প্রথম পর্ব
গঙ্গাবীচিপ্লুত পরিসরঃ সৌধমালাবতংসো
বাস্যতুচ্চৈ স্তুয়ি রসময়ো বিস্ময়ং সুহ্ম দেশঃ।
অর্থাৎ, ‘যে-দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গঙ্গাপ্রবাহের দ্বারা প্লাবিত হয়, যে দেশ সৌধশ্রেণীর দ্বারা অলংকৃত, সেই রহস্যময় সুহ্মদেশ তোমার মনে বিশেষ বিস্ময় এনে দেবে।’
খ্রিস্টীয় ৮ ম ও ৯ ম শতাব্দীতে সমগ্র রাঢ়দেশ শূর বংশীয় নৃপতিদের অধিকার ভুক্তছিল। তৎপরে পালরাজ গণের প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে তাঁদের অধিকার ভুক্ত স্থান উত্তররাঢ় এবং শূর ও দাস বংশ অধিকারভুক্ত স্থান দক্ষিণ রাঢ় নামে পরিচিতি হয়। বর্তমান বর্দ্ধমানের উত্তরাংশ ও মুর্শিদাবাদে আজও উত্তর রাঢ়ীয়দিগের আদি সমাজ স্থান এবং বর্দ্ধমান জেলার দক্ষিণাংশে , হুগলী ও ২৪ পরগনা মধ্যে দক্ষিণরাঢ়ীয়দিগের সমাজ স্থান নির্দিষ্ট হয়ে থাকে । বর্দ্ধমানস্থ শূরনগর , প্রদু্্যম্নপুর , গড়মন্দারণ নামক স্থানে বিভিন্ন শূররাজের এবং হুগলীর ভুরসুট নামক স্থানে দাস বংশের এবং তৎপরে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণরাজ বংশের রাজধানীর চিন্হ বিদ্যমান।
রাঢ় ভূমি , যুগ যুগ ধরে তন্ত্র সাধনা এখানে প্রচলিত । পূর্বেই বলেছি যে রাঢ় বঙ্গ গৌড় হতে পৃথক ছিল না। তাছাড়া স্কন্দপুরাণে পঞ্চ গৌড়ের উল্লেখ আছে ।
সারস্বতা কান্যকুব্জা উৎকল মৈথিলাশ্চ যে
গৌড়াশ্চ পঞ্চব্য চৈব – পঞ্চগৌড়া প্রকীর্তিতা।।
সারস্বত কনৌজ উৎকল মিথিলা ও গৌড়ের অধিবাসী ব্রাহ্মণদের পঞ্চগৌড়া বলে অভিহিত হন। কুর্ম্ম এবং লিঙ্গ পুরাণেও গৌড়ের উল্লেখ আছে।
নির্মিতা যেন শ্রাবস্তী গৌড়দেশে দ্বিজোত্তমা।
স্কন্দপুরাণের সহ্যাদি খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে যে, কুরুক্ষেত্র এবং গৌড় সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থান করছে। নানা শিলালিপি ও তাম্রশাসনে সেই গৌড়ের উল্লেখ আছে। গৌড় চেদি, মালব, বেরার সীমান্ত অবধি বিস্তার লাভ করেছিল।
পাণিনি বলেছেন – অরিষ্ক গৌড় পূর্বে চ ….
শক্তি সংগম তন্ত্রে বলা হয়েছে। –
বঙ্গদেশং সমারভ্য ভুবনেশান্তগং শিবে।
এহেন সুপ্রাচীন রাঢ় তথা গৌড় বঙ্গের সুপ্রাচীন সনাতন ধর্ম তার সকল মান ও ঐতিহ্য নিয়ে অবস্থান করত। সেখানে নিরাকার রূপে প্রকৃতির উপাসনা হতে সিদ্ধ তন্ত্রপীঠ সকলের অবস্থান ছিল একাধারে। সেখানে অবস্থান ছিল ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিদের তপোবনের। সেই রাঢ় তথা গৌড়ে জন্ম হয়েছিল সুপ্রাচীন তন্ত্র সাধনার।
গৌড়ে প্রকাশিতা বিদ্যা , মৈথিলৈঃ প্রবলীকৃতা।
ক্কচিৎ , ক্কচিন্মরাষ্ট্রে গুর্জরে প্রলয়ং গতা।।
পূর্বকালে এতদঞ্চলে যেমন বৈষ্ণব এবং বৈষ্ণবমার্গীয়দের প্রভাবাধিক্য ছিল তেমনই শক্তিসাধক সম্প্রদায়ের প্রভাবও বড় কম ছিল না । তাঁরাও কালীকীর্তনে ধর্মজগৎ কম্পিত করে সিংহের ন্যায় ধরা বিচরণ করত। শাক্ত মহাত্মাগনের নাম এবং সাধন স্থানে বহু নিদর্শন সিদ্ধপীঠ , উপপীঠ নাম ধারণ করে আজও বিরাজ করছে ।
পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের বজ্রযান শাখাও তন্ত্রভাবাপন হয়ে পড়ে । ওই সমস্ত বৌদ্ধ তান্ত্রিকগন রাঢ়ের জঙ্গলাকীর্ণ পশ্চিমাঞ্চলে, মলুটি, তারাপীঠ, ভাবুক ইত্যাদি স্থানে তাদের তন্ত্র সাধনা চালিয়ে যান ।
অতীতে রাঢ় অঞ্চলের পশ্চিম প্রান্ত অরণ্যময় । সেই অঞ্চলটি নানা সাধক, তান্ত্রিক এবং পরবর্তী কালে বৌদ্ধদের প্রভাবাধীন ছিল । জঙ্গলের মধ্যে তান্ত্রিকগন ছোট ছোট মন্দির তৈরি করে তার ভিতর তাদের উপাস্য দেবীকে স্থাপন করে গোপনে সাধন ভজন করত। বহু গ্রামেই এই সকল দেব দেবীর প্রস্তর প্রতিমা দেখতে পাওয়া যায় ।
