(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তৃতীয় অধ্যায়: খ্রিস্টান অবশিষ্টাংশ
ভারতে ব্রিটিশ শাসন দু ধরণের তলানি ফেলে গেছে – খ্রিস্টানবাদ ও ম্যাকলেবাদ:
ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে ম্যাকলেবাদকিছুটা গড়ে উঠেছিল যাকে উৎসাহের আতিশয্যে ‘বিপ্লবী ভাবধারা’ বলা হয়। এই মতবাদ রাশিয়ার বলশেভিকদের জয়ের পর কমিউনিজ়মের সঙ্গেই হাত মেলায়। কমিউনিজ়ম যা আদ্যন্ত হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি তীব্র বিদ্বেষপরায়ণ, তার পুরোটাই ম্যাকলেবাদ নয়। তবু যদি ম্যাকলেবাদ নিজেদের আদর্শের ভিত্তিভূমি তৈরি না করত, তাহলে কমিউনিজ়ম সারা ভারতে এভাবে ছেয়ে যেত না।
আমরা প্রথমে খ্রিস্টান মতবাদ বিশ্লেষণ করব। এটাই ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে প্রবলভাবে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়।
এখানেও একটা ব্যাপার গোড়াতেই পরিষ্কার করে রাখি, খ্রিস্টানবাদ বলতে আমাদের দেশের খ্রিস্টানদের বোঝাচ্ছে না। তারা আমদেরই মানুষ যারা কোনও এক সময় খ্রিস্টানবাদ দ্বারা তৈরি করা পরিস্থিতি ও শোষণের শিকার হয়ে বিদেশী বিশ্বাস গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু নিজেদের পূর্বসূরীদের বিশ্বাস ত্যাগ করলেও খ্রিস্টানরা হিন্দুসমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি তেমন উল্লেখযোগ্য শত্রুতা দেখায়নি। উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু রাজ্য বিশেষত মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড ছাড়া দেশের অন্যান্য ভাগে খ্রিস্টীয় মতবাদ প্রসারের মাধ্যম হিসাবেও কাজ করেনি। খ্রিস্টানবাদ ভারতে মূলত অসংখ্য খ্রিস্টান মিশন কেন্দ্রিক, বিশেষতঃ তথাকথিত আদিবাসী অধ্যুষিত জায়গাগুলোতে।
ভারতে খ্রিস্টীয় মতবাদের আটটি মূলগত বৈশিষ্ট্য হল:
১। বুদ্ধ ছাড়া হিন্দুদের মধ্যে আর কোনও ইতিহাস সমর্থিত ত্রাতা আসেনি।
২। যিশু খ্রিস্ট যাঁর ঐতিহাসিকতা প্রশ্নাতীত, হিন্দুদের পূর্ববর্তী সমস্ত ত্রাতাদের (যদি তারা প্রতারকদের স্যাঙাত না হয়ে আদৌ ত্রাতা হয়ে থাকে) ছাপিয়ে গেছেন এবং হিন্দু সাধু-সন্তদের নিতান্ত অগভীর সাব্যস্ত করেছেন।
৩। যিশুর সাক্ষাৎ শিষ্য ও ধর্ম প্রচারক সেন্ট টমাসকে চার্চ বিশেষভাবে বেছেছিল প্রভুর বার্তা ছড়িয়ে ভারত জয়ের উদ্দেশ্যে।
৪। সেন্ট টমাস নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে পারেননি যেহেতু হিন্দুদের, খুব সম্ভবত ব্রাহ্মণ ও হীদেনদের (আব্রাহামীয় ধর্মে অবিশ্বাসী বিধর্মীদের) হাতে তাঁর অকাল মৃত্যু ঘটে। [1]
৫। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে ধর্মান্তরিত হওয়া খ্রিস্টানরা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ করে যে খ্রিস্ট ধর্মও ভারতের প্রাচীন ধর্ম এবং এটা বিদেশ থেকে পশ্চিমীদের আমদানি করা নয়।
৬। সেন্ট টমাসের অপূর্ণ মিশন পূর্ণ অর্থাৎ ভারতবর্ষকে পুরোপুরি খ্রিস্টান দেশে পরিবর্তিত করাই খ্রিস্টানদের পবিত্র কর্তব্য।
৭। যদি হিন্দুধর্মে ভালো ও পরিপূর্ণ কিছু থেকেও থাকে, তা হিন্দু মুনি ঋষিদের সত্য দর্শন বা চেতনার জন্য নয়, ঘটেছে যিশুর আবির্ভাবের জন্য বিশ্বপ্রকৃতি যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তার সংস্পর্শে তারা এসেছিল বলে।
৮. যদি কোনও হিন্দু যদি Ten Commandments মানে এবং জীবনাচরণেও প্রভুর বাণী অনুসরণ করে, তাহলেও যতক্ষণ না কোনও গীর্জায় গিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে খ্রিস্টান নির্দেশাবলী পালন করছে, অনন্ত নরকবাস থেকে তার উদ্ধার নেই।
এই নীতিগুলোর উৎস খ্রিস্টধর্ম যা ইসলামের মতোই রক্ষণশীল অপরিবর্তনীয়। [2] খ্রিস্টান মতবাদও সত্য ও মূল্যবোধের নির্ণয়ক হিসাবে নিজের একাধিপত্যে বিশ্বাস করে; শপথ করে প্রকৃত ঈশ্বরের নামে; মনে করে প্রকৃত ত্রাতা হল প্রকৃত ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র, একমাত্র সত্যের প্রকাশ; খ্রিস্টান মতই একমাত্র সত্য উপাসনা ইত্যাদি। এরও কৃতিত্বে রয়েছে বহু প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিনাশ এবং হীদেনদের গণহত্যা। এরও অন্দরে রয়েছে ইওরোপ, এশিয়া মাইনর, উত্তর আফ্রিকা ও আমেরিকা বিশেষত মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় ধ্বংস ও রক্তপাত ঘটানোর বিভীষিকাময় ইতিহাস।
আমরা ভারতে খ্রিস্টানদেরকে মুসলিমদের অনুরূপ অপকর্ম করতে দেখিনি তার কারণ যে ব্রিটিশ আগন্তুকরা শেষ পর্যন্ত ভারত বিজয়ে সফল হয়, তারা খ্রিস্টান ক্রুসেডার বা ধর্মযোদ্ধাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় সরাসরি ও যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ করতে দেয়নি। তারা হয়তো ভারতে মুসলিমদের ইতিহাস পড়ে কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করেছিল, আর তাই স্থিতিশীল সাম্রাজ্য গঠনে ধর্মমতকে নাক গলাতে দেয়নি। তাছাড়া ইওরোপে ‘রেনেসাঁ’ বা নবজাগরণের ফলে ধর্মীয় উন্মাদনা নিজেদের বসতভূমিতেই নিন্দিত হচ্ছিল।
কিন্তু খ্রিস্টীয় আগ্রাসনের সহজাত স্বাদ আমরা মিশনারিদের প্রথম দিকে যুঝতে গিয়েই পেয়েছি। এরা ষোড়শ শতাব্দী থেকেই পশ্চিমীদের জয়ের হাত ধরে আমাদের তটভূমিতে দলে দলে ঢোকা শুরু করেছিল। যখন পর্তুগীজ়রা গোয়া ও আশেপাশের অঞ্চল দখল করে, তখন ক্যাথলিক চার্চ একটুও সময় নষ্ট না করে স্থানীয় মানুষ যারা নিজেদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ভালোই ছিল, তাদের ধর্মান্তরিত করার প্রতিষ্ঠান খুলে বসে। ক্যাথলিক চার্চের কাছে প্রাচ্য পৃষ্ঠপোষক সন্ত বলে স্বীকৃত ফ্রান্সিস জ়েভিয়ার পর্তুগীজ়দের হাতে ছয় হাজার মুসলিমের হত্যা দেখে বিশেষ সন্তোষ ব্যক্ত করেন। তিনি বলপূর্বক ধর্মান্তরণ, হিন্দু মন্দির ধ্বংস, হিন্দু দেবমূর্তি নষ্ট করা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা ইত্যাদি কীর্তির জন্য প্রসিদ্ধ, যা ইদানীং প্রগতিশীল চিন্তা ও রাজনীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে ব্রিটিশ সেনার জয়োদ্ধত কুচকাওয়াজ খ্রিস্টান মিশনারিদের বোঝাতে পেরেছিল যে ব্রিটিশদের জয় শুধু তাদের রণকুশলতার জন্য নয়, ব্রিটিশরা খ্রিস্টধর্মের যে শাখায় দীক্ষিত তার উৎকর্ষের কারণে। তারা অবিলম্বে হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতি বিষ ওগরানো শুরু করে দিল। খ্রিস্টীয় সত্যে কোনও মিথ্যা থাকতেই পারে না। খ্রিস্টীয় মূল্যবোধের স্বার্থে কোনও প্রতারণাই অপরাধ নয়।
