চতুর্থ অধ্যায়: ম্যাকলেবাদের অবশিষ্টাংশ
ব্রিটিশ শাসনের দ্বিতীয় তলানি হল এই ম্যাকলেবাদ। পদটি এসেছে টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলে (Thomas Babington Macaulay)-এর নাম থেকে, যিনি ১৮৩০ সালে গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। প্রথমে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকার দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর বাংলা, বোম্বে ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে একটা সমীক্ষা করে নেওয়া হয়। দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা রাখা হবে নাকি নতুন ব্যবস্থা চালু করা হবে, তাই নিয়ে বিতর্ক হচ্ছিল। ম্যাকলে সাহেব এখান থেকেই আশা করেছিলেন, একটা এমন শ্রেণী তৈরি হবে যারা চামড়ায় বাদামী কিন্তু রুচি ও মেজাজে বিলেতি। এই আশা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পূরণ হয়েছিল বলা চলে।
এ দেশের শিক্ষিত সমাজের ধারণা হল ব্রিটিশ আগমণের আগে ভারতের বলার মতো কোনও শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। তক্ষশিলা, নালন্দা, বিক্রমশিলা ও ওদন্তপুরীর মতো বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম আক্রমণের ফলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। যা অবশিষ্ট ছিল বলে আমাদের বোঝানো হয়েছে, তা কিছু ‘পাঠশালা’ যেখানে অর্ধশিক্ষিত শিক্ষকদের দ্বারা মূলত উচ্চ বংশের বিশেষ করে ব্রাহ্মণ ছেলেদের প্রাথমিক স্তরের পাটীগণিত, পড়তে ও লিখতে শেখানো হতো। কিন্তু ধারণাটা কোনও মান্য তথ্য দ্বারা সমর্থিত নয়।
১৯৩১ সালের ২০ অক্টোবর লন্ডনের চ্যাথাম হাউসে (Chatham House) সীমিত কিছু শ্রোতার মাঝে বক্তৃতা রাখতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধী বলেন: “I say without fear of my figures being successfully challenged that India today is more illiterate than it was before a fifty or hundred years ago, and so is Burma, because the British administrators when they came to India, instead of taking hold of things as they were, began to root them out. They scratched the soil and began to look at the root and left the root like that and the beautiful tree perished.” অর্থাৎ আমি নির্ভয়ে বলতে পারি পাঁচশো বছর পূর্বেকার চেয়ে ভারত এখন আরও বেশি অশিক্ষিত, ঠিক যেমনটা বার্মার ক্ষেত্রে হয়েছে; কারণ ব্রিটিশ শাসকরা যা আছে তাকে লালন করার বদলে সমূলে উৎপাটন করেছে। তারা মাটি খুঁড়ে শেকড় দেখতে পেয়েও তাকে সেভাবেই ফেলে রেখেছিল। ফলে সুন্দর বৃক্ষটা মারা যায়।
মহাত্মা গান্ধী যে কথা নেতিবাচক ভঙ্গীতে বলেন, তা অর্থাৎ সাক্ষরতার ব্যাপারে অনেক ভারতীয় পণ্ডিত ইতিবাচকভাবে নথিকৃত করেন। এঁদের মধ্যে মহাত্মার পর বক্তব্য রাখা দৌলত রাম, ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ স্যর ফিলিপ হারটগ বিশেষ উল্লেখ্য। শ্রী ধর্মপাল যিনি ১৯৭১ সালে “Indian Science and Technology in the Eighteenth Century: Some Contemporary European Accounts” বইটি সংকলিত করেন, তিনি ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর একটি বই সম্পূর্ণ করেছেন।1