ঐতিহাসিক বিনয়তোষ ভট্টাচার্য্য বলেছেন ” বজ্রযানী বৌদ্ধদের প্রভাব বাংলা বিহার উড়িষ্যায় যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। এই সব জায়গায় বৌদ্ধদের দেবদেবীর মূর্তি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। “
ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্টদেব সাধন ক্রিয়ার জন্য কামরূপে পাড়ি দেন কিন্তু কামরূপের সাধনার মার্গফল করা সম্ভব নয় দেখে তিনি অঙ্গদেশ ত্যাগ করেন। এরপর তিনি সাধন পদ্ধতির জন্য রাঢ় বাংলায় পাড়ি দেন। রাঢ়দেশে অন্তর্গত বক্রেশ্বরের ঈশান কোন অবস্থিত দ্বারকা নদীর পূর্ব তীরে শ্মশানে প্রতিষ্ঠিত এক পঞ্চমুন্ডির আসনে তিনি গভীর তপস্যায় বসেন এবং সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি দেবী উগ্রতাঁরার মাতৃরূপ দর্শন করেন। পরে একই আসনে সিদ্ধিলাভ করেন সাধক বামাক্ষ্যাপা । সেই সিদ্ধস্থানই তারাপীঠ এবং কিরীটেশ্বরী নামে সুপরিচিত।
এছাড়াও পূর্ব পর্বেই উল্লেখ করেছি যে, আদিদেব পশুপতি শিবের উপাসনা হত এই প্রাচীন বঙ্গে। বৌদ্ধ জাতকের গল্পে বর্ধমান এবং মেদিনীপুর অঞ্চলে শিবি এবং চেত নামক দুই রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। এই দুই রাষ্ট্রেই শিবপূজার প্রচলনের কথা জানা যায়। এই সব পূজাই হতো প্রাচীন বৃক্ষতলে। রামায়ণ , মহাভারত , পুরানাদিতে , তন্ত্রে নানাভাবে বঙ্গ সহ তার নানা স্থানের উল্লেখ আছে। রাঢ় অঞ্চলের নানা স্থানে ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিদের আশ্রম ছিল এরূপ প্রবাদ আছে। জলন্দার গড়ের কিছু দূরে আঙ্গোরা নামক স্থানের ঋষি অঙ্গীরার আশ্রম ছিল। মুলুকের নিকটবর্তী শিয়ান গ্রামে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রম ছিল । মুলুকের অনতি উত্তরে ঋষ্যশৃঙ্গের পিতা বিভান্ডকের আশ্রম ছিল বলে কিংবদন্তি আছে আর বক্রেশ্বরে ছিল ঋষি অষ্টবক্রার আশ্রম।
রাঢ় দেশ একসময় শৈব এবং শাক্ত গণের লীলাস্থান বলে গণ্য ছিল। তার কারণ ৫১ পীঠের মধ্যে এই রাঢ় বঙ্গেই ৯ টি ডাকর্ণব পীঠ অবস্থিত। কুঞ্জিকাতন্ত্রের ৭ ম পটলে কর্ণসুবর্ণ বা কর্ণস্বর্ণ ,ক্ষীরগ্রাম , বৈদ্যনাথ , বিল্বক , কিরীট , অশ্বপ্রদ বা অশ্বতীর্থ , মঙ্গলকোট ও অট্টহাস এই আটটি সুপ্রাচীন সিদ্ধপীঠের উল্লেখ আছে।
তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে বহুলা, উজাণী, ক্ষীরখণ্ড , কিরীট, নলহাটী , বক্রেশ্বর , অট্টহাস, মন্দিপুর এই ৯ টিকে মহাপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শিব চরিত সংগ্রহ গ্রন্থে অট্টহাস, নলহাটী ও মন্দিপুর উপপীঠ বলে গণ্য হয় এবং সুগন্ধা , রণখণ্ড ও বক্রনাথ মহাপীঠ বলে গণ্য হয়। যা হোক এসব ক্ষেত্রে কুঞ্জিকাতন্ত্রকেই প্রামাণ্য হিসাবে ধরা হয়।
অজয়- কুনুর তীরবর্তী উজানি মঙ্গলকোটের #চন্ডীসংস্কৃতিওতন্ত্রমার্গের প্রবাহ সমগ্র রাঢ় বঙ্গকে প্রভাবিত করেছিল । কেতু রাজবংশের রাজধানী #বহুলানগর তথা আজকের কেতুগ্রামের সতীর যুগ্ম পীঠ যথা – বহুলাক্ষী ও ফুল্লরা শাক্তধর্মের এক বিরল তীর্থস্থান ।কাটোয়ার শাঁখাই ঘাট থেকে দাঁইহাট ভাউসিং পর্যন্ত ভাগীরথীর পশ্চিম তীর বরাবর প্রসারিত ইন্দ্র, ইন্দ্রেশ্বর ও ইন্দ্রানীকে নিয়ে একদা গড়ে উঠেছিল এক সর্বভারতীয় তীর্থনগরী #ইন্দ্রানী…এর প্রাণকেন্দ্র ছিল বর্তমান বিকিহাট, বেড়া ও দাঁইহাট।
আরো কত শত শাক্তস্থান আছে, তা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে তার উল্লেখ সম্ভব নয় । এইরূপ যে সকল শৈব কীর্তি আছে তন্মধ্যে বৈদ্যনাথ এবং বক্রেশ্বর সর্ব প্রাচীন ও প্রধান।
তাছাড়াও এস্থলে বিষ্ণু উপাসকের আধিক্যও স্বল্প ছিল না। রাময়েত , নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। এখানেই মহাপ্রভুর সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে মহাকবি জয়দেবের কথা , কদমখন্ডি র ঘাটের কথা , কেন্দুবিল্ব গাঁয়ের কথা….. কত শত কিংবদন্তি!
পৌষের সংক্রান্তি কাল তীব্র শীত রাত!
অসুস্থ শরীর নিয়ে পড়ে আছে ঘরের কোনায়-
সাধক কবির চোখে নেমে আসে
আকুতির জল..
এবার তার মন্দভাগ্যে গঙ্গা স্নান নেই।
ভক্ত প্রাণ কেঁদে ওঠে , অন্ধকার শুক্লপক্ষ চাঁদ…
পরদিন ভোরবেলা অবাক বিস্ময়ে দেখে
কেন্দুবিল্ব গ্রামের মানুষ
অজয়ের কানায় কানায়
সাদা জলে মিশে আছে ভাগীরথীর গেরওয়ার রং!
এই শক্তি ও শৈব এবং প্রকৃতির উপাসনার বহু বহু পরে এখানে জৈন মতের প্রবেশ। মহাবীর স্বামীর অবস্থানের হেতু এই স্থান জৈন মার্গীয় সম্প্রদায়ের নিকট রাঢ় দেশ তথা বর্দ্ধমান পুণ্যভূমি রূপে বিবেচিত হয়।
চৈতন্য মতাবলম্বী গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ই যে কেবল কাটোয়া ও তৎপরবর্তী স্থানসমূহের প্রতিভা গৌরবান্বিত করেছিল তা নহে। তার সঙ্গে একধারে ইন্দ্র, শৈব এবং শাক্তগনের কথাও বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। বর্তমান যুগে অনেক ব্যক্তি ধর্মমার্গ পরিভ্রষ্ট ও নাস্তিকভাবগ্রস্থ দেখা যায়। কিন্তু তৎকালীন সময়ে ধারণা আদৌ ছিল না। ধর্মের যথার্থতা উপলব্ধি করে সেই নিগুঢ় রসাস্বাদনে সকলেই মাতোয়ারা হয়ে থাকতেন। পরিবর্তনশীল কালের অখন্ডনীয় প্রভাবে যেন সে ভাব বিলীন হয়ে গিয়েছে।হায়! সেই পাপ হরণকারী শান্তি যেন ভ্রান্তি বিজড়িত মানবকূলকে পরিত্যাগ করেছেন।
যাহোক , পূর্বকালে এতদঞ্চলে যেমন বৈষ্ণব এবং বৈষ্ণবমার্গীয়দের প্রভাবাধিক্য ছিল তেমনই শক্তিসাধক সম্প্রদায়ের প্রভাবও বড় কম ছিল না । তাঁরাও কালীকীর্তনে ধর্মজগৎ কম্পিত করে সিংহের ন্যায় ধরা বিচরণ করত। শাক্ত মহাত্মাগনের নাম এবং সাধন স্থানে বহু নিদর্শন সিদ্ধপীঠ , উপপীঠ নাম ধারণ করে আজও বিরাজ করছে । তারমধ্যে কাটোয়া থেকে ক্রোশকমাত্র দূরে বেড়া গ্রামের স্বনাম প্রসিদ্ধ মহাত্মা রামানন্দের কথা কাটোয়ার ইতিহাসের অঙ্গীভূত হবার উপযুক্ত ।
আর আছেন রাঢ়দেশে, ধর্ম স্বরূপ নারায়ণের কুর্ম্ম রূপ ধর্মঠাকুর।
একে শনিবার তায় ঠিক দুপুরবেলা।সম্মুখে দন্ডাইল ধর্ম্ম গলে চন্দ্রমালা।।গলায় চাঁপার মালা আসাবাড়ি হাথে।ব্রাহ্মণ রূপে ধর্ম্ম দন্ডাইল পথে।।
রাঢ় অঞ্চলের অন্ত্যজ দরিদ্র শ্রেণীর সাধারণ মানুষের ঠাকুর হলেন নারায়নের লৌকিক রূপ স্বরূপনারায়ণ অর্থাৎ ধর্ম্মঠাকুর। তিনি রাঢ় বঙ্গের সাধারণ মানুষের ত্রাণ কর্তা। তাঁর নিকট লাউসেনও যা কালু ডোমও তাই। ধর্মমঙ্গল তাই হয়ত রাঢ় বঙ্গের মহাকাব্য।ধর্মমঙ্গল থেকে জানা যায় তৎকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় পরিস্থিতির কথা। এসব কারণেই রাঢ় বঙ্গের গাঁয়ে গাঁয়ে ধর্ম ঠাকুর নানা নামে স্বয়ং অবস্থান করেন।
উর ধর্ম্ম আমার আসরে।।কাতর কিঙ্কর ডরে আসরে স্মরণ করে।তেজ ধর্ম্ম বৈকুণ্ঠ নগর ।।বিড়ম্বনা দন্ড কত দেখ নাট শুন গীত।আপনি আসরে কর ভর।।
ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের ধর্মঠাকুর নিজেই কৃষি দেবতা। বৃষ্টির দেবতাও। তাঁর কৃপায় কৃষক ভাল ফসল পায়। সপ্তদশতকের কবি রূপরাম চক্রবর্তী তার ‘ধর্মমঙ্গলে’ ধান, কাপাস, কলাই ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন। ধর্মমঙ্গল রাঢ়ের মহাকাব্য বলে বিবেচিত হয়। যদিও বিষয়টি বিতর্কিত।
এতশুনি কালুবীর নিদারুণ কয়।
উচিত বলিতে গালি দিবে অতিশয়।।
অদ্যকথা কহিলে পাইবে পারিতাপ।
গরুর রাখাল ব্যাটা ছিল তোর বাপ।।
কাননে রাখিত গরু মুখে নাই রা।
ঘরে ঘরে রাখালি সাধিত তোর মা।।
কেহ দিত চালু খুদ পুরান কলাই।
অন্ন বিনে অকালে মরিল তোর ভাই।।
মানিকরাম গাঙ্গুলি ধর্মমঙ্গলে বিপর্যস্ত কৃষি জীবনের স্পষ্ট চিত্র এঁকেছেন। তিনি বলেছেন যে,
, মাহুদ্যা রাজা হয়ে জবুল জমির জমা বেশি করে ধরে।
যে না দেয় তার সদ্য গুণাগার করে॥
ক্ষেতে হাল খন্দ সে বেচে লয় সব।
বিব্রত হইল প্রজার পেয়ে আধি ভব॥
দেশ ছেড়ে দেশান্তরে পালাইয়া গেল।
শহর নগর গ্রাম শূন্যময় হল॥
রাঢ় বঙ্গ সহ তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বহু বহু স্থানে তাই আজও তিনি কুলদেবতা রূপে পূজিত হন।
এহেন তন্ত্রের রাঢ় অঞ্চলের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আদ্যাশক্তি মহামায়া মা চণ্ডী রূপে পূজিতা হন। তিনি ব্রহ্মময়ী । নানা রূপে , নানা ভাবে তিনি বিশ্ব জুড়ে অবস্থান করেন ।
ওঁ জয় ত্বং দেবি চামুণ্ডে জয় ভূতাপহারিণি।
জয় সর্বগতে দেবি কালরাত্রি নমোঽস্তু তে।।
হে দেবী চামূণ্ডা, তোমার জয় হোক। হে দেবী, তুমি জীবের দুঃখনাশকারিণী; তুমি সর্বভূতে অবস্থিতা; আবার তুমিই প্রলয়ের অন্ধকার স্বরূপিণী কালরাত্রি। তোমায় নমস্কার করি।
জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোঽস্তু তে।।
হে দেবী, তুমি সর্বোৎকৃষ্টা জয়যুক্তা দেবী জয়ন্তী; তুমি জন্মমৃত্যুবিনাশিনী মোক্ষপ্রদায়িনী দেবী মঙ্গলা; তুমি সর্বসংহারকারিণী কালী; তুমি সুখদায়িনী ভদ্রকালী; আবার তুমিই প্রলয়কালে ব্রহ্মা প্রমুখের মাথার খুলি হস্তে নৃত্যরতা কপালিনী। তুমি দুর্গা, কারণ বহু কষ্ট স্বীকার করে তবে তোমায় লাভ করা যায়; তুমি চৈতন্যময়ী শিবা; তুমি করুণাময়ী ক্ষমা; তুমি বিশ্বধারিণী ধাত্রী; তুমি দেবগণের পোষণকর্ত্রী স্বাহা ও পিতৃগণের পোষণকর্ত্রী স্বধা। তোমায় নমস্কার করি।
বিষ্ণুঃ শরীরগ্রহণম অহম ঈশান এব।কারিতাস্তে যতোহ্তস্ত্বাং কঃ স্তোতুং শক্তিমান ভবেৎ।।
সা ত্বমিত্থং প্রভাবৈঃ স্বৈরুদারৈর্দেবী সংস্তুতা।মোহঐতৌ দুরাধর্ষাবসুরৌ মধুকৈটভৌ।।
প্রবোধং চ জগৎস্বামী নিয়তাং অচ্যুতো লঘু।বোধশ্চ ক্রিয়তামস্য হন্তুং এতৌ মহাসুরৌ।।
বিষ্ণুর শরীর গ্রহণ করেতুমি-ই সব করো, তোমার স্তুতি করে কতজন শক্তিমান হয় ।।
তোমার প্রভাবে দেবী ,থামাও তুমি এই প্রায় অপরাজেয় অসুরদের।মোহাচ্ছন্ন করে দাও দুই দুর্ধর্ষ অসুর মধু আর কৈটভকে ।।
জগৎস্বামী (বিষ্ণুকে) তুমি তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গিয়ে জাগিয়ে তোল ।আনো তাঁকে সেই বোধে যাতে তিনি ধ্বংস করেন এই দুই মহা অসুরকে ।।
দেবী দুর্গা শাক্ত মার্গের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব মার্গে তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং শৈব মার্গে দুর্গাকে শিবের শক্তি পার্বতী হিসাবে অর্চনা করা হয়। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনিই কেনোপনিষদে বর্ণিত হৈমাবত দুর্গা হিসাবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে; ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গা আখ্যা দেওয়া হয়েছে যিনি হরি সহায়িনী তথা হরিভক্তিপ্রদায়িনী। এইসমূহ ছাড়াও দুর্গাদেবীর বর্ণনা মহাভারতের বিরাট পর্ব ও অন্যান্য পুরাণে পাওয়া যায়।
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা।
বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদ্যৌ গোলকে রাগমণ্ডলে।
