শ্যামা-আরাধনায় ভূত চতুর্দশী, মাকালী-পূজা ও দীপাবলির মাহাত্ম্য।

[কালী সাধনা এই বঙ্গদেশে অতন্ত প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। এই বাংলার বুকেই জন্মেছেন বিখ্যাত শিল্পী তথা কালীসাধক রামপ্রসাদ, পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও তারা সাধক বামাখ্যাপা। বামাচারী পূজা পদ্ধতির জন্য তৎকালীন সমাজ তাঁদের ‘পাগল ঠাকুর’, ‘খ্যাপা’ আখ্যান দিয়ে থাকলেও কিন্তু সাম্প্রতিক কালের চলে আসা বাঙ্গালি তথা ভারতীয় রীতি-রেওয়াজে মিশে গেছে কালী সাধনার নানান প্রকারভেদ। তাদের মধ্যে অন্যতম ভূত চতুর্দশী, কালীপূজা ও দীপাবলি। আলোকপাত করলাম এই উৎসবের পূজানুষ্ঠান ও ইতিহাসে।]

ভূত চতুর্দশী
সনাতনী হিন্দু মত অনুসারে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন অর্থাৎ দীপান্বিতা কালীপূজার আগের দিন ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়।এই একই দিনে উত্তর ভারতে নরক চতুর্দশী বলে অপর একটি হিন্দু উৎসবও পালিত হয়।
এই দিন বাঙ্গালী গৃহস্থের বাড়িতে চৌদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো,চৌদ্দ রকম শাক একত্রে রান্না করে অন্নের সাথে খাওয়া হয়।
বিশ্বাস করা হয় মৃত পূর্ব পুরুষরা আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশীর দিন পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন৷ সকল পরোপকারী সদর্থক আত্মা (benevolent spiritদের) আনন্দে রাখতে এবং অতৃপ্ত নঞর্থক আত্মার (malevolent spirit) অভিশাপ দূর করতে তাদের পূজা করা হয়। প্রথা অনুযায়ী চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানো হয়। চৌদ্দ প্রদীপের আলো জ্বেলে উত্তর পুরুষ তাদের পূর্বপুরুষদের চিনিয়ে দেন ইহলোকের ঘর-গৃহস্থালী। এই কী আলোক বর্ষের উদযাপন? ঘনান্ধকার দিয়ে আসেন তারা, সন্তানের আলোর মুখ দেখবেন বলে।
ভূত চতুর্দশী শাক-ভাত খাবার দিন। লৌকিক জীবনে গরীবের সহজলভ্য সাত্ত্বিক খাবার। নানান শাকের অসীম গুণ, ভেষজ ব্যবহার। আবার এই শাক উৎপাদিত হয়েছে ‘শাকম্ভরী দুর্গা’-র দেহ থেকে, তাই পূত পবিত্র। চৌদ্দশাক খেলে সম্বৎসর ভূতের ভয় থাকে না, এটাই লোকবিশ্বাস।
এছাড়াও চোদ্দ শাক খাওয়া হয় যা হলো- ওল, কেও, বেতো, কালকাসুন্দা, নিম, সরষে, শালিঞ্চা, জয়ন্তী, গুলঞ্চ, পলতা, ঘেঁটু, হিঞ্চে, শুষুনী, শেলু। এই চৌদ্দটি শাক একত্রে খাওয়া হয় যার উল্লেখ পাই আমরা এই শ্লোকে-
“ওলং কেমুকবাস্তূকং, সার্ষপং নিম্বং জয়াং।
শালিঞ্চীং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলুকং গুড়ূচীন্তথা।
ভণ্টাকীং সুনিষন্নকং শিবদিনে খাদন্তি যে মানবাঃ,
প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্ত্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।”
কালীপূজা
কথায় আছে বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বন । ঠিক তেমনিই কালীপূজা বা শ্যামাপূজা হল হিন্দু দেবী কালীর পূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত একটি হিন্দু উৎসব। প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই উৎসব উপলক্ষে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষিত হয়। কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় এই বিশেষ জনপ্রিয় সাংবাৎসরিক দীপান্বিতা কালীপূজা । এই দিন আলোকসজ্জা ও আতসবাজির উৎসবের মধ্য দিয়ে সারা রাত্রিব্যাপী কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, দীপান্বিতা কালীপূজার দিনটিতে ভারতের অন্যান্য জায়গায় দীপাবলি উৎসব পালিত হয়। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই দিন লক্ষ্মীপূজা অর্থাৎ অলক্ষী বিদায় অনুষ্ঠিত হলেও বাঙালি, অসমীয়া ও ওড়িয়ারা এই দিন কালীপূজা করে থাকেন। এছাড়া মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালীপূজাও যথেষ্ট জনপ্রিয়।

পূজানুষ্ঠান:-
মধ্যরাত্রে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দেবীকে ছিন্নমস্তক সহ বলির পশুর রক্ত, মিষ্টান্ন, অন্ন বা লুচি, মাছ ও মাংস উৎসর্গ করা হয়।গৃহস্থবাড়িতে সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যমতে আদ্যাশক্তি কালীর রূপে কালীর পূজা হয়। এছাড়া সুদূর অতীতে নরবলি দিয়েও কালীপূজা হতো।লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কালী শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই কারণে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে শ্মশানে মহাধুমধামসহ শ্মশানকালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে এই দিন দেবী কালীকে লক্ষ্মীরূপে পূজা করা হয়। হাজার হাজার ভক্ত এই দিন কালীঘাট মন্দিরে ভিড় করেন এবং দেবীর উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ করেন।কলকাতার এক বিখ্যাত কালীমন্দির -দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতেও কালীপূজা উপলক্ষে মহাসমারোহ হয়। এইখানেই অতীতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কালী আরাধনা করেছিলেন। সেই কারণে এই মন্দিরে কালীপূজা দেখতে প্রচুর পুণ্যার্থী এখানে ভিড় জমান।

ইতিহাস:-
সপ্তদশ শতকের নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়।তাঁর পূর্বে কালী উপাসকগণ তাম্রটাটে ইষ্টদেবীর যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে পূজা করতেন।পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়িয়া পূজা করিতেন। আগমবাগীশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া বাংলার সাধক সমাজ অনেকদিন চলেন নাই; লোকে ‘আগমবাগিশী’ কাণ্ড বলিয়া তাঁহার পদ্ধতিকে উপেক্ষা করিত।”
অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।এই সময় রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।বর্তমানে কালীপূজা বাংলায় দুর্গাপূজার সমতূল্য এক বিরাট উৎসব।
দীপাবলি
“দীপাবলি” নামটির অর্থ “প্রদীপের সমষ্টি”। দীপাবলি বা দেওয়ালি হল একটি পাঁচ দিন-ব্যাপী হিন্দু ধর্মীয় উৎসব। এই দিন হিন্দুরা ঘরে ঘরে ছোটো মাটির প্রদীপ জ্বালেন। এই প্রদীপ জ্বালানো অমঙ্গল বিতাড়নের প্রতীক।বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সারা রাত প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে ঘরে লক্ষ্মী আসেন বলে উত্তর ভারতীয় হিন্দুরা বিশ্বাস করেন। বাংলার দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এই উৎসব সাড়ম্বরে আলোকসজ্জা সহকারে পালিত হয়। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাস অথবা ধনত্রয়োদশী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলি উৎসবের সূচনা হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই উৎসব শেষ হয়। নবরাত্রি উৎসব অথবা বাঙালিদের দুর্গোৎসব শেষ হওয়ার ১৮ দিন পর দীপাবলি শুরু হয়।বাংলা, আসাম, ওড়িশা ও মিথিলাতে এই দিনটি কালীপূজা হিসেবে উদ্‌যাপন করা হয়। ভারতীয় সমাজের দৃঢ় বিশ্বাস ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ বা ‘ন্যায়ের কাছে অন্যায়ের পরাজয়’ এই নীতিতে। দীপাবলির মাধ্যমে উপনিষদের আজ্ঞায় এই কথাটা খুবই সদৃঢ় ভাবে চরিতার্থ হয়ে ওঠে যথা “অসতো মা সৎ গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়। ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ॥” অর্থাৎ “অসৎ হতে সত্যে নিয়ে যাও, অন্ধকার হতে জ্যোতিতে নিয়ে যাও, মৃত্যু হতে অমরত্বে নিয়ে যাও। সর্বত্র যেন ছড়িয়ে পড়ুক শান্তির বার্তা॥”

পূজানুষ্ঠান :-
এই পা্ঁচ দিনের শুরুতেই ধনতেরাসের দিন অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অর্থবর্ষের সূচনা হয়; লোকজন নতুন বর্তন, বাসন, গয়না প্রভৃতিও কিনে থাকেন এই দিনে। তবে বেশির ভাগ বাঙালি ব্যবসায়ীদের অর্থবর্ষের সূচনা হয় পয়লা বৈশাখে। দ্বিতীয় দিনটিকে বলে ভূত চতুর্দশী। এই দিনে বাঙালিরা বাড়ির চোদ্দোটা এঁদো কোণায় চোদ্দোটা প্রদীপ জ্বালিয়ে কালো মুছিয়ে আলোকিত করে তোলেন বাড়িটাকে। কথায় আছে যে এমনটা করলে ভূতপ্রেত পরিবার আর স্বজনদের ঘাড়ের কাছে নড়তে পারে না; এমনটাও লোককথায় শোনা যায় যে, এই প্রদীপসজ্জার মাধ্যমে পরিবারের পিতৃপুরুষদের অনুষ্ঠানে পদার্পণ করার জন্য নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়, যাতে তারা মায়ের বাৎসরিক আগমনে উপস্থিত হয়ে সবাইকে শুভাশিস দিয়ে নিজেরা মায়ের আশীর্বাদে মোক্ষ লাভ করবেন। তৃতীয় দিন কার্তিক অমাবস্যায় যেখানে উত্তর ভারতে লক্ষ্মীর পূজা চলছে, পশ্চিমবঙ্গে দারুণ জাঁকজমকে ঘটা করে পালন করা হয় কালীপূজা। অবশ্য সেদিন আদি পশ্চিমবঙ্গ বাসিন্দারা, ঘটিরা, বাড়িতে লক্ষ্মীর পূজাও করে থাকেন। তবে আদি বাংলাদেশি হিন্দুদের, বাঙালদের, এই নিয়ম নেই; তা অনেকে বাড়িতেও কালী পুজো করেন, যদিও এই পুজোর বারোয়ারি ভাবে পালন হওয়ার প্রচলন বেশি। কদাচিৎ কালীপুজোর দিন আর দেওয়ালির দিন পৃথকও হতে পারে; দেওয়ালির তারিখটা একদিন পরে কিংবা আগেও পড়া সম্ভব। চতুর্থ দিন কার্তিক শুক্লা প্রতিপদ। এই দিন বৈষ্ণবেরা গোবর্ধন পূজা করেন। পঞ্চম দিন যমদ্বিতীয়া বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা। এই দিন বোনেরা তাদের ভাইদের জন্যে উপোস করে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে।

ইতিহাস :-
উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের মতে দীপাবলির দিনেই শ্রীরামচন্দ্র চৌদ্দ বছরের নির্বাসনের পর অযোধ্যা ফেরেন। নিজের পরমপ্রিয় রাজাকে ফিরে পেয়ে অযোধ্যাবাসীরা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সাজিয়ে তোলেন তাদের রাজধানীটাকে। এই দিনটিতে পূর্বভারত বাদে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে লক্ষ্মী-গণেশের পুজোর নিয়ম আছে। জৈন মতে, ৫২৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মহাবীর দীপাবলির দিনেই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেছিলেন।১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ও ৫২ জন রাজপুত্র দীপাবলির দিন মুক্তি পেয়েছিলেন বলে শিখরাও এই উৎসব পালন করেন। আর্য সমাজ এই দিনে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুদিন পালন করে। তারা এই দিনটি “শারদীয়া নব-শস্যেষ্টি” হিসেবেও পালন করেন। এছাড়া, নেপাল-ভারত-বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই এই উৎসব নিয়ে উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়।
তবে এই পূজা প্রাচীন নয়। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যাবিধিগ্রন্থে এই পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তার সকল প্রজাকে শাস্তির ভীতিপ্রদর্শন করে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন। সেই থেকে নদিয়ায় কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্রও বহু অর্থব্যয় করে কালীপূজার আয়োজন করতেন। অমঙ্গল বিতাড়নের জন্য আতসবাজিও পোড়ানো হয়। বিশেষত উত্তর ভারতে দীপাবলির সময় নতুন পোশাক পড়া, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণের প্রথাও আছে।

অরিত্র ঘোষ দস্তিদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.