ষষ্ঠ অধ্যায়: শত্রুভাবাপন্ন শক্তিগুলির যুক্ত বাহিনী
এ পর্যন্ত আমরা আলোচনা করেছি (১) পরবর্তী মতাদর্শগুলোর আগ্রাসন থেকে বেঁচে থাকা শেষ প্রাচীন সমাজ হিসাবে হিন্দু সমাজের তাৎপর্য, এবং (২) তার সঙ্গে হিন্দু সমাজকে শেষ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই আগ্রাসী মতাদর্শগুলো দ্বারা নিযুক্ত পদ্ধতি ও শক্তি সম্পর্কে।
উপসংহারে আমরা এই মতাদর্শগুলো বিশেষত ইসলামপন্থা ও কমিউনিজ়ম নিয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট কীভাবে হিন্দু সমাজকে কলঙ্কিত করার জন্য জোট বেঁধেছে এবং সেটাকে অটল অনড় করে রেখেছে। এই যুক্তফ্রন্ট অধিকাংশতঃ মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ে কাজ করে। কিন্তু যখনই হিন্দু সমাজের কল্যাণে নির্দিষ্ট কতগুলো বিষয় সংসদে উঠে আসে বা সেগুলো নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্ক হয়, তখনই এই মোর্চা নিজেকে রাজনৈতিক জোট হিসেবেও উপস্থাপন করে।
ইসলামবাদ ও কমিউনিজ়মের মধ্যেকার যুক্তফ্রন্টের অস্তিত্ব ও সক্রিয়তা চল্লিশের দশক থেকেই প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল, যখন পাকিস্তান দাবিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে সমর্থন জানায়। অনেকেই এখন মনে রাখে না, কমিউনিস্ট পার্টি একসময় তাদের বিপুলসংখ্যক মুসলিম সদস্যকে মুসলিম লীগে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল দ্বি-জাতি বা দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বে বৌদ্ধিক শক্তি সরবরাহ করার জন্য। ইসলামবাদের হয়ে খেলতে আগে থেকেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ছিল হিন্দু কমিউনিস্টরা। যারাই দেশভাগের বিরোধিতা করে, এই দুই কমিউনিস্ট ব্রিগেড একযোগে তাদের সকলকেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যবাদী হিসাবে কলঙ্ক লেপে হিন্দু বুদ্ধিবৃক্তিকে নমনীয় হতে বাধ্য করে। এই কৌশলের মাধ্যমে কমিউনিস্টরা ইসলামপন্থীদের হয়ে দুর্দান্ত কাজ করেছিল। ইসলামবাদও কমিউনিজ়মের প্রতি ঋণ আংশিক পরিশোধ করে। পূর্বতন হায়দরাবাদ থেকে রাজাকার মুসলিমরা তেলঙ্গানার কমিউনিস্ট বিপ্লবের সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করে।
ইসলামবাদ ও কমিউনিজ়মের মধ্যে এই ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা স্বাধীনতার পরেও অক্ষুণ্ণ রইল। ইসলামবাদের প্রতি অধিকাংশ মানুষের চোখে সন্দেহের ছায়া ঘনিয়েছে। কিন্তু সর্দার প্যাটেলের মৃত্যুর পরপরই কমিউনিজ়ম তার পূর্ববর্তী প্রতিপত্তি পুনরুদ্ধার করে এবং তার ফলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গ্রহণ লাগা শুরু হয়। আর তথাকথিত সাম্যবাদ প্রগতিশীলতার ছদ্মবেশে ইসলামবাদের পুনর্বাসনের জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় যা দেশভাগের প্রাক্কালে ইসলামবাদের তপ্ত আবহে ছেয়ে গিয়েছিল, এরপর তা হয়ে উঠল প্রগতিশীল মুসলিম অধ্যাপকদের গুপ্ত ডেরা। মুসলিম কবি ও লেখক যারা একসময় মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে বজ্র হুংকার দিয়েছিল, এবার প্রগতিশীল লেখক সংঘ ও অন্যান্য কমিউনিস্ট ফ্রন্টে পাড়ি দিল। সেইসব মুসলিম অধ্যাপক, কবি ও লেখক যারা এক সময় মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল বা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, তারা এখন Progressive Writers Association ও অন্যান্য কমিউনিস্ট গোষ্ঠীতে দলে দলে যোগ দিল। এইসব অধ্যাপক, কবি ও লেখকরা তাদের শতাব্দী প্রাচীন ইসলামিজ়মের স্লোগানের সঙ্গে সদ্য অর্জিত ভাষায় progressivism বা প্রগতিশীলতার বুলিও জুড়ে দিল।