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মণা সা দ্বিতীয়তঃ।
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা।
।ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেন শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী।।
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈর্দেবৈশ্চ মুনিমানবৈঃ।
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভূব সর্ব্বতঃ সদা।।
কোথাও তিনি প্রস্তর খোদিত মূর্তি, ধাতুনির্মিত কাষ্ঠ নির্মিত বা কেবলমাত্র বৃক্ষে , শিলায় উপাসিতা হন। তাঁর পূজাকে ঘিরে নানান অনুষঙ্গের অভাব নেই। তিনি অলৌকিক থেকে লৌকিকে এসেছেন , মানুষের বিশ্বাসে মিশে জেগে আছে তাঁর অপার মাতৃমহিমা। এই পর্যায়ে এক ব্যতিক্রমী দেবী আদ্যাশক্তির রূপ চণ্ডীদেবীর প্রসঙ্গ নিয়ে এই আলোচনার অবতারণা। লৌকিক রূপে জনপ্রিয় দেবীচণ্ডী বাঁকুড়ার এক অঞ্চলে ঝগড়াই বা ঝকড়াই চন্ডী নামে উপাসিতা হন। দেবীর অভিজাত নাম #ঝগড়ভঞ্জনী। নানা কিংবদন্তি, জনশ্রুতির রহস্যে , বিশ্বাসের মায়ায় ও লোকসংস্কৃতির স্বতন্ত্র ক্রিয়ার এই দেবী রাঢ় অঞ্চলের লোকদেবীর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।
দেবী ঝগড়াই বা ঝগড়ভঞ্জনী চণ্ডী বিরাজ করেন বাঁকুড়া জেলার জয়পুর সলদা, প্রত্ন ভূখণ্ডের বৈতল উত্তর বাড় মৌজায়। অধুনা বাঁকুড়া , হুগলী ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সীমান্তে অবস্থিত এই জনপদ। প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় প্রত্ন ইতিহাসে এই অঞ্চলটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ময়নাপুর , কুচিয়াকোল , দিকপাড় , সলদা এবং বৈতল এই গ্রামগুলি সেই প্রাচীন কাল হতেই বর্ধিষ্ণু। অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দুই ক্ষেত্রেই উক্ত গ্রামগুলি আপন আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
একদা বৃক্ষতলে পূজিতা হতেন মা ঝগড়াইচণ্ডী। এখন একটি সুন্দর ছোট্ট মন্দিরে তাঁর অবস্থান। মাকড়া পাথরের উপর দেবী মূর্তি খোদিত হয়েছে। উত্তর দুয়ারী মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবী অপরূপ মূর্তি হয়ে বিরাজ করছেন।
মন্দিরের প্রস্তরলিপি অস্পষ্ট। গবেষকগণ অন্য একটি লিপির কথাও বলেছেন। সেসব কালের নিয়মে ক্ষয়ে যাওয়া, অস্পষ্ট লিপিগুলি বৈতল ও দেবী মন্দিরের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আজও। প্রস্তরলিপি গুলি বলে , দেবীর মন্দির নির্মিত হয় বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ প্রথম রঘুনাথসিংহের আমলে। তবে গবেষক মতান্তরে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের সময়কালে। এ প্রসঙ্গে , শ্রদ্ধেয় অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা থেকে জানতে পারি যে , মন্দিরটি ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ৯৬৫ মল্লাব্দে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। তবে , বহুকাল ধরেই দেবীর জনপ্রিয়তা যে অনেকখানি ছিল তা আমরা মধ্যযুগের কাব্য থেকেও পেয়ে থাকি। সেই কাব্য হল মানিকরামের লেখা #ধর্মমঙ্গল।
পূর্বেই বলেছি স্বরূপনারায়ণ ধর্মঠাকুর রাঢ় অঞ্চলের অন্যতম উপাস্য । তাঁর নামেই রচিত ধর্মমঙ্গল রাঢ় অঞ্চলের জাতীয় মহাকাব্য হিসাবে বিবেচিত হয়। কবি মানিকরাম তাঁর ধর্মমঙ্গল কাব্যের #দিগ্বনদনা অংশে রাঢ় অঞ্চলের নানা স্থানের জনপ্রিয় এবং জাগ্রত দেবীদেবতার বন্দনা করেছেন। তিনি তাঁর কাব্যে স্বরূপনারায়ণ ধর্ম ঠাকুর এবং লৌকিক নানা দেবদেবীর মহিমার নিকট প্রণত হয়েছেন। এখানেই তিনি #ঝগড়াইচন্ডীরঅনুষঙ্গআবৃত্তি করেছেন –
কুলুয়ের জয়দুর্গা বৈতলের ঝকড়াই।
ক্ষেপুতে খেপাই বন্দি আমতার মেলাই।।
মানিকরামের ধর্মমঙ্গল অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত হয়। অর্থাৎ , সেই সময়ও জাগ্রত দেবী ছিলেন ঝগড়াইচন্ডী। ঝগড়াই না ঝকড়াই সে নিয়ে একটি ভাষাটীকার উল্লেখ করা যায় বিজিত দত্ত সম্পাদিত মানিকরামের ধর্মমঙ্গল কাব্যের আলোচনা থেকে । ঝকড়াই না ঝগড়াই – ক >গ আসলে দুটোই একই। আলোচনায় আছে ক > গ দিগে দিগে >দিকে দিকে। উগি >উঁকি একইভাবে বলা যায় ঝগড়াই > ঝকড়াই। যদিও দেবীর অভিজাত নাম ঝগড়ভঞ্জনী , তবুও বিস্তৃত রাঢ় অঞ্চলের মানুষ তাঁকে মা ঝগড়াই চণ্ডী নামেই উপাসনা করেন।
আলোচ্য প্রবন্ধের প্রথমেই বলেছি, যে দেবী প্রস্তর খোদিতা। নানা ফুল, বস্ত্র, অলঙ্কারে অপরূপ দেবী ঝগড়াইচন্ডী সুসজ্জিতা। স্নানের পর দেবীর সজ্জার সময় তাঁরের প্রকৃত মূর্তি দেখা যায় , সেখানে দেবীকে অষ্টভূজা রূপে দেখা যায়। যদিও জনশ্রুতি আছে , তিনি দশভূজা। বাম দিকের একটি হস্তে তিনি ধনুর্বান ধারণ করে থাকেন । অপর হস্তগুলি শঙ্খ ইত্যাদি নানা আয়ুধে সজ্জিত। তবে মূর্তির মস্তক ও দেহের সামঞ্জস্য অস্পষ্ট। বহু প্রাচীন মূর্তি হবার কারণে হয়ত পরবর্তী সময়ে পাথরটি পুনরায় খোদিত হয়ে থাকতে পারে। মূর্তির উচ্চতা চারফুট বাই আড়াই ফুট। মূর্তিটি এক অপরূপ মাতৃমূর্তির আবেদনে পরিপূর্ণ। কবে কিভাবে এবং কেন এমন মাতৃরূপা দেবী বট বৃক্ষের তলে এসেছিলেন তার ইতিহাস রহস্যাবৃত।
জনশ্রুতি বা কিংবদন্তি থেকে এই দেবী এবং মন্দির সংক্রান্ত কিছু ইতিহাস জানতে পারা যায়। তখন বিজয়া দশমীর দিন সকল রাজ বংশের যুদ্ধে যাবার নিয়ম ছিল। শূর , বীর বা মল্ল রাজবংশেরও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হতো না। এপ্রসঙ্গে আমি একটু #অপরাজিতা_পূজার কথা বলব –
আগেকার দিনে দুর্গা , কালী পূজা করে ,বলি দিয়ে, রক্ত তিলক নিয়ে রাজারা যেতেন রাজ্য দখলে। তবে এখন আর সে রাজাও নেই , সে রাজপাট , রাজ্যও নেই, যুদ্ধনীতি চলে গেছে, কিন্তু নিয়ম রয়ে গেছে। বীরভূমের গ্রাম ঘরে বিজয়া দশমীর দিন একটি অনুষ্ঠান হয় তার নাম যাত্রাসাৎ ।বাড়ির সকলে মিলে দশমীর অনুষ্ঠান করে তারপর শুরু হয় গুরুজনদের প্রণাম করা। এই অনুষ্ঠানে ঘরের বিভিন্ন যন্ত্র এবং অস্ত্র পূজা করা হয় । তাদেরকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয় চন্দনের ফোঁটা দেওয়া হয় । এটি অতি প্রাচীন প্রাচীন প্রথার অনুরণন ।
দূর্গা পূজা শেষে গ্রামের অন্যদেবীর কাছে পূজা দেওয়ার প্রথা অন্যান্য বহু গ্রামে প্রচলিত আছে । যেমন – কোমা দেখতে পাওয়া যায় বিসর্জনের পর শুধুমাত্র পুরুষেরা অপরাজিতার ডাল হাতে বেঁধে সেই গ্রামের গ্রামদেবী মনসা তলায় ষোড়শপচারে পূজা দিতে যান । আবার রাজনগরের দে পরিবারের বিসর্জনের পর গৃহে ঢোকার আগে অনেক কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। জলন্দিতে দশমী পূজার পর গ্রামে জলেশ্বরীতলায় পূজা এবং কুমড়ো বলি দেয়া হয়। এমনটি লক্ষ্য করা যায় অন্যান্য বহু গ্রামেও….
পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর বাঙালীর দুর্গোৎসব প্রবন্ধে বলেছেন – ” চন্ডীর উপাসক গন একটা দীর্ঘ সময় ঘট স্থাপন করিয়া চন্ডীর পূজা করিতেন। ” তিনি আরো বলেছেন ,” ভগবানকে ভাবময়রূপে পূজা করিতে হইলে, সেই ভাবের ভিতর দিয়া তাঁহার সর্ববৈর্শর্যের স্ফুরণ হইয়া থাকে। এইটুকু জপে বুঝা যায়।জপের ফলে প্রথমে বিভীষিকা, পরে প্রলোভন, শেষে সমীপ্য ঘটিবেই ঘটিবে।….ভয় ও ত্রাসের উপর বিভীষিকার প্রভাব ,কাম ও লোভের উপর প্রলোভনের বিস্তার। এসকল কাটিয়া উঠিতে পরিলেই ঐশ্বর্য অনুভূতি ঘটে। “….এই ঐশ্বর্য দর্শন হইতেই দেবী চিন্ময়ী থেকে মৃন্ময়ী রূপে পূজিতা হন।
শিব হলেন গিরিষা (পর্বতের দেবতা) এবং দুর্গা হলেন গিরিজা ; শৈলপুত্রী , উমা , হৈমবতী এবং পরবর্তীতে পার্বতী । শিব হলেন উমাপতি শক্তিরুপিনী দুর্গা হলেন মহেশ্বরী , ঈশাণী মহাদেবী ,মহাকালী এবং শিবানী । বিভিন্ন নামের মধ্যে দিয়ে বর্ণিত হয়েছে তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক যেমন কালি (ধংসাত্মক) , করালি (ভয়ানক) , ভীমা (ভয়াবহ) , চণ্ডী /চণ্ডিকা /চামুণ্ডা (ক্রোধান্বিতা ) , দুর্গার অসুরনিধন এর মধ্যে রয়েছে মহিষাসুর , রক্তবীজ , শম্ভু এবং নিশুম্ভ, চণ্ডা এবং মুন্ডা ।
মহাভারতে যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন-কে দুর্গা-স্তোত্র দুটি ভিন্ন পর্বে পাঠ করতে দেখা যায় (ভিরাট পর্ব এবং ভীষ্ম পর্ব) । হরিবংশে বিষ্ণুপর্বে দুর্গার উদ্দ্যেশে যে আর্য স্তব রয়েছে সেখানে দেবীকে-আর্য , নারায়ানি , ত্রিভুবনেশ্বরী , শ্রী , রাত্রি , কাত্যায়নী , কৌশিকি , অপর্না , নাগ-শর্বরী নামে সম্বোধন করা হয়েছে । উল্লেখ্য দেবীর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে পর্বত (বিশেষত বিন্ধ্য) , নদী , গুহা , অরণ্য , বনানী , এবং পশু (বণ্য ও গৃহপালিত) প্রভৃতির নাম ; একইসাথে শবর , বর্বর , পুলিন্দা্র উপজাতিদের মধ্যেও দেবীর আরাধনা এই নাম গুলির মাধ্যম সংযুক্ত হয়েছে । তাঁকে নন্দগোপের কন্যা ও বলদেবের ভগিনী হিসেবেও দেখা যায় । সোমরস , মাংস , এবং বলিদানের মাধ্যমে দেবীর আরাধনা রীতি যেমন দেখা যায় তেমনই দেবীকে দেখা হয়েছে জগতের রক্ষাকর্তা হিসেবে । তিনি সকলেরই আরাধ্যা।
শ্রীশ্রী চণ্ডীর ত্রয়োদশ অধ্যায়ের দশম শ্লোকে বর্ণিত আছে যে, সত্য যুগে রাজ্যহারা মহারাজ সুরথ ও আত্মীয়-স্বজন পরিত্যক্ত সমাধিবৈশ্য যথাক্রমে রাজ্যলাভ ও দুর্গতি মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে মহামায়ার ‘মহীময়ী’ মূর্তি নির্মাণ করে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। ঐ ‘মহীময়ী’ মূর্তিই হাজার হাজার বছর ধরে সনাতনী দুর্গামায়ের মৃন্ময়ী প্রতিমা।
ঋগবেদে বিশ্বদুর্গা, সিন্ধুদুর্গা ও অগ্নিদুর্গার উল্লেখ আছে। কালীকা পুরাণ, দেবী পুরাণ, মৎস্য পুরাণ ও বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণে দুর্গা পূজার পদ্ধতি লিপিবদ্ধ আছে বিস্তৃতভাবে। বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণে বর্ণিত পূজা পদ্ধতিটি বর্তমানে প্রায় সর্বত্রই সমাদৃত। কৌটিল্যের ‘অর্থ শাস্ত্র’ অনুযায়ী সেই প্রাচীন কাল থেকেই ‘অপরাজিতা পূজা’ তথা দুর্গাপূজা এদেশে চলে আসছে।
