনাথ ময়নামতী , বিমলা প্রমুখ নারীকেও তিনি যোগমার্গে দীক্ষা দিয়েছিলেন। নাথ শৈব মার্গকে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানিক মর্যাদায় স্থাপন করতে পেরেছিলেন এবং সেদিক দিয়ে গৌতম বুদ্ধ এবং শঙ্করাচর্যের ন্যায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। বুদ্ধদেবের পর শঙ্করাচার্য এবং গোরক্ষনাথই সনাতন ধর্মের সুসংহত তত্ত্ব এবং ভাব সকল প্রচার করবার জন্য এবং হিন্দুসমাজে উদার , সার্বজনীন , নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলেন। উভয়েই সনাতনের আস্তিক ভাব ও আচারের সঙ্গে বুদ্ধ প্রচারিত মার্গনীতির সামঞ্জস্য করে সনাতন থেকে ভুল বুঝিয়ে পৃথক করে নেওয়া বৌদ্ধসমাজকে পুনশ্চ সনাতন সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে এবং সনাতন সমাজকে নবভাবে গঠিত করতে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন।
অর্থাৎ নাথ কোনো পৃথক ধর্ম নয় । যোগ মার্গীয় পন্থারই একটি সুপ্রাচীন শাখা । সর্ব্বেশ্বর পিনাকপাণি শঙ্কর তাঁর পঞ্চবক্ত্রের(পঞ্চ মুখের) সদ্যোজাত নামক মুখ দিয়ে অব্যক্ত দুর্জ্ঞেয় নির্জ্ঞান ভূমি হইতে বেদকে সদ্যো জাত অর্থাৎ সদ্যো প্রকাশিত করিয়াছিলেন, তাই ওই মুখের নাম সদ্যোজাত । অব্যক্ত হইতে এই বেদবিদ্যা, এই বেদজ্ঞান নাদব্রহ্ম রুপেই প্রথম প্রকাশিত হয় । নাদব্রহ্মের অব্যক্ত সুক্ষ রুপের স্থুল রুপ হল ডমরু ধ্বনি । স্থুল প্রকাশ হল ডমরুধ্বনি বা ডমরুনাদ । এই ডমরুনাদ একটি নির্দিষ্ট তাল, লয় ও ছন্দে ধ্বনিত হয়। এবং ঐ তাল লয় ও ছন্দের মধ্যেই সৃষ্টির বীজ নিহিত আছে, যথা–
“ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি,
যস্তং বেদঃ স বেদবিৎ।”
বেদমূর্তি শঙ্কর এইভাবে নাদব্রহ্মরুপী অব্যক্ত বেদজ্ঞান ডমরুকে দান করলেন । শঙ্করের নির্দেশে ডমরু নিনাদিত হতে থাকলে অব্যক্ত মহানাদ, স্থুল ব্যাক্তনাদরুপে প্রকাশিত হতে লাগল । ব্রহ্মার চারি মানসপুত্র সনক, শৌনক, সুনন্দ ও সনৎ সুজাতীয় তখন সমাধির গভীরে নির্ব্বিকল্প অসম্প্রজ্ঞাত যোগাবস্থায় অবস্থিত ছিলেন। তাঁরা বোধির ওই নির্জ্ঞানভুমিতে স্থিতাবস্থায় লাভ করলেন ওই ব্যাক্ত নাদব্রহ্মের চৈতন্যময় প্রকাশ । যার অর্থ চার জনের কাছে,চারি মহাবাক্যরুপে প্রকাশিত হল । তাঁরা তাঁদের গুরু বেদমূর্তি শঙ্করের দিব্যভাবময় নির্দেশে উপলব্ধি করিলেন যে, ওই চারি মহাবাক্যের মধ্যেই চারিটি বেদ লুকিয়ে আছে । তাঁরা চারজনে ওই চারিটি মহাবাক্যের ওপর কঠোর তপস্যা দ্বারা মহাবাক্যোদ্ভব মন্ত্রময় তরঙ্গরাশি সমাধির উচ্চ ভূমিতে প্রকাশিত ও প্রেরণ করতে লাগলেন এবং উচ্চ আধার সম্পন্ন মেধাবী ও সমাধিমগ্ন ঋষিগণের অতীন্দ্রিয় চৈতন্যময় ভূমিতে সঞ্চারিত করতে লাগলেন । ব্রহ্মর্ষিগণও ওই অখণ্ড চৈতন্যময় নির্জ্ঞান বোধভূমিতে দর্শন করতে লাগলেন ব্রহ্মতেজোময় দিব্য মন্ত্ররাজি। ধীরে ধীরে ক্রমশঃ প্রকাশিত হতে লাগল বেদমন্ত্র । এইভাবেই সাক্ষাৎ বেদমূর্তি দেবাদিদেব শঙ্কর বেদকে অব্যক্ত নির্জ্ঞানভূমি হতে ব্যাক্তাকারে প্রকাশিত করলেন ঋষিদের মধ্য দিয়ে । আবার “ঈশান” নামক মুখ দিয়ে প্রকাশিত করলেন শৈবাগমতন্ত্র বিদ্যা যা আদি শৈববিদ্যা বা শাম্ভবীবিদ্যা নামে খ্যাত । “বামদেব” নামক মুখ দিয়ে প্রকাশিত করলেন শাক্তাগমতন্ত্রবিদ্যা ।
Chakleshwar Mahadev is one of the dig-pals or the area protector deities of Braj which is said to have been established by king Vajranabh, the great grandson of Sri Krishna. Lord Shiva in his form of chakleshwar Mahadev acts as the protector of the holy Govardhan Dham. It is located near to Manasi Ganga.
“অঘোর” নামক মুখ হতে প্রকাশিত হল অতি উচ্চ কাপালিকীতন্ত্রোদ্ভব অঘোর তন্ত্রবিদ্যা । আর পঞ্চম মুখ “তৎপুরুষ” নামক মুখ দিয়ে ব্যাক্ত তথা প্রকাশিত করলেন বিশুদ্ধ জ্ঞানমার্গীয় বিচারনিষ্ঠ বেদের অন্তর্নিহিত সার তত্ত্ব অদ্বৈত ব্রহ্মবিদ্যা, যাহা গৌড়পাদ, গোবিন্দপাদ ও আচার্য্যশঙ্করের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে বিকশিত, প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছিল । সুতরাং আদিপুরুষ দেবাদিদেব শঙ্কর এইভাবে সমস্ত বিদ্যাই প্রকাশ করেন । একমাত্র তিনিই সগুণ হয়েও নির্গুণাবস্থায় এবং সক্রিয় অর্থাৎ ক্রিয়াশীল হয়েও নিষ্ক্রিয় বিশুদ্ধ ব্রহ্মচৈতন্যস্বরুপে অব্যক্তে নিত্য বিদ্যমান । তাই তাঁকে “শবশিব” বলা হয় । যাক্ এবার পূর্ব্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসি । যোগমার্গীয় সাধকেরা দুটি পন্থ এ বিভক্ত ছিল একটি হল “অষ্টাঙ্গযোগপন্থ” এরা যোগের আটটি ধাপ বা স্তর অতিক্রম করে ক্রমশঃ ঊর্ধ্বগামী হন অখণ্ড নির্বিকল্প স্তরে । আর দ্বিতীয়টি হল “নাদযোগ পন্থ “/”নাথযোগপন্থ” ।
এঁরা ওঁকাররুপী মহানাদ এর সাধনা করেন। অব্যক্ত নাদ হতে ব্যাক্তনাদে । সূক্ষ্ম নাদ হতে স্থুল বিস্তৃত ব্যাপ্তনাদে অনুরণিত করেন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে প্রথমে । পরে, আবার অনুলোম বিলোম প্রক্রিয়ায় ওই বিস্তৃত ব্যাপ্তনাদকে সুক্ষ্ম অব্যক্তনাদরুপে পরমব্রহ্মে লীন করে তুরীয় ব্রহ্মচৈতন্যে সমাহিত হন, যাহা যোগের লক্ষ্যভূমি তথা পূর্ণাবস্থা । এই নাদব্রহ্মের সাধক যোগীগণ যোগস্রষ্টা শঙ্করকেই তাঁদের প্রভূ বা নাথ বলে মানতেন বা মানেন,তাই তাঁরা তাঁদের নামের সাথে নাথ কথাটি যোগ করে নিজেদের যোগপন্থার ও সম্প্রদায়ের পরিচয় বহন করতেন ও করেন । এঁদের প্রথম আচার্য্য ছিলেন “আদিনাথ” । ইনি অষ্টাঙ্গ যোগে সিদ্ধ হবার পর শিবকৃপায় “নাদতত্ত্ব ও নাদযোগ” লাভ করেন । তারপর দ্বিতীয় আচার্য্য হলেন “হাড্ডিনাথ” যোগপ্রভাবে অস্থিকঙ্কালসার দেহে দিব্যতেজ ও দিব্য অবয়ব পুনরায় লাভ করেছিলেন বলে তাঁর নাম হয় “হাড্ডিনাথ” ।