পাকিস্তান যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রযোজিত CENTO ও SEATO-র সদস্য হয়ে যায়, তখন ইসলামবাদ ও কমিউনিজ়মের মধ্যেকার এই যুক্তফ্রন্ট কিছুটা ধাক্কা পেতে পারত। সেই সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সমর্থনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল। কিন্তু প্রায় একই সময়ে নাসেরের নেতৃত্বে আরব জাতীয়তাবাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিমুখে ধাবিত হওয়ায় সেই মোর্চা রক্ষা পেয়ে গেল। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি মুসলিম রাষ্ট্রগুলির জোট থেকে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টায় আরবের পক্ষে বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠে। এছাড়াও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল যারা তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিক্রমা নিয়ে গর্বিত, তারা ইসলামের কারণে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যকেই ভারতের মুসলমানদের দুর্ভোগের উৎস হিসাবে দেখানো শুরু করে। কমিউনিজ়মও তখন এই জাতীয় ঐক্যের বাহিনীতেই ছিল। তাই তখন ইসলামপন্থা ও তার রক্ষক হিসাবে কমিউনিজ়মকে সামান্যতম অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি।
সম্প্রতি ইসলামিক মৌলবাদের বাড়বাড়ন্তের ফলে ইসলাম ও কমিউনিজ়মের মধ্যেকার বোঝাপড়া কিছুটা চাপে পড়ে যায়। আফগানিস্তান নিয়ে পাকিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কোনও রফা মোটেই অসম্ভব নয়, যদিও তাদের বেকায়দায় রাখার জন্য আমেরিকার প্রচেষ্টা অব্যাহত। ভারতে ইসলাম ও কমিউনিজ়মের মধ্যে খুব দ্রুত আঁতাত পুনরায় গড়ে উঠবে। এই দু’ পক্ষই ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনির সমর্থনে এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট সাদাতের বিরোধিতায় পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। [1] কিন্তু ভবিষ্যতে ইসলামবাদ ও কমিউনিজ়মের মধ্যে সমঝোতা হবে না সংঘাত, তাই নিয়ে অনুমান ব্যক্ত করার পরিসর এটা নয়। এখানে আমরা পারস্পরিক তাদের সহযোগিতা-কালীন সাফল্যকে তুলে ধরতে চাই ।
ইসলামবাদ এবং কমিউনিজ়মের ভেতর মোর্চা প্রথম বড়সড় বিজয় লাভ করে জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দীর উত্থানকে সফলভাবে প্রতিরোধ করে। সংবিধানের প্রতিষ্ঠা লগ্নেই তার প্রণেতারা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছিলেন যে, ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে হিন্দীকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তা পেতে সাহায্য করা উচিত। রাষ্ট্রভাষার ভূমিকা পালনের জন্য হিন্দী স্বাভাবিকভাবেই সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারের ওপর নির্ভর করেছিল, বিশেষত আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপযুক্ত পরিভাষা বিকাশের জন্য। ইউরোপীয় ভাষাগুলিও অনুরূপ পরিস্থিতিতে একইভাবে গ্রীক এবং ল্যাটিন ভাষার ওপর নির্ভর করেছিল। হিন্দীর এই সংস্কৃতীকরণ (Sanskritisation) তামিল-সহ অন্যান্য ভারতীয় ভাষা যাদের শব্দভাণ্ডারের প্রধান উৎস সংস্কৃত, হিন্দীকে অবধারিতভাবে তাদের কাছাকাছি নিয়ে যেত। তাছাড়া হিন্দীই ছিল একমাত্র ভাষা যা অন্যান্য ভাষার সাহিত্য ও অপরাপর সৃষ্টি ব্যাপকভাবে অনুবাদ করে আপন করে নিয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় বহু ভারতীয় ভাষার বাগ্ধারা ও রূপকগুলোও হিন্দীতে সম্মানজনক স্থান খুঁজে পেয়েছিল।
