অন্নদামঙ্গল কাব্যে সর্পবৈচিত্র্যের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে, “কেউটে খরিশ কালী গোখুরা ময়াল।/ বোড়া চিতি শঙ্খচূড় সূঁচে ব্রহ্মজাল।।/শাঁখিনী চামর কোষা সূতার সঞ্চার।/খঁড়ীচোঁচ অজগর বিষের ভান্ডার।।/তক্ষক উদয়কাল ডারাশ কানাড়া।/লাউডগা কাউশর কুয়ে বেতাছাড়া।।/ছাতাড়ে শীয়রচাঁদা নানাজাতি বোড়া।/ঢেমনা মেটিলী পুঁয়ে হেলে চিতী ঢোঁড়া।।/বিছা বিছুপিঁপিড়া প্রভৃতি বিষধর।/সৃষ্টিহেতু জোড়ে জোড়ে গড়িল বিস্তর।।”
এখানে কোবরা গ্রুপের কেউটে (Indian Cobra), খরিশ/গোখরো (Common Cobra), শঙ্খচূড় (King Cobra) সাপের মতো বিষধর সাপের নাম পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া এখানে বিষধর শাঁখিনী (Banded Krait), শীয়রচাঁদা (কালো কালাচ Black Krait), বোড়া (চন্দ্র বোড়া Russell’s Viper)-র মতো তীব্র বিষধর সাপের কথা পাওয়া যাচ্ছে। এ সকলই বাংলার সর্প বৈচিত্র্য। এছাড়া এখানে নাম পাওয়া যাচ্ছে নির্বিষ এবং স্বল্প বিষধর নানান সাপ, যেমন ময়াল (Rock Python), অজগর (Common Python), বোড়া চিতি (Wolf Snake), দাঁড়াস (Rat Snake), কানাড়া বা কাঁড় (Common Cat Snake), লাউডগা (Whip/Vine Snake), বেতাছাড়া (Bronze Back Snake), মেটিলি, পুয়ে (Common Blind Snake), হেলে (Striped Keelback), ঢোঁড়া (Checkered Keelback) ইত্যাদি।
সাপের দেবী মনসা। দেবী মনসার মূর্তি ভাবনার মধ্যে একটা সুস্পষ্ট ক্রমবিকাশ পরিলক্ষিত হয়। আদিতে সাপ নামক সরীসৃপটি পূজিত হত। তারপর এল সাপের অবয়বে সর্পচালি রেখে পূজা, এটাই হল জুমর্ফিক ফর্ম; আজকের মনুষ্য-মূর্তির মনসা বা অ্যান্থ্রোমর্ফিক দেবীর উদ্ভব অনেক পরে। এরমাঝে যে মূর্তি ভাবনা, তাতে সাপের অবয়ব আর মনুষ্য অবয়বের মিশেল। যে মনসা-ঘটে, মনসা-চালায় দেবীর আবক্ষ মানবী-রূপ, আর নিচে সাপের মতো দেহ, তাকে বলা হয় থেরিওমর্ফিক মূর্তি।
সাপ এক ভয়ংকর-সুন্দর সরীসৃপ। লোককবি সাপের সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন বলেই না মনসামঙ্গল কাব্যে দেখা যায় দেবী নানান সাপে সজ্জিতা— কোনও সাপ তার গলার হার, কোনও সাপ কাঁচুলি, কোনওটি হাতের বালা। এই নান্দনিকতা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। সাপ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র লভ্য, লভ্য কৃষিবাস্তুতন্ত্রে। বাংলার জমি-জিরেতে, জলে-জঙ্গলে সাপের অহরহ আনাগোনা ছিল; ছিল সর্পাঘাতে মৃত্যুর ঘটনা। ভয়ে-ভক্তিতে মানুষ সাপকে পুজো করতে শুরু করল— শুরু হল মানুষের সর্প-চারণা। দেবী মনসা হলেন বাঙালি হিন্দুর সর্প-চারণার এক চরম আধ্যাত্মিকতা, নান্দনিক দার্শনিকতা।
ভারতীয় ডাকবিভাগ ২০০৩ সালে চারটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে সাপের ছবি দিয়ে, কৃষি-বাস্তুতন্ত্রে এই সাপ ভারতের কোনও না কোনও অঞ্চলে পাওয়া যায়। এই চারটি সাপ হল বিষধর King Cobra বা শঙ্খচূড়, বিষধর Bamboo Pit Viper বা বাঁশ-বোড়া, ক্ষীণ-বিষ Gliding Sanke বা কালনাগিনী এবং নির্বিষ অথচ ভয়ংকর Python বা অজগর।
পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ মিলিয়ে বঙ্গদেশে সবচাইতে পূজিতা নারী দেবীর নাম মনসা এবং সবচেয়ে অধিক পূজিত পুরুষ দেবের নাম মহাদেব। তাই দেবী মনসাকে নিয়ে আমাদের মনোভূমিতে অনেকানেক মৌলিক তত্ত্বের জন্ম। তা আমাদের জারিতও করে। এই তত্ত্বগুলি লোকস্মৃতি (Folk memory)-তে প্রবাহিত হয় আমাদের মতো অনেক মানুষের মধ্যে, যারা কিছুটা চিন্তা করতে পারি। চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মনে দেবী মনসাকে নিয়ে অনেক কথা জমা হয়ে থাকে। তাই শ্রাবণ আর ভাদ্র মাস জুড়ে আমরা সর্পচারণায় নিবিষ্ট হই। গ্রাম-বাংলায় আয়োজিত হয় মনসা-ভাসান পালা।
অনেকে মা মনসাকে নিছক সর্প কুলদেবী বলে মনে করেন না। তাঁরা অনন্য আধ্যাত্মিক অর্থ অন্বেষণের চেষ্টা করেন সর্পচারণার মধ্যে। সহজিয়া বৌদ্ধধর্মের কথায়, চর্যাপদের গূঢ় সাধনতত্ত্বে দেখা যায় নাভি থেকে তিনটি ধারা উৎপন্ন হয়। তার মধ্যে ঊর্ধ্বগামী সদর্থক ধারা হল সুষুম্না। নিম্নগামী দুই ধারা হল ইঢ়া-পিঙ্গলা। ঊর্ধ্বগামী সুষুম্নার ধারা যদি কোনও সাধক জাগ্রত করতে পারেন, তাহলে তিনি শূন্যতা প্রাপ্ত হন। বিদ্যাবিদেরা বলেন, কুলকুণ্ডলিনী চক্র যে সুষুম্না চক্রের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে অবিরল প্রাণ রসের ধারায়, নিম্ন থেকে ঊর্ধ্ব পানে, মূলাধারের সগুণ ব্রহ্মস্বরূপকে আবর্তন করে সাড়ে তিন পাক খেয়ে আবদ্ধ মহামায়ার বন্ধন খুলে, একের পর এক গ্রন্থিচ্ছেদন করে, ছুটে চলেছে সহস্রারে, অপেক্ষারত নির্গুণ ব্রহ্মের দিকে, সেই মিলনের অব্যবহিত পরে যখন খোলে সেই মহা ঈপ্সিত সহস্রারের দ্বার, যখন ব্রহ্ম কমল হয় সেখানে পূর্ণ প্রস্ফুটিত, অষ্ট ফণা ধারী সর্প যখন হন তাঁকে ঘিরে পরিবেষ্টিত, তখন কূটস্থে হয় আত্মদর্শন! সাধকের সাধনার অন্তিমে প্রাপ্তি হয় নির্বিকল্প মহাসমাধি ! শূন্যের সঙ্গে শূন্য মিলিয়ে যায়, পরম ব্রহ্মের সঙ্গে মিলে মিশে লয় হয়ে যায় স্বাতন্ত্র্যের অস্তিত্ব! সেই খানে ব্রহ্ম রন্ধ্রে সেই সুষুম্না চক্রের অগ্রভাগে মা মনসার অবস্থান।
বৌদ্ধধর্মে নির্বাণ লাভের কথা আছে, বৈদিক ধর্মে মোক্ষলাভের কথা আছে, কখনও মনে হয়— এ সবই যেন সর্পচারণা! সুষুম্নার এই ধারাকে ব্যঞ্জনায় সর্পের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সবার গন্তব্যটি এক, পথ ভিন্ন। গন্তব্যটা একটু আলাদা বৈষ্ণব সাধনায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মনুষ্য শরীর পাওয়াটাই সবচাইতে বড় পাওনা। কারণ মানুষ হয়ে জন্মালে হরিসংকীর্তনের মধ্যে দিয়ে শ্রীহরিকে অনন্তে পাওয়া সম্ভব। Western concept-এ সাপ মানে যৌনতা। পুরাণে দেখা যায় বাসুকি নাগের মাথার উপরে পৃথিবী থাকে নাগ-মণির মতো। সাপের মণি কনসেপ্টটা এসেছে এই বাসুকি নাগ থেকে।
‘মনসা’ নামের মধ্যে ‘মন’ কথাটি আছে যেহেতু… তাই প্রবুদ্ধজন মাত্রই তাঁকে আলাদাভাবে অন্বেষণ করে এসেছেন, মনস্তাত্ত্বিক আলোচনায়। অনেক গবেষণা করেছেন কালচারাল অ্যান্থ্রোপোলজির পণ্ডিত মানুষেরা, লোকসংস্কৃতিবিদেরা। দেবাদিদেব শিবের মানস কন্যা— মনসিজ, তিনিই দেবী মা মনসা। বাঙালি হিন্দুর ইষ্টদেবীর অন্যতম, যিনি লৌকিক আচার ও মঙ্গল কাব্যের কিংবদন্তি দিয়ে ঘেরা সদা রহস্যময়ী এক দেবী।
সেই দেবাদিদেব শিবের মানস কন্যা, মা মনসা, তাঁর অবস্থান নিয়ে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। কিন্তু সহস্রারে অবস্থানরত নির্গুণ ব্রহ্ম, যিনি হলেন স্বয়ং সেই শিব, তাঁর সঙ্গে জাগৃত কুলোকুণ্ডলিনি শক্তির যে মিলন— সেই নিত্যানন্দ স্বরূপিনী, সেই ব্রহ্মানন্দ স্বরূপিনী আধ্যাত্মিক ব্রহ্ম কমল স্বরূপ অবস্থার ওপরে যিনি তাঁর তেজ দৃপ্ত অষ্ট ফণা তুলে ধরে থাকেন, সে যে আমাদেরই ‘মানস সরোবর’!
● কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শ্রী অংশুমান গাঙ্গুলি এবং ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী