রণক্ষেত্রে নারী ও অসুর।

রম্ভা ও করম্ভা নামক দুই অসুর একবার ইচ্ছা প্রকাশ করল তারা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হবে। সেজন্য তারা গভীর ভাবে ধ্যানে ডুবে গেল। তারা একমনে অগ্নি ও বরুণের কাছে প্রার্থনা করে যেতে লাগল। রম্ভা চারপাশে আগুন ধরিয়ে তার মধ্যে বসে অসহ্য উত্তাপের মধ্যেই অগ্নিদেবের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে যেতে লাগল। অন্যদিকে নদীর মধ্যে বুকজলে দাঁড়িয়ে করম্ভা বরুণের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে যেতে লাগল।


দেবরাজ ইন্দ্র তাদের এই প্রার্থনা দেখে প্রচণ্ড চিন্তিত বোধ করলেন। তিনি মোটেই চাইছিলেন না যে, অসুররা প্রার্থনা করে দেবতাদের সন্তুষ্ট করে এমন কোনও শক্তি অর্জন করুক, যাতে দেবতাদের বিরুদ্ধে সে শক্তি কাজে লাগানো হোক।

অনেক ভাবনাচিন্তা শেষে দেবরাজ ইন্দ্র একটি অতিকায় কুমিরের রূপ ধরে নদীতে গিয়ে করম্ভাকে আক্রমণ করলেন। এর ফলে করম্ভার মৃত্যু হল। এরপর ইন্দ্র ভালুকের রূপ ধরে রম্ভাকে আক্রমণ করলেন। দুর্ভাগ্যবশত রম্ভা আগুনকে কাজে লাগিয়ে কোনও রকমে পালিয়ে গেলেন। অগ্নিদেব স্বয়ং তাকে সাহায্য করেছিলেন।


কয়েক বছর বাদে রম্ভা অসুরদের রাজা হয়ে বসলেন। প্রায় একই সময়ে তার একটা ছেলেও হয়েছিল। তার নাম রাখা হয়েছিল মহিষাসুর, সংস্কৃত এই নামের অর্থ মহিষের সমান শক্তিধর অসুর।

যখন মহিষাসুর সাবালক হল, তার পিতার কাছে খুড়োর শোচনীয় হত্যার কাহিনী জানতে পারল। রম্ভা গল্প শেষ করে বলল, “ইন্দ্রকে যতদিন মারতে না পারছিস, ততদিন নিজেকে অসুর বলে কারুর কাছে পরিচয় দিস না।”

মহিষাসুর তখন পিতার কাছে প্রতিজ্ঞা করল, “তাই হবে। খুড়োর হত্যাকারীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবই।”

মহিষাসুর জানত তার কাজ মোটেই সহজ হবে না। সেজন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল উপযুক্ত সময়ের জন্য। সে স্থির করল ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করবে যাতে অর্জিত শক্তি দিয়ে ইন্দ্রকে শাস্তি দেওয়া যায়।


মহিষাসুর কয়েক বছর সাধনার শেষে ব্রহ্মার দেখা পেল। বলল, “প্রভু আমাকে দয়া করে অমরত্বের বরদান করুন।”

ব্রহ্মা বললেন, “তা হয় না। তুমি অন্য কিছু বর চেয়ে নাও।”

কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তার শেষে মহিষাসুর বললেন, “হে ব্রহ্মা! তাহলে কেবল মাত্র কোনও নারীর হাতেই আমার মৃত্যু হবে, এই বর দাও।”
ব্রহ্মা রাজি হয়ে গেলেন “তথাস্তু।” উল্লসিত হয়ে নাচতে নাচতে মহিষাসুর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি জানতেন, কোনও নারীর পক্ষে তার মত শক্তিমান মানুষকে পরাজিত বা বধ করা সম্ভব নয়। ফলে তার ঔদ্ধত্য স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে গেল।

মহিষাসুর স্থির করলেন তিনি ইন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। তিনি বিশাল অসুর বাহিনী নিয়ে স্বর্গে রওয়ানা হলেন। স্বর্গের দেবতাদের বাহিনী বিভিন্ন ছলচাতুরি করেও অসুর বাহিনীকে পরাস্ত করতে পারলেন না। উলটে নিজেরাই শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে স্বর্গ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন দেবতারা। তারা অন্যত্র লুকিয়ে একত্রিত হয়ে কিভাবে মহিষাসুরকে দমন করা যায়, সে আলোচনা করতে লাগলেন। তখনই ইন্দ্র জানতে পারলেন মহিষাসুরের মৃত্যু কেবল নারীর হাতে আছে।


এরপর ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা অনেক ভাবনাচিন্তার পর ঠিক করলেন তারা তাদের দেহস্থিত শক্তি দিয়ে একটি নারী গঠন করবেন। ইন্দ্র এই কাজে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরকে নিয়োগ করলেন। তাদের শক্তি থেকে উৎপন্ন হল এক সুন্দরী ও অসম্ভব শক্তিশালী এক নারী। ইনিই পরবর্তী কালে পার্বতী নামে পরিচিত হন। এবং শিবের স্ত্রীও হয়েছিলেন।

দেবতারা তাকে শাড়ি, অলঙ্কার ও অতিকায় মুকুট দিলেন। সাথে বিভিন্ন দেবতা তাকে যথাক্রমে বিভিন্ন অস্ত্রাদিও দিলেন। সেগুলো হল – ত্রিশূল (মহাদেব), সুদর্শন চক্র (বিষ্ণু), কমণ্ডলু (ব্রহ্মা), ধনুক (বায়ু), তীর (সূর্য), বজ্র (ইন্দ্র), বর্শা (অগ্নি), শাঙ্খ (বরুণ)।


এবার ব্রহ্মা তাকে আশির্বাদ করে বললেন, “আজ থেকে তুমি দুর্গা নামে পরিচিত হবে। যার মানে যে দেবী যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন। আমাদের আশীর্বাদে তুমি নিশ্চিত ভাবেই মহিষাসুরের বিরুদ্ধে জিতবে।”


এরপর দুর্গা মহীশূরের কাছে চামুণ্ডা পর্বতের কাছে গিয়ে দশদিন ধরে যুদ্ধের শেষে মহিষাসুরকে বধ করলেন। সে থেকে তার নাম হয়ে গেল মহিষাসুরমর্দিনী, অর্থাৎ যিনি মহিষাসুরকে বধ করেছেন।


–  অয়ন চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.