রাষ্ট্রভাষা হিসাবে হিন্দীর উত্থানের বিরুদ্ধে তথাকথিত সাম্যবাদই প্রথম তার প্রোলেতারিয়ান ধ্বজা তুলে ধরে। কমিউনিস্ট মুখপাত্ররা চিৎকার করে, চাঁদনিচকে কটা মানুষ All India Radio-তে বলা হিন্দী বোঝে? পরবর্তী ধাপে ভারত একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রের সমাহার তত্ত্ব তুলে ধরে, যেটা চল্লিশের দশকে পাকিস্তানের দাবি সমর্থন করার সময় প্রথম উত্থাপন করেছিল। পরিশেষে ভারতের ভাষা নীতি জন্য সোভিয়েত মডেল অবলম্বনের সুপারিশ দেয়। আর এই হিন্দী বিরোধী ক্রুসেড প্রদর্শন করতে গিয়ে তারা রাহুল সাংকৃত্যায়নকেও পদচ্যুত করে। কমিউনিজ়মের জন্য অনন্য অবদান রাখা সত্ত্বেও রাহুলজীর অপরাধ ছিল হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে সমর্থন জানানো। হিন্দীর হয়ে ওকালতি করা লোকেদের ‘হিন্দী শভেনিস্ট’ ও ‘হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী’ হিসাবেও দাগানো হয়।
ইসলামবাদীরা সেই সুযোগে হিন্দী বিরোধী কমিউনিস্ট অভিযানে তৈরি ধোঁয়াশার আড়লে শক্তি সঞ্চয় করে ‘উর্দু’র দাবিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলল। খুবই দৃষ্টিকটুভাবে ফিরাক গোরখপুরীর মতো উর্দু কবিও হিন্দীকে ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালাগাল দিতে শুরু করেন। একই সঙ্গে হিন্দীর অধীনে থাকলে ইসলামবাদী সংস্কৃতির মহান পরিশীলিত ভাষা উর্দু ভারত থেকে হারিয়ে যাবে বলে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। সেই সংস্কৃতি ও পরিমার্জন মুসলিম দরবারের উত্তরাধিকার এবং তুচ্ছ মুসলমানী অভিজাত্যের অবশেষ কিনা যাচাই করতে কোনো কমিউনিস্ট এগিয়ে আসেনি। কোনও কমিউনিস্ট উর্দুর অত্যধিক আরবীকরণ ও ফারসীকরণ যা ভাষাটিকে শিক্ষিত মানুষের কাছেও দুর্বোধ্য করে তোলে, তাই নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। চাঁদনি চকের মানুষজনের জন্য তখন আর তাদের মাথাব্যথা দেখা যায় না। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুর দাবিকে স্বীকৃতি আজ ধর্মনিরপেক্ষতার একটি পরিচায়ক চিহ্ন হয়ে উঠেছে।
ইসলামপন্থা ও কমিউনিজ়মের মোর্চা দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-এর প্রশ্নে। তারা যোগসাজিশ করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে এমনভাবে আঘাত শুরু করে যে ‘সেকুলারিজ়ম’ ধারণাটি পুরোপুরি বিকৃত ও ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের প্রতিশব্দে পরিণত হয়ে যায়।
রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা আধুনিক পশ্চিমে বিকশিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় গীর্জার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে, তাদের ধর্মনীতির দাবিতে সমাজ অসুস্থ হয়ে পড়ায়। এই ধর্মতন্ত্র (Theocracy) খ্রিস্টান ও ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজে যতটা অবিচ্ছেদ্য, হিন্দু রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে ততটাই ভিনগ্রহী। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা হিন্দুদের কাছে নতুন কিছু ছিল না। তারা তাদের সমাজ-রাজনৈতিক এমনকি ব্যক্তিগত পরিবার জীবনেও এটি দীর্ঘকাল ধরে অনুশীলন করে এসেছে। কোনও হিন্দু রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণের বিষয়ে আপত্তিও উত্থাপন করেননি। তবে কমিউনিজ়ম দ্রুত ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে ক্ষেপণাস্ত্র চালানো শুরু করে, যার অধীনে নাকি “হিন্দুরা সমস্ত ক্ষমতা ও মর্যাদাপূর্ণ পদে আসীন ছিল এবং দরিদ্র মুসলিম সংখ্যালঘুরা জাতীয় জীবনে তাদের যথাযথ স্থান পাচ্ছিল না।” জনৈক রাষ্ট্রপতির রাষ্ট্রপতি ভবনে হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা ও হিন্দু তীর্থস্থানগুলিতে ভ্রমণ করা নিয়েও সাম্যবাদ অভিযোগের আঙুল তোলে। জনগণের প্রকল্প উদ্বোধনের সময় নারকেল ভাঙা বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফুলের মালার ব্যবহারকে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা এবং পুনরুজ্জীবনবাদ হিসাবে দাগিয়ে নিন্দার ঝড় তোলে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাব অনুসারে এই ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল মিথ্যে ও লজ্জাজনক।
ইসলামবাদ এই জনপ্রিয় বাহনে ঝাঁপিয়ে পড়তে একটুও দেরি করেনি। নিজেদের অন্তহীন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিযোগ নিয়ে রীতিমতো কুচকাওয়াজ শুরু করে দেয়। কেই বা এইসব অভিযোগগুলির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে? এখন তো আর এগুলো সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত মুসলিম লীগের নয়, বরং ‘প্রগতিশীল সাম্প্রদায়িক ঘুঁটিবিহীন হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা উত্থাপিত’? রাজনৈতিক দলগুলিকে এবার মুসলিম ভোট-ব্যাংক দ্বারা সতর্ক করা হল, যে তাদের সেক্যুলারিজ়মের দাবি মোটেই যথাযথ নয় যতক্ষণ না তার দ্বারা ঘরোয়া ও পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইসলামিক স্বার্থগুলি সর্বোচ্চ প্রাধান্য পায়। চূড়ান্ত ফলশ্রুতি হিসাবে সশস্ত্র বাহিনী সহ জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণের পুরানো ইসলামপন্থী দাবি আবার জেগে উঠল।
আর একটি ক্ষেত্র যেখানে ইসলামবাদ এবং কমিউনিজ়মের মধ্যে আঁতাত অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে, তা হল ভারতীয় ইতিহাসের পুনরায় ব্যাখ্যা করা যার দ্বারা একটি জাতিকে পুষ্ট করতে পারার মতো যাবতীয় বিষয়বস্তু ফাঁকা করে দেওয়া যায়। আমরা ইতিমধ্যে এই বিষয়টি আলোচনা করেছি। ইসলাম ধর্ম ও কমিউনিজ়ম উভয়ের এই সম্মিলিত প্রয়াস বা যৌথ উদ্যোগ হল হিন্দুরা এক জাতি এই তত্ত্বটিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া। সেই সঙ্গে ভারতে অহিন্দু সম্প্রদায়গুলিকে যে হিন্দুদের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা ও অনুমোদন পেয়েই ভারতীয় জাতীয়তার অঙ্গ হয়ে উঠতে হবে, এই নিখাদ অকাট্য প্রস্তাবটিকে ইচ্ছাকৃত নষ্ট করে দেওয়া। নতুন প্রগতিশীল দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী ‘হিন্দু হল বহু জাতের সমাহার’, তাদেরকেই অহিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে সব কিছু সমর্পণ করতে হবে, কিন্তু অহিন্দুদের কাছ থেকে তারা কিছুই দাবি করতে পারবে না।
আরও অনেক ছোট বড়ো ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে ইসলামপন্থা এবং কমিউনিজ়ম একযোগে মিছিল করেছে। খ্রিস্টধর্ম হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে এই মোর্চায় সমান এবং প্রত্যক্ষ অংশীদার ছিল না। কিন্তু পরোক্ষভাবে এটিও এই সংযুক্ত ফ্রন্টে সম্মতি দিয়েছে এবং অংশগ্রহণ করেছে; যেমন আরও স্পষ্টভাবে বললে হিন্দীর রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র নিরূপণের মতো বিষয়গুলির ক্ষেত্রে। সমস্ত কিছু বিশদে আলোচনা করা এখানে সম্ভব নয়।
এ কথাও বলে রাখা দরকার যে এই যুক্তফ্রন্ট ম্যাকলেবাদের সুরক্ষিত ছত্রছায়ায় কাজ করে, যা ফ্রন্টের স্লোগানগুলিকে নিজের পরিমার্জিত ভাষায় তর্জমা করে অন্তর্ভুক্ত করতে কখনই ব্যর্থ হয় না। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি যে ম্যাকলেবাদের সঙ্গে কমিউনিজ়মের একটা মতাদর্শগত টান রয়েছে এবং কীভাবে সেই সংযুক্তি দ্বারা ম্যাকলেবাদ সর্বদা কমিউনিজ়মকে আগলে রাখে। সুতরাং, কমিউনিজ়মের পক্ষে তার নিজস্ব স্লোগান ও পাশাপাশি এর প্রধান স্যাঙ্গাত ইসলামিবাদের স্লোগানগুলো ম্যাকলেবাদের মর্যাদাপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তর করা খুব সহজ। খ্রিস্টান ধর্ম ম্যাকলেবাদকে সরাসরি ব্যবহার করতে পারে কারণ মিশনারি স্কুল এবং কলেজগুলিই ম্যাকলেবাদের প্রধান নিয়োগ ক্ষেত্র সরবরাহ করে। সুতরাং আমরা আরও খানিক তদন্ত করে দেখব ম্যাকলেবাদ কেন এই ভূমিকা পালন করে।
প্রতিটি সমাজের কতগুলো সামাজিক কুফল স্বাভাবিকভাবেই থাকে। মানুষ নামক প্রাণীটি কোনও সমাজকেই তার অধঃপতন থেকে রেহাই দেয় না। হিন্দু সমাজও প্রকৃতির এই সর্বজনীন নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। হিন্দু সমাজেরও বেশ কিছু নিজস্ব সামাজিক অপকীর্তির অংশীদারিত্ব আছে এবং থাকবেও। হয়তো তার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি জমে উঠেছে, কারণ একে নিজের পরিচয় অক্ষুন্ন রেখেও বারবার দীর্ঘমেয়াদী বিদেশী শাসনের শিকার হতে হয়েছে। স্বাধীনতা হানি একটি সমাজের শিরা উপশিরার নমনীয়তা ও গতিশীলতা হ্রাস করে। আর স্বাধীনতা হ্রাসের অবধারিত পরিণতি অর্থনৈতিক দীনতা যা সামাজিক অবক্ষয়েরও একটি উর্বর ক্ষেত্র।
তবে এত কিছুর পরেও হিন্দু সমাজ এখনও যথেষ্ট মানবিক সমাজ হিসাবে অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রয়েছে। এটি এখনও নিজের মহান আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং বৌদ্ধিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে এবং লালনও করছে। এক সময় এই সমাজ বিশ্বকে মহৎ সাধু, কবি, রাজনীতিবিদ তথা বিজ্ঞানীদের একটি নীহারিকা উপহার দিয়েছিল। হিন্দু সমাজের হৃদয় ও মনে এখনও প্রবল আশার স্পন্দন। এর সৃজনশীলতার দিন এখনও ফুরোয়নি এবং মনুষ্যজাতির বৃহত্তর কল্যাণে এর এখনও অনেক অবদান রাখা বাকি।
ম্যাকলেবাদের শিকার হিন্দুর সমস্যা হল এই যে, সে হিন্দু সমাজে প্রচলিত কুফল সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু হিন্দু নীতিশিক্ষা যে সেই মন্দগুলোকে অনুমোদন করে না, বরং কুপ্রথাগুলি নির্মূল করার যে কোনও প্রচেষ্টার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হতে পারে, সে সম্পর্কে অবগত নয়। এই প্রক্রিয়ায় সে নিজেকে ‘মিস মাও’র পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, যাকে মহাত্মা গান্ধী সঙ্গতভাবেই ‘নর্দমা-পরিদর্শক’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