দুর্গা পূজার সঙ্গে অন্যান্য দেব দেবীর পূজার একটি যোগ প্রায়শ লক্ষ্য করা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেবীর পূজার সঙ্গে গ্রাম দেবতার, আবার বহু পরিবারে পারিবারিক দামোদর , বিষ্ণু, কালী, মনসা ইত্যাদি পূজার যোগ রয়েছে। এসব পরিবারের কেউ কেউ বলছেন পরিবারের অষ্টভূজা সিংহবাহিনী মূর্তির সাথে শালগ্রাম শিলার পূজার কথা, কেউ বা দামোদর পূজার কথা, কেউ বা কালী পূজার কথা। উদাহরণ স্বরূপ – মণ্ডল পরিবার – ইন্দ্রগাছা , দে পরিবার -রাজনগর , গুপ্তপরিবার- দ্বারন্দা, বড়বাড়ি – খটঙ্গা ইত্যাদি পরিবারে এই নিয়ম পালন করা হয় । তাঁদের কথা অনুযায়ী বাড়িতে সিংহবাহিনী মূর্তির থাকার কারণেই ও পূজা হবার কারণেই মা দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি হয়না । যেমন – দে পরিবার – রাজনগর, মন্ডল পরিবার- ইন্দ্রগাছা । রাজনগরের দে পরিবারের পুরোহিতের মত অনুসারে এখানে অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী মূর্তি রয়েছেন। সেই মূর্তির প্রতিবিম্ব আয়নায় পাওয়া যায় না। তাই পটের ছবিকে অবলম্বন করা হয় । সেই পটের ছবি বা প্রতিবিম্বিত আয়নায় পড়লে মায়ের আবাহন এবং স্নান ইত্যাদি নিয়ম পালন সম্ভব হয় ।
এইসব আচার-আচরণ রীতিনীতির পিছনে থাকে বহুকালের চর্চিত অভ্যাস। কোথাও পারিবারিক রীতি ,কোথাও প্রাচীন সনাতনী সংশ্লেষ, আবার কোথাও আদিম ধর্মবিশ্বাস। দুর্গাপূজার সঙ্গে গ্রাম দেবতার সম্পর্ক দেখে মনে হতে বাধ্য – এর রীতি প্রাচীন আদিম নিয়ম হতে উদ্ভব। যেদিন পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন থেকে শক্তি প্রকাশিত হয়েছে প্রকৃতির মাধ্যমে অথবা বলা যেতে পারি শক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর সৃষ্টি। তাই প্রকৃতির সঙ্গে, গ্রাম দেবতার সঙ্গে, সেই শক্তির সম্পর্ক আত্মিক।
তো এমনি, বিজয়ার দিনে মল্লরাজ শ্ৰী রঘুনাথ সিংহ মহাশয় তাঁর রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং আরো নানা দিকে অভিযানে বেরতেন। তাঁর এক সুবিশাল , যুদ্ধপটু , ভয়াল সেনাবাহিনী ছিল। সেই সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছিল স্থানীয় বাগদী, ডোম , বর্গক্ষত্রিয় প্রমুখদের নিয়ে। কোনো এক শারদীয়া বিজয়ার দিন রঘুনাথ সিংহ চেতুয়া বরদার বিরুদ্ধে অভিযান করেন। কিংবদন্তি আছে , যে সেই অভিযানে যাবার সময় বটবৃক্ষের নীচে পূজিতা জাগ্রত দেবী মা ঝগড়াই চণ্ডীর নিকট তিনি ও তাঁর সুবিশাল সেনা বাহিনী মানত করলেন – ” যদি যুদ্ধে জয়লাভ করি তবে তোমার মন্দির গড়ে দেব মা… আর তোমার প্রাঙ্গনের উৎসব করব বিজয়ের। তুমিই সাক্ষাৎ বিজয়া। বিজয় লক্ষ্মী হয়ে চল মা..” বলাবাহুল্য সেই যুদ্ধে রাজা জয়লাভ করলেন।
শোনা যায় যুদ্ধে জয় করে তিনি অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা চন্দ্রপ্রভাকেও লকভ করেন। এই বিজয়ের স্মরণেই দেবীর নিকট মানত অনুসারে দেবী প্রাঙ্গণে উৎসব সূচিত হয়। সে এক বিশাল বিজয়ল্লোস। সেই আনন্দ চলে দীর্ঘদিন ধরে। আজও #বিজয়ার দিন মন্দির প্রাঙ্গণে চলে #কাদাখেলা। এটি বৈতল এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এলাকার মানুষজন , মন্দিরের পুরোহিতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় , জয়লাভের পর মল্লরাজ গাছতলা থেকে দেবীকে নিয়ে আসেন মন্দিরে। সনাতনী বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে মন্দির পূর্ব বা দক্ষিণ মুখী হয়। তবে , মা ঝগড়াই চণ্ডীর মন্দির উত্তরমুখী। কেন ? তা নিয়ে তর্ক বিতর্কিত আছে । প্রসঙ্গত , গড়বেতা – র সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দিরটিও এমনি উত্তরমুখী।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত)
তথ্যঃ ১ ) পথে প্রান্তরে বাঁকুড়া টেরাকোটা
২) বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি
৩) বৈতলের ঝগড়াই চণ্ডী