একটা উদাহরণ দিলে খ্রিস্টান মিশনারিদের বিদ্বেষপূর্ণ ঘৃণ্য মনোভাব ফুটে উঠবে। তারা ভারত ও বিদেশে রটনা করেছিল, পুরীতে রথযাত্রার সময় বহু ভারতীয় নাকি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে রথের চাকার তলায় প্রাণ ত্যাগ করে মোক্ষ লাভের সন্ধানে। তাদের বর্ণনায় সেই মস্ত রথের সঙ্গে নাকি সর্বদা নর্তকীর দল রাস্তার দুধারে জনতার উদ্দেশ্যে উত্তেজক গান সহকারে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গীতে নাচতে নাচতে যেত। ব্রিটেনের ক্রুসেডারদের নেতা উইলিয়াম ইলবারফোর্স যিনি ভারতে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে খ্রিস্টানবাদ প্রতিষ্ঠা করতে রীতিমতো অনড় ছিলেন, তিনি সবার মঙ্গলের জন্য জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করে অবিলম্বে এই কদর্য নৃত্যচর্চা বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তৎকালীন পুরীর ব্রিটিশ কমিশনার জনৈক উদারমনস্ক ব্রিটিশ এমপি-কে এক লম্বা চিঠি লিখে পরিস্থিতি সামাল দেন। তাতে জানান তিনি ও তাঁর সঙ্গে বহু ব্রিটিশ নাগরিক পুরী জেলায় প্রায় কুড়ি বছর ধরে নিয়মিত ‘রথযাত্রা’ দেখছেন, কিন্তু রথের চাকায় প্রাণ দেওয়ার একটিও ঘটনা প্রত্যক্ষ করেননি, আর নর্তকী মেয়েদের নাচগানের মধ্যেও অশালীন ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু দেখতে পাননি। ‘Chambers Twentieth Century Dictionary’ অনুযায়ী ইংরেজী শব্দ “Juggernaut” যার অর্থ হল যে কোনও নিয়ন্ত্রণাতীত ধ্বংসাত্মক বল, আদি খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্ভাবনী কল্পনায় তা প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান ছিল।
হিন্দুদের সবকিছুর বিরুদ্ধে এই নেতিবাচক প্রচার উনিশ শতক পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। স্বামী বিবেকানন্দ এই স্থূল অপপ্রচারের বিরুদ্ধে শিকাগোর ধর্ম মহাসভায় (Parliament of Religions) প্রথম ক্ষোভ উগরে দেন, “…if we Hindus dig out all the dirt from the bottom of the Pacific Ocean and throw it in your faces, it will be but a speck compared to what your missionaries have done to our religion and culture”। অর্থাৎ যদি আমরা হিন্দুরা প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশ থেকে সমস্ত আবর্জনা তুলে এনে তোমাদের মুখে ছুঁড়ে মারি, তাহলেও তা আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি তোমাদের মিশনারিরদের করা সব কুকীর্তির তুলনায় নগণ্য হবে।”
যদি হিন্দুরা নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য এগিয়ে আসত, তাহলে মিশনারিদের বদমাশি আরও বহুগুণ বেড়ে যেত। ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ ও ‘আর্য সমাজ’ ছিল প্রথম হিন্দুদের আধ্যাত্মিক প্রতিরোধ। Theosophical Society এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা ম্যাডাম ব্লাভাটস্কি (Madame Blavatsky) খ্রিস্টানবাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দাবির মুখোশ খুলে দিয়েছেন। আর হিন্দু ঐতিহ্য তুলে ধরতে ভারতে এর প্রধান অ্যানি বেসান্তের অনুপ্রেরণা তো কোনও অংশে কম ছিল না।