এই সমস্যা দ্বিগুণ বিপজ্জনক হবার কারণ অহিন্দু সমাজের খারাপগুলো সম্পর্কে তার অজ্ঞতা। ঐসব সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে তাকে যে থাকতে হয়নি। সে এও জানে না যে অহিন্দু সমাজগুলো বেশ কিছু অসাম্য সেই মতবাদগুলির মধ্যেই স্বীকৃত রয়েছে, যার নামে ঐ সমাজগুলি শপথ গ্রহণ করে। সুতরাং সে অনায়াসে ধরে নেয় ইসলাম ধর্মের উপস্থাপনা অনুযায়ী সত্যিই মুসলিম সমাজ পুরুষদের সৌভ্রাতৃত্বের ওপর দাঁড়িয়ে, অথবা খ্রিস্ট ধর্ম যে খ্রিস্টান সমাজের প্রেম ও দয়া-দাক্ষিণ্যে উথলে ওঠা নিয়ে গর্ব করে তা যথাযথ, কিংবা কমিউনিজ়মের দাবি অনুযায়ী প্রকৃতই সোভিয়েত ইউনিয়নে একটি সমাজ সমীকরণ বিদ্যমান। সে জানে না যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বরাবরই একটি দস্যুদের ভ্রাতৃত্ব ছিল, খ্রিস্টান প্রেম এবং দয়াদাক্ষিণ্য মূলত ধনী পশ্চিমা দেশগুলির খ্রিস্টান মিশনগুলিকে ধন-সম্পদ সরবরাহ করায় নিয়োজিত, এবং কমিউনিস্টদের প্রচার করা সাম্যবাদ আসলে দ্বিচারিতা ছাড়া কিছুই না, যা মনুষ্য ইতিহাসে একপ্রকার নজিরবিহীন দাসপ্রথা।
হিন্দু সমাজের ত্রুটিগুলি সম্পর্কে মহর্ষি দয়ানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী এবং ডাঃ হেড়গেওয়ারের চেয়ে তীব্রতর সচেতন আর কে হতে পারে? কিন্তু সেই সচেতনতা তাঁদেরকে যেমন ম্যাকলেবাদের শিকার করে তোলে না, তেমনি তাদের সমসাময়িক নীরদ চৌধুরীদের পংক্তিতে যোগ দিতেও অনুপ্রাণিত করে না। ইসলামপন্থা এবং খ্রিস্টানবাদ হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে যে সাংঘাতিক অভিযোগ করে আসছিল, আমাদের ম্যাকলেবাদীদের মতো তাঁরা সেগুলো স্বাগত জানাননি।
এই চার জন মহান চিন্তাবিদ, সংস্কারক ও জননেতার চেয়ে হিন্দু সমাজের বড় সমালোচক এবং কঠোর নিন্দুক আর কে হতে পারে? তবে তাঁরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দপ্তরে আরামকেদারায় বসে নিজেদের সমাজের কদর্যতা খুঁজে বেড়াননি, বা সেই মন্দগুলোকে বিভিন্ন দৈনিক সাপ্তাহিক বা সাময়িকীগুলো ব্যবহার করে কালি ছেটানোর বিষয় করে তোলেননি, কিংবা নিজেদের সমাজের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে মুক্ত ও আত্মগরিমায় প্রাণিত হয়ে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে হিন্দু সমাজের কালিমাগুলোকে দেখেননি। পরিবর্তে, তাঁরা হিন্দু সমাজকে সময়ের সাথে সাথে সংগৃহীত ময়লা এবং জঞ্জাল থেকে মুক্তি পেতে এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ঐতিহ্যের আলোকে নিজেকে পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন করতে আন্তরিক আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাছাড়া তাঁরা নিজেরাই মাঠে নেমে বহু গোঁড়ামি, অজ্ঞতা, সুবিধাবাদ ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে এবং ন্যায়বিচার ও সাম্য রক্ষার্থে লড়াই করেছিলেন।
আমাদের ম্যাকলেইজ়মের শিকার হিন্দুদের কাছ থেকে আশা করাটাই বাতুলতা, যে তারা কোনও দিন সামাজিক কর্মকাণ্ড ও সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রবেশ করবে। একজন ম্যাকলেবাদী বড়ো জোর কোনও পণ্ডিত হতে পারেন, যিনি বিদেশ থেকে পরিভাষা ধার করে হিন্দু সমাজের একটি রূপরেখা কল্পনা করে তার খাপে খোপে সেগুলো সোজাসুজি বসাতে চাইছেন। আর খুব খারাপ হলে একজন লেখক, যিনি তাঁর জীবিকাদাতার নির্দেশে যা হোক একটা বাগাড়ম্বর লিখে ছাপাখানায় পাঠাতে পারেন। তবে এই পণ্ডিতরা তো অন্তত নিজেদেরকে অহিন্দু সমাজের ত্রুটিগুলি সম্পর্কে আরও ভালভাবে অবহিত করাতে পারেন যাতে তাঁরা একদেশদর্শিতা থেকে নিরাময় লাভ করেন।