হাড্ডিনাথের পর “মৎসেন্দ্রনাথ” । এই মৎসেন্দ্রনাথই মৎসেন্দ্রাসন, মৎস্যাসন, ময়ুরাসন, বৃশ্চিকাসন ও ব্যাঘ্রাসন এর স্রষ্টা । এঁর নাম অনুসারেই ওই আসনের নাম হয় মৎসেন্দ্রাসন । তাঁর পরবর্তী আচার্য্য হলেন গোরক্ষনাথ । এই মৎসেন্দ্রনাথ ও গোরক্ষনাথ এর সময়েই “নাদযোগের” চরম বিকাশ ঘটেছিল । পরবর্তী সময়ে এর প্রভাব ” আদি শঙ্করাচার্য্য” এর মধ্যেও পড়েছিল । তিনি বৌদ্ধ মহাশ্রমণ মন্ডনমিশ্রের স্ত্রী ভারতী দেবীর কামশাস্ত্র বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে এক নাথযোগীর নিকট হইতেই “পরকায়া প্রবেশ” নামক যোগের এক বিশেষ বিদ্যা তথা কৌশল আয়ত্ত করে এক মৃত রাজার শরীরে প্রবেশ করে সেই শরীর দ্বারা কাম বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করে আবার নিজ দেহে প্রত্যাবর্তন পূর্ব্বক ভারতী দেবী সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেছিলেন ।
মহাযোগী গোরক্ষনাথের পরবর্তী আচার্য্য হলেন “গম্ভীরনাথ” বিখ্যাত “চর্য্যাপদ” এদেরই সৃষ্টি । “চর্য্যাচর্য্য বিনিশ্চয়” নামক বিখ্যাত গ্রন্থও এদেরই সৃষ্টি । যাহা ডঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপালের রাজ দরবার থেকে উদ্ধার করে এনেছিলেন । সেখানে “শবর নাথ”, লুইনাথ প্রভৃতি আরও কয়েকজন নাথযোগীর কথা পাওয়া যায় । সুতরাং এরাই হলেন নাদযোগী তথা নাথযোগী ।
“নাদব্রহ্মেতি সমুচ্চার্য্য
নাদযোগসৃজাম্যহম ।
সেই জন্যই বলা হয় –
যথা শিবময়ো রামরেবং রামময়ঃ শিবঃ
যথাহরন্তং ন পশ্যামি তথা মে স্বস্তিরাযূষি
যথাহরন্তং না ভেদাঃ স্যুঃ শিবরাঘবয়োস্তথা।।
শ্রীরামচন্দ্র যেমন শিবময়, শিবও সেইরকম রামময়। আমি যেন ভেদদর্শন না করি। অবান্তর ভেদসমূহের বিনাশের মত শিব এবং শ্রীরামচন্দ্রের ভেদদর্শন বিনষ্ট হোক।
সুতরাং ভগবান শিব পরেমশ্বর, সর্বেশ্বর, পরমাত্মা, পরমব্রহ্ম। বেদ বেদান্ত সর্বশাস্ত্র একথা বলে। অথচ এক শ্রেণীর মূর্খগন শাস্ত্র না জেনেই তথাকথিত ধর্মগুরু ও তাদের প্রচারিত ও অপব্যাখ্যা কৃত কতিপয় কয়েকটা শাস্ত্রের উদ্ধৃতি টেনে ভগবান শিবের অপব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। কেউ বলে শিব নাকি পরম বৈষ্ণব আর কেউ বলে শ্রীকৃষ্ণের দাস! আশ্চর্যের বিষয় তাদের অনেকেই বেদকে পর্যন্ত অস্বীকার করে থাকে। যে বেদ হল অখিল ধর্মের মূল, আর সেই বেদকেই তারা বলে অকার্যকর। শাস্ত্রে বলা আছে “বেদপ্রণিহত ধর্ম, অধর্মস্তদবিপর্যয় ।” অর্থাত্ যা বেদ দ্বারা স্বীকৃত তাই ধর্ম। আর বেদের বিপর্যয়ই হল অধর্ম।