পরবর্তী পর্যায়ে রামকৃষ্ণ মিশন এগিয়ে এল উদ্ধার কাজে। মহাত্মা গান্ধী খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব বা ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র যিশুই মানবতার পরিত্রাতা, এমন ধারণাকে মোটেই আমল দেননি। ধর্মোপদেশ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব মন্থন ছিল, যেখানে মিশনারিদের টোপের শিকার মানুষগুলোর প্রতি সহানুভূতি স্পষ্ট প্রতিফলিত। [3]
সম্ভবতঃ এই অসত্য কুচক্রী অপপ্রচারের কারণেই খ্রিস্টধর্ম নিজের জন্মভূমি ইওরোপে দুর্বল হয়ে বসে পড়েছিল। প্রতীচ্য খুব স্পষ্টভাবে বিজ্ঞানমনস্কতার দিকে বাঁক নেয়। ইতিমধ্যে হিন্দু আধ্যাত্মিকতার বার্তা পশ্চিমী দুনিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হয়। হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রচারক তথা পৃষ্ঠপোষকরা যেমন রামকৃষ্ণ পরমহংস, আনন্দ কুমারস্বামী ও মহাত্মা গান্ধী নিজেদের বচন ও কাজের মাধ্যমে পালন করে দেখিয়েছিলেন হিন্দুত্বের মধ্যে মানবতার কী প্রতিশ্রুতি নিহিত আছে। ফলে মিশনারিদের এরপর পদ্ধতি পাল্টাতে হল।
ভারতে খ্রিস্টধর্মের মূল চরিত্র অটুট রইল। তবে তারা এরপর বুঝতে পারল সামনাসামনি অসম্মান করে হিন্দু সমাজের দুর্গ অবরোধ করা যাবে না। তাই তারা নিজেদের নানান ধোঁয়াটে ধর্মতত্ত্বের আড়ালে নিয়ে গিয়ে কলকাঠি নাড়া শুরু করল। এই ধর্মান্তকরণের পদ্ধতিগুলি ছিল:
১। যথাসম্ভব বেশি দেশীয় মিশনারিদের প্রচুর অর্থব্যয় করে সুদূরপ্রসারী, সুসজ্জিত ও প্রাচুর্যপূর্ণ সমাবেশ আয়োজন করে তালিম দেওয়া, যাতে করে মিশনারিদের কাজকর্ম বিদেশীদের দ্বারা পরিচালিত মনে না হয়;
২। খ্রিস্টান পুরোহিতদের বহিরাঙ্গে হিন্দু সাজসজ্জা, গণ উপাসনা পদ্ধতি দ্বারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে হিন্দুদের বোঝানো খ্রিস্টধর্ম বহিরাগত কোনও কোনও মতবাদ নয়, এবং এর দ্বারা হিন্দু সংস্কৃতির ক্ষয় হবে না;
৩। নিজেদের শক্তিশালী গণমাধ্যম ও প্রকাশনাগুলোকে সরাসরি হিন্দুত্বে আক্রমণ করতে নিষেধ করে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় তুলনামূলক সমালোচনার মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজকে খাটো করা;
৪। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার করে উচ্চবিত্ত হিন্দু সন্তান ও যুব সম্প্রদায়কে খ্রিস্টানবাদের আকৃষ্ট করতে না পারলেও হিন্দুত্বের প্রতি বিমুখ করে তোলা;
৫। হাসপাতাল নির্মাণ ও নানাবিধ সমাজসেবা করে খ্রিস্টান মতবাদের প্রতি সার্বজনীন শ্রদ্ধা গড়ে তোলা এবং গোঁড়া মিশনারিদের আসল উদ্দেশ্য আড়ালে রাখা;
৬। প্রতিবন্ধীদের জন্য অনাথাশ্রম ও হোম খুলে নির্বিঘ্নে ও অলক্ষ্যে ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা চালানো;
৭। হিন্দু সমাজের মূল স্রোতের বাইরে উপজাতিদের বেছে নেওয়া যাতে অবাঞ্ছিত প্রচার না হয়;
৮। ধর্মান্তরকরণের জন্য প্রতিশ্রুতিবান প্রার্থীদের তুলে নিয়ে লম্বা বিদেশ যাত্রার মাধ্যমে খ্রিস্টানদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধায় তাদের অভিভূত করে দেওয়া;
৯। পশ্চিমী দেশের ধনী ব্যক্তিদের দরিদ্র ভারতীয় পরিবার থেকে ছোট ছেলে মেয়ে দত্তক নিতে, মিশনারি স্কুলে পাঠাতে ও মন্তেসারি প্রশিক্ষণ নিতে উৎসাহিত করা যতদিন না তারা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে;
১০। ভারত রাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলে পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলে ধরা ও আর্থিক মদত যোগানো।
নানাবিধ পদ্ধতি অবলম্বন করে ও উত্তেজক বক্তৃতা দিয়ে কৌশলে মিশনারিরা হিন্দুদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এর মধ্যে কয়েকটি পদ্ধতি তো বেশ স্থূল মোটা দাগের, বিশেষত আমেরিকান মিশনারিরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করে। যেমন প্রাত্যহিক সংবাদপত্রে মস্ত বিজ্ঞাপন দিয়ে, বেতারে সম্প্রচার করে এবং বাড়ি বাড়ি মুক্তি দূত বা বিক্রেতা পাঠিয়ে উচ্চস্বরে ও সোজাসাপটা প্রতিশ্রুতি দেওয়া – যেমন তোমরাও বাঁচাতে পারবে, অথবা মৃদু ভর্ৎসনা করা – তোমরা কি নিজেদের বাঁচাতে চাও না? অন্যান্য পদ্ধতিগুলি অবশ্য পরিশীলিত এবং ভারতীয় ধর্মতত্ত্বের ছদ্মবেশে। [4]
তবে এই সমস্ত পদ্ধতির পেছনে যেটি সবচেয়ে বেশি প্রকট তা হল, বিশাল আর্থিক অনুদান যা ইউরোপ ও আমেরিকার খ্রিস্টীয় গীর্জা এবং সম্প্রদায়ের তহবিল থেকে অবাধে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এই অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে একটি ধারণা সাম্প্রতিক একটি ঘটনা থেকে পাওয়া যেতে পারে যা দৈনিক সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। জনৈক কল্পনাপ্রবণ ও উদ্যোগী কিন্তু দরিদ্র দক্ষিণ ভারতীয় খ্রিস্টান মিশনারিকে পনেরো লক্ষ টাকা নগদ অর্থের বিনিময়ে হাত করা হয়, যাতে দক্ষিণ ভারতে সেন্ট টমাসের অ্যাডভেঞ্চার সম্পর্কে প্রচুর জাল লিখিত এবং জাল প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হস্তগত করা যায়। এই টাকার অঙ্কটা মিশনের মোট বাজেটের একটা বড় অংশ ছিল। আর ভারতে এই ধরণের কত শত যে মিশন রয়েছে।
১৯৮১ সালের ১৭ই আগস্টের স্টেটসম্যান পশ্চিম জার্মানির আচেন থেকে একটি আকর্ষণীয় সংবাদ প্রকাশ করে: “সংবাদ সংস্থা UNI-DPA জানায় যে নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী মাদার টেরেসা তার সমর্থকদের দাতব্য অনুদান স্থগিত করতে বলেছেন। International Association of Friends of Mother Teresa-র জার্মান শাখা ১৯৮০ সালে যে ৬ মিলিয়ান মার্কস দান করতে চলেছিল, এই আবেদনের ভিত্তিতে ঐ বছরের শেষেই তা বাতিল করে দেয়। ১৯৭৯ সালে দরিদ্রতমদের মধ্যে দরিদ্রতমদের সেবা বা সাহায্য করার জন্য ১৯৭৯ সালে মাদার টেরেসা পুরষ্কারটি জিতেছিলেন। ইতিমধ্যে যা কিছু অনুদান পেয়েছেন, সেটা খরচ করে ওঠার আগে পর্যন্ত অর্থসাহায্য লাভে সাময়িক বিরতি চেয়েছিলেন মাদার। “তারপর আবার আপনাদের সাহায্য চাইব”, মিশনারি অফ চ্যারিটির প্রতিষ্ঠাতা একটি বিজ্ঞপ্তিতে কথাটা জানান। সম্ভবত একটি দাতব্য সংস্থাকে অত্যধিক সহায়তা দিতে গিয়ে অন্যান্য ‘হাজার হাজার’ সংস্থার চাহিদা ভুলে যাওয়া হচ্ছিল মনে করেই এই অনুরোধ।”
ছয় মিলিয়ন পশ্চিম জার্মান মার্কস্ মানে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। অনুমান করাই যায়, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ফ্রেন্ডস অফ মাদার্স টেরেসা-কে তার অন্যান্য বিভাগের দেওয়া মোট অনুদান এর চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাই ইতিমধ্যে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ ব্যবহার করে ফেলার মতো অবস্থায় মাদার টেরেসা নেই। সুতরাং অনুদান সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ইশারা করার সাথে সাথে সে সব আবার চালু হবে। তাঁর সংস্থা ছিল হাজার হাজার দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেবলমাত্র একটি। ভারতে খ্রিস্টান ধর্ম বিস্তারের জন্য কী অমিত বিস্ময়কর পরিমাণ অর্থের যোগান আসে, তা কেউ কল্পনা করতে পারে।