হিন্দু সমাজের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মতাদর্শগুলির মোর্চা সেদিন অবশ্যই এক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হবে, যেদিন ম্যাকলেবাদ তার পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নেবে, এবং মোর্চার সংক্রমণ শৃঙ্খল হিসাবে কাজ করতে অস্বীকার করবে। ম্যাকলেবাদের সঙ্গে কিন্তু সেক্যুলারিজ়ম ও ডেমোক্রসি দুটোরই গাঁটছড়া বাঁধা। ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের শত্রু কারা আর কারা তাদের সেরা বন্ধু, তা তাদের নিজেদেরই অনুসন্ধান করতে হবে। এটা কিন্তু ইসলামবাদ, কমিউনিজ়ম ও খ্রিস্টানবাদের যুক্তমোর্চার বাইরে তাকিয়েই করা সম্ভব।
এই যুক্তমোর্চার প্রকৃতি নেতিবাচক। মোর্চার অংশগ্রহণকারীরা একটা বিষয়ে একমত, যে হিন্দু সমাজের মৃত্যু এবং বিলোপ হওয়া উচিত। তবে হিন্দু সমাজকে কোন ধরণের সমাজ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা উচিত সে সম্পর্কে তাদের মধ্যে মতৈক্য নেই। খ্রিস্টানবাদের মনে কী মডেল রয়েছে সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। তারা ভারতবর্ষ যিশু খ্রিস্টের দেশ – এর বেশি কিছু কখনই বলে না, যার অর্থ অনেকের কাছে অনেক রকম। তবে ইসলামবাদ এবং কমিউনিজ়মের অভিপ্রায় নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ইসলামপন্থী মডেলটি বর্তমানে জ়িয়ার পাকিস্তান এবং খৌমেনির ইরানে প্রদর্শিত হচ্ছে। আর আমাদের পাশেই দোরগোড়ায় আফগানিস্তানে প্রদর্শিত হচ্ছে কমিউনিস্ট মডেলটি।
তিনটি মতাদর্শ এখনও নিজেদের আঘাতগুলোর আদানপ্রদান শুরু করতে পারেনি, কারণ তাদের অভিযানের ক্ষেত্রগুলি এখনও সমাপতিত হয়নি। তারা বিশালাকার হিন্দু সমাজের বিভিন্ন অঙ্গকে গ্রাস করার জন্য বেছে নিয়েছে। খ্রিস্টানধর্ম ব্যস্ত আছে জনজাতিগুলিকে নিয়ে, যাদেরকে হিন্দুরা বরাবর নিজেদের মতো থাকতে দিয়েছে। ইসলাম শিকার করে চলেছে হরিজনদের যাদেরকে ক্ষমতালোভী নেতৃত্ব রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইলের জন্য ব্যবহার করার জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর কমিউনিজ়ম উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে নিজেদের ‘প্রলেতারীয় ভিত্তি’ হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে নিজের শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে চলেছে।
সুতরাং হিন্দু সমাজ শুধু এই একচেটিয়া অসহিষ্ণু ও সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শগুলির শিকার হিসাবেই নিজেকে ফেলে রাখে না, তাদের মধ্যে একটি পারস্পরিক সংঘাত প্রতিরোধকারী অংশ বা বাফার হিসাবেও কাজ করে। ভারত হিন্দু বলেই দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ। এর সঙ্গে আর একটি অনুসিদ্ধান্তও যোগ করা যায়, যে ভারত হিন্দু বলেই একটি গণতন্ত্রও। হিন্দু সমাজ যদি এর পরেও এইসব নিখরচায় অনুমোদন করে চলে, তাহলে এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রের দিন গোনা শুরু হয়ে যাবে। হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ হোক; এবং নিজেদের গণতান্ত্রিক রাজনীতি, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সনাতন ধর্মের সভ্যতাকে রক্ষা করে সভ্যতার নতুন চক্র আরম্ভ করুক – শুধু নিজেদের জন্য নয়, সারা বিশ্বকে বাঁচানোর জন্যও।
পাদটীকা
1 This was written before President Sadat was assassinated.
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়