যারা হিন্দুদের মূর্তি ভাঙায় অভ্যস্ত, যারা মূর্তিপূজার বিরোধী, পুতুলপুজোকে অস্বীকার করেন, তারা কি ছট্পূজায় সায় দেবেন? যতদূর জানি এই পূজায় মূর্তি নেই কোনো, নির্বিকল্প প্রকৃতি উপাসনার একটি ঐতিহ্য মণ্ডিত অধ্যায়। সংস্কৃত ‘ষষ্ঠী’ কথাটি থেকে ‘ছট্’ কথাটি এসেছে। এর অর্থ হল ছয়। কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে এই উপাসনা৷ সূর্যের উপাসনা এবং সূর্যের সহধর্মিণী উষা বা ছটি মায়ের আরাধনা।
ভারতের কয়েকটি রাজ্য যেমন বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ এবং নেপালের মাধেশ অঞ্চলে ছট্পূজার আয়োজন খুব ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়। এই অঞ্চলের মানুষ নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ছট্পূজার আয়োজনও ছড়িয়ে গেলো ভারত ও বিশ্বের নানান জায়গায়। মূর্তি উপাসনা না হওয়ার কারণে কোনো কোনো মুসলমান জনগণকেও ছট্ উৎসব পালন করতে দেখা যায়। পরিবেশবিদেরা বলে থাকেন এই পুজো পরিবেশ-বান্ধব, প্লাস্টিকের ব্যবহার নেই, নেই ক্ষতিকারক রঙের ব্যবহার, জলে প্রতিমা বিসর্জনের ব্যাপারও নেই। তাই পরিবেশ প্রকৃতিকে দূষণের সম্ভাবনাও নেই।
সূর্য আমাদের সমস্ত শক্তির উৎস। প্রভাতে ও সায়াহ্নে সূর্য বন্দনার মধ্যে রয়েছে আলট্রাভায়োলেট রশ্মিমুক্ত সূর্যালোককে দেহমন্দিরের মধ্যে সমন্বয় করানোর প্রয়াস। ছট্পূজায় সকাল-সন্ধ্যেতে পুস্করিণীর ধারে ধর্মীয় কৃত্যের মধ্যে প্রতীয়মান হয় আলো ও জল সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সবুজ উদ্ভিদের মধ্যে আলো ও জলে, পরিবেশের বায়বীয় উপাদানের সামীপ্যে তৈরি হওয়া খাবারই জীবকূলের বেঁচে থাকার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। তাই সূর্যদেবকে সস্ত্রীক ধন্যবাদ জ্ঞাপনই এই পূজার মূল বিবেচ্য। আমরা প্রকৃতিকে নিয়েই বাঁচবো, সূর্যসম্ভব দেবতা আমাদের নিরন্তর আশীর্বাদ করুন, এই বিশ্বাসে, এই ভরসায়।
ছট্পূজার ডালিতে কি থাকে? থাকে কৃষিপণ্য, যা প্রকৃতির আশীর্বাদ, যা দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত নৈবেদ্য যেন। সধবা নারী বাঁশের কুলোয় সূর্যের পানে সাজিয়ে ধরেন এক টুকরো খোসাসমেত আখ, পরিছন্ন করে রাখা মূলাগাছ, গোটা নারকেল, বাতাবি লেবুর গোটা ফল, পাকা কলার একটি ছড়া এবং আলাদাভাবে পুষ্টকলার কাঁদি, থেকুয়া মিষ্টি, কিছু ফুল ইত্যাদি। কমলা রঙে রঙিন সিঁদূরের পবিত্র চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয় ডালার মধ্যস্থ ফলের গায়ে। যেন তোমারই প্রদত্ত ফসলের আশীর্বাদ তোমাকেই উৎসর্গ করলাম শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, কৃতজ্ঞতায়। যেন গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা সম্পন্ন হল। ছট্পূজা প্রকৃত অর্থেই একটি কৃষি-কেন্দ্রিক প্রকৃতি পুজো।
অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এবং কল্যাণ চক্রবর্তী।