“ওঁ নমঃ শিবায়” মহামন্ত্র যা আমাদের দিতে পারে কৈবল্য মুক্তি।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের নিয়েই সূচিত হয়েছিল গোরক্ষনাথের জয়যাত্রা। কিংবদন্তি ছিল তাঁর উৎপত্তি গোবর থেকে । আবার অনেকেই বিশ্বাস করেন স্বয়ং শিবের দেহ থেকে। আসলে তাঁর জন্ম রহস্যাবৃত। তাই জাতিগৌরব তাঁকে কোনোভাবে সম্পূর্ণ সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি । তাই গোরক্ষসিন্ধান্তসংগ্রহ তাঁকে যে ঈশ্বরের সন্তান এবং গোরক্ষবিজয় যে শিবের জটা থেকে তিনি উদ্ভূত বলেছেন – তা এই অর্থে একেবারেই সঙ্গত। যদি গোময় তাঁর জন্ম হয় তাও তাঁর জন্ম সার্থক। তিনি শিবের ন্যায়ই তো গো রক্ষক হয়ে উঠেছেন মানুষের কাছে। হয়ে উঠেছেন পঙ্কজের মতই সুরভিত। পদ্মফুলের ন্যায় তাঁরও তপস্যা ছিল সেই মহারুদ্রের জন্য , আলোকের জন্য , আলোক বিতরণের জন্য। তাঁর যে ভীষণ ভারতব্যাপী প্রভাব ছিল তার জন্য তাঁকে একাধারে বঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, দক্ষিণভারতের মানুষ বলে মনে করা হয়েছে। তাঁকে সবাই নিজের নিজের আপন বলে মনে করতে ভালোবাসেন।
গোরক্ষনাথের নিজের লেখা কোনো পুঁথি বা পদ পাওয়া যায় না। সামান্য যা পাওয়া গেছে তাও মিশ্রিত দেহাতি ভাষায় লেখায়। তাঁকে অবলম্বন করে গোরক্ষবোধ গ্রন্থ নাথযোগীদের নিকট অত্যন্ত পবিত্র মানা হয়। অখন্ড ভারতে তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হন। কোথাও গুরুরূপে, কোথাও শিবের গণ রূপে , কোথাও শিবাংশ রূপে। নেপালের মুদ্রায় গোরক্ষনাথের নাম শ্রদ্ধাবহন করে মুদ্রিত হয়েছে।
নাথপন্থের তপস্যা হল হঠযোগ বা কায়সাধনের সাহায্যে দেহকে সত্য উপলব্ধির উপযুক্ত করে তোলা। গোরক্ষবোধ গ্রন্থে সেই হঠসাধনার ইঙ্গিত আছে। নাদানুসন্ধানও এই সাধনার অংশবিশেষ। আমাদের জীবনে #গোলকধাঁধা বলে যে শব্দটি আছে তা তাঁর রচিত সাংকেতিক ভাষা #গোরক্ষ_ধন্ধা থেকে উৎপন্ন বলে কেউ কেউ মনে করেন। তখনকার সাধনাই ছিল সাংকেতিকলিপি নির্দিষ্ট। চর্যাপদ গানগুলিতেও তো আমরা এমন সাংকেতিক ভাষা পাই। যাকে বলা হয় উল্টাবাচনরীতি।
বলদ বিআঅল গাঁবিয়া বাঁঝে- বলদের বাচ্চা হচ্ছে,
গাভী বন্ধ্যা
অথবা , রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাএ – গাছের তেঁতুল কুমিরে খাচ্ছে।
দুলি দুহি পিঠা ধরণ ন জাএ – কাছিম দোহন করে দুধ পাত্রে ধরছে না ।
এসবই তো সাধনের কথা। যোগী সাধকরা এসবের মানে বোঝেন।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস
২. উত্তরবঙ্গে গোরক্ষনাথের গান
৩. শ্রী শিবগোপাল দেবশর্মা