আজ আমার শরীর অসুস্থ। মধ‍্যাহ্নে ঠাকুরের নিকট নামমাত্র মহাভারত পাঠ করিলাম।

 ঠাকুর ( বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী )  ধ‍্যানস্থ হইলেন, আমিও একপাশে বসিয়া বাতাস করিতে লাগিলাম। ঠাকুর ভাবাবেশে পুনঃ পুনঃ ঢলিয়া ঢলিয়া পড়িয়া যাইতে লাগিলেন। প্রায় একটার সময় ঠাকুর অকস্মাৎ যেন চমকিয়া উঠিলেন এবং খুব ব‍্যস্ততার সহিত ঘরের পশ্চিমদিকের দরজার ভিতর দিয়া পশ্চিম উত্তর আকাশ পানে একদৃষ্টে চাহিয়া বলিতে লাগিলেন, ” আহা, কি সুন্দর !! কি সুন্দর !! কি সুন্দর !!  

 সোনার রথ, কি শোভা !  ধন‍্য !! ধন‍্য !! ধন‍্য !! 

হলুদ রংয়ের কত পতাকা উড়ছে , আহা ! 

সমস্ত আকাশ আজ হলুদ রংয়ের উজ্জ্বল ছটায় একেবারে ঝলমল করছে। চারিদিকে কত সুন্দরী সুন্দরী দেবকন‍্যাগণ !  

দেবকন‍্যারা চামর নিয়ে ব‍্যাজন করছেন, অপ্সরা সকল নৃত‍্য-গান করছেন। আহা কত আনন্দ ! আজ গুণের সাগর বিদ‍্যাসাগরকে নিয়া আকাশপথে সকলে আনন্দ করতে করতে যাচ্ছেন। মহাপুরুষ আজ পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গে চললেন। 

হরি বোল !! হরি বোল !! 

ঠাকুর আর কথাবার্তা না বলিয়া চোখ বুজিলেন। সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন। 

বিদ‍্যাসাগর মহাশয় বহুমূত্র রোগে শয‍্যাগত, এরূপ একটা কথা কিছুদিন হয় সংবাদপত্রে প্রচারিত হইয়াছিল। স্বয়ং বিদ‍্যাসাগর মহাশয় এই ঘটনার বিরুদ্ধে তখনই প্রতিবাদ করিয়া লিখিয়াছিলেন,”আমার চোদ্দপুরুষেও বহুমূত্র রোগ  নাই।”  ইত্যাদি। উহা পড়িয়া বিদ‍্যাসাগর মহাশয় বেশ সুস্থ আছেন, — এ পর্যন্ত এইরূপ সংস্কারই আমার ছিল। 

সুতরাং ঠাকুরের ভাবাবেশে বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের সম্পর্কে এই সকল কথা শুনিয়া মনে করিলাম — হয়ত ঠাকুর বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের ভবিষ্যৎ জীবনেরই চিত্র দর্শন করিয়া ঐ সব কথা বলিলেন।

 কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই খবর পাইলাম, দয়ার সাগর বিদ‍্যাসাগর দেহত‍্যাগ করিয়াছেন। স্কুল কলেজাদি সমস্তই বন্ধ হইল। 

জয় বিদ‍্যাসাগর !  ধন‍্য বিদ‍্যাসাগর ! 

 বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের সম্বন্ধে ঠাকুর আজ অনেক কথাই বলিলেন। …..

 ঠাকুর বলিলেন, বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের  “বোধোদয়” পুস্তকখানা প্রকাশ হতেই সর্বত্র  ছেলেদের পাঠ‍্য হল, আমি পুস্তকখানা পড়ে দেখলাম, ওতে ভগবানের নামগন্ধও নেই। আমার মনে বড়ই দুঃখ হল ; আমি বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের কাছে গিয়ে বললাম, সাধারণ প্রয়োজনীয় সকল বস্তুরই খুব সহজে যাহাতে একটা বোধ জন্মে, বোধোদয় খানা সে ভাবেই লিখেছেন।

 কিন্তু মানুষের সংসারে সর্বাপেক্ষা যে বিষয়ের বোধ থাকা বেশি আবশ‍্যক, সেই ঈশ্বর সম্বন্ধে একটি কথাও বোধোদয়ে নাই। বিদ‍্যাসাগর মশায় আমার কথা শুনে একটু  লজ্জিত হয়ে বললেন,  “হ‍্যাঁ, গোঁসাই, ঠিকই বলেছ। আচ্ছা, আগামী সংস্করণে গোড়াতেই আমি ঈশ্বর সম্বন্ধে লিখব।” 

 পরে দেখলাম, বোধোদয়ের দ্বিতীয় সংস্করণেই  ঈশ্বর সম্বন্ধে প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। সকলের কথাই তিনি নিরপেক্ষভাবে মন দিয়ে শুনতেন।” 

শ্রীশ্রী সদগুরুসঙ্গ ; কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.