এই পাশ্চাত্য থেকে আসা সম্পদের অবাধ প্রবাহ মিশনারিদের ভরণপোষণ এবং মিশনের লক্ষ্যপূরণে নানান সমাবেশ ও সভা করার উপযুক্ত প্রাসাদোপম অট্টালিকায় বসবাস সম্ভব করেছে। তাদের দারিদ্র্যের প্রতি অঙ্গীকার বা দায়বদ্ধতা কখনই আধুনিক স্যানিটেশনের সুবিধা, রান্নাঘর, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবহণ এসব ভোগ করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। তারা কেবল এই দেশের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বরাবর নয়, নানা ধরণের সম্মেলন, মণ্ডলী, সেমিনার এবং সিম্পোসিয়ায় অংশ নিতে পৃথিবীর সুদূরতম প্রান্তেও ভ্রমণ করতে পারে। তারা যেখানেই যাক, তাদের বিলামবহুল জীবনযাত্রার অভাব হয় না। মানুষ অবধারিতভাবে তাদের জীবনযাপন দেখে খ্রিস্টীয় ধারার মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত হবে।
ইদানিং কিছু মিশনারি বিশেষত ক্যাথলিক মিশনগুলি একটি নতুন ভাষায় কথা বলা শুরু করেছে – র্যাডিকালিজ়ম বা কট্টরপন্থা এবং বিপ্লবের ভাষা। এটি মোটেই বিরল নয়। যাদের মানুষের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই, সহানুভূতি নেই, তারা খুব সহজেই কথাগুলো আওড়াতে পারে। তারা উভয় বিশ্ব থেকেই নিজেদের জন্য সেরা সুবিধাটা বাগিয়ে নেয়। আমাদের কমিউনিস্ট নেতারা এই সংশ্লিষ্ট র্যাডিক্যালিজ়মের একটি দুর্দান্ত উদাহরণ।
পশ্চিমী বিশ্ব বিশ্বাসের প্রতি মোহ হারিয়ে ফেলেছে। পশ্চিমী দুনিয়ার এমন নারী পুরুষ ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছে, যারা ধর্মানুশাসন মেনে সতীত্ব, দারিদ্র্য ও আনুগত্য পালন করবে। তবে পশ্চিমীরা নিজেদের উদ্বৃত্ত অর্থ দান করতেও কুণ্ঠিত নয়। তাই খ্রিষ্টান ধর্মমত প্রাচ্যেই নিরাপদে ও সাফল্যের সঙ্গে সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে।
ভারত এক্ষেত্রে বিশেষ করে একটি সহজ শিকার (soft target)। খ্রিস্টান মিশনগুলো ইসলামিক ও কমিউনিস্ট দেশগুলোতেও বটুয়া খুলতে পারে; কিন্তু ধর্মান্তরিত করার সুবিধা সেখানে নেই। দারিদ্র্যে নিমজ্জিত ও সাংস্কৃতিকভাবে আত্মবিস্মৃত হিন্দু ভারতই একমাত্র এশিয় দেশ যেখানে সেই সুবিধা অগাধ ও অবাধ। [5]
পাদটীকা
- Ishwar Sharan, Myth of St. Thomas and the Mylapore Shiva Temple, Voice of India, New Delhi, 1991.
- See Sita Ram Goel, Papacy: Its Doctrine and History, Voice of India, New Delhi, 1986.
- See Sita Ram Goel, History of Hindu-Christian Encounters, Voice of India, New Delhi, 1989.
- See Sita Ram Goel, Catholic Ashrams: Adopting and Adapting Hindu Dharma, Voice of India, New Delhi, 1988.
- See Ram Swarup, Cultural Self-Alienation and Some Problems Hinduism Faces, Voice of India, New Delhi, 1987.
লেখক: সীতারাম গোয়েল
অনুবাদিকা: শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়