শ্রী ধর্মপাল পুরোনো ব্রিটিশ আর্কাইভ বিশেষত মাদ্রাজে রক্ষিত নথি থেকে খুঁজে বার করে লিখেছেন যে, ভারতের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা সমকালীন ইংল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় উন্নত ছিল। ভারতীয় ব্যবস্থা বাংলা, বোম্বে, মাদ্রাজের ব্রিটিশ জেলাশাসকদের (Collectors) কথামতো পতনের মুখে ছিল। তবুও যে তথ্য তারা সংগ্রহ করেছিলেন, তাতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা ইংরেজদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে উন্নততর ছিল। যেমন: (১) জনসংখ্যার অনুপাতে বিদ্যালয় ও উচ্চ-বিদ্যালয়ের সংখ্যা, (২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের উপস্থিতির সংখ্যা, (৩) বিদ্যালয়ে কাটানো সময় কাল, (৪) শিক্ষকদের মান, (৫) ছাত্রদের নিষ্ঠা ও বুদ্ধিমত্তা, (৬) বিদ্যালয় ও উচ্চ-বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য, (৭) উচ্চবর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) তুলনায় নিম্নবর্ণের (শূদ্র ও অন্যান্য জাত) অধিক সংখ্যক ছাত্রের উপস্থিতি, এবং (৮) শিক্ষণীয় বিষয় – এই সবকটি ক্ষেত্রেই।
ভারতের দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে নাকচ করে ব্রিটিশরা যে তাকে মরণের মুখে ঠেলে দেয়, তা তার অপ্রতুলতার জন্য নয়, বরং শাসকরা ভারতীয়দের যে কাজে লাগাতে চাইছে সেই উদ্দেশ্য সাধিত হবে না বলে। উদ্দেশ্য ছিল প্রথমতঃ সারা ভারতে ইংল্যান্ডে সেই সময় প্রচলিত অনুরূপ প্রশাসনিক ব্যবস্থার সমতুল্য শাসনব্যবস্থা চালু করা। ইংরেজী শাসন ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কেন্দ্রীকৃত, যার লক্ষ্য ছিল সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় আয় নিশ্চিত করা, এবং পরিচালিত হতো ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণীর দ্বারা নীচুতলার মানুষের প্রতি যাদের অপার ঘৃণা। এর ফলে যে কোনও গণ-অসন্তোষকে তারা বেপরোয়াভাবে দমন করতে পারত। দ্বিতীয়ত, নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল এক নতুন উচ্চ শ্রেণীর ভারতীয় নির্মাণ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা, যারা বিনিময়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে আশীর্বাদ জ্ঞানে সুস্থিতি লাভে সহযোগিতা করবে। দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ঘরে বাইরে কোথাও এই জাতীয় প্রশাসক তৈরির শিক্ষানবিশী দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না।
মোটামুটি ম্যাকলে যেমনটা অনুমান করেছিলেন, ব্রিটিশদের প্রণীত নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা সেভাবেই কাজ করল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, লোকমান্য তিলক, মহাত্মা গান্ধী, মদনমোহন মালব্য, বীর সাভারকার, এম. এস. গোলওয়ালকর – এইরকম গুটিকয় ব্যক্তিত্ব এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে নিজেদের শেকড় খুঁজে পেয়েছিলেন। এই মহাত্মারা জাতীয়তাবাদ নষ্ট করে দেওয়ার পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বাকিদেরকে এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে সমূলে উপড়ে ফেলেছিল। ম্যাকলে সেই বিরল কৃতিত্বের দাবিদার যাঁর মতবাদ বা ‘ইজ়ম’ থেকে আমরা এখনও মুক্ত নই।
‘ম্যাকলেবাদে’-এর নীতি বা মতবাদকে ইসলামবাদ বা খ্রিস্টানবাদের মতো যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা সহজ নয়। মতবাদ হিসাবে ম্যাকলেবাদ অনেকটা ছড়ানো ছেটানো। এর কোনও ঐতিহাসিক দেবদূত বা পয়গম্বর নেই যাকে সর্বশেষ তথা সর্বশ্রেষ্ট বলে দাবি করা হয়েছে। এই তত্ত্ব একটি নির্দিষ্ট বইয়ে লিপিবদ্ধ কোনও সত্য বা জ্ঞানের একাধিপত্য দাবি করে না। এটা কোনও পয়গম্বরের জীবন বা গীর্জার পবিত্র ঐতিহ্যের ভিত্তিতে মানুষের একটিও আচরণবিধির নির্দেশও করে যায়নি।
ম্যাকলেবাদ ইসলামপন্থার মতো হিংসক বা খ্রিস্টপন্থার মতো কুচক্রী নয়। বরং মৃদুমন্দ বাতাসের মতোই নরম ও উপভোগ্য, যা নিঃশব্দে বয়ে মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশে পাখনা মেলে, এক ধরণের মানসিকতা তৈরি করে, বৌদ্ধিক মনোভঙ্গীকে অনুপ্রেরণা দেয়, এবং সব শেষে সর্বত্রব্যাপী সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিকৃত ও পরিবর্তিত করে একেবারে গেড়ে বসে।
ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মের মতো ম্যাকলেইজ়ম নিজের প্রসার বা বিস্তারের জন্য কোনও তৈরি করা পদ্ধতি প্রয়োগ করে না। এটা নির্দিষ্ট কোনও ভারতীয় গোষ্ঠীকে নিজের তীব্রতা বিস্তারের স্বার্থে ব্যবহারও করে না। ইসলামের মতো কড়া পাঁচনও নয় যা সংস্কৃতির শরীরকে নষ্ট করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। খ্রিস্টানবাদের মতো সূক্ষ্ম কৌশলে সমাজকে বিচ্যুতও করবে না। কিন্তু এমন এক মৃদু বিষক্রিয়া যা ধীরে ধীরে কোনও সংস্কৃতির আত্মাকে ক্ষইয়ে সমাজ ব্যবস্থাকে দূষিত করতে পারে। এর লক্ষ্য ভারতীয় সমাজের প্রতিটি শ্রেণীই।
যাই হোক হিন্দু সমাজে বিশেষত হিন্দুদের বৌদ্ধিক জগতে এর বিস্তার সমীক্ষা করে আমরা এর কতগুলি পক্ষাঘাতী পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছি। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রকৃষ্টগুলো হল:
১। হিন্দু আধ্যাত্মিকতা, সাংস্কৃতিক নির্মাণ ও সমাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে পুরোপুরি নেতিবাচক না হলেও উন্নততর জ্ঞানবিদ্যার অহমিকায় অবিশ্বাস তৈরি করে দেওয়া। হিন্দু ভারতের অতীত বা বর্তমানের কোনও কিছুই অনুমোদনযোগ্য নয় যতক্ষণ না পশ্চিম দুনিয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব তাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
২। প্রগতি, যুক্তি ও বিজ্ঞানের নামে অতীত বা বর্তমান পশ্চিমী সমাজ ও সংস্কৃতিকে সরাসরি উপাসনা করতে না শেখালেও হলেও সেগুলোর প্রতি একটা সশ্রদ্ধ মনোভাব তৈরি করা। পশ্চিমের কোনও কিছুই তাদেরই মূল্যায়নে অসম্পূর্ণ প্রমাণিত না হলে বাতিল করা যায় না।
৩। প্রাচীন হিন্দু আদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সমসাময়িক পশ্চিমী আদর্শ ও প্রতিষ্ঠানের তুলনা না করে বিগত ১৯ ও ২০ শতকে প্রতীচ্য যা অর্জন করেছে, তার সঙ্গে তুলনা করার একটা বৌদ্ধিক প্রবণতা তৈরি করা।
৪। পশ্চিমী দেশগুলোকে তাদের আদর্শ ও দাবি করা কল্পনার নিরিখে বিচার করার একটা মানসিক প্রবণতা গড়ে তোলা হচ্ছে। অথচ হিন্দুদের বিচার করা হচ্ছে তাদের সমাজ ও সংস্কৃতির বর্তমান আপাত নিতান্ত তুচ্ছ অর্থহীন প্রথার নিরিখে, যেখানে হিন্দুরা সুদীর্ঘ কাল ধরে বিদেশী আক্রমণের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
৫। হিন্দু সংস্কৃতি, ইতিহাস, সমাজ ও আধ্যাত্মিকতাকে পাশ্চাত্য বিদ্যায় গড়ে ওঠা ধারণা ও তুলাযন্ত্র দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করার একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা তৈরি করা হচ্ছে। হিন্দুদেরও যে নিজস্ব দর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ধ্যান-ধারণা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি আছে বা থাকতে পারে, যেগুলো দিয়ে হিন্দু ঐতিহ্যকে বিশ্লেষণ করা বেশি লাভজনক, ভিনদেশী বেমানান পদ্ধতি দ্বারা বিচার করা যে অনুচিত, সেটা কখনও স্বীকারই করা হয় না। হিন্দুরা নিজেদের জ্ঞান ও পদ্ধতি প্রয়োগ করে যদি পাশ্চাত্যের ঐতিহ্যকে বিশ্লেষণ করে, তাহলে আমাদের ম্যাকলেবাদীরা সেই প্রচেষ্টাকে বিশ্বচরাচরে অবৈজ্ঞানিক ও অপ্রাসঙ্গিক বলে উড়িয়ে দেয়।
ম্যাকলেবাদীদের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক ফ্যাশন বা ক্ষণস্থায়ী হুজুগ পশ্চিমের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক জলবায়ুর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। এই ইংলিশ ইউলিটারিয়ানিজ়ম (Utilitarianism), তো এখন জার্মান আইডিয়ালিজ়ম (Idealism), এই রাশিয়ান নিহিলিজ়ম (Nihilism), তো কখনও ফরাসী পজ়িটিভিজ়ম বা এক্সিসটেনশিয়ালিজ়ম (Positivism or Existentialism) অথবা এখনকার আমেরিকান কনজ়িউমারিজ়ম (Consumerism) – পশ্চিমী দেশগুলোতে যখন যে ধারার দাপট থাকে, ঠিক সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত হিন্দুরা তাই আঁকড়ে জোট বেঁধে ফেলে। শুধু একটা জিনিস ধ্রুবক থাকে। যেটাই হোক, ভারতে দেখা বা শোনার আগে পাশ্চাত্যে তার মঞ্চ নির্মিত হতে হবে।
আর এই অনুমোদন, বাতিল, বিচার ও যৌক্তিকতা প্রতিপাদনের সমস্ত প্রক্রিয়া ম্যাকলেবাদ তুলে ধরে এর হিন্দু নায়কদের মধ্যে। প্রচার করার ব্যাপারটা আর নিছক মানসিক মেজাজ মর্জি অথবা বৌদ্ধিক ঝোঁক বা মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা হয়ে আটকে থাকে না; বরং বলা যায় মানুষ ও বিষয়গুলোর ওপর এর একটা বিষয়গত অবস্থান আছে। এর প্রতিফলন অনিবার্যভাবে ও অতি দ্রুত পুরো জীবন-শৈলীতেই দেখা যায়। ফলতঃ পশ্চিমীদের প্রস্তাবিত সর্বাধুনিক ও সর্বোত্তমের পক্ষ নিয়ে হিন্দুরাই হিন্দুদের আচার-আচরণকে নির্বিচারে বাতিল ও প্রতিস্থাপন করতে থাকে। যে ভূমি থেকে জীবনশৈলী আমদানি করা হয় তা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ অব্দি ছিল ইংল্যাণ্ড কিংবা তারপর থেকে অদ্যাবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে সর্বদা এটা নিশ্চিত যে, জমিটি পশ্চিম গোলার্ধের কোথাও না কোথাও অবস্থিত। ‘ফরেন’ মানেই সবসময় ভালো।
পশ্চিম থেকে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় আমদানি করা মডেলগুলিকে যে ভারতে উপলব্ধ ভৌগোলিক অবস্থা, জলবায়ু, অর্থনৈতিক সম্পদ, প্রযুক্তিগত প্রতিভা, প্রশাসনিক দক্ষতা ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। যদি আমদানি করা মডেলটি ভারতের মাটিতে ভারতের আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে সফল নাও হয়, তাহলেও প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় শক্তির নির্মম ব্যবহার করে হলেও সেগুলোকে ধরে বেঁধে যতটা সম্ভব খাপ খাওয়াতে হবে। তবে এত সব চেষ্টার পরেও যদি আমদানি করা মডেলটি বেমানান সাব্যস্ত হয়, তাহলে অন্তিম ফলাফলেও তাকে অপূর্ণতা প্রতিফলিত হলেও বেমানান মডেলটি যেনতেন প্রকারে বহাল রাখা হয়। পশ্চিম থেকে আমদানিকৃত কোনও মডেল যদি অর্ধেক বা সিকি ভাগও ভারতীয় মাটিতে রোপণ করা যায়, তাহলেও তাকে এ দেশের প্রয়োজন ও স্থানীয় অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনও দেশীয় নকশার তুলনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং পরিকল্পিত অর্থনীতি থেকে শুরু করে, বর্ণহীন সমাজ ও বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি হয়ে, হিন্দুদের ঘরে ঘরে নিত্য ব্যবহার খতিয়ে দেখে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সেই একই আরোপিত প্রচেষ্টার পরিচিত অন্তহীন ছবি। আমাদের সংসদীয় প্রতিষ্ঠান, আমাদের সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ, বিদ্যুৎ ও পরিবহনের পরিকাঠামো, আমাদের ওষুধ, জনস্বাস্থ্য ও আবাসন, আমাদের শিক্ষা ও বিনোদন, আমাদের পোশাক, খাবার, আসবাব, চীনা মাটির বাসনকোসন, খাবার টেবিলের কেতা, এমনকি যেভাবে আমরা অঙ্গভঙ্গী করি, বিদ্রূপাত্মক অথবা মুচকি হাসি – সবকিছুই পশ্চিমে বর্তমানে যা চলছে, তার হুবহু অনুলিপি (“কার্বন কপি”) হতে হবে।
ড্রেন-পাইপ, বেল-বটম, লম্বা চুল, চোমড়ানো গোঁফ; মেয়েদের জিন্স পরা; বাবা মাকে ‘মম’ ও ‘পাপা’ কিংবা ‘মাম্মি’ ড্যাডি’ বলে ডাকা; বৈবাহিক বিজ্ঞাপনগুলিতে কনভেন্ট শিক্ষার দাবি; এবং ইংরেজ নাগরিকরা বাধ্য হয়ে যেভাবে ভারতীয় ভাষা উচ্চারণ করে তার অনুকরণে স্থানীয়দেরও নিজেদের মাতৃভাষা বলা – এগুলি সম্ভবত নেহাত ছোট ও তুচ্ছ ব্যাপার। হিন্দুরা নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করলে এগুলোর জন্য তেমন কিছুই ইতর-বিশেষ হতো না। তবে বর্তমান প্রেক্ষিতে পাশ্চাত্যের সামনে নতজানু হওয়া মানে সমগ্র সংস্কৃতিকে হীনমন্যতা দ্বারা চালিত হয়ে নর্দমায় ফেলে দেওয়ার মতো বেদনাদায়ক।
হিন্দুদের মাঝে মাঝে নিজেদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ঐতিহ্যের জন্য কিছুটা গর্ব অনুভব করা প্রয়োজন, বিশেষ করে পশ্চিম থেকে আগত দর্শকদের কাছে নিজেদের হীনমন্যতা ঘোচানোর সময়। ম্যাকলেবাদ সানন্দে তাদের এই সুযোগ করে দেয়। যেমন কালিদাস ভারতের শেকস্পীয়ার হিসাবে প্রশংসিত হন বা সমুদ্রগুপ্ত ভারতের নেপোলিয়ন হিসাবে স্বীকৃতি পান। হিন্দুরা সেইসব দেশীয় সাহিত্যকীর্তি নিয়ে গর্ব করার অনুমতি পায়, যেগুলো পশ্চিমী সমালোচক দ্বারা প্রশংসিত। তবে হিন্দুদের সেগুলো ইংরেজি অনুবাদে পড়া আবশ্যক। যে সব স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, সংগীত, নৃত্য ও নাটকের নিদর্শনগুলি কোনও প্রদর্শনী বা উপস্থাপনার মাধ্যমে পাশ্চাত্য সমঝদারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে, নিজেদের সেইসব কীর্তির প্রশংসা করার অনুমতিও আছে। তবে প্রশংসা বা গর্ববোধ নিজেদের স্থানীয় ভাষায় প্রকাশ করলে চলবে না; এমনকি ইংরেজিতে বললেও মান্য উচ্চারণ ছাড়া না। বলতে ও লিখতে হবে খাস সাহেবি ঢং-এ।
ম্যাকলেবাদে আসক্ত হিন্দু এমন এক পৃথিবীতে বাস করে, যার সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী হিন্দু সমাজের যোগাযোগ খুবই কম। এই ধরণের হিন্দু প্রতীক্ষা করে ভারতীয় সমাজ কবে পশ্চিমী সমাজের মতো হবে, যেখানে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার, মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) ও জীবনযাত্রার মানই হবে প্রগতির মাপকাঠি। এরা ধর্মের প্রতি ততক্ষণ সহনশীল যতক্ষণ তা ব্যক্তিগত পরিধির মধ্যে রয়েছে এবং সমাজ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে প্রভাবিত করছে না। ব্যক্তিগতভাবে তাদের জন্য ধর্ম অপ্রাসঙ্গিক, যদিও এর কিছু আচার এবং উৎসব মাঝে মাঝে তাদের কারও কারও জীবন অল্পবিস্তর রাঙাতেও পারে। আর বাকিদের ক্ষেত্রে ধর্ম নিতান্তই অস্পষ্ট ও আদিম কুসংস্কার, যা বর্তমান ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অন্যতম স্রষ্টা।
সুতরাং, আত্মবিস্মৃত ও আত্ম-বিচ্ছিন্ন হিন্দু যার মধ্যে হিন্দুত্ব বিরোধিতার দুরারোগ্য ব্যাধি রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ নীরোদ সি চৌধুরী, যদি হিন্দু সমাজ সংস্কৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও তাদের নিয়তির প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যে সব সনাতন হিন্দু এখনও নিজের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য আঁকড়ে আছে, নিজেদের ধর্মের পবিত্র তীর্থস্থানগুলো এখনও ভিড় করে, উৎসবগুলি নিষ্ঠার সাথে উদযাপন করে, নিজেদের নিত্যকার জীবন চিরাচরিত আচার অনুষ্ঠান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের পিতৃপুরুষদের, বিশেষত বৃদ্ধ সাধু, ঋষি ও মহাপুরুষদের শ্রদ্ধা করে, তাদের প্রতি এই ম্যাকলেবাদীরা বিশেষ ধৈর্য বা সহনশীলতা দেখায় না। বরং প্রথাগত হিন্দুদের প্রতি যারা শত্রুভাবাপন্ন, যারা হিন্দুদের ঘৃণা ও বিদ্রূপ করে চলে– সে যে সম্প্রদায়ের বা বিশ্বাসেরই হোক না কেন, নিজেরা সেই ধর্মীয় বা আদর্শগত ধর্মান্ধতার অংশীদার না হয়েও তাদের প্রতি যথেষ্ট প্রশ্রয়ী।
অন্যদিকে, ঐতিহ্যবাহী হিন্দুরা কিন্তু তার সহ-দেশবাসীর সাথে শান্তি ও মৈত্রী বজায় রেখে বসবাস করতে চায়। তারা সচরাচর তাদের মুসলিম ও খ্রিস্টান দেশবাসীদের প্রতি অত্যন্ত সহনশীল, সানন্দে তাদের নিজস্ব উপাসনা পদ্ধতি পালন করার অধিকার মঞ্জুর করে। এমনকি আর এক কদম এগিয়ে প্রায়শই মুসলিম এবং খ্রিস্টান ধর্মকে নিজেদের ধর্মের মতোই শুভ মনে করেন। তারা মুসলিম ও খ্রিস্টান নবি বা ঈশ্বরের দূত, ধর্মগ্রন্থ ও সন্তদের প্রতিও যথাযোগ্য সম্মান দেখায়। অথচ নিজেদের ধর্ম নিয়ে কাউকেই নির্দ্বিধায় আলোচনা, কাটাছেঁড়া, এমনকি হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে উপহাস করতেও বাধা দেয় না। যে হিন্দুরা তার ঐতিহ্যময় ধর্মীয় উত্তরাধিকারের প্রতি নিস্পৃহ, তাদের বিরুদ্ধে কখনও ঐতিহ্যবাহী হিন্দুরা খুনে জনসমাগম আয়োজন করে না। নিজেদের পূজ্য দেব-দেবীদের ক্যালেণ্ডার এবং বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে সস্তা মডেল হিসাবে ব্যবহৃত হতে দেখেও তাদের কোনও হেলদোল হয় না। আর অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিজের মতানুসারীতে রূপান্তরিত করতে তো কখনই দেখা যায় না।
একমাত্র মুসলমান এবং খ্রিস্টানরা যখন সব সীমা অতিক্রম করে দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতাকে বিপন্ন করে, তখনই ঐতিহ্যগতভাবে যারা হিন্দু তারা আলোড়িত হয়। নিজেদের একমাত্র নিজস্ব বাসভূমিতেও নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে কখনও প্রতারণার মাধ্যমে গণ-ধর্মান্তরণ দ্বারা মুসলিম ও খ্রিস্টানদের সংখ্যালঘু করে রাখার চেষ্টা করে না। তাদের বিশ্বাস হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিরও বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, এবং সেই অধিকার বজায় রাখতে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। কিন্তু ম্যাকলেবাদে আসক্ত হিন্দুরা অদ্ভূত একগুঁয়েমি নিয়ে হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির সেই অধিকারটুকুও মানতে নারাজ। আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা তারা দেখতে পায় না, কারণ বিপদটিও তাদের চোখে পড়ে না। তাদের ধনুকে অনেকগুলি ছিলা রয়েছে যা দিয়ে জুলুমবাজি মানতে অরাজি হিন্দুদের নিমেষে নস্যাৎ করে দেয়। ম্যাকলেবাদীদের মনোভাব নীচে সংক্ষেপে দেওয়া হল:
১। শুরুতেই বলতে হয়, এরা নাকের ডগায় অকাট্য তথ্য তুলে ধরলেও হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির কোনও বিপদ দেখতে পায় না। বরং যারা হিন্দুদের আত্মরক্ষার চেষ্টা অনুভব করে, উল্টে তাদেরকেই ভীতি প্রদর্শক, সাম্প্রদায়িক, বৈষম্যবাদী বা পুরুষতান্ত্রিক (chauvinists) ও ফ্যাসিস্ট বলে গালাগাল শুরু করে দেয়। অন্য সম্প্রদায়ের লোকেদের আগ্রাসন ও হিংসাকে ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা’র প্রতিফল হিসাবে ব্যাখ্যা করতে চায়।
২। তারা হামলাবাজদের করুণ ছবি এঁকে সাব্যস্ত করতে চায়, এরা গরীব বঞ্চিত ও পদদলিত সংখ্যালঘু, যাদের হিন্দুরা নাগরিক সমানাধিকার দিতে চায় না, যেখানে সংবিধান অনুযায়ী তাদের যথোপযুক্ত (বা তারও বেশি) জাতীয় সুবিধা প্রাপ্য।
৩। পরবর্তী ধাপে তারা ধর্মধ্বজী ভান করে অন্য সম্প্রদায়কে অবহেলিত, সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখার জন্য হিন্দুদেরকেই দায়ী করে তাদের ওপরেই ঐ শ্রেণীকে উদ্ধার করার নৈতিক দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। যতই যাই হোক, ছোট ভাইরা অল্পবিস্তর ভুল করলেও বড় ভাই হিসাবে হিন্দুরা উদারতা দেখালে হিন্দুদের কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই;
৪। পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমাগত জোর করে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, যদি হিন্দু সমাজের সত্যিই কোনও বিপদ থেকে থাকে, তা বাহ্যিক আগ্রাসনের কারণে নয়, হয়েছে তাদের নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থার অবিচার ও নিপীড়নের শিকার নিম্নবর্গের মানুষজন ভিন্ন সমাজের দিকে সরে যাওয়ায়। তাদের বক্তব্য: ইসলাম কি নিজের ভ্রাতৃত্বের মহান আদর্শের কারণে সব মানুষকে সমান সামাজিক মর্যাদার প্রতিশ্রুতি দেয় না? খ্রিস্টধর্ম কি মাদার টেরেসার মতো কোনও উৎসর্গীকৃত সমাজসেবীর নিদর্শন রাখেনি?
৫। হিন্দুরা যদি এই সমস্ত যুক্তিতে না ভুলে কোনওরকম আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা করে, তাহলে ম্যাকলেবাদীরা সেই পরিণতির জন্য একটি অকাট্য সূত্র আমদানি করে। হিন্দুরা তাদের নিজের বাড়ি সামলাক, সেটাই তাদের পক্ষে সেরা আত্মরক্ষার ব্যবস্থা। তাদের অবিলম্বে জাতিভেদপ্রথা তুলে দেওয়া উচিত, নিম্নবর্গের বিশেষত হরিজনদের সঙ্গে একত্রে খাওয়াদাওয়া ও অসবর্ণ বিবাহ শুরু করা উচিত ইত্যাদি ইত্যাদি। সামাজিক সংস্কার যে একটি ধীর প্রক্রিয়া যা পরিপক্ব হতে সময় নেয় এবং সেই সময়ে সমাজটিকে টিঁকিয়ে রাখার স্বার্থেই একটি প্রতিক্ষার ব্যবস্থার প্রয়োজন, সে কথা এই বুদ্ধিজীবীদের কখনই মনে হয় না।
৬। হিন্দুরা তারপরেও অনড় থাকলে এরা নিজেদের শেষ ও সেরা ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রয়োগ করে। অকস্মাৎ একটি আধ্যাত্মিক মুখোশ পরে হিন্দুদের কাছে মধুরভাবে আবেদন করে যে, ধর্মীয় সহনশীলতাই হিন্দুধর্মের চিরাচরিত ঐতিহ্য। গৌতম বুদ্ধ বা গান্ধীর অনুগামীরা কী করে ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের পর্যায়ে নেমে আসছে, যাদের শিক্ষায় সহিষ্ণুতা বলে কিছু নেই? হিন্দুরাও যদি সেমেটিক ধর্মের অনুসারীদের মতো আচরণ শুরু করে, যা তাদের জন্মসূত্রে ভিন্ন ঐতিহাসিক পরিস্থিতির দ্বারা জারিত, তাহলে আর হিন্দুদের হিন্দুত্ব বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু অনুরূপ একটি শব্দও ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের অনুসারীদেরকে তাদের কীর্তিকলাপ থেকে বিরত রাখার জন্য বলার সাহস নেই। তারা খুব ভালো করে জানে যে, হিন্দুদের উপর ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্ম যে আপত্তিকর অভিযোগ বর্ষণ করে থাকে, মুসলমান ও খ্রিস্টানদের সুপরামর্শ দিতে গেলে ঠিক একইরকম অভিযোগ তত্ক্ষণাৎ ম্যাকলেবাদীদের ঘাড়েও চাপবে। মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর সেই পরিণতি। এরা হিন্দু নিন্দা ও বিরোধিতার মাধ্যমে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের কাছ থেকে অর্জিত নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীলতার প্রসিদ্ধি খোয়ানোর ঝুঁকি কখনই নিতে পারে না।
যে অবস্থানটা ম্যাকলেবাদকে সবচেয়ে মানায়, সেটা হল নিরাপদ দূরত্বে বেড়ার ওপর বসে দুই পক্ষের মড়ক দেখে যাওয়া। ম্যাকলেবাদের অনুসারীদের পক্ষে ন্যায্য বিচার করা অত্যন্ত কঠিন। তারা অন্তর থেকে একটাই কাজ করতে পারে, তা হল বিতর্কে অন্যায়ের পক্ষ নেওয়া, যদিও একান্তে ব্যক্তিগতভাবে এরা খুব ভালো করেই জানে কারা আগ্রাসী আর কারা আগ্রাসনের শিকার। দুই বিবদমান পক্ষের লড়াইটা তারা নিস্পৃহ বহিরাগতের মতো দেখে কিছুটা উপভোগই করে। মীনাক্ষীপুরম ও অন্যান্য কিছু জায়গায় ইসলামের ভয়াভয় তাণ্ডব সম্পর্কে বিখ্যাত সাংবাদিকরা যেসব প্রতিবেদন লিখেছেন ও আলোচনা করেছেন, সেখান থেকে এটা পরিষ্কার যে এই ভদ্র মহোদয়গণ আর যাই হোক হিন্দু সমাজের সদস্য নয়, ভিনগ্রহ থেকে বেড়াতে আসা জীব যারা সাময়িকভাবে নিম্ন প্রজাতির খেয়োখেয়ি প্রত্যক্ষ করতে এসেছে।
একজন ম্যাকলেবাদে আসক্ত ব্যক্তি হিন্দু সমাজের সমস্যা ও সংগ্রামের প্রতি সম্পূর্ণ নিরাসক্ত এমনকি শত্রুতাপূর্ণ অবস্থান নিতে পারে, কারণ সে নিজেকে আর হিন্দু সমাজের একজন ভাবে না; এই সমাজকে নিজের অপরিহার্য বা হিতকারী বলেও মনে করে না। এরা ইতিমধ্যে এ দেশের যাবতীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতায় নিজেদের একছত্র আধিপত্য স্থাপন এবং বাণিজ্য ও অন্যান্য পেশাতেও সেরা জায়গাগুলো দখল করে ফেলেছে। প্রচার মাধ্যমের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদগুলোতেও নিজেদের দুর্গ গড়ে ফেলেছে। রাজনৈতিক ভুঁইফোঁড় ও নব্য পয়সাওয়ালারা ম্যাকলেবাদীদেরই আদর্শ মনে করে নিজেদের সন্তানদেরও সেই ছাঁচেই গড়তে চায়।
সচেতনভাবে না হলেও সর্বদা মাথায় থাকে পশ্চিমী দেশে, মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এদের পৃষ্ঠপোষক আর্থিক মদতদাতা ও রক্ষাকর্তাদের কথা। এরা ভারতের সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির রুগ্নতা দেখিয়ে এবং তার জন্য পাশ্চাত্য দাওয়াইয়ের পরামর্শ দিয়ে কিছু লিখলেই প্রগতিশীল পশ্চিম দুনিয়ার সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষকরা এদের শুধু অনুমোদনই দেয় না, প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়। তারা প্রচুর সম্মানির বিনিময়ে আন্তর্জাতিক সেমিনারে আলোকপ্রাপ্ত পশ্চিমী শ্রোতাদের কাছে তাদের অভাগা জন্মভূমি ও অন্যান্য অনগ্রসর দেশগুলোর আসল দুঃস্থ চেহারাটা তুলে ধরে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পায়। তাদের পুরো বিদেশ ভ্রমণটাই বিলাসবহুল ও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বন্দোবস্ত হয়ে যায়। এমনকি এই দেশেও তারা সামাজিক বৃত্তগুলোতে পশ্চিম বিশ্বের সঙ্গে ঘনঘন যোগাযোগ রাখা ও ভ্রমণের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়।
আর ঈশ্বর না করুন যদি চরমতম দুর্দিনে আরএসএস বা মুসলিম মৌলবাদীদের মতো ধর্মান্ধ অথবা ‘সহিষ্ণু কমিউনিস্ট’-দের দ্বারা এই রাষ্ট্র অধিকৃত হয়, তাহলে তাদের জন্য বিদেশে নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত হয়ে আছে। বিশ্বের অনেক জায়গা আছে যেখানে তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ রয়েছে পারস্পরিক লাভবান হওয়ার বিনিময়ে। সেই সব জায়গার পারিশ্রমিক ও অন্যান্য অনুমোদিত খরচ-খরচা খুবই আকর্ষণীয়। আধুনিকতম জীবনযাত্রার সবকটি আকর্ষণীয় উপাদান তাদের হাতের মুঠোয়। তাদের ছেলে-মেয়ে, ভাইঝি, ভাইপো, ভাগ্নে, ভাগ্নী, নিকট আত্মীয়রা সবাই রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিভিন্ন বিভাগে (UN agencies), ডাকসাইটে প্রতিষ্ঠানে, বাণিজ্যিক সংস্থায়, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণামূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরামপ্রদ চাকরিতে বহাল থাকতে পারে।
সুতরাং হিন্দু সমাজ তার যাবতীয় হৈহল্লা ও সংস্কৃতি নিয়ে চুলোয় যাক। তারা নিজেদের উন্নতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে ব্যস্ত। না পারলে তারা নিজেরা নয়, এই সমাজকেই ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। এই সমাজ তো তাদের জুতো পালিশের খরচটুকুও বহন করতে অক্ষম।
পাদটীকা
1 The Beautiful Tree, Dharampal, New Delhi, 1983.
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়