দেশমাতারূপে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেবী দুর্গাকে উপস্থাপন করেছিলেন। তেমনই উপস্থাপন করেছেন দেবী কালী ও জগদ্ধাত্রীকেও। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ব্রহ্মচারী সত্যানন্দকে দেখা যাচ্ছে, মহেন্দ্রকে তিনি দেবী দুর্গার তিনটি রূপ চেনাচ্ছেন। “মা যা ছিলেন….মা যা হইয়াছেন…. মা যা হইবেন।” রূপ তিনটি যথাক্রমে দেবী জগদ্ধাত্রী, দেবী কালিকা এবং দেবী দুর্গা। উপন্যাসের প্রাসঙ্গিক কিছুটা অংশ তুলে ধরছি —
…. ব্রহ্মচারী মহেন্দ্রকে কক্ষান্তরে লইয়া গেলেন। সেখানে মহেন্দ্র দেখিলেন, এক অপরূপ সর্বাঙ্গসম্পন্ন সর্বাভরণভূষিতা জগদ্ধাত্রী মূর্তি৷ মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইনি কে?”
ব্রহ্মচারী। মা — যা ছিলেন।
মহেন্দ্র। সে কি?
ব্রহ্মচারী। ইনি কুঞ্জর কেশরী প্রভৃতি বন্য পশুসকল পদতলে দলিত করিয়া, বন্য পশুর আবাসস্থানে আপনার পদ্মাসন স্থাপিত করিয়াছিলেন। ইনি সর্বালঙ্কারপরিভূষিতা হাস্যময়ী সুন্দরী ছিলেন৷ ইনি বালার্কবর্ণাভা, সকল ঐশ্বর্যশালিনী।…
বিদেশী মুসলমান ও ব্রিটিশ শাসনে ভারতবর্ষের ভূলুণ্ঠিত রূপকে কালীরূপে দেখিয়েছেন বঙ্কিম — অন্ধকারসমাচ্ছন্না, কালিমাময়ী, হতসর্বস্বা, নগ্নিকা রূপ। সেই সময় ভারতবর্ষের সর্বত্রই শ্মশান, দেশমাতা তাই কঙ্কালমালিনী, নিজেরই শিব নিজের পায়ে দলিত করছেন দেবী কালিকা। দেশের চূড়ান্ত হতশ্রী দশা, বিদেশী শাসনে ভারতবর্ষ ভূলুণ্ঠিত, বঙ্কিম সে কথাই বললেন। একদা ভারতবর্ষের যে সমৃদ্ধশালী রূপ ছিল, কৃষিতে, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, শিল্পে-ভাস্কর্যে তা ভেঙে তছনছ করা হল। ভাঙা হল মন্দির-দেবালয়, বেরিয়ে এলো শাসকের কদর্য কালো রূপ।
একই সঙ্গে বঙ্কিমের আশাবাদও প্রকাশিত হয়েছে। তা হচ্ছে দেশমাতার দুর্গা-ভাবনা। ভারতের গৌরব পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হলে ভারতমাতা হবেন দুর্গারূপা। তাঁর দশভূজ দশদিকে প্রসারিত হবে, তাতে নানান আয়ুধ থাকবে, নানান শক্তি শোভা পাবে, পায়ে শত্রুর বিমর্দন ঘটবে, বাহন সিংহও শত্রুনিপীড়নে নিযুক্ত হবে। এই দুর্গারূপের অপেক্ষায় বর্তমান ভারতবর্ষ।
জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হয় কার্তিকের শুক্লানবমী তিথিতে। “পূজয়েজ্জগতং ধাত্রীং কার্তিকে শুক্লপক্ষকে।” সাধারণভাবে সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় তিনবার পূজা সম্পন্ন হয়। “দিনোদয়ে চ মধ্যাহ্নে তথা সায়াহ্নকেহহনি।।”
যদি আগের দিন ত্রিসন্ধ্যা নবমী তিথি থাকেও, পরদিন সকালে কিছুকালও নবমী তিথি পড়লে, পূজা পরদিনই হবে। পুরোহিত দর্পণ অনুযায়ী পরদিনের দশমীতেও তাই বলিদান হতে পারে।
দেবীর রূপ কেমন তা তাঁর ধ্যানমন্ত্রে উল্লেখ দেখা যায়।
“ওঁ সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্।
চতুর্ভুজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম।।
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামমপাণিদ্বয়ান্বিতাম।
চক্রঞ্চ পঞ্চ বাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে।।
রক্তবস্ত্রপরীধানাং বালার্কসদৃশীং তনুম্।
নারদাদৈ মুর্নিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।।….
অর্থাৎ দেবীর বাহন সিংহ, তিনি নানান অলঙ্কার পরিহিতা, তাঁর চার হাত, সর্পকে মালার মতো পরেছেন। তিনি নানান আয়ুধ ধারণ করেছেন।
দেবী ত্রিভুবনের পালিকা, তিনি বিচিত্ররূপধারিনী, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় বিধাত্রী, পরমা প্রকৃতি, মহামায়া, মহাদেবী। তিনি হৈমবতি, সর্বলঙ্কার ভুষিতা। দেবী দুর্গা যেমন মহিষাসুরমর্দিনী, দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুরমর্দিনী। তিনি হস্তীরূপী করীন্দ্রাসুরকে দেবী বধ করেছিলেন।
বঙ্গদেশে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন মোটামুটি অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে বঙ্গদেশে এই পূজার অধিক প্রচার হতে থাকে। হুগলি জেলার অন্তর্গত চন্দননগরে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী জগদ্ধাত্রী পুজো করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন ফরাসিদের এই দেওয়ান। কৃষ্ণচন্দ্রের সংস্পর্শে এসে তিনি দেবী জগদ্ধাত্রী সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত হন। ইন্দ্রনারায়ণ নিজের এলাকায় অর্থাৎ চন্দননগরে এই পুজো প্রবর্তনে করেন। ১৭৬৩ খৃস্টাব্দের কাছাকাছি চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের চাউলপট্টিতে দেবী পূজিতা হলেন। এই পূজাই সম্ভবত চন্দননগরে আদি পূজা। এখনও পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে পূজার সংকল্প হয়। এই প্রতিমা সনাতনরীতিতে নির্মিত। প্রতিমায় সাদা সিংহ দেখা যায় এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে হাতি। শুধু চন্দননগরেই নয়,পূজা প্রবর্তনের সাথে সাথেই এর জনপ্রিয়তা আশেপাশে মানকুন্ডু, ভদ্রেশ্বর এমনকি দূরবর্তী রিষড়াতেও বিস্তৃতি লাভ করে।
প্রাচীন পূজার মধ্যে লক্ষ্মীগঞ্জ চালপট্টি, কাপড়পট্টি, তেঁতুলতলা, ভদ্রেশ্বরগঞ্জে ২০০ বছর অতিক্রম করেছে এই পূজা, বাগবাজার ১৭৫ বছর পার করেছে। মহাসমারোহে পূজা হয় হেলাপুকুর বিদ্যালঙ্কা, ফটক গোড়া, খলিসানী, তেমাথা নতুনপাড়া, অম্বিকা অ্যাথলেটিক ক্লাব, গোন্দল পাড়া, মনসাতলা, চারমন্দিরতলা বিভিন্ন স্থানে। ক্রমে ক্রমে এই পুজো হুগলি জেলার এক বিখ্যাত পুজো হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।
মন্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা, শোভাযাত্রা প্রভৃতির টানে আজও বাংলার হাজার হাজার মানুষ এই আনন্দ উৎসবে মুখরিত হন। আলোকসজ্জার দিক থেকে চন্দননগরের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে। আলোকসজ্জার উৎস নিহিত আছে প্রাচীন ফরাসডাঙার গর্ভে। ফরাসি শাসন বিলুপ্ত হলেও তার প্রভাব এই আলোকসাজের মাধ্যমে রয়ে গেছে। তবে বাইরে এই জাঁকজমক ও আড়ম্বর থাকলেও এই পূজার প্রধান শর্ত নিষ্ঠা ও ভক্তি; আজও তা চন্দননগর থেকে মুছে যায়নি। দুর্গা পূজার মতোই টানা পাঁচ দিন ধরে পূজিতা হন মা হৈমন্তিকা।
চন্দননগরের মতো বাংলার আর কোথাও এত বিশালাকৃতির প্রতিমা পূজিত হয় না। এখানে চালচিত্রসমেত প্রায় ২০-৩০ ফুটের প্রতিমা দেখা যায়। এমন প্রকান্ড ও মনোহর সাজে সজ্জিত প্রতিমা কুমারপাড়াতে নয়, তৈরি হয় জগদ্ধাত্রী তলাতেই। মায়ের মনমোহিনী রূপ বাংলার সকল মানুষকে মুগ্ধ করে।
চন্দননগর শহরের জগদ্ধাত্রী পূজার নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা শুরু হয় মোটামুটি ১৮ শতকের মধ্যভাগে বা তার কিছু আগে । ১৮৫৪ সালে রেলপথ চালু হওয়ার পর এই শহরের জগদ্ধাত্রী পূজা এবং নিরঞ্জন শোভাযাত্রা দেখতে বাইরে থেকে বহু মানুষ আসতেন। ফলস্বরূপ এই শহরের জগদ্ধাত্রী পূজার সমৃদ্ধি ও জৌলুস বেড়ে যায়। তৎকালীন সময়ে সারা শহরে পুজোর সংখ্যাও ছিল সীমিত। তার মধ্যে আরও সীমিত সংখ্যক পূজা কমিটি এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করত। সেই সময় জগদ্ধাত্রী মায়ের মৃন্ময়ী প্রতিমাকে কাঁধে করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করানো হত। জগদ্ধাত্রী মায়ের মৃন্ময়ী প্রতিমাকে কাঁধে বহন করার জন্য বাহকরা আসতেন গঙ্গার ওপার থেকে। এই বাহকরা মূলত জুটমিল বা ইটভাটার শ্রমিক বা মুন্ডা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে দিন অতিবাহিত হবার সাথে সাথে সরাসরি কাঁধে নেওয়ার পরিবর্তে আসে বাঁশের খাঁচা। এই সময় পর্যন্ত এই শোভাযাত্রার দিন প্রতিমা নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার সময় রাস্তার দু’ধারে বা বাড়ির ছাদে মহিলারা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তারও পরবর্তী সময় ট্রলি এবং বর্তমানে বড় বড় লরি করে জগদ্ধাত্রী মায়ের মৃন্ময়ী প্রতিমা সারারাত ধরে শহর প্রদক্ষিণ করেন।
অবন্তিকা গোস্বামী এবং অরিত্র ঘোষ দস্তিদার।
ফিচার ইমেজটি হাওড়া ব্যাতাইতলার পল্লীবাসীবৃন